Skip to content

কবির চেতনা – শুভদীপ চক্রবর্তী

রাস্তায় অনেকক্ষন ধরে যানজটে আটকে থাকায় বিরক্ত হয়ে সুজয় তার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে,
– “এত জ্যাম কিসের?”
-“সামনে Contractual Teacher দের একটা বড় মিছিল আছে স্যার।সেই জন্যই দেরি হচ্ছে।” ড্রাইভার জানায়।
– “আবার মিছিল! এই তো গত সপ্তাহে এখানেই ‘প্রত্যাশা’ কর্মীদের মিছিল হয়েছিল। এখন আবার এরাও নেমে পড়েছে! সত্যি আর পারা যায়না! ” একরাশ বিরক্তি নিয়ে কথাগুলি বলে সুজয়।

আজ একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাকে যেতে হবে। মাননীয় মন্ত্রীমশাই নিজে সেখানে উপস্থিত থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেবেন। অল্প বয়সেই কবি হিসেবে সুজয়ের খুব নামডাক হয়েছে।মনে মনে সে খুব রোমাঞ্চিত। কিন্তু এই অসহ্য যানজটের জন্য তার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল। কবির গাড়ি গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো।

বাড়ী ফিরতে সুজয়ের অনেক রাত হয়ে যায়। সে তার স্ত্রী পার্বতীকে অনুষ্ঠানে পাওয়া পুুরষ্কারগুলি দেখায়। কিন্তু পার্বতীর এই বিষয়ে কোন উৎসাহ নেই দেখে সে খুব হতাশ হয়।
স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে,
– “কি হয়েছে তোমার? রাগ করেছ নাকি? শরীর ঠিক আছে তো?”
– “আমি ঠিকই আছি। ভাত বাড়ছি। খেয়ে নাও।” পার্বতী উদাসীন ভাবে কথাগুলি বলে।

পার্বতীর এই উদাসীনতায় খুব বিস্মিত হয় সুজয়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাতে শুতে যাওয়ার আগে পার্বতী সুজয়কে বলে,
– “আমি খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমাকে দেখে। এই তিন বছরে তুমি কতো বদলে গিয়েছো!”
-” মানে? কি বলতে চাইছো?” অবাক হয় সুজয়।
-“তুমি তো জানো সুজয় তোমার লেখা কবিতা আমি কত ভালোবাসতাম! তোমাকে যেমন ভালেবেসেছিলাম তোমার লেখা কবিতাগুলিও ঠিক ততটাই প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম।”
-“তাহলে আজ কি এমন হল? এভাবে কেন বলছো? ” সুজয় জানতে চায়।
– “তুমি অধিকাংশ সময় নিপীড়িত, বঞ্চিত, অসহায় মানুষদের নিয়ে কবিতা লিখতে। তাদের পাশেও দাঁড়াতে। অন্যায় দেখলেই তোমার কলম গর্জে উঠতো। তোমার কবিতা পড়ে একসময় আমি ভীষন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। শুধু আমি কেন তোমার কত গুনমুগ্ধ পাঠক তোমার ঐ সকল কবিতা ভালোবাসতো,কদর করতো। সেইসব কবিতা আজ কোথায় গেল? তোমার কবিতায় প্রতিবাদের ভাষা আজ হারিয়ে গেছে কেন? ”

সুজয় চুপ করে থাকে। কি বলবে ভেবে পায়না।
খানিক চুপ থাকার পর পার্বতী বলে,
-“সুজয়, তুমি তো জানো আমাদের পাড়ার মেয়ে সবিতাকে একদল শয়তান ধর্ষন করেছে।শুধু তাই নয়, জামিন পেয়ে এখন তো ওরা আবার ওর পরিবারকে অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য লাগাতার চাপ দিচ্ছে।ওরা হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে। মেয়েটির পরিবারের নিরাপত্তার কি হবে? বিষয়টা নিয়ে মন্ত্রী মশাইকে তুমি জানিয়েছিলে? ”
– “তুমি কি পাগল হয়েছো? সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একথা আমি মন্ত্রীকে কি করে বলবো? তাছাড়া এটা political issue. একথা আমি ওনাকে বলতে পারি না।” সুজয় চেঁচিয়ে ওঠে।
-“কি করে এটা political issue হলো? এমন অদ্ভুত কথা কেন বলছো তুমি? একটা মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে। সে তোমার পাড়াতেই থাকে। তার পরিবার আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে কি করে তুমি দায় এড়িয়ে যেতে পারো? তোমার এই মনোভাব দেখে আজ সত্যি খুব ঘেন্না হচ্ছে আমার! এত সংকীর্ণ মন তোমার! “পার্বতীর গলায় হতাশার সুর।
– “কি বলছো তুমি? আমার মন সংকীর্ণ! এটা তুমি বলতে পারলে পার্বতী?” বিস্মিত হয় সুজয়।
– “হ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি। আমার কাছে কোন মূল্য নেই তোমার লেখা কবিতার। যে কবি অন্যায় দেখলে মুখ লুকিয়ে নেয়, যে কবির কলম বিক্রি হয়ে যায় তাকে আমি ধিক্কার জানাই!”
-“পার্বতী!” হিংস্র পশুর মতো গর্জে ওঠে সুজয়। নিজের স্ত্রীর কাছে এতটা অপমানিত হতে হবে সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।

রাতে সুজয়ের ঘুম এল না। অনেক রাতে সে অস্থিরভাবে বারান্দায় পায়চারি করতে থাকে। পুরোনো দিনের কথা বিক্ষিপ্তভাবে মনে পড়ে। পার্বতীর সাথে প্রথম দিনের আলাপের কথা, তাকে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনানোর সেই রঙ্গিন দিনের কথা….আরও কত কি! একবার কি মনে হলো, ড্রয়িং রুমের আলমারি থেকে সে তার পুরোনো পান্ডুলিপি গুলো এক এক করে টেনে বের করে দেখতে লাগলো। এগুলি সবই তার প্রথম দিকের লেখা কবিতা। পার্বতী ঠিকই বলেছিল। পান্ডুলিপির ছত্রে ছত্রে তার কলমের প্রতিবাদী ভাষা জ্বলজ্বল করছে। সে আবেগে বিহ্বল হয়ে যায়। কিন্তু একি! ওটা কি তার প্রিয় পান্ডুলিপিতে? রক্ত! ফোঁটা ফোঁটা রক্ত! সে ভয়ে ভয়ে পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকে! প্রতি পৃষ্ঠায় ছোপ ছোপ তাজা রক্ত! সরু সুতোর মতো রেখায় রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে খাতা থেকে মেঝেতে!
সুজয় পাগলের মতো দৌড়ে যায় অন্য ঘরে। কম্পিউটার অন করে। Desktop এ রাখা folder খুলে তার নিজের লেখা কবিতাগুলি দেখতে লাগলো। কিন্তু একি! কম্পিউটার screen এ লাল লাল ওগুলো কী? রক্ত! এখানেও রক্ত! কম্পিউটারের screen বেয়ে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে টেবিলে পড়তে লাগলো! মুহূর্তের মধ্যে অজস্র পোকা এসে রক্তের উপর ভনভন শুরু করে দিল! উঃ! কি বীভৎস! মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগলো সুজয়ের।

-” পার্বতী! ” প্রাণপনে ডাকার চেষ্টা করে সুজয়।
হঠাৎ গোঙানির আওয়াজে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়ে পার্বতী। সে দেখে সুজয় বিছানায় ছটফট করছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে! এই শীতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম!
-“কি হয়েছে সুজয়? এমন করছো কেন? কোন স্বপ্ন দেখেছো? ”
পার্বতীর ডাকে সুজয় ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করে।আস্তে আস্তে উঠে বসে। বাড়ির চারদিকটা ভালো করে দেখতে থাকে। বুঝতে পারে সবটাই একটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন ছিল।
-“কিছু হয়নি পার্বতী। আমি ঠিক আছি।” কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেয় সুজয়।
এরপর সে পার্বতীর দিকে তাকায়। কি অপরূপ মায়া জড়ানো তার দৃষ্টি! সেই দৃষ্টি যে তার সবচেয়ে ভরসার জায়গা! তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। সুজয় দৃঢ়ভাবে পার্বতীকে আলিঙ্গন করে। পার্বতী জিজ্ঞেস করে,
” কি হয়েছে বলো তো? রাতে কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে? ”
-“হ্যাঁ পার্বতী! ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন! ” কিছু গোপন না করে পার্বতীকে সব খুলে বলে সুজয়।এরপর সে বলে,
-“আমি কালই মন্ত্রী মশাইকে সবিতার বিষয়ে জানাবো। বলবো এর একটা প্রতিকার করতে।”
-” আর একটা কথা, সবিতার বাবার পেনশনের ফাইলটাও ওনার অফিসে কোন কারণে আটকে আছে।ভদ্রলোক ছয় মাস হলো রিটায়ার্ড হয়েছেন অথচ এখনো পেনশন চালু হয়নি।খুব আর্থিক কষ্টে ওদের দিন কাটছে।মন্ত্রীমশাইকে একবার বলে দেখ যদি তাড়াতাড়ি ওনার পেনশনটা চালু হয়।পরিবারটা বেঁচে যায় তাহলে।” একটানে কথাগুলো বলে যায় পার্বতী।
-“অবশ্যই।”সুজয় দৃঢ়তার সাথে কথা দেয়।
পার্বতী এবার সুজয়ের ডান হাতটা নিয়ে নিজের গালে স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করে,
-” আমি কি তাহলে আমার আগের সুজয়কে ফিরে পেতে পারি?”

প্রশ্ন শুনে সুজয় মৃদু হাসে। বাইরে তখন রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে ভোরের আলো একটু একটু করে দেখা দিয়েছে। নতুন ভোর যেন নতুন আশায় দিন শুরু করতে উদগ্রীব হয়ে আছে।
……………….

মন্তব্য করুন