Skip to content

ইরার পাগলামি – প্রসূন গোস্বামী

ইরার অসুখটা একটু অন্যরকম।
কোন জ্বর, কোন কাশি নেই।
শরীরটা সুস্থ, হাসিটা ঝলমলে।
কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত দুরন্ত,
যেন নীল সাগরের গভীরে কোনো ঝড়ের আঁচ।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে জানালা খুলে দাঁড়ায়।
গাছের পাতায় শিশিরের মুক্তো,
দূরের ঢেউয়ের ঝাপটানি,
এসব দেখে তার মুখে কোনো আনন্দ নেই।
এক দৃঢ় বিশ্বাসে সে মনে করে,
সবকিছুই একটা মায়া, একটা ক্যানভাসের ছবি।

দিনের বেলা সে বাড়ির কোণে গিয়ে বসে থাকে।
হাতে কোনো কাজ নেই, চোখ দুটো বন্ধ থাকে।
কিন্তু মনটা ব্যস্ত থাকে অন্য কোনো জগতের কথা ভাবতে।
হয়তো সে কোনো নক্ষত্রের রাজকন্যা,
এখানে নির্বাসনে এসেছে।
হয়তো সে কোনো মৃত মানুষের আত্মা,
পৃথিবীতে আটকে আছে কোনো অজানা কারণে।

মানুষেরা ইরাকে পাগল বলে।
কিন্তু তার পাগলামিতে একটা গভীর সত্য আছে।
সে জীবনের এই চলমান ধারাকেই প্রশ্ন করে।
কেন আমরা জন্মাই, কেন বাঁচি,
কীসের টানে এই পৃথিবীতে আটকা?
আমরা কি সত্যিই আছি,
নাকি শুধু একটা স্বপ্নের অংশ?

একদিন ইরা বাড়ির ছাদে উঠে দাঁড়ায়।
হাত বাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চায়।
সে মনে করে হয়তো এইভাবেই সে ফিরে যেতে পারবে,
যেখানে সে আসলে থাকে।
কিন্তু আকাশটা অনেক দূরে।
সে হতাশ হয়ে বসে পড়ে ছাদে।
চোখে জল এসে যায়।

কিন্তু ঠিক তখনই পাখির একটা ঝাঁক তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়।
সাদা, ঈশ্বরী রঙের পাখিরা।
তাদের ডানায় লেগেছে সূর্যের আলো,
যেন স্বর্গীয় রথের চাকা।
ইরা চোখ মুছিয়ে তাকায়।
হঠাৎ তার মনে হয়,
হয়তো এই পাখিরাই হচ্ছে সেতু,
এই দুনিয়া আর তার আসল জায়গার মাঝে।

পরের দিন থেকে ইরা আর বাড়িতে থাকতে চায় না।
সে খোঁজে নদীর ধার।
সে জানে, পাখিরা সবসময় নদীর উপর দিয়েই উড়ে যায়।
হয়তো সেখানে, নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকলে,
সে একটু কাছাকাছি যেতে পারবে তার নিজের জগতের।

দিনের পর দিন সে নদীর ধারে বসে থাকে।
চোখ রাখে আকাশে, পাখিদের পথ চেয়ে।
মাঝে মাঝে সে নিজের গলায় গান গাওয়ার চেষ্টা করে।
অদ্ভুত সুর, যেন কোনো দূরের দেশের সঙ্গীত।
কেউ বোঝে না তার গান,
কিন্তু পাখিরা থামে তার উপরে একটু সময়ের জন্য।
হয়তো তারা চিনতে পারে এই অচেন সুরের ভাষা।

একদিন সন্ধ্যায়, ঠিক সূর্য ডুববার সময়,
একটা বুড়ো মাঝি ইরার কাছে এসে দাঁড়ায়।
হাতে তার একটা ঝুড়ি, ভরা সাদা, ঈশ্বরী রঙের ফুল।

“কী খুঁজছো বাছা?” – মাঝি জিজ্ঞেস করে, মৃদু হাসি মুখে।

ইরা চুপ করে থাকে একটু।
তারপর পাতলা গলায় বলে,
“আমি ফিরে যেতে চাই, যেখান থেকে এসেছি।”

মাঝি মাথা নাড়ে।
“ফিরে যাওয়া হয় না বাছা।
সবকিছুই একটা নদীর মতো, সব সময় এগিয়ে চলে।”

ইরা হতাশায় মাথা নিচু করে ফেলে।
কিন্তু মাঝি তার হাত বাড়িয়ে দেয় ফুলের ঝুড়িটা।

“এই ফুলগুলো নিয়ে যাও।
ছেড়ে দাও নদীতে।
হয়তো এই ফুলের সঙ্গে তোমার কোনো স্মৃতি ভাসবে,
কোনো দূরের দেশে পৌঁছে যাবে।”

ইরা ফুলগুলো নেয়।
একটা একটা করে ছেড়ে নদীতে ফেলে দেয়।
প্রতিটা ফুলের সঙ্গে যেন একটা করে স্মৃতি ভাসিয়ে দেয় সে,
এই পৃথিবীর স্মৃতি।
হয়তো কোনো একদিন,
কোনো অজানা জমিতে,
ফুলগুলো তার হারানো স্বর্গের খবর দিয়ে যাবে।

সেদিন সন্ধ্যায় নদীর ধারে বসে ইরা,
আর পাগল মনে হয় না।
তার চোখে একটা শান্তির আভা।
হয়তো সে জেনে গেছে,
ফিরে যাওয়া না হলেও,
স্মৃতির মাধ্যমে হয়তো একটা যোগসূত্র থাকে
সবারই নিজের আসল জায়গার সঙ্গে।

মন্তব্য করুন