Skip to content

এ নহে কাহিনী – কোয়েল তালুকদার

এ নহে কাহিনী

অনেকদিন আগের কথা। রাজশাহী থেকে ট্রেনে ফিরছিলাম সিরাজগঞ্জ। রাত আটটার দিকে ট্রেন সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনে এসে পৌঁছে। শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে আমাদের গ্রামের বাড়ি। বাড়িতে যাবার তখন কোনো পাকা রাস্তা ছিল না। কোনো রিক্সাও চলত না। হেঁটে যেতে হতো অথবা টমটমে কিংবা গরুর গাড়ীতে। টমটমও সব সময় পাওয়া যেত না। আমি স্টেশনে নেমে খুঁজছিলাম টমটম কিন্তু কোথাও দেখছিলাম না। হেঁটে হেঁটে চলে আসি স্টেশন রোডের মোড়ে। দেখি কড়োই তলায় একটি টমটম দাঁড়িয়ে আছে। সাধারনতঃ সন্ধ্যার পরে কোনো টমটমই রাজি হয়না গ্রামে যেতে। তারপরেও কাছে যেয়ে কোচোয়ানকে বললাম — তুমি যাবে ?
কোচোয়ান: কোথায় যাবেন ?
আমি : ছোনগাছা হাট।
কোচোয়ান : শালুয়াভিটা খেয়াঘাট পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তারপর আর যাব না।
আমি : আমি যদি তোমাকে দেড়গুণ বেশি টাকা দেই।
কোচোয়ান : যদি খেয়া নৌকা টমটম পার করে, তবেই যাব।
আমি : ঠিক আছে, তাই হবে। চলো।

আমি উঠে বসলাম টমটমে। কোচোয়ানকে দেখে ভালোই মনে হলো। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। টমটম শহর থেকে বের হয়ে কাটাখালি নদীর তীর ধরে চলতে থাকে। নদীর তীরে এসে দেখি — পূর্ব আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে । কাটাখালি নদীর ওপাড়েই ভাঙ্গাবাড়ি গ্রাম। সেই গ্রামের মাথার উপর দিয়েই চাঁদটি দেখা যাচ্ছে। সারা লোকালয় আর প্রান্তর যেন জ্যোৎস্নার প্লাবনে ভেসে গেছে। আমার মনটা খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ভাবলাম,এই পূর্ণিমার আলোর নীচ দিয়ে পথ চলতে ভালোই লাগবে।

নদীর ওপারে ভাঙ্গাবাড়ী গামটি দেখে মনে পড়ল স্কুলে পড়ার সময় সহপাঠিনী ঝর্ণার কথা। ঝর্ণা বাগবাটী স্কুলে আমার সাথে পড়ত। মেট্রিক পরীক্ষার পর ওর বিয়ে হয়ে যায় । শুনেছি এই ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামেই ঝর্নার বিয়ে হয়েছে। আজকের এই পূর্ণিমার চন্দ্রভূক রাতে হঠাৎ মনটা উদাস হয়ে উঠল ঝর্ণার জন্য। মনে হলো কোচোয়ানকে বলি, টমটমটি ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামের দিকে ঘুরিয়ে দিতে। একটু দেখে যাই আমার সেই প্রিয় সহপাঠিনী ঝর্ণাকে।

ঝর্ণা ছিল নিতান্তই গ্রামের সহজ সরল একটি মেয়ে। আমাদের ক্লাশে আটজন মেয়ে পড়ত। ওদের সাথে বেশি কথা বলার সুযোগ হতো না। স্যাররা ক্লাশে আসার সময় কমনরুম থেকে ওদের নিয়ে আসত, আবার ক্লাস শেষ হলে ওদেরকে আবার নিয়ে যেত।একবার আমার কাছ থেকে ঝর্ণা ‘এ নহে কাহিনী’ নামে একটি বই নিয়েছিল। বইটি তখন গল্পের বই হিসাবে ক্লাস সেভেনে আমাদের পাঠ্য ছিল। বইটি যখন ঝর্ণা আমাকে ফেরৎ দেয়, তখন খুলে দেখি, ভিতরে একটি ঝাও গাছের ঝিরিঝিরি পাতা।

আরেকবার তখন ক্লাস নাইনে উঠেছি। ঝর্ণা আমার কাছ থেকে এ্যালজাবরা নোট খাতাটি চেয়ে নিয়েছিল। খাতাটি যখন ঝর্ণা ফেরৎ দেয়, দেখি খাতার ভিতরে একটি কাগজ ভাঁজ করা। খুলে দেখি কাগজটিতে কোনো কিছু লেখা নেই। শুধু একটু জল ছাপ বোঝা গেল। আমি বাড়িতে যেয়ে কাগজটি জলে ভিজাই। দেখলাম, সেখানে জলছাপে লেখা আছে – ‘ ঝর্ণা + আমার নাম।’

সেদিন মেট্রিক পরীক্ষার ফরম ফিল-আপ করার শেষ দিন ছিল। ঝর্ণাকে দেখলাম, খুব বিষণ্ণ। আমার সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজছিল। আমি বুুঝতে পারছিলাম, হয়তো ঝর্ণার সাথে আর কোনো দিন দেখা হবেনা। আমারও মন খারাপ লাগছিল- ভাবছিলাম, মেয়েটিকে না হয় ভালোবাসি নাই, কিন্তু মায়া তো করেছি। ওকে দেখে আজকেও খুব মায়া হলো। আমি ওর কাছে এগিয়ে যাই, বলি- পরীক্ষার রেজাল্টের পর কোন্ কলেজে তুমি ভর্তি হবে ?
ঝর্ণা : জানিনা, বাবা আর পড়াবে কিনা, তাও জানিনা।
আমি : পড়া বন্ধ করো না।
ঝর্ণা : হুম। তুমি কোথায় ভর্তি হবে ?
আমি : ঢাকায় চলে যাবো।
ঝর্ণা: তোমার সাথে আর দেখা হবেনা ?
আমি : হয়ত হবে, হয়ত না।

তারপর অনেক বছর চলে গেছে। ঝর্ণার সাথে আমার আর দেখা হয় নাই। শুনেছি মেট্রিক পরীক্ষার পর এই ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে ঝর্ণার বিয়ে হয়েছে। অনেকদিন পর্যন্ত ‘এ নহে কাহিনী’ র ভিতরে ঝর্ণার দেওয়া সেই ঝাউ গাছের পাতাটি রেখে দিয়েছিলাম। এক সময় পাতাটি শুকিয়ে অস্তিত্ব চিহ্নহীন হয়ে যায়। তারপর ঝর্ণাকে ধরতে গেলে এক প্রকার ভুলেই যাই।

আজ এই হেমন্ত পূর্ণিমা রাতে, এই বাঁধভাঙ্গা জ্যোৎস্নায় দুরের ঐ ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামটি দেখে ঝর্ণার কথা খুব মনে পড়ছে। একসময় কাটাখালী নদীর কাঠের পুল আমরা অতিক্রম করি। ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দে রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে চলতে থাকে টমটম। রহমতগঞ্জের কবরস্থানটি অতিক্রম করে আরো কিছুদূর চলে যাই। গা’টা একটু ছমছমই করছিল। নির্জন দুই রাস্তার মোড়ে, যেখানে ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামের শেষ প্রান্ত। সেখানে দেখতে পাই- অদূরে বটগাছের নীচে বসে একটি মেয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। কোচোয়ান লোকটিকে বললাম- ‘ঐ বটগাছের নীচে আমাকে নিয়ে যাও’ কিন্তু কোচোয়ান আমার কথা শুনল না। বলল- ‘ভাই, ওদিকে আমাদের যাওয়া ঠিক হবেনা।’

আমার কাছে মনে হয়েছিল- ঝর্ণাই এ রকম করে বসে বসে ওখানে কাঁদছে। ও হয়তো আমাকেই বলতে চাইছে, ‘তুমি তোমার টমটমে তুলে আমাকে নিয়ে যাও। ওরা খুব অত্যাচার করে।’ ভাবলাম কোচোয়ানকে আবার বলি- ‘টমটমটি ঐ বটগাছের দিকে ঘুরিয়ে দিতে’।

দেখলাম- কোচোয়ান ততোক্ষণে ঘোড়ার পিঠে জোরে চাবুক মারছে। ঘোড়াটি তখন আরো জোরে পায়ের খটখট শব্দ তুলে শালুয়াভিটা খেয়াঘাটের দিকে দৌড়ে চলে যেতে থাকে।

~ কোয়েল তালুকদার

মন্তব্য করুন