Skip to content

একটি নক্ষত্রের নির্বাসন – যুবক অনার্য

একটি নক্ষত্রের নির্বাসন
যুবক অনার্য

সারারাত মান্তুর শরীরে জ্বর বইয়ে গেলো।তারপর সকাল হলো ; হলো না ভোর।ভোর হয় কেটে গেলে মানুষের মনের ভিতরে বিচরিত অন্ধকার।

আজ সারাদিন হেঁটে হেঁটে হেঁটে দেখা হোক দৃশ্যযন্ত্রণা কিছু। কারো কাছে অতি অনেকের কাছেই এ সকল তো যন্ত্রণা নয়; বরঞ্চ এ বড়ো সুখ- সমাদৃত। যেমন ছুরিপতি সমাজপতি অধিপতিদের কাছে!
সুখ,যেমন,যেহেতু, গাছের পাতা ঝরে গেলো সেই কবে,
ফের তো এলো না ফিরে।খোকা দুপুর বেলা বেরিয়েছিলো কলেজে ফেয়ারওয়েল,বিকেল রাত্তির পরদিন সকাল গেলো, কই এলো না তো আজ অব্দি।

এ শহরের সাইনবোর্ড আর বিলবোর্ডগুলি প্রায়শ ভুল; আরও বেশি ভুল,বলা ভালো – মিথ্যে-মুদ্রিত কথামালা,

‘তুমি তো অতোটা পথ হেঁটে এলে’ – প্রশ্ন করে মান্তু নিজেকেই – এসবের মধ্যে কোনো সঙ্গতি আছে কি কিংবা যোগসুত্র?

না না অতো করে ভাবতে নেই।এমনিতেই জ্বর বয়ে গেলো, মাথা ঝিম ঝিম।
তারচেয়ে বরং ভেবে নেয়া- ইরার সঙ্গে দেখা হবে আজ; ভেবে নেয়া নাকি সত্যিই দেখা হবে!

দুপুর ১.৪৫

ঘাসের বুক কিংবা বুকের মধ্যে ঘাস এবং ঘাসের বুকে ইরা – ঘাস ফড়িঙের মতো আর মান্তু যেনো হাঁটু ভাঙা ‘দ’!

ইরা: জ্বর নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিস। – মানে হয় কোনো!
মান্তু: ” মানুষ জাগবে ফের ফের জাগবে মানুষ ” – তাই মানে হয়।
ইরা: ” সে অনেক শতাব্দীর মনিষীর কাজ”। তুই বুঝি মনিষী হয়ে উঠছিস!
মান্তু: ইরা
ইরা: বল
মান্তু: এ শহর চেয়ে দেখ – মাটির নিচে দেবে গেছে।
পুস্তকের প্রাতিষ্ঠানিক পাতা উড়ছে এলোপাতাড়ি। অক্ষরগুলি প্রাতিষ্ঠানিক ততোধিক, শুধু বলছে অবদমনের কথা আর বলছে মৌন থেকে যেতে।
ইরা: তো কি করতে চাইছো হে কমরেড?
মান্তু: মনে কর তুই মানে ইরা একটি স্থাপত্য কলা।
তোর নাকের উপর চোখ, ঠোঁট বসে গেলো হাঁটুর উপর।
তোর অষ্টাদশী স্তনযুগলের একটি চলে গেল ঘাড়ের উপর, অন্যটি তলপেটে- এভাবে এমন এলোমেলো। তুই কিংবা তোর মত কেউই মেনে নিতে পারবে না।কিন্তু মেনে নিচ্ছে সমাজপতিগণ।

ইরা: স্তব্ধ প্রহর স্তব্ধতম করে দিচ্ছিস কেনো!
মান্তু:” সুন্দর -কে যেভাবেই রাখো সে সুন্দর”-
এটা যে contexual, মোটেই literal নয়,বলতে চাইছিলাম সে কথাই।
ইরা: মান্তু, সময় গড়িয়েছে। তলপেটে স্তন নিয়েই আমাকে ছুটতে হবে ন্যুনতম আহার্য খুঁজে নিতে এবং সহস্র ইরাকে।আমি উঠছি।সাবধানে বাড়ি ফিরে সেল করিস।
মান্তু: ইরা, এই যে তুই ফোন করাকে সেল করা বলিস এটাই তোর স্বকীয়তা এবং মৌলিকত্ব। figure of speech or like coining।
ইরা:কাছে আয় মান্তু তোকে একটু ছুঁয়ে দি।
মান্তু:দূর থেকে আমার চোখ ছুঁয়ে দে।
ইরা: কীভাবে?
মান্তু: চোখে চোখ রাখ, তাহলেই ছোঁয়া হয়ে যাবে।

ইরা চলে গেল আহার্য সন্ধানে।

ইরার ছুটন্ত ছায়ার দিকে চেয়ে মান্তুর মন পড়ে- বিনিকে কখনো জানতেই হয় নি আহার্য সন্ধান কী।
জ্যাক্সন হাইটের বাইশ তলায় সকল বৈভব পৌঁছে যায় তার পায়ের কাছে। “পৃথিবীর এইসব ইতিহাস রয়ে যাবে চিরদিন /এশিরিয়া ধুলো আজ বেবিলন ছাই হয়ে আছে”।

হেঁটে হেঁটে এই পথ দীর্ঘ হয়ে গেছে।সড়কের শেষ মাথা – একটি লেজের মত – এখানে শতবর্ষী এক পা ওয়ালা তালগাছ। ব্রিটিশ ভারত, পাক ভারত, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেনো এক “নিঃসঙ্গ পাইন”।-
ইরা এসব ভাবতে চাইছে না।দূরন্ত কৈশোরে ইরার যখন অকস্মাৎ রক্তক্ষরণ হলো- ইশকুলে- কী মনে করে মান্তুকে বলেছিলো।অইটুকুন ছেলে – বিজ্ঞের মতন বলেছিলো -সেরে যাবে, বাসায় চলে যা।
ইরার কাছে আজও প্রশ্ন হয়ে আছে – অই বয়সেই কি মান্তু মেয়েলি ওসব জেনে গিয়েছিলো!

সূর্যটা স্থির নয় যেমন অস্থির হয়ে আছে ইরার মন।
বহুদিন পর আজ মনে হচ্ছে – মৃত্যুর চেয়ে জীবন রহস্যময়।কিন্তু এসব ভাবনা ইরা চাইছে না আজ ভেবে নিতে।আজ তবে কী! পোড়া মন ভাঙা বাসন! – ওসবও পুরনো, ভীষণ ন্যাকা।

বাম দিকে চোখ চলে যায়। একটি কিশোরী একটি যুবক হাঁটছে। হাত ধরে আছে। সংযত গতিবিধি।- তবে কি প্রেমের চেয়ে অধিক কিছু- প্লেটোনিক অথবা পেত্রার্কীয়! হঠাৎ শূন্যতার নেমে এলো বৃষ্টিমেঘছায়াপটভূমি।হ্যাঁ জীবন তো এরকমই হয়;
পথ ফুরিয়ে এলে মনে হয় – আরও কিছু পথ বাকি থেকে যাক – ইচ্ছে মতো বাঁক নেয়া যেতো তবে।

পুঁজিবাদের পাথরে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া পোকার মতো মানুষগুলির দিকে দৃকপাত করে দেখা গেলো- এরা হেঁটে চলেছে পেছন দিকে। ট্রেনের স্লিপারে গাড়ি সড়কে নৌকো সমুদ্রে উড়োজাহাজ,স্টেডিয়ামে রেফারি খেলছে আর খেলোয়ার বসে ঝিমুচ্ছে। হ্যাঁ এমন হবারই কথা এই মধ্যদুপুরে আজ।
এই মধ্যদুপুরে ইরার ব্যাগে এক মুঠো আহার্য,তাই মনে হলো – জীবন খুব বেশি মন্দ নয়।

দুপুর ২.৪৫

মান্তু আধশোয়া।
বিনি: তুই আজ হেঁটে এসেছিস ৫০০ বছর নাকি তারও চেয়ে বেশি!
মান্তু: অন্তত হাজার বছর না হেঁটে বাংলা কবিতা বোঝা তো সম্ভব নয়।
বিনি: কবিতা আজ দুইটি চা’য়ে ভিজিয়ে খেয়েছি।ভালো অভিজ্ঞতা হলো আবার জিভ তেতো হয়ে গেলো।সম্ভবত অফ ট্র্যাক।
মান্তু: তোর বাড়িতে কোনো কবিতা নেই।
তুই নেটে প্রেস করলে কিছু সর্প বেরিয়ে আসে।ওরা তোর সমগ্র শরীর করে নেয় রোমন্থন।
বিনি: কিন্তু মনকে নয়।
মান্তু: তোর মন এক আয়না বৃহৎ- যেখানে অদৃশ্যাদি হচ্ছে দৃশ্যমান কিন্তু দেখা যাচ্ছে না নিজেকেই।
বিনি: তবে তোর মন?
মান্তু: একটি গরম কড়াই।তেল ঢেলে পুরি ভাজা হচ্ছে।পুরিগুলি পার্সেল হবে জ্যাক্সন হাইট এলসেশিয়ানের উদ্দেশে।
বিনি: আমি এলসেশিয়ান কতোবার ডিনাই করেছি কিন্তু সে বড্ড আমায় ভালোবাসে।
মান্তু: হয়েছে কী শোন, যা হয় কিংবা হয়েই গেছে- এ শহরে জেগে উঠেছে পুরনো পুকুর যেখানে মাছগুলি মরে ভেসে আছে। অসংখ্য ভেসে উঠেছে সালু কাপড়- বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা।
এ শহরে একটি কিশোরীকে আত্মহত্যার দায়ে ফাঁসি দেয়া হলো। আদালত জানতেই চাইলো না কী ছিলো নেপথ্য কাহিনী – আত্মহননের। আহা এ শহরে তোর মত এক শহরপতি কমরেড মান্তুর ঘরে বসে ফলাচ্ছে আধা দাদাবাদ আধা পরাবাস্তব বিলাসিতা। কেনো তুই বিনি হলি, তুই কেনো হলি না ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো ইন্দ্রিয়জ! কেনো তুই অমন তেজস্ক্রিয় মাখনেও কী ভীষণ নিষ্পাপ।অসংগতি, কেবলি ডেবিট ক্রেডিট অমীমাংসিত ফাইনাল একাউন্ট – মৃত এ শহর!

বিনি দেখতে পায় – মান্তু তুমুল চিৎকারে আরও কিছু চলেছে ব’লে কিন্তু এ শহর ভাইব্রেট, শব্দ কম্পাংক বন্ধ করার বসিয়ে রেখেছে মেশিন। মান্তুর কথা শুনতে পাচ্ছে না কেউ।প্রবল শক্তি যোগ করে মান্তু তীর্যক চাইছে তাকিয়ে থাকতে খুব দেখে নিতে এবং চাইছে দেখিয়ে যেতে ; এ শহর মান্তুর চোখে গ্লুকোমা সেঁটে দেবার যন্ত্র রেখেছে বসিয়ে!

বিনি মান্তুকে ছুঁতে চাইলো।মাঝখানে দেয়াল- এ শহর দিয়েছে নির্মাণ করে।

অগত্যা প্রস্থান।

মৃত নগরীর প্রধান সড়ক।ভি – সিক্স।
বিনির মনে পড়ে -একদিন ইরা-কে সে প্যাকেট আহার্য পাঠিয়েছিলো।মান্তুর কাছ থেকে প্যাকেটটা নিয়ে ইরা তুমুল উত্তেজিত কলেবরে ছুঁড়ে ফেলেছিলো নিকটতম ডাস্টিবিনে।ইরা জানবেও না – বিনি প্রত্যাশা করেছিলো ঠিক ওরকম প্রতিবাদ – ইরাময়।
বহুদি পর আজ মনে হচ্ছে- এখনও এ শহরে নিভে যায় নি আগুন।কিন্তু একি! মানচিত্র আজ ওরকম শূন্যে ঝুলে আছে কেনো!

আর মাত্র ৩০ মিনিট পর পৃথিবীতে থাকবে না কমরেড মান্তু নামে কেউ।বিনি মান্তুকে মনে মনে বলে নেয়- কমরেড মান্তু, তুই জেনে যেতে পারলি না বিনির সমস্ত বিত্ত বৈভবের চেয়ে এই পৃথিবীতে তোর এক সেকেন্ড বেশি সময় নিঃশ্বাস নেয়া আমার কাছে অনেক বেশি অনিবার্য।খুব খুব খুব বেশি।

স্টেয়ারিং ধরে আছেন- যিনি একজন জামশেদ কিংবা কৈলাস -ব্যাক ভিউ মিররে দেখতে পায়-বিনির লাল টুকটুকে গালে কাজলভাঙা জল।মানচিত্র এখনও শূন্যে ঝুলে আছে।

৩০ মিনিট শেষ হতে আর কয় মিনিট বাকি!- বিনির কাছে কোনো ঘড়ি নেই।নেই, কেননা ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে অদৃষ্টের কোনো সম্পর্ক নেই।

বিনির সমুখে গড়িয়ে চলেছে আজ একটি দুপুর- অটিস্টিক।

মন্তব্য করুন