Skip to content

“ অরুনরাঁঙ্গা তুঁলি ” – অথই মিষ্টি

মা আমার সামনে বসা । আর আমি খেতে বসেছি । কিছু বলার অবস্থায় এখন আর আমি নেই । কারন মুখ ভর্তি ভাত । স্কুল থেকে আসার সময় নিতুকে বলেছি ,“শুধু বইগুলা রেখেই দৌড় দিবো ।” কিন্তু নাহ্ , তা আর হলো না । কারন বাড়িতে এসেই পরেছি মায়ের সামনে , এখন দুপুরে না খেলে বেড়তে দিবেনা । তাই কি আর করার খেতে বসেছি । খেতে খেতেই হঠাৎ ,
“ তুলি ! ও তুলি !”
মুহূর্তেই গা শিহরে উঠলো আমার । বুঝতে পারলাম যে , নিতু এসেই পরেছে । চোখ বড় বড় করে শুধু তাকিয়ে রইলাম । মুখ ভর্তি ভাত কথা বলার তো আর কোনো উপায় নাই আমার ।ভাবতেছি এই যাহ্ , মায়ের কাছে আজ বোধ হয় ধরা খেয়েই গেলাম ! মা বলে উঠলো,
“ কে !”
“ আমি চাচি । আমি !”
“ ও নিতু !”
“ হ্যাঁ ”
“ তো কই যাওয়া হচ্ছে আজ শুনি !”
“ না কোথাও যাবনা । আমাদের বাড়িতেই খেলবো ।”(ভয়ে ভয়ে বলল)
“ হ্যাঁ , এই খাঁ খাঁ দুঁপুরে যেনো কোথাও না যাওয়া হয় ।”
“ আচ্ছা চাচি ।”(ভিরু হয়ে)
মনে মনে ভাবতেছি যাক বাঁচলাম এ যাত্রায় ।ততক্ষনে আমার খাওয়া শেষ ।তারাতারি করে উঠে মায়ের আঁচলে হাতটা মুছেই নিতুর হাতটা টেনে বাড়ির বাহিরে আসলাম । আর নিতুর উদ্দেশ্যে বললাম ,
“ তুই বাঁচালি রে ।আর একটু হলে তো ধরাই খেয়ে যেতাম ।”
ঝাঁড়ি দিয়ে আমার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে নিতু ওর ভ্রু-দ্বয় সংকুচিত করে ভাব নিয়ে বলে উঠলো ,
“ প্রতিবার তো আমিই তোকে বাঁচাই , তুই কি তা মনে রাখিস !”
“ ও আচ্ছা তাই বুঝি ! তবে কি করতে হবে আমার সেটা তো বল !”
“ থাক থাক বীর কন্যা সেজে বিশেষ কিছু করতে হবেনা তোকে ।চল চল ঐ উত্তর পাড়ার শিমুল তলায় ।”
“ উত্তর পাড়ার শিমুল তলা ! কেন ? সামিউলদের বাড়ির পরে যে শিমুল গাছ আছে সেখানে না যাওয়ার কথা ?”
“ আরে সামিউলদের বাড়ির পাশের গাছটা অনেক ছোট আর ফুলগুলোও অনেক ছোট ছোট । তার চেয়ে চল ঐ উত্তর পাড়ার শিমুল তলা যাই !”
“ আচ্ছা ঠিক আছে চল ।”
তারপর দুজনে মিলে যাইতেছি ঐ উত্তর পাড়ায় । পথটা একটু লম্বা তবে বেশি লম্বা নয় প্রায় দুই কিলোর মতো হবে । আজ বসন্ত । প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে । সকালে স্কুলে যেয়ে দেখি আমাদের সকল শিক্ষকরা কি সুন্দর লাল হলুদ পাঙজাবি পরেছেন । আর শিক্ষিকারা পড়েছেন লাল হলুদ শাড়ি আর মাথায় দিয়েছেন ফুল ।আজ ক্লাসে এই বসন্ত নিয়ে খুব সুন্দর কথা বলেছেন স্যার । তাই তো আমি আর নিতু ঠিক করেছি আজ রক্ত লাল শিমুল ফূল দিয়ে দুজনে সাজবো আপন মনে মনের আনন্দে ।
আদা ঘন্টার মধ্যেই এসে পৌচ্ছালাম আমরা এ বিশাল শিমুল গাছের নিচে ।কোলাহলে আবর্তিত হাজার কাজে ক্লান্ত আঁখি তুলে এ বিশাল দানব দেহী সু-সজ্জিত রক্ত লালে পূর্ন শিমুল গাছের দিকে একবার তাকালেই যেনো মন ভরে যায় শান্তিতে ।সে কি সৌন্দর্য আহা যেনো মন মাতানো ।
উত্তর পাড়ার এ গাছটি মাথা উচু করে দ্বাড়িয়ে আছে পুরাতন পাকা রাস্তার ঠিক কিনারে ।আর গাছ তলা ভরে গেছে হাজারো ফুলে । যেনো শিমুলের চরন রক্ত লালে লাল আলতা পায়ে দ্বাড়িয়ে আছে বধূর সাজে ।যাই হোক অবশেষে এসেছি হেতায় , এতা ফুল ছেড়ে কি মন বাড়ি ফিরতে চায়? নিতু বলে উঠলো ,
“ ঐ দেখ দেখ কত ফুল !”
“ তা দেখার সময় নাই , তারাতারি কুড় । বাড়ি ফিরতে হবে ।”
“ অতো কিসের তাড়া রে তোর? এসেছি যখন এতো দুর মন ভরে ফুল নিব তার পর যাব । বুঝেছিস !”
“ আচ্ছা , কথা বাদ দিয়ে আগে কুড় ।”
“ কুড়াইতেছিই তো না-কি ?”
“ ঐ পাশে দেখ কি সুন্দর ”
“ তো যা তুই ঐ পাশেই কুড় । আমি এ পাশে কুড়চ্ছি ।”
আমি সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে কুড়নো শুরু করলাম । তো আমার চোখে পরলো স্যাঁতস্যঁতে ফুড়ফুরো বালির মতো কিছু । রাস্তার পাশে বেশ কিছু জায়গাজুরে এ বালু । যেনো মনে হচ্ছিলো তুলোর মতো হালকা আর ফুড়ফুড়ে নোরম ।আমার হাত ভর্তি শিমুল ফুল তাই হাতে স্পর্শ করতে পারলাম না ।তাই বলে কি স্পর্শ করবোনা ! আমি আমার পা দিয়ে একটু উপরে স্পর্শ করতেই দেখি দখিনা হাওয়ায় কি সুন্দর ভাবে উড়ে গেলো , কিছুটা ভালো লাগা কাজ করছিলো আমার মাঝে , কিন্তু নাহ্ বুঝতে পারছিলাম না যে এগুলা কি ।এবার আমি লাফাতে লাফাতে এই বালিগুলার মাঝখানে প্রবেশ করলাম । পা দিতেই মনে হচ্ছিলো যেনো পা সরাসরি মাঠি স্পর্শ করছে । এতোখানি হালকা এগুলা । লাফাতে লাফাতে মাঝখানে এসে নিতুকে ডাকতেছি ।
“ নিতু , নিতু এই দেখ …
নিতু পিচনে ফিরেই , আচমকা চমকে উঠে , ওর চোখ দুটো বড় বড় করে , আমার দিকে দৌড়ে আসছে আর চিৎকার করে বলতেছে ,
“ তুলি ! নেমে আয় , নেমে আয় …
আমি কিছু না বুঝেই ওর কথা শুনে হতবাক হয়ে তা থেকে নেমে দ্বাড়ালাম । নিতুও আমার পাশে এসে দ্বাড়ালো । আমি বুঝতেছিনা আসলে বিষয়টা কি ! আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । আর নিতুও বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে ,
হাঠাৎ আচমকা আমার পা দুটো তরতাজা আগুনের লেলিহাশীখার ন্যায় জ্বলতে আরাম্ভ করলো ।আমি তাকিয়ে দেখি আমার হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পযর্ন্ত সমস্ত পায়ের লোম গুলো কুকড়িয়ে গেছে , আর লাল হয়ে গেছে ।ফুটন্ত গরম পানিতে গোল মরিসের কুড়া দিলে যে রুপ ধারন করে যেনো তেমনি রুপ ধরেছে আমার পা দ্বয় ।জলন্ত কয়লার আগুন যেমন জ্বলে ঠিক তেমনি জ্বলতেছে আমার পা ।আমি হতোভম্ভ হয়ে , বলে উঠলাম,
“ নিতু ! আমার পা জ্বলতেছে , আমার পা জ্বলতেছে …(অস্থির হয়ে আকুতি নিয়ে)
“তুলি কেন তুই এ তুষের আগুনে নামলি ? গতকালই রাস্তার কাজ করেছে এ আগুন জ্বালিয়ে । এ যে জ্বলন্ত আগুন । কেন নামলি ?” ( করুন সুরে )
“ নিতু ! খুব জ্বলতেছে , আগুনের মতো জ্বলতেছে নিতু …( আকুতির সাথে কাঁন্না জড়ানো কন্ঠে )
কাঁন্না করতে করতে আমি আমার সমস্তটুকুন শক্তি দিয়ে দৌড়াতে আরাম্ভ করলাম বাড়ির দিয়ে । আর আমার অঝড়ে পড়া চোখের পানি মুছতে মুছতে ।এ বিশাল পৃথিবী যেনো আমার সংকুচিত হয়ে আসছে , আমার ভিষন কষ্ট হচ্ছে , আমার পা দুটো খুব জ্বলতেছে , আমার ভিষন কষ্ট হচ্ছে …
আমার পিচন পিচন নিতুও দৌড়াচ্ছে ।আমার যেনো আর কোনো দিকে নজন নাই । এ অপূর্ব সুন্দর ভূবন যেনো আমার চোখে এখন আর পরছেনা ।এ বিশাল বিষাদময় দূসময়ে যেনো ভিষণ করে একজনকেই বার বার মনে পড়ছে , খুব দূত তেনার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে , তাই তো তেনাই উদ্দেশ্যেই আমি প্রানপণে ছুটতেছি । তিনি আমার মা । হ্যাঁ , এখন আমার আপন বলতে শুধু মা কেই মনে পড়ছে ভিষণ ।মনেহচ্ছে আমার পৃথিবী আমার মা , আমার শত শত কষ্ট আমার মা , আমার অতিব আপন আমার মা , আমার কষ্টের ভাগিদারী আমার মা , কেই নেই ছাড়া আমার মা , আমায় বুঝবে শুধু আমার মা , মা , মা বলে চিৎকার দিতে দিতে আমি দৌড়াচ্ছি ।
দৌড়াতে দৌড়াতে এক পর্যায়ে আমাদের গ্রামে প্রবেশ করলাম । আমাদের গ্রামের শুরুর দিকে নিতুদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি গ্রামের মাঝখানে । নিতু বলর ,
“ আমাদের বাড়িতে আয় ।”
ওদের বাড়িতে গেলাম । ওদের বাড়িতে নিতু সমস্ত কিছু তারাহুরা করে খুঁজে দেখলো । কিন্তু কোথাও কোনো পানি পেলো না । ফাল্গুন মাস পানি সংকট মৌসুম ।অবশেষে সমস্ত বাড়ি খুঁজে একটা ছোট্ট বাটিতে সামান্য কিছু পানি নিতু আমাকে এনে দিলো । শত বছরের ক্ষুধার্থ ব্যক্তির সামনে এক মুষ্টি ভাত রাঁখলে , সে ব্যক্তি ঠিক যতটা অস্থির হয়ে খাওয়া আরাম্ভ করবে , আমিও অনুরুপ অস্থিরতার সাথে নিতুর হাত থেকে পানির বাটিটা নিয়ে অধিক জ্বলোমান আমার ডান পায়ের ডান পাশে ঢেলে দিলাম ।এক মুহূর্তের জন্য এতোটুকুন শান্তি অনুভব হলো আমার ।কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জ্বলোমান যন্ত্রনা যেনো শতগুন বেড়ে গেলো ।আমার চোখ দিয়ে অঝড়ে ঝরছে পানি ।আমি নিতুদের বাড়ি থেকে বেড় হয়ে আবারও দৌড় দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে ।নিতু আর আমার পিছু নিলোনা । কারন , নিতুর চোখে মুখে হতাশা আর ভয়ের ছাঁপ স্পষ্ট ।
প্রানপণে ছুঁটতে ছূঁটতে পরিশেষে আসলাম বাড়ির দরজায় । কিন্তু , বাড়ির দরজা লাগানো ।উত্তপ্ত আগুনে ঝলসানো আমার পায়ের মাংস গুলিন যেনো সিদ্ধ হয়ে গেছে , এতোখানি প্রদাহ আর যন্ত্রনা অনুভব হচ্ছে আমার ।বাড়ির দরজায় দু হাত দিয়ে শরিরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বারি মারতেছি আর চিৎকার করে করে কাঁন্না করতেছি যন্ত্রনার কষ্টে গলাকাটা মুরগির মতো লাফায়ে লাফয়ে ।আমার বিষয়ে অজানা আমার মা , দরজার ওপাশ থেকে শান্তনার উদ্দেশ্যে বলতেছে ,
“ কি হয়েছে তোর ! একটু অপেক্ষা কর আসতেছি । গোসল শেষ আমার জামাটা পড়েই আসতেছি মা … ”
কিন্তু ,নাহ্ আমি পারছিনা আর একমুহূর্তও অপেক্ষা করতে ।মায়ের জবাব শুনে যেনো আমার প্রদাহ আরও বেড়ে গেলো । কিন্তু আমার পা যে পুড়ে গেছে এ কথা বলার এক বিন্দুও সামর্থ আমার নাই এ সময়ের এক মুহূর্ত আমার কাছে সহস্র বছর ধরে চলোমান যন্ত্রনা মনে হচ্ছে । আমার শুধু চিৎকার করার আওয়াজ সবাই শুনতে পারছে ,কিন্তু না পারছেনা আমার তূষের আগুনে জ্বলে যাওয়া প্রদাহমান দাউ দাউ যন্ত্রনার একবিন্দুও অনুভব করতে কেউই । আমার বুক ফাঁটা কষ্টের হাহাকার , মুখ দিয়ে কাঁন্নার চিৎকার আর যন্ত্রনার তাঁড়নায় গলাকাটা মুরগির মতো লাফানোটা দেখতে দর্শকের সারিতে উপস্থিত হলো আশেপাশের প্রতিবেশি …

মন্তব্য করুন