Skip to content

আমি হিমু নই – এম. আরিয়ান হাবিব

আমরা যারা নয়া-নয়া বইপ্রেমী হই, প্রেমের প্রথম দিনগুলো তাদের কাটে হুমায়ূন আহমেদের বইগুলোর সাথে।পরবর্তীতে বহু কিংবদন্তি পর্যায়ের লেখকদের বই পড়ে হুমায়ূন সাহেবের লেখার ত্রুটি উপলব্ধি করতে পারলেও মানুষ যেমন প্রথম প্রেমকে ভুলতে পারেনা তেমনি পাঠকও হুমায়ূন আহমেদকে অগ্রাহ্য করতে পারেনা।প্রথম প্রেমের রেশ যেমন একজন মানুষ তার গোটা জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারেনা ; একজন পাঠকও হুমায়ূনের বইয়ের উপর থেকে ভালোবাসা তুলে নিতে পারেনা।আর সেই প্রেমের একটা বড় অংশজুড়ে থাকে ‘হিমু’ নামের এক হলুদ পাঞ্জাবিওয়ালা ছেলে।তার সাথে থাকতে থাকতে আমাদের কিশোর মনেও ইচ্ছা জাগে একজন হিমু হওয়ার আকাঙ্খা। কেমন হয় যদি আমিও হিমুর মতো ৩৪ সাইজের একটা পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি? কেমন হয় যদি আকাশ দেখতে দেখতে গন্তব্যহীন এক পথে হাটতে থাকি?আমারও ইচ্ছা হয় হিমুর মতো ‘মহামানব’ হয়ে উঠতে।ইচ্ছা হয় নিজের ইনটুইশন ব্যবহার করে মানুষকে হকচকিয়ে দিয়ে নিজেকে রহস্যময় করে তুলতে।বড্ড ইচ্ছা হয় হিমুর মতো মায়াহীন জীবন কাটাতে, তার মতো মনোবল তৈরি করতে।
কিন্তু তা-যে আমি পারিনা, আমি তো হিমু নই!আমি মায়ায় পড়ে যাই বাবার ঘামে ভিজে কালো হয়ে যাওয়া শার্টের কলারের দিকে তাকিয়ে, তার বলা ‘আব্বু’ ডাক-টা যে আমায় অবাধ মায়ায় তলিয়ে দেয়।আমি জড়িয়ে যাই এক কঠিন মায়ায় যখন দেখি রান্নাঘরে মা ঘামে চুপচুপে হয়েও চুলোর সামনে দাঁড়িয়ে, তার আদর পেলে যে আমি আর মায়াহীন জীবনের কথা ভাবতে পারিনা।আমার মায়া হয় যখন আমার ভাই আমার খেলার সাথি হয়, আমার মায়া হয় যখন আমার বোন আমায় ভালোবেসে খাইয়ে দেয়।আমার মনে মায়া জাগে যখন সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেলে হাসে।আমার মায়া জন্মায় সেসব মানুষদের প্রতি যাদের জন্য মায়া করার মতো কেউ নেই, আমি মায়ায় পড়ি তাদের জন্য যাদের মনে মায়া থাকে সবার জন্যে। আমি পারিনা হিমুর মতো হতে যখন আমার চারপাশের জগৎকে আমি দেখি।আমি পারিনা নিজেকে আটকাতে ভালোবাসায় জড়ানো থেকে, আমি পারিনা তাকে আমার থেকে দূর করতে।আমি আনন্দে হাসতে-হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি,সেই আমি-ই আবার দুঃখ পেলে অশ্রু ঝড়াই। না-ই বা হলাম মহামানব, এই জীবনের বিচিত্রতা না হয় একজন সাধারণ মানুষ হয়েই প্রত্যক্ষ করি?
কিন্তু হিমু-ও কি পেরেছিল তার বাবার ‘মহামানব’ হতে?সে কেন তার প্রতিবেশীকে তার অংশের খাবার দেয়?কেন সে তার বন্ধুর জন্য নিজে কষ্ট বরণ করে?কেন-ই বা সে নিজে বিপদে পড়ে অপরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে?সে কেন নিয়মিত রুপার সাথে আলাপ করে?তার তো রুপার এত খোজ নেওয়ার কথা নয়!তবে কি হিমু পারেনি এই মায়াময় জগতের মায়াকে উপেক্ষা করতে?উপেক্ষা তো হিমুর স্রষ্টা স্বয়ং হুমায়ূনও করতে পারেননি।নাহলে সে কেন সকল আলোচনা-সমালোচনা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে পঞ্চাশোর্ধ বয়সে পৌঁছে দ্বিতীয়বারের মতো সংসার বাধার মতো কার্য করলেন? বস্তুতপক্ষে এ মায়াময় জগতের মায়া অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা আমাদেরকে মহান সর্বশক্তিমান দিয়ে পাঠাননি।নয়তো তিনি আদমের জন্য কখনোই হাওয়াকে পাঠাতেন না।
আমি হিমু নই।আমি হতে চাইনা কোনো মহামানব।তবে এতে যে আমার হিমুর প্রতি অনীহা প্রকাশ পায়, তা অবশ্যি নয়।আমি হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে হাটি, আকাশ দেখি, আড্ডা দেই, চা খাই।যখন আবার আচ্ছন্ন হতে ইচ্ছে করে মায়াহীন জীবনে, তখন নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেই কিছু কথা।
“জীবনটা হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস নয়।এখানে চাইলেই হিমু হওয়া যায়না।আমার জীবন মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে এবং আমি একে ঘিরেই বাঁচতে চাই।আমি মা-বাবার মুখে হাসি ফুটাতে চাই, ভাই-বোনদের সাথে সময় কাটাতে চাই, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চাই, ভালোবাসতে চাই তাকে সকল কিছু উজাড় করে দিয়ে। আমি মায়ার এই অটুট বন্ধনে নিজেকে বেঁধে রাখতে চাই, আজীবন।”

মন্তব্য করুন