অভিলাষ – মোঃ ইব্রাহিম হোসেন (প্রথম পার্ট)
ভূমিকাঃ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের জীবনে থাকে কিছু স্বপ্ন, কিছু আশা, থাকে কিছু চাওয়া পাওয়া। এই স্বপ্ন আশা, চাওয়া পাওয়াকে ঘিরেই মানুষের জীবন। জীবন বড়োই বৈচিত্র্যময়। বৈচিত্র্যময় জীবনের সাথে লড়াই করেই মানুষকে টিকে থাকতে হয় এ পৃথিবীতে। টিকে থাকতে হয় যুদ্ধ করে জীবন যুদ্ধের রণক্ষেত্রে। আর এই যুদ্ধ যদি হয় সৎ পথের, তবে ইহকাল পরকাল, উভয় জগতেই মানুষের জন্য কল্যাণ নিহিত আছে। আমরা মহান আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে এ পৃথিবীতে আগমন করেছি। আমাদের লক্ষ্য থাকতে হবে অটুট ও সৎ। তবেই আল্লাহ ও রাসুল (সঃ) এর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হবে। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য আমাদের বিবেককে, মনুষ্যত্বকে কাজে লাগাতে হবে। কারণ, মহান আল্লাহ তায়ালা৷ মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে প্রেরণ করেছেন এবং মানুষের মাঝে হালাল হারাম দুটোই দিয়েছেন। আর এটা নির্বাচন করার জন্য সবচাইতে বড় হাতিয়ার দিয়েছেন মানুষের মধ্যে বিবেক ও মনুষ্যত্ব। যার মনুষ্যত্ব নাই, সে কখনো মানবিক হতে পারে না ; সে মনুষ্যত্বহীন। যার বিবেক নাই, সে কখনো বিবেকবান হতে পারে না, সে বিবেকহীন। সে হয় পশুর সমতুল্য বা তার থেকেও অধম চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়। চতুষ্পদ জন্তু শুধু গরু ছাগল, ভেড়া বকরিই নয়। বরং এর থেকেও বনের নিকৃষ্টতম প্রাণি। যা মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। বিবেকহীন ব্যক্তি এর থেকেও অধম। তেমনি এক রোমান্টিক সামাজিক মিষ্টি প্রেম-ভালোবাসার কাহিনি নিয়ে এই অভিলাষের যাত্রা।
কাহিনিঃ বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে এক সুবিশাল পদ্মা নদী। কী নয়নাভিরাম অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য! একবার দেখলে তা বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। সবার নজর কাড়ে। এ পদ্মা নদীর পাশ দিয়েই গড়ে উঠেছে ইসলামপুর নামের এক সুন্দর পল্লিগ্রাম। এ গ্রামে বাস করতেন আব্দুর রহিম নামের এক সরকারি চাকরিজীবী। তাঁর স্ত্রী রহিমা বেগম। তাঁর ছিলো চারটি সন্তান। তিনটি মেয়ে ও একটি ছেলে। বড় মেয়ের নাম চম্পা, মেজো মেয়ে জবা, সেজো মেয়ে শাপলা এবং ছোট ছেলে জিয়াদ। এ চার সন্তান নিয়ে আঃ রহিম সাহেব খুব সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে জীবনযাপন করেন। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় ধীরে ধীরে সন্তনেরা বেড়ে উঠে। বড় মেয়ে চম্পা অনেক বড় হয়ে গেছে। বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। জবা, শাপলা ও জিয়াদ তার থেকে বেশ কয়েক বছরের ছোট বড়। কিন্তু তারা পরস্পর ভাই বোন সবাই দেখতে অনেক সুন্দর। কিন্তু সবার থেকে সুন্দর শাপলা। কাজেও চটপটে। সবাই তাকে সবার থেকে বেশি ভালোবাসতো। কারণ, সে যেমন ছিলো চাঁদের মত সুন্দর, তেমন ছিলো তার কাজও খুব সুন্দর, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সে খুব দ্রুততার সহিত সকল কাজ সম্পন্ন করতে পারে। বাবা মাও শাপলাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। অথচ কোনো সন্তানের প্রতিই দরদ কম নাই। তাদের বড় আপু চম্পার বিয়ের দিনধার্য ঠিক করা হয়েছে। ছেলেও দেখতে সুন্দর ও লম্বা চওড়া। সরকারি চাকরিজীবী। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাঁর নাম সোলায়মান। চম্পা ও সোলায়মান উভয়ের পরিবারের সম্মতিক্রমেই ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক তাঁদের বিবাহের আয়োজন করা হয়েছে আগামীকাল ১ লা সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ ইং রোজ শুক্রবার। আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে তাঁদের পরিবারে। শাপলা ছিলো যেমন সুন্দর, তেমন মেধাবী, তেমন সুরেলা কণ্ঠ। সবেমাত্র পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তার যাদুমাখা কণ্ঠে সকলেই মুগ্ধ হয়।
শাপলা বলে, বড় আপু! তোমার কালকে বিয়ে আজ সারারাত আনন্দ ফূর্তি করবো নাচবো গাইবো। তুমি আমাদের সাথে থাকবে। তোমাকে একটুও ঘুমোতে দেবো না।
বড় আপু চম্পাঃ দুষ্টু মেয়ে কোথাকার, তোর এই দুষ্টুমি কবে দূর হবে?
শাপলাঃ আপু আমার দুষ্টুমি কখনোই দূর হবে না। আজ সারারাত গাইবো, সারারাত নাচবো, কত্ত মজা করবো! হাহাহাহা,,,,,,,,,
চম্পাঃ এই শাপলা! ভালো হবে না কিন্তু। সর আমার কাছ থেকে। দূর হ। বড় আপুর সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, তাও জানিস না?
শাপলাঃ আপু! তোমার সাথে আমার আড়ি। আর কথা বলবো না। এই কান ধরলাম। এই দিনটা কি জীবনে আর কখনো কোনোদিন পাবো, আর কখনো কোনদিন আসবে ? একটা দিন একটু আনন্দ করতে চাইলাম, তোমার সহ্য হলো না। আমার বিয়ের সময় আমি একাই নাচবো, গাইবো কত্ত মজা করবো! তখন কিন্তু কেউ বারণ করতে পারবা না। কারণ, বিয়েটা আমার, হাহাহাহা। থাকো, আমি চললাম আমার ঘরে। আমার অনেক পড়া আছে । সামনে ফাইনাল ও বৃত্তি পরীক্ষা আছে। আমাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে। আমি এখন পড়তে বসবো। সারারাত পড়বো। আমাকে কেউ বিরক্ত করবা না, ওকে ?
চম্পাঃ লক্ষ্মী বোন আমার, বড় আপুর উপর রাগ করতে নেই। আমি তোমাকে রসিকতা করে বললাম। এসো আপু এসো, তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। তোমাকে আর বারণ করবো না, লক্ষ্মী বোন আমার।
শাপলাঃ ঠিক আছে আপু, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সে জবাকে ডাক দেয়।
এই জবা আপু ! তুমি কোথায় ? তাড়াতাড়ি এসো। সময় বয়ে যাচ্ছে। এসো আমরা খুব দ্রুত বিনোদনের আয়োজন করি।
জবাঃ ঠিক আছে বোন, আমি আসছি। একটু কাজ আছে। হাতের কাজটা সেরে নেই। নইলে আম্মু আবার বকা দেবে। তুই শুরু কর্। আমি একটু পরে আসছি।
শাপলাঃ আম্মু বকা দেবে না। আম্মু জানে, আজকে আমাদের আনন্দের দিন, বিনোদনের দিন। সবচাইতে সুখের দিন।
শাপলা যেন নাছোড়বান্দা। কোনক্রমেই জবাকে ছাড়তে চায় না। অবশেষে জবার আম্মু জবাকে বলে,
জবা! যাও তুমি পাগলীটারে সামলাও। জবা খিক করে হেসে বললো,
আম্মু! তোমার শাপলা শুধু পাগলীই না, বরং সে বিশ্ব পাগলী।
শাপলাঃ জবা আপু! তুমি এ কী বললে! আমি বিশ্ব পাগলী! আর তুমি বিশ্বের মহা পণ্ডিত, তাই না? তোমাকে সেলুট আপু, তোমাকে সেলুট। এবার তোমার দোহাই লাগে আমার সাথে এসো।
জবাঃ ঠিক আছে লক্ষ্মী বোন আমার, চলো চলো, আর দেরি নয়। আমরা এখনই আমাদের আয়োজন শুরু করবো।
তাদের সাথে তাদের বান্ধবীদেরও কয়েকজন আসলো এবং রঙ মাখামাখি শুরু করে দিলো। সারা বাড়ি আলোক রশ্মিতে ঝলমলে আলোকিত।
শাপলা তার জবা আপুকে বলে,
জবা আপু! আজ এই আনন্দঘনমুহুর্তে তোমাকেই গাইতে হবে।
আর বড় আপু! তুমি আমাদের মাঝখানে হলুদ শাড়ি পরে বসে থাকবা। আমরা তোমাকে ঘিরে হলুদের রঙে রাঙিয়ে গাইবো।
জবাঃ লক্ষ্মী বোন আমার তুই তো জানিস, আমি গাইতে পারি না। তোরা গেয়ে যা, আমি তোদের সাথে মুখ মিলাবো।
শাপলাঃ আপু তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমার বিয়েতে কিন্তু তোমাকেই গাইতে হবে। আর যদি তুমি না গাও, তবে আমি বিয়েই করবো না, বলে দিলাম কিন্তু।
বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাবো। কেউ আর হাসি ধরে রাখতে পারলো না। সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো। পাশে থেকে তাদের বান্ধবীর একজন, নাম হাসনা বলে উঠলো, তোরা এভাবে হাসাহাসি করবি, না কাজ শুরু করবি? আমি কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না, চলে যাবো। কারণ, আব্বু জানতে পারলে বকা দিতে পারে।
জবাঃ শাপলা শুরু কর্। তুই পিচ্চি মানুষ, তুই আগে শুরু কর্। আমরা পরে সুর মিলাবো।
শাপলা তার সুরেলা কণ্ঠে মিষ্টি হাসি দিয়ে গাইতে শুরু করলো,,,,
আজকে আপুর গায়ে হলুদ কালকে হবে বিয়ে,
আনন্দতে বর ও কনের নাচবে দু’টি হিয়ে।।
স্বপ্ন হাজার মনের মাঝে
সাজবে আপু বিয়ের সাজে,,
দুলা ভাইয়ে নিয়ে যাবে পাগড়ি মাথায় দিয়ে।
আজকে আপুর গায়ে হলুদ কালকে হবে বিয়ে,
আনন্দতে বর ও কনের নাচবে দু’টি হিয়ে।।
তিন কবুলে করবে আপু
ভিনদেশীকে আপন,
তার কাছেতে পূরণ হবে
আপুর মনের স্বপন।।
দু’টি চোখে স্বপ্ন আঁকে
জীবন সুখের নদীর বাঁকে,,
দুলা ভাইয়ে নিয়ে যাবে লাল শাড়িটা পরিয়ে।
আজকে আপুর গায়ে হলুদ কালকে হবে বিয়ে,
আনন্দতে বর ও কনের নাচবে দু’টি হিয়ে।
মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে
যাবে পরের বাড়ি,
অঙ্গে জড়ায় লাল পেড়ে ওই
বেনারসি শাড়ি।।
আপুর মলিন বদনখানি
বাবা মায়ের চোখের পানি,
মাওলা তুমি সুখে রেখো কাঁদি যে বুক ভিজিয়ে।
আজকে আপুর গায়ে হলুদ কালকে হবে বিয়ে,
আনন্দতে বর ও কনের নাচবে দু’টি হিয়ে।
“শাপলার বোন চম্পার বিয়ের দিন”
=======================
আজ পহিলা সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ ইং রোজ শুক্রবার। চম্পার বিয়ের দিন।
আনন্দ বিনোদনের মধ্য দিয়ে বিয়ের আগের রাত, সারারাত কেটে গেলো। আজকে চম্পার বিয়ে। সকাল হয়েছে। খুব ভোর বেলা। আব্দুর রহিম ও তাঁর স্ত্রী রহিমা বেগম ফজরের নামাজ পড়েছে। আব্দুর রহিম ফজরের নামাজ মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করে বাড়িতে এসে তাঁর স্ত্রী রহিমাকে ডাক দেন,
রহিমা! কই তুমি? এদিকে এসো।
রহিমাঃ এই তো আমি, কি বলবেন বলেন?
আঃ রহিমঃ ফজরের নামাজ পড়ে এসে দেখি কারও কোনো চালা শব্দ নাই। সব নীরব। কেউ কি ঘুম থেকে উঠেনি? নামাজ পড়ে কোরআন তিলাওয়াত করেনি?
রহিমাঃ জি,আমি নামাজ পড়ে সূরা ইয়াসিন খতম করে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছি কাজের জন্য। আজ পবিত্র জুম’য়ার দিন, আমাদের চম্পা মা-মণির শুভ বিবাহের দিন।
কাল সারারাত আনন্দ বিনোদন করে আজ সকালে ওরা ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। সবাই ঘুমে মগ্ন।
আঃ রহিমঃ মহান রব্বুল আলামীন আমাদের সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য। আর আমরা যে সমস্ত কাজকর্ম করি তা শুধু আমাদের এই প্রার্থিব জীবনের আনুষঙ্গিক মাত্র। যেহেতু আমাদের বেঁচে থাকার জন্য নিয়মিত খাওয়া দাওয়া পানাহারের প্রয়োজন। তাই আমাদের প্রতিনিয়ত কাজকর্মের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। তার মানে এই নয় যে আল্লাহ ও তাঁর বিধিবিধান ভুলে, তাঁর নামাজ রোজা বাদ দিয়ে জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মোহে পড়ে বিলাসিতার সহিত জীবনযাপন করা। তুমি তাদেরকে কেন নামাজের জন্য ডাকো নি?
এ দায়িত্ব কী তোমার ছিলো না?
রহিমাঃ জি, আপনি ঠিক বলেছেন। এ সমস্ত দায়-দায়িত্ব আমাদেরই। আমি ওদের সবাইকে ডেকেছি। কিন্তু চম্পা ছাড়া কারও সাড়া পাইনি। এ কথা বলেই তিনি চম্পাকে ডাক দেন। চম্পা ঘুম থেকে উঠে বলে ,জি আম্মু, কী হয়েছে?
রহিমাঃ তোমাকে নামাজের জন্য ডাকলাম, সবাইকে আহ্বান করতে বললাম। তুমি কি তাদেরকে ডেকেছো, তুমি কি নামাজ পড়েছো?
চম্পাঃ আম্মু! আমি ওদের সবাইকে নামাজের জন্য ডেকেছি এবং আমি নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে গেছি, চোখে ঘুম ঘুম ভাব ছিলো তাই।
রহিমাঃ জবা, শাপলা ও জিয়াদকে ডাক দাও।
চম্পাঃ ঠিক আছে আম্মু, আমি এখনই ডাকছি বলেই শাপলার রুমে চলে যায় এবং ডাক দেয়, শাপলা! ও শাপলা! ঘুম থেকে ওঠো। শাপলা উঠে না। সে জবাকে ডাক দেয়। জবা দ্রুত উঠে বলে, কী হয়েছে আপু এত সকাল সকাল ডাকাডাকি করছো কেনো?
চম্পাঃ তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? আজকে কোন দি তুই জানিস না?
জবাঃ হ্যাঁ আপু, আমি তো জানি। আজকে তোমার বিয়ের দিন। তাতে কী হয়েছে, তোমার কি চোখে ঘুম নাই?
চম্পাঃ আরে পাগলী, আমার চোখে ঘুম আছে। আম্মু নামাজের জন্য ডেকেছে। আমি উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে গেছি। আব্বু মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে আসার পর বাসায় কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে।
জবাঃ কী হয়েছে আপু, কী হয়েছে! তাড়াতাড়ি খুলে বলো।
চম্পাঃ আমরাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আব্বুর মাথা নষ্ট, আমরা নামাজ না পড়ে ঘুমাচ্ছি কেন? তুই কী নামাজ পড়েছিস?
জবাঃ হ্যাঁ আপু, তুমি ডাকার পর নামাজ পড়ে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছি। শাপলা মনে হয় নামাজ পড়েনি আর জিয়াদ তো উঠেই নি।
চম্পাঃ আরে জিয়াদের কথা বাদ দে, সে তো অনেক ছোট। তাঁর এখনো নামাজ ফরজ হয়নি। কিন্তু শাপলার বিষয়টা ব্যাতিক্রম।
আমি শাপলাকে ডাকলাম কিন্তু সে উঠলো না।
জবাঃ আপু! শাপলা কাল সারারাত আনন্দ ফূর্তি করেছে। তার শরীরটা খুব ক্লান্ত। তাই সে ঘুম থেকে উঠেনি। এ কথা আব্বুকে জানতে দিওনা, নইলে খুব বকাবকি করবে। সে তো প্রতিদিন সবার আগে ঘুম থেকে উঠে এবং আমাদেরকেও ডেকে দেয়। আজ তাকে আব্বুর বকা থেকে বাঁচিয়ে দাও।
চম্পাঃ চল্ তার ঘরে, তাকে ডেকে উঠাই।
জবাঃ চলো আপু।
চম্পা ও জবা তার ঘরে গিয়ে ডাক দেয়,
এই শাপলা! ওঠ ওঠ। আব্বু ডাকাডাকি করছে। চম্পা জবাকে বলে তুই আব্বুকে বল আমরা নামাজ পড়েছি। জবা তার আব্বুকে গিয়ে বলে, আব্ব,আব্বু! আমরা নামাজ পড়েছি।
তার আব্বু আঃ রহিম খুব আনন্দ চিত্তে বললো – আলহামদুলিল্লাহ।
জবা! তুমি শাপলা সবাই মিলে খুব দ্রুত হাতের কাজগুলো গুটিয়ে নাও। কিছুক্ষণ পরেই লোকজন আসা শুরু করবে।
জবাঃ ঠিক আছে আব্বু আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। সব আমরা দেখছি বলেই তার চম্পা আপুর কাছে চলে গেলো শাপলার ঘরে। তারা এত ডাকাডাকি করার পরেও শাপলা ঘুম থেকে ওঠেনা, শুধু উঁ উঁ করে। তারা দু’জনে দিশেহারা হয়ে জবা চম্পাকে বলে আপু! ওর গায়ে পানি ঢালো।
চম্পাঃ আমি গায়ে পানি ঢাললে সমস্যা আছে। এক কাজ কর, তুই ওর গায়ে পানি ঢাল্। আমি ট্যাকেল দেবো। চম্পার কথা শুনে জবা এক বালতি পানি নিয়ে এসে দিলো শাপলার গায়ে ঢেলে। শাপলা চিৎকার দিয়ে ওঠে, কে, কে, কে?
জবা হাসি চেক দিতে না পেরে খিলখিল করে হাসতে হাসতে বাইরে চলে যায় । জিয়াদ বাচ্চা ছেলে দৌড় দিয়ে শাপলার ঘরে এসে বলে,
আপু, আপু কী হয়েছে তোমার ? শাপলা জিয়াদকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
এই জিয়াদ! এই কাজ কে করলো? তাড়াতাড়ি বল, নইলে তোকে বালতির পানিতে চুবানি খাওয়াবো। জিয়াদ ভয়ে জানি না বলে দৌড় দিয়ে বাইরে চলে গেলো। আর শাপলা একাই বিড়বিড় করে বলে, এ কাজ কে করলো? আমি তাকে উঁচিৎ শিক্ষা দেবো। সে জবাকে ডাকে, জবা আপু, জবা আপু! এ কাজ কে করলো তাড়াতাড়ি বলো। জবা হাসে কিন্তু কিছু বলো না। কারণ, সে-ই তো তার গায়ে পানি ঢেলেছে, পানি ঢেলেই দৌড় দিয়ে বাইরে চলে এসেছে। জবা তার এই চেঁচামেচি দেখে তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে সব খুলে বলে,
শাপলা! যা হয়েছে একদম চুপে যা। নইলে আব্বু যদি জানতে পারে, তুই ফজরের নামাজ পড়িস নি, তবে কপালে শনি আছে কিন্তু। তোকে জাগ্রত করার জন্য আমরা এ কাজ করেছি। তোর গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়েছি। শাপলা রেগে একাকার। কিন্তু তার আব্বুর ভয়ে একদম চুপ! ,,,,,,,,,,,,,,,,
আজ পহিলা সেপ্টেম্বর রোজ শুক্রবার।
বর সোলায়মান এর সাথে চম্পার বিয়ে।
সকাল ১০টা। সোলায়মানের বন্ধু রিয়াদ, ফায়াদ, তামিম তিন বন্ধু মিলে তাদের বাড়িতে এসেছে।
রিয়াদঃ দোস্ত আজ কি বার, কোন দিন? বলতো।
সোলায়মানঃ আমার তো মনে নাই, তুই বল।
ফায়াদঃ মনে থাকবে কি করে? রাজকন্যার স্বপ্নে বিভোর। চোখে তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব। কোন বনে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে দোস্ত আমার? বুঝি এ জগতে আর নাই।
তামিমঃ এই তোরা থাম, আমার দোস্তকে তোরা এত জ্বালাতন করিস ক্যান? আমার দোস্ত কি মূর্খ ? ভুলে গেলে চলবে না। সে কিন্তু প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
রিয়াদঃ প্রাইমারির প্রধান শিক্ষক অর্থ কী জানিস?
তামিমঃ হ্যাঁ, জানি।
রিয়াদঃ কী বলতো?
তামিমঃ আরে বন্ধু। প্রাইমারির প্রধান শিক্ষক মানেই তো একজন গরুর ছাগলের প্রধান রাখাল। গরু ছাগলগুলোকে যেমন এই র র র, রে রে রে, রা রা রা বলতে হয় এবং কখনো কখনো পিছনে পিছনে ছুটতে হয়। যাতে করে পরের ক্ষেতে না লাগে। ঠিক তেমনি বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। কখন এর নালিশ, কখন ওর নালিশ। এ বলে স্যার! আমাকে বসতে দেয় না বেঞ্চে। ও বলে স্যার! আমাকে মেরেছে। সে বলে স্যার! আমার খাতা কলম চুরি করে নিয়েছে, ইত্যাদি। এই হলো প্রাইমারির প্রধান শিক্ষকের কাজ গরু ছাগল চরা।
রিয়াদঃ বন্ধু তুমি ঠিক বলেছো, প্রাইমারির শিক্ষকগণ আসলেই রাখালের মতই পরিশ্রম করে। ছোট ছোট বাচ্চারা অবুঝ শিশু। এরা কিছুই বুঝেনা। শুধু হৈচৈ হেচৈ করে, চেঁচামেচি করে, কান ঝালাপালা করে দেয়। এদেরকে মানুষের মত মানুষ করতে হয়। এরা কাঁচা কঞ্চি, নরম তুলতুলে কাদামাটি। এদেরকে স্নেহ মমতা ভালোবাসা দিয়ে অ আ ক খ, এ বি সি ডি, এক দুই তিন, অন টু থ্রী করে, একটা একটা করে বর্ণ তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হয়। ধীরে ধীরে কচিকচি বাচ্চা গুলো বড় হয়ে ওঠে। কিছু বুঝার ক্ষমতা অর্জন করে। এক দুই তিন করে পাঁচটি বছর অতিক্রম করে ক্লাস ফাইভে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে হাইস্কুলে পদার্পণ করে। তখন তারা অনেক কিছুই বুঝে যায়। বুঝে যায় লেখাপড়ার প্রতি গুরুত্বের কথা। বুঝে যায়, মাতাপিতা, শিক্ষক গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করার কথা। একে একে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, ভার্সিটি অতিক্রম করে। লেখাপড়ার ইতি টেনে একটা সুন্দর জীবনের সন্ধান পায়। তাদের জীবন হয় সুখী ও সমৃদ্ধশালী।
প্রাইমারি শিক্ষক মানেই মানুষ গড়ার প্রধান কারিগর, প্রধান হাতিয়ার। এঁদেরকে জানাই অন্তরের অন্তস্তল থেকে শ্রদ্ধা সম্মান ও স্যালুট। আমার দোস্তের মত ভাগ্য ক’জনের আছে? আমারও একটা স্বপ্ন ছিলো শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু আজকে হয়েছি ইঞ্জিনিয়ার। তবুও আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া – আলহামদুলিল্লাহ।
তামিমঃ এই! তুই কি তোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য এখানে এসেছিস? তোর স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগে দোস্ত সোলায়মান এর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথাটা ভাব। দোস্ত আমার চম্পার চিন্তায় অধীর হয়ে আছে।
ফায়াদঃ চম্পা আবার কে হলো?
তামিমঃ সে সোলায়মান এর হবু বৌ। তার নাম জানিস না?
রিয়াদঃ ও—— চম্পাকে চিনস না? আরে বেকুব, তোর গার্লফ্রেন্ড চম্পা।
ফায়াদঃ নাউজুবিল্লাহ! দোস্ত! তুই জানিস না। আমার জীবনে কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিলো না। কোনো মেয়ে কোনো ছেলের গার্লফ্রেন্ড হবে, এটা আমার পছন্দ না। মেয়ে মানুষের কোনো ছেলে বন্ধু থাকতে পারে না। হতে পারে সে ক্লাসমেট, হতে পারে পাড়াপ্রতিবেশি ভাই বোনের সম্পর্ক। কিন্তু গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড না। গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড মানেই দু’জনের মাঝে একটা অনৈতিক সম্পর্ক তৈরী হওয়া। সেখানে থাকে দু’জনের মাঝে কিছু গোপনীয় চাওয়া পাওয়া।
তাদের মাঝে, (বিশেষ করে ছেলেদের কথা বলি) একটা চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্খা, অভিলাষ থেকেই যায়। আর এটা থেকেই হয় তাদের যতসব খারাপ কর্মকাণ্ড। যা সমাজ ও দেশ বহির্ভূত। ইসলাম বিরোধী। ইসলাম কখনোই এমন সম্পর্ক মেনে নেয় না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এমন ঘটনা ঘটলে মেয়েদের নানান সমস্যা হয়। সমাজ তাকে অসতী বলে আখ্যায়িত করে।
এই সম্পর্ক মেয়েদেরকে অসতী করে দেয়, করে দেয় কলঙ্কিত। আর এ কলঙ্কের বোঝা সারাজীবন মাথায় বহন করতে হয়।
তাই আমার কাছে বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড শব্দ দু’টি একেবারেই অপছন্দনীয় এবং ইসলাম বিরোধী সম্পর্ক। এর পরিণামই আমার কাছে মেয়েদের কলঙ্ক ছাড়া আর কিছুই না।আমি তোদের ভাষায় বুঝে নিয়েছি। আমাদের হবু ভাবির নাম চম্পা।
রিয়াদঃ (হাসতে হাসতে) বাহ! দারুণ নীতি কথা শোনালিরে বন্ধু!
ফায়াদঃ আরে বন্ধু! এটাই বাস্তবতা ঘাঁটি কথা। এর জন্যই কলঙ্কের বোঝা নিয়ে নারীকে ঘুরতে হয় আজীবন। অনেক মেয়েকে স্বামীর ঘরে স্বামী ও শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদের কাছে খোঁটা শুনতে হয়, হয় নির্যাতনের শিকার। অনেকের আবার বিয়েও হয় না। মাথায় কলঙ্কের বোঝা নিয়ে সারাজীবন ঘুরতে হয়।
কারণ, সাধারণত বয়ফ্রেন্ডগুলো গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ফূর্তি করে, রঙ্গ লীলায় মত্ত থাকে। ছলেবলে কলাকৌশলে নিজের দৈহিক চাহিদা পূরণ করে। নানান বাহানা ও অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়ে। তখন তার গার্লফ্রেন্ডটি জীবনের সর্বস্ব হারিয়ে সমাজে কলঙ্কিত হয়ে বসে থাকে। হয় পরিবারের বোঝা, হয় সমাজের বোঝা।
বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড সম্পর্কে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কিছু উক্তি কান পেতে শোন, তাহলে আশাকরি তোদের বুঝতে আর অসুবিধা হবে না। ক্লিয়ার বুঝতে পারবি।
১। “কোনো যুবক যুবতী কখনোই কারো প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না।
কারণ, তাদের এই বন্ধুত্বের মাঝে কারো না কারো মনের চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্খা থাকবেই। যা পরবর্তী সময়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
কাজেই বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ড বয়কট করাই তাদের জন্য মঙ্গল”।
(মোঃ ইব্রাহিম হোসেন রাজশাহী)
২। শেক্সপিয়র বলেছিলেন , “একজন ছেলে কখনো একজন মেয়ের বন্ধু হতে পারে না, কারণ এখানে আবেগ আছে , দৈহিক আকাঙ্খা আছে” ।
৩। “একই কথা বলেছেন আইরিশ কবি Oscar Wilde. “নারী এবং পুরুষের মাঝে কেবলই বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকা অসম্ভব । যা থাকতে পারে তা হলো আকাঙ্খা, দুর্বলতা, ঘৃণা কিংবা ভালোবাসা”।
“বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে ঢোকা একটা ভণ্ডামী। শুধুই সুযোগের অপেক্ষা। সবশেষ পরিণতি পরকীয়া”।
৪। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন , “ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হতে পারে কিন্ত তারা অবশ্যই প্রেমে পড়বে । হয়তো খুবই অল্প সময়ের জন্য অথবা ভুল সময়ে । কিংবা খুবই দেরিতে , আর না হয় সব সময়ের জন্য । তবে প্রেমে তারা পড়বেই । শুধুই সুযোগের অপেক্ষা”।
প্রকৃতপক্ষে,ছেলে এবং মেয়েতে শুধুমাত্র বন্ধুত্বসুলভ আচরণে অবস্থান করা কখনোই সম্ভব নয়, এটা অসম্ভব ও সম্পূর্ণ ইসলাম পরিপন্থী, সুশীল সমাজ বিরোধী।
কেননা, চুম্বক আর লোহা কখনো পাশাপাশি থাকতে পারে না। চুম্বক লোহাকে আকৃষ্ট করবেই। এটাই স্বাভাবিক, অস্বাভািক এর কিছুই নয়। যদি কেউ তা মানতে না চায়, এড়িয়ে যায় ; তবে মনে করে নিতে হবে নিশ্চয়ই তার ভেতরে অসৎ উদ্দেশ্য আছে, আছে ভণ্ডামি ও ধোঁকাবাজের একটা গোপন কৌশল। আগুন ও মোমের সাথে যতই নিবিড় সম্পর্ক থাকুক না কেন, আগুনের তাপে মোম গলবেই এতে কোনো সন্দেহ নাই।
তামিমঃ এই! থাম থাম, অনেক হয়েছে।
তুই তো দেখছি বিখ্যাত মুফতি হয়ে গেছিস।
যাইহোক, সত্যি বন্ধু আজকে সোলায়মান এর বিয়ের দাওয়াত খেতে এসে আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে অনেক অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আলোচনা করলাম এবং অনেক কিছু জানতে পারলাম। এ বিষয়টি প্রত্যেক অভিভাবকদের নজরদারি করা প্রয়োজন।
ফায়াদঃ (ঘড়ি দেখে) আরে বন্ধু! গল্পে গল্পে সময় তো অনেক হয়ে গেছে, টেরই পাইনি। তাড়াতাড়ি চল্, বরযাত্রীর যাত্রার ব্যবস্থা কর। আজ শুক্রবারের দিন নামাজ কালামেরও ব্যাপার আছে।
তামিমঃ হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস বন্ধু। তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নে । আমরা কন্যা বাড়িতে গিয়ে জুম’য়ার নামাজ পড়বো ; তারপরেই বিবাহের আয়োজন করবো ইনশাআল্লাহ।
সোলায়মানঃ ফায়াদের কথা যুক্তিসঙ্গত। আমি এক্সেপ্ট করলাম। বিয়ের গাড়ি কতদূর?
রিয়াদঃ দোস্ত গাড়ি চলে এসেছে সমস্যা নাই। ঝটপট তৈরি হয়ে নে। আমরা এখনই গাড়িতে উঠবো।
সোলায়মানঃ ঠিক আছে, চল্ তাহলে। দুই গাড়িতে ডুলিরবিবি আর দুুই গাড়িতে বরযাত্রী।
তামিমঃ হ্যাঁ দোস্ত। চারটা গাড়িই ভাড়া করা হয়েছে। চল্ চল্, আর দেরি নয়। এখনই চল্।
সোলায়মান বরের সাজে সাজগোজ করে বিসমিল্লাহ বলে যাত্রা শুরু করলো। তার বন্ধুদের মধ্যে রিয়াদ একটু রসিকতা বেশিই করে। যাত্রাকালে পথিমধ্যে রিয়াদ সোলায়মানকে বলে,
দোস্ত! বিয়ে করতে তো যাচ্ছিস। বিয়ে মানে কী জানিস ?
সোলায়মানঃ বিয়ে মানে দু’টি মনের চিরস্থায়ী মিলন বন্ধন। যা কম পক্ষে তিনটি সাক্ষী সাপেক্ষে তিন কবুলে ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিক সম্পূর্ণ করতে হয়। বিয়ে মানে সুখ দুঃখের চিরসাথী, দু’জনের দু’টি আত্মা এক হওয়া। দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
রিয়াদঃ না দোস্ত না, তোর এ উত্তর হয়নি।
সোলায়মানঃ এর থেকে কি তুই আরো ভালো কিছু জানিস?
রিয়াদঃ কী বলিস! অবশ্যই জানি।
তামিমঃ তাহলে বলে ফেল ভাই, আমরা শিখি। বিশেষ করে আমার আর সোলায়মান এর এটা জানা খুবই জরুরি।
কারণ, সোলায়মান আজ বিবাহের সম্মুখীন। আর সামনে আমারও বিয়ের দিন আসছে। আমি জানতে খুবই আগ্রহী। বল্ বন্ধু বল্।
ফায়াদঃ আরে চুপ কর। রিয়াদ তো একটা ফাজিল ছেলে। কখন কী যে বলে তার কোনো ঠিক নাই।
রিয়াদঃ আরে বন্ধু তুই চুপ কর। বিয়ের প্রকৃত অর্থ জেনে রাখ, তাতে উপকার আছে।
তামিমঃ বল ভাই বল, তুই বল। ফায়াদের কথা বাদ দে।
রিয়াদঃ বিয়ের প্রকৃত অর্থ হলো, দাম্পত্য জীবনের এক নাম্বার লাইসেন্স। যে লাইসেন্স থাকিলে পথে-প্রান্তরে, রাস্তা-ঘাটে, অলিতে-গলিতে, চলিতে-ফিরিতে কোনো সমস্যা হয় না।
এই লাইসেন্স না থাকিলে রাস্তা-পথে একই সাথে দুইজনে হাত ধরিয়া অলিতে-গলিতে, চলিতে-ফিরিতে জনতার প্যাদানি খাইতে হয়। অনেক সময় জেল হাজতেও যাইতে হয়। আর কলঙ্কের কথা তো বলিলামই না।
এবার বুঝিলি দোস্ত? বিয়ে কাহাকে বলে, ইহার অর্থ কী? এ কথা শুনে গাড়িতে সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো।
তামিমঃ দোস্ত! তুই একখান জিনিস।
ফায়াদঃ আরে জিনিস না, সে একটা ভণ্ড। লুচ্চা প্রেমিক।
রিয়াদঃ দোস্ত ভুলভাল বলিস না ভাই। আমার একটা ক্যারেক্টারের ব্যাপর আছে না ?
আমি প্রেম করে বিয়ে করেছি ঠিকই। কিন্তু লুচ্চামি করিনি। বিয়ের আগে তাকে স্পর্শ পর্যন্ত করিনি। আমরা যা কথাবার্তা বলেছি, শুধুই মুখে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বসে, কলেজ বারান্দায় বসে।
তামিমঃ দোস্ত! তাহলে তো তোদের প্রেম ভালোবাসা স্বর্গীয়, পূতপবিত্র,খাঁটি নির্ভেজাল প্রেম। তোদের প্রেম ভালোবাসার প্রতি রইলো আমার স্যালুট। দোয়া করি তোদের ভালোবাসার দাম্পত্য জীবন সুখী ও দীর্ঘজীবী হোক – আমিন।
এভাবে তারা রসিকতার সহিত নানান কথাবার্তা বলতে বলতে বিয়ে বাড়ির সামনে পৌঁছালো।
বাইরে দূর থেকে শাপলা বিয়ে গাড়ি দেখেই বাড়ির ভেতর ভোঁ দৌড় দিলো,,,,,,,,,,,,,।
শাপলা বর এসেছে, বর এসেছে বলে হৈ-হুল্লোড় করে সবাইকে জানিয়ে দিলো। শাপলা দ্রুত করে ঘর থেকে একটা হাতঘড়ি জামাই সোলায়মানের হাতে পরিয়ে দিয়ে বললো,
দুলাভাই! ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। আর আমার থেকে ছোট আমার ছোটভাই জিয়াদ। আপনাকে গাড়ি থেকে কোলে করে নামানোর মত আর কেউ নাই। তাই দয়া আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে নেমে আসুন এবং সামনের সিংহাসনে বসুন আপনার বন্ধুসহ। ঐটা আমরাই গতকাল বানিয়েছি আপনাদের আপ্যায়ন করার জন্য।
সোলায়মান তার হাত ধরে গাড়ি থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসলো এবং শাপলা তাদের বানানো সিংহাসনে বসতে দিলো।
এবার শরবত খাওয়ার পালা।
সেখানে টেবিলের উপর তিন বন্ধুর জন্য একই কালারের তিনটি শরবতের গ্লাস আছে। একটিতে আছে লবণ মিশ্রিত শরবত, দ্বিতীয়টিতে আছে মরিচ মিশ্রিত শরবত এবং তৃতীয়টিতে আছে চিনির শরবত। কিন্তু শাপলা ছাড়া কেউ জানে না কোন গ্লাসে কীসের শরবত আছে ?
সোলায়মান এর বন্ধু তামিমঃ
শাপলা আপু! আমাদেরকে শরবত তুমি খাইয়ে দাও।
শাপলাঃ না না, আপনারা দু’টি গ্লাসের শরবত দুইজনে খাবেন। আর আমি দুলাভাইকে খাওয়ায় দেবো।
তবে একটা কথা, শরবত খাওয়ার পর আপনারা কেউ কোনো কথা বলতে পারবেন না৷ চারপাশে অনেক দর্শক তা দর্শন করছে।
তামিম নিজের হাতে একটা গ্লাস তুলে নিলো। মুখে চুমুক দিতেই ঝাল। কঠিন ঝাল। পেটে যতদূর গেলো জ্বলিয়ে দিলো। গ্লাসটি নিয়ে চুপচাপ, আর খায় না।
মনে বলে বাপরে বাপ, এত ঝাল! না জানি পিচ্চি মেয়েটা কতই ঝাল!
শাপলাঃ কী ব্যাপার ভাই? খেয়ে ফেলুন।
তামিমঃ আপু! তুমি এত সুন্দর শরবত বানাইতে পারো? যা একবার খেলে আর কখনো ভোলা যাবে না। সাড়ে তিন হাত মাটির তলে গেলেও না।
শাপলাঃ জি ভাই, এটা আমি আপুর কাছ থেকে শিখেছি। আপু অনেক সুন্দর করে শরবত বানাইতে পারে।
রিয়াদঃ তাই নাকি? এত সুন্দর! তাহলে আমিও একটা খাই বলে দ্বিতীয় শরবতের গ্লাসটি তুলে নিয়ে চুমুক দেওয়া মাত্রই তার মনে হলো এ যেন শরবত না। নির্ভেজাল জহর। যেন তার বুক এঁটে যাচ্ছে। লজ্জায় কিছু বলতেও পারছে না। সেও চুপচাপ খুব প্রশংসা করতে শুরু করলো।
এইবার তৃতীয় চিনির শরবতের গ্লাসটি শাপলা নিজের হাতে তার দুলাভাই সোলায়মানকে খাইয়ে দিলো।
এরপর শাপলা তাদের সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে সামনে একটা রুমাল পেতে দিলো।
তামিমঃ আপু আমাদের খুব সুন্দর করে শরবত খাওয়াইলা। এর মূল্য তো কখনো কোনদিন শোধ করতে পারবো না। এখন আবার রুমালের মতলব কী আপু ?
শাপলাঃ আপনি জানেন না? কিছু নিলে কিছু দিতে হয়। আমরা কত কষ্ট করে আপনাদের আপ্যায়ন করলাম, যা চিরদিন মনে রাখবেন। এখন তো এর প্রতিদান কিছু না হলেও কিছু দিতে হবে, তাই নয় কি?
তামিমঃ রিয়াদ! তুই যা দেবার দে। তুই ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, তোর কোনো অভাব নাই।
একই সাথে ফায়াদও সুর তুলে বললো, ঠিক বলেছিস। রিয়াদ তো ইঞ্জিনিয়ার। সত্যি তার টাকা পয়সার কোনো অভাব নাই। একটা বিল্ডিং ধরলেই লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম।
দোস্ত! তুই দিয়ে দে।
রিয়াদঃ দোস্ত! আমি জীবনে কখনো হারাম খাইনি। যা ন্যায্য সেটাই নিয়ে থাকি। অতিরিক্ত কিছুই নেই না। আর হ্যাঁ, তোদের দোয়া ও আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার কোনো কিছুর অভাব নাই। আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া – আলহামদুলিল্লাহ।
শাপলাঃ হাসতে হাসতে এই মিয়া ভাই! আপনারা কী শুরু করলেন? আমরা কী আপনাদের কাছে ভিক্ষা করতে এসেছি যে, আপনারা চাঁদা তুলে দিবেন?
আরে দুলাভাই! খাইলে তো আপনার শালিরাই খাইবে, এত কৃপণতা করেন কেন? চারদিকে কত মানুষ আপনাদের তামাশা দেখছে, দেখেছেন? আমি ছোট্ট মেয়ে মানুষ। আমাকেই লজ্জা লাগছে। আপনাদের লাজ নাই, লজ্জা লাগছে না?
রিয়াদঃ আচ্ছা শাপলা আপু! কত দিতে হবে?
শাপলাঃ আমরা ভদ্র ঘরের ভদ্র সন্তান। আপনি বিবেক অনুযায়ী যা দিবেন, তাতেই আমরা সন্তুষ্ট।
রিয়াদ তার পকেট থেকে ৫০০০৳ বের করে দিলো। শাপলা আর কোনো কথা না বলে রুমালটা ভাঁজ করে উঠিয়ে নিলো।
তামিম চল চল করে উঠতে যাবে। কিন্তু সে জানে না যে, তার পাঞ্জাবি চেয়ারের সাথে বাঁধা আছে। উঠতে যাওয়া মাত্রই পাঞ্জাবি ফড়ফড় করে ছিঁড়ে গেলো।
শাপলাঃ সরি ভাইয়া, রসিকতা করতে গিয়ে পাঞ্জাবিতে গিঁট দিয়েছিলাম চেয়ারের সাথে। খুলতে যাবো এমন সময় উঠতে গেলেন আর ছিঁড়ে গেলো। এখানে কিন্তু আমাদের কোনো দোষ নাই।
কারণ, আপনারা তো দেখেশুনে উঠবেন তাই নয় কি?
তামিমঃ আচ্ছা ঠিক আছে আপু, কোনো সমস্যা নাই। আবার নতুন হবে।
শাপলা সেখান থেকে তাদেরকে নিয়ে আলাদা স্থানে বরযাত্রীর ঘরে বসতে দিলো।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছোট্ট মেয়ে শাপলা খুব উল্লাসিত, উৎফুল্ল। আবার তার মনে একটু ভয়ের উদয় হয়। সে তার বড় আপু চম্পার কাছে যায় এবং ফিসফিস করে বলে,
আপু! আমার একদিকে যেমন আনন্দের সীমা নাই, ঠিক তেমন অপরদিকে মনের মাঝে ভয়ও লাগছে !
চম্পাঃ কেনো রে আপু, কী হয়েছে তোর ?
শাপলাঃ কী জানি আপু? জানি না। তোমাকে ভয় লাগছে না?
চম্পাঃ একটু একটু ভয় লাগা স্বাভাবিক।
শাপলাঃ বলো আপু, সেই স্বাভাবিক ভয়টা কীসের ?
চম্পাঃ সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, মা বাবা কত কষ্ট করে লালন-পালন করলো! কত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করলো। কখনো চোখের আড়াল হতে দেয়নি। কখনো ক্ষুধার জ্বালা বুঝতে দেয়নি। কখনো ধমক দিয়ে কথা বলেনি।
এখন তাদের সেই স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, মায়াজাল ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য পরের ঘরে চলে যেতে হবে। সেখানেই সারাজীবন কাটাতে হবে। জানি না তাদের সাথে নিজেকে ম্যাচ করতে পারবো কিনা? শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর,ননদ কেমন হবে, কেমন হবে তাদের আচরণ? কেমন হবে তোর দুলাভাই? এ-সব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক করেছে।
শাপলাঃ আপু এই চিন্তা তো আমারও মনের মাঝে ঘুরপাক করছে। তুমি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি কাকে আপু বলে ডাকবো? কার সাথে থাকবো, কার সাথে রাতে ঘুমাবো। ওরা তো তোমাকে সবসময় আসতে দেবে না। তুমি পরাধীন হয়ে যাবে। তোমার নিজের কোনো ক্ষমতা বল কোনো কিছুই থাকবে না। পরের ঘরে এতিমের মত পরাধীন হয়ে থাকতে হবে বলেই শাপলা আর কান্না ধরে রাখতে পারলো না। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরতে লাগলো।
চম্পাঃ তার চোখের পানি মুছিয়ে,
কাঁদিস না বোন, মেয়েদের জীবনই এমন হয়।
দ্যাখ, আম্মুর কথা ভাব। আম্মুও তো একদিন তার বাবা মা, ভাই বোন পরিবারের সবার মায়া-মমতা, স্নেহ ভালোবাসার বন্ধন ত্যাগ করে আব্বুর বাড়ি এসেছিলো। যার জন্যে আজ আমরা এ পৃথিবীর মুখ দেখতে পেয়েছি।
আর কাঁদিস না বোন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি না থাকলে কী হয়েছে? তোর মেজো আপু জবা তো আছে, তোর ছোট ভাই জিয়াদ আছে। তাছাড়া তোর সাথে আব্বু, আম্মু তো সারাক্ষণই থাকবে। কীসের চিন্তা, আর কীসের ভয়? সৃষ্টিকর্তার আদিকাল থেকেই এ নিয়ম চলে আসছে। এটাই বাস্তবতা। এই যে আজ আমি চলে যাবো। তারপর যাবে তোর মেজো আপু জবা। আর শেষে তুইও চলে যাবি। আমরা মেয়েরা চিরদিন কেউ বাপের বাড়িতে চিরস্থায়ী থাকতে পারি না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তারপর জিয়াদও তো পরের মেয়েকে নিজের ঘরে নিয়ে আসবে। সেও তো তার বাবা,মা, ভাই, বোন সকলের মায়া-মমতা ছিন্ন করে চলে আসবে আমার ছোট্ট ভাই জিয়াদের ঘরে। আর আমি তো একেবারেই চলে যাচ্ছি না। প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে আসবো ইনশাআল্লাহ।
শাপলাঃ আপু! তুমি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছো। ঐ যে পাশের বাড়ির আব্দুল করিম চাচার ময়না নামের মেয়েটির বিয়ের কতদিন হয়ে গেলো। বাবা মাকে দেখতেই আসে না। মন চাইলে বছরে দু’একবার আসলো, না চাইলে নাই। তুমিও একদিন ঐ পাশের বাড়ির ময়না আপুর মত হয়ে যাবে। এমন সময় বিয়ে বাড়িতে কাজী সাহেবের উপস্থিতি,,,,,,,
কাজী সাহেব বিয়ে বাড়িতে সালাম দিয়ে উপস্থিত হলেন। আসসালামু আলাইকুম আঃ রহিম সাহেব। আপনি কেমন আছেন?
শাপলার বাবা আব্দুর রহিমঃ
ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর রহমতে আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি, আপনি কেমন আছে কাজী সাহেব?
কাজী সহেবঃ জি আলহামদুলিল্লাহ । আমিও আপনাদের দোয়ায় ও আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
এমন সময় জুমআ’র আযান শুরু হলো। আব্দুর রহিম কাজী সাহেবকে বললেন,
কাজী সাহেবঃ জুমআ’র আযান হলো। চলুন সবাই মিলে নামাজ পড়ে আসি। নামাজ পড়ে এসেই বিবাহের কাজ সম্পূর্ণ করবো ইনশাআল্লাহ।
কাজী সাহেবঃ ঠিক আছে জনাব, চলুন আগে নামাজ পড়ে আসি।
আব্দুর রহিমঃ সবাইকে ডাক দিলেন নামাজের জন্য।
তাঁর ডাকে সবাই নামাজে গেলো। জুমআবাদ কাজী সাহেব সোলায়মান ও চম্পার বিবাহ সম্পূর্ণ করে তাদের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রার্থনা করলেন।
ইয়া আল্লাহ! তুমি এই নব দম্পতির জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে দাও। তাদেরকে তোমার দ্বীনের পথে কবুল করে নাও। স্বামী স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসার গভীর বিশ্বাস স্থাপন করে দাও। যাবতীয় বালা-মসিবত ও বিপদ আপদ থেকে হেফাজতে রেখো। তাদের মনের সমস্ত নেক আশা পূরণ করে দাও।
রব্বানা তাক্বাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আন্তাশ্শামি’উল আ’লীম। ওয়াতুবু আলাইনা ইন্নাকা আন্তাততাওয়াবুর রহিম।
সুবহানা রব্বিকা রব্বিল ঈজ্জাতি আ’ম্মা ইয়াসিফুন, ওয়া সালামুন আ’লাল মুরসালিন। ওয়াল হামদুলিল্লাহি রব্বিল আ’লামীন।
আমিন, আমিন, সুম্মা আমিন।
কালিমা ত্বয়্যিবাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মোনাজাত শেষে খাওয়া দাওয়ার পর চম্মাকে বৌ সাজিয়ে নিয়ে যাবে এমন সময় শাপলা তার দুলা ভাইয়ের হাত ধরে ছন্দে ছন্দে বলতে লাগলো,,,
ও দুলাভাই বিনয় করি তোমার প্রতি আমি,
আপুকে মোর সুখে রেখো চাই না কিছুই দামি।
আমি তোমার ছোট্ট শালি একটা শুধু দাবি,
বোনকে আমার ভালোবেসো সেই তো সুখের চাবি।
তোমার ঘরের আলোক রশ্মি ওই আকাশের চন্দ্র,
হৃদয় মাঝের মণিকোঠে ঠাঁই দিও ভাই রন্ধ্র।
পিতামাতা ভাই ও বোনের ছিন্ন করে মায়া,
যাচ্ছে চলে তোমার ঘরে দিতে প্রেমের ছায়া।
আপুকে মোর রাখলে সুখে ফুটবে মুখে হাসি,
আদর্শ এক স্বামী হবে জানবে বিশ্ববাসী।
তোমার মতই চাইবে হতে জগতের সব ছেলে,
বধূ তো নয় আসমানের চাঁদ জান্নাতের হুর পেলে।
দোয়া করি ও দুলাভাই তোমরা থেকো সুখে,
সারাজীবন ফুটুক হাসি তোমাদেরই মুখে।
কয় দুলাভাই ছোট্ট শালি হস্তে দিয়ে তালি,
তোমার যখন আসবে সময় দেবো কানের বালি।
আর করো না চিন্তা কভু থাকবে সুখের সাথে,
তোমার আপুই জীবন মরণ আমার দিবস রাতে।
এসো শালি আমার কোলে একটুখানি হাসো,
বিদায় বেলা একটু করে আলতো ভালোবাসো।
দুলাভাই এর এমন জবাব শুনে সবার মনেই খুশির জোয়ার। সবাই আনন্দ চিত্তে হেসে উঠলো। সোলায়মানের বন্ধু রিয়াদ বলে উঠলো,
সোলায়মান! তোমার জীবন ধন্য, তোমার জীবন পূর্ণ। তুমি তো বৌ পাও নাই, পেয়েছো আকাশের পূর্ণিমার এক চাঁদ। পেয়েছো জান্নাতের হুর। এখন আমরাকে করবা দূর দূর।
এবার সবাই আরও হেসে উঠলো। তামিম হাসতে হাসতে বললো,
ভাইরে! আমি সত্যি অসহায়! তোরা সবাই জোড়ায় জোড়ায়, মনের কথা ক্যামনে বুঝাই?
চল চল এবার বাড়ি যাই।
রিয়াদঃ বুঝেছি বুঝেছি। আর চিন্তা করিস না এর পরেই তোর কারাগারের পালা। তোকেও কিছু দিনের মধ্যেই বন্দি করে ফেলবো এক প্রেমের কারাগারে।
সোলায়মান তার শ্বশুর শাশুড়ির কাছে বিদায় নিয়ে, সালামের আদান-প্রদান করে নিজের বাড়ির দিকে নতুন বৌ চম্পাকে নিয়ে রওনা দিলো। সন্ধ্যা লগন ঘনিয়ে এলো। সোলায়মান বৌ নিয়ে বাড়ি পৌঁছলো।
এদিকে শাপলার মন খারাপ, তার বোন চম্মাকে ছাড়া একা একা কীভাবে থাকবে? তার মেজো বোন জবা তাকে বুঝায়।
শাপলা! তুই মন খারাপ করিস না বোন। বড় আপু নাই তো কী হয়েছে? আমি তো তোর সাথে সবসময়ই আছি। আম রাতে তোকে সাথে নিয়ে ঘুমাবো,,,,,,,।
চম্পার বিয়ের ৭ বছর পর শাপলার মেজো বোন জবারও বিয়ে হয়ে গেলো। এখন বাবা মা’র সংসারে শাপলা ও তার ছোট ভাই জিয়াদ রইলো। ফুটফুটে সুন্দর চেহারা নিয়ে বোরখা পরে প্রতিদিন কলেজ যাওয়া আসা করতে থাকে তার নিজ গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে। সেই গ্রামেরই এডভোকেট ইউসুফ নামের একটি ছেলে তাকে মনে মনে দীর্ঘদিন যাবৎ ভালোবাসে সেই ছোট্টবেলা থেকেই। কোনদিন সাহস করে তাকে কোনো কথা বলতে পারেনি। বলার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু বুকে সাহস জোটে না। কারণ, শাপলা সবসময় বোরখা হিজাব পরিহিত অবস্থায় থাকে। কোনো ছেলের সাথে কথা বলে না, কোথাও আড্ডাও দেয় না। শাপলা কিন্তু তার আচরণে কিছুটা টের পায়। কিন্তু সেও তাকে কিছুই বলে না। না জানার ভান করেই চলতে থাকে।
এভাবে দিন মাস বছর পার হতে থাকে। শাপলা খুব ব্রেনিয়ান ও মেধাবী ছাত্রী, অতি চালাক। বড় হয়ে এখন সে সমাজ সেবায় তৎপর হয়ে উঠেছে এবং সমাজের লোকজনের কাছে অতি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তার একমাত্র অভিযান যৌতুক ও বেপর্দার বিরুদ্ধে। সে নিজেও পর্দা করতো এবং পর্দানশিন নারীদেরকেও খুব ভালোবাসতো। তার ব্যবহার, আচার-আচরণে সকলেই মুগ্ধ। সকলের মুখে একটাই স্লোগান শোনা যায়। আঃ রহিম সাহেবের মেয়ে শাপলার মত কন্যা যেন বাংলার প্রত্যেক ঘরে ঘরে জন্ম নেয়।
সেই ছোট্টবেলায় তাকে পর্দাবিহীন দেখা গেছে। কিন্তু সাবালিকা হওয়ার পর থেকে তার মুখ কোনদিন কোনো পরপুরুষ দেখার সুযোগ পায়নি।
একদিন তাদের গ্রামের আঃ রহমান চাচার মেয়ে জোরিনার বিবাহের দিন বর পক্ষ থেকে যৌতুকের দাবি আসে ৫ লক্ষ টাকা নগদ দিতে হবে। মেয়ের বাবা কষ্ট করে ৪ লক্ষ টাকা মেনেজ করেছে। বাকি এক লক্ষ টাকা পরে দেবো বলায় বর পক্ষ সরাসরি জানিয়ে দেয়, সম্পূর্ণ যৌতুকের টাকা পরিশোধ না করলে এ বিবাহ বাতিল বলে ঘোষণা করা হবে। মেয়ে পক্ষ খুব অনুনয় বিনয় করে। কিন্তু নিষ্ঠুর, পাষাণ বর পক্ষ তা মানতে কখনোই রাজি নয়। শেষমেশ বর পক্ষ বরকে নিয়ে চলে যাবে বিয়ের আসর থেকে। এমতবস্থায় শাপলার কর্ণপাত হয় যে, যৌতুকের টাকা পুরো দিতে না পারায় বিবাহ বাতিল করে বর পক্ষ বরকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। শাপলা এ খবর পেয়ে দ্রুত তাদের বাড়ি পৌঁছলো। সেখানে গিয়ে দেখে শুধু কান্নার রোল। কী হবে অভাগিনী জোরিনার? মা কাঁদে, বাবা কাঁদে।
হায়রে আমার পোড়া কপাল! কত কষ্ট করে, অভাবী সংসারে মেয়ের বিয়ের জন্য ঘটিবাটি বিক্রি করে চার লক্ষ টাকা জোগাড় করলাম। আর এক লক্ষ টাকার জন্য আমার মেয়ের কপাল পুড়ে গেলো। কীভাবে সমাজে মুখ দেখবো? সমাজের লোকের মুখে হাত দেওয়া যাবে না। তারা বলবে, কপালপুড়ী, কালনাগিনী বিয়ের আসর থেকে বর পক্ষ চলে যায়।
হায় আল্লাহ! এ দৃশ্য দেখার আগে আমার মরণ কেনো হলো না ?
এমন সময় শাপলা বলে কী হয়েছে রহমান চাচা? আপনি কেনো কাঁদেন? আপনার কিছুই হবে না, কিছুই হবে না আমাদের ছোট বোন জোরিনার।
বর পক্ষ কোথায় ? লোকজন সবাই মিলে তাদেরকে আটকানোর ব্যবস্থা করুন। বর বিয়ে করবে না, বরের বাবার বাবা বিয়ে করবে যৌতুকবিহীন।
শাপলার কথায় এলাকার লোকজনের মনে সাহস গজায় এবং তারা এলাকাবাসী বর পক্ষকে বরসহ ঘেরাও করে আবার বিয়ের আসরে নিয়ে আসে। শাপলা তাদের জিজ্ঞেস করে, আপনাদের সমস্যা কী? আপনার কেনো এই অসহায় গরিব বাবার একমাত্র কন্যার বিবাহ বাতিল করে মান-সম্মান ধূলিসাৎ করে দিয়ে চলে যাচ্ছেন?
ছেলের বাবা বলে,
যাবো না তো কী করবো? মেয়েকে ও মেয়ের বাবাকে কি ধূপ চন্দন দেবো? বিয়ের আগে তো ঠিকই বলেছিলো, বিয়ের দিনই ৫ লক্ষ টাকা নগদ যৌতুকই পরিশোধ করবে। এখন বলে ৪ লক্ষ টাকা জোগাড় করেছে এক লক্ষ টাকা পরে দেবে। আমরা জানি বাকির নাম ফাঁকি। আমরা পুরো টাকা যৌতুক পরিশোধ না করলে ছেলের বিয়ে দেবো না।
শাপলাঃ বাহ! চমৎকার বাণী শোনালেন। আপনার কি জানা নাই, যৌতুক নেওয়া হারাম এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এর জন্য জেল জরিমানা দুটোই অবধারিত।
ছেলের বাবাঃ এখন এসব নিয়ম কোন দেশে, কোন সমাজে প্রচলন আছে? রাজা বাদশার ছেলেমেয়ের বিয়েতেও যৌতুক প্রথা লেনদেন হয়। আর আমরা করলে দোষ কোথায় ?
শাপলাঃ মনে করেন রাজা বাদশারা মানুষের ত্যাগকৃত মলমূত্র খায়। তাহলে কি আপনিও তাই খাবেন? আপনার কি রুচি বলতে কিছুই নাই?
আপনি তো মুসলিম ঘরের মুসলিম সন্তান।
যৌতুক একটি বিধর্মী প্রথা। আর এ প্রথা অনুসরণ করা মুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণ হারাম। আর হারাম অর্থ হলো সেই অর্থ, যে অর্থের বিনিময়ে কোনো খাদ্যদ্রব্য কেনা সেটাও হারাম। আর এই হারাম খাদ্য খেয়ে শরীরে যে রক্ত মাংস হয়, সেটাও হারাম। আর সেই হারাম রক্ত মাংসের দেহ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মিলনের ফলে যে সন্তান ভূমিষ্ট হয়, সেটাও হারাম মানে অবৈধ সন্তান । আর এই হারাম রক্ত মাংসের দেহ কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তার স্থান হবে জাহান্নাম! (তবে এখানে এই অবৈধ সন্তান হবে নিষ্পাপ।
কারণ, এই অবৈধ সন্তানের কোনো দোষ নাই।)
আর এর কর্মফল ভোগ করবে তার পিতামাতা ও অভিভাবক। আর সেই পিতামাতার অভিভাবক আপনি নিজেই।
যৌতুক তো তারই একটি অংশ। এখন আপনিই ভাবুন, আপনার ছেলের বিয়েতে যৌতুক নিবেন, কি নিবেন না?
চাচা জান! একটি কথা সবসময় মনে রাখবেন,
আমাদের জিন্দেগী ষাট – পঁয়ষট্টি বছরের। আর এর থেকে খুব বেশি হলে ১০০ বছরের। এর থেকে আর বেশি নয়। অতীতের দিকে তাকিয়ে দেখুন কত শত বছর চলে গেছে। শত সহস্র বছরের একটি মানুষও বেঁচে নেই। একদিন আমরা কেহই থাকবো না। থাকবে আমাদের আমল ও কৃতকর্মের ফলাফল। আর এই ফলাফল এর উপর ভিত্তি করেই জান্নাত ও জাহান্নাম।
ছেলের বাবাঃ থাক, থাক হয়েছে মা। তুমি আমার কন্যার মত। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছো। আমার মনের কালিমা দূর করে দিয়েছো। আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ মা, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমিও আজ থেকে যৌতুক প্রথা বাতিল করলাম এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলাম।
কই আঃ রহমান বিয়াই সাহেব? আপনি কোথায়? আমার কাছে আসুন। আমার এই আচরণের জন্য আমি অনুতপ্ত ও আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমাকে মাফ করবেন। আপনার এক টাকাও যৌতুক লাগবে না। আমি যৌতুকবিহীন আপনার মেয়ে মা জোরিনাকে পুত্রবধূর স্বীকৃতি দিয়েই আমার ঘরে নিয়ে যাবো।
এবার জোরিনার বাবা আঃ রহমান এর অশ্রুসিক্ত মলিন বদনে মিষ্টি মধুর মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো – আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তোমার কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া।
ইয়া আল্লাহ! আমার মা-মণি শাপলাকে তুমি দীর্ঘজীবী করো। তার মনের সমস্ত নেক আশা পূরণ করো। তাকে নেক হায়াত দান করো। পৃথিবীর বিপদ-আপদ থেকে তোমার রহমতের দ্বারা রক্ষা করো। তাদের এমন দৃশ্য দেখে শাপলার মুখেও মৃদু হাসি ফুটে উঠলো এবং সবাইকে সালাম দিয়ে উক্ত স্থান প্রস্থান করলো।
বিয়ে বাড়ি থেকে শাপলা চলে আসছে তার সুন্দর গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে নিজের বাড়ির দিকে। পথিমধ্যেই শুনতে পায় কোনো এক নারীর কান্না। সে বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে কাঁদছে, আমাকে আর মেরো না। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
ইয়া আল্লাহ! তুমি আমাকে রক্ষা করো!
শাপলা মনে মনে ভাবে এ আবার কার কী হলো?
নিশ্চয়ই আঃ কুদ্দুস ভাই তার বৌয়ের উপর নির্যাতন করছে বলেই তাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। গিয়ে দেখে সত্যি সে তার স্ত্রী জায়েদাকে শারীরিক নির্যাতন করছে। খুব মারধর করছে। মেয়েটির কোনো কথাই সে শুনছে না। চারপাশে অনেক লোকজনও জমায়েত হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ কিছু বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার তামাশা দেখছে।
শাপলা সেখানে গিয়ে লোকজনের উদ্দেশ্যে বলে,
এই যে শুনুন, আপনারা এতগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছেন না। একটি মেয়েকে নির্মমভাবে আঘাত করছে, আর আপনারা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন! আপনাদের মুখে তালা লেগে গেছে। আপনারা যেন বোবা হয়ে গেছেন। কেউ কিছু বলছেন না। আজ যদি আপনাদের কারো বোনকে তার স্বামী এভাবে প্রহার করতো, তাহলে কি এভাবেই চুপ থাকতেন? মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতেন? জবাব দেন।
শাপলার এমন প্রশ্নের কেউ কোনো উত্তর দেয় না।
শাপলা আঃ কুদ্দুসকে উদ্দেশ্য করে বলে,
এই কুদ্দুস ভাই! দাঁড়ান, ভাবিরে আর মাইরেন না। কী সমস্যা আমার কাছে বলুন ? কী হয়েছে ভাবির, তাকে এত মারধর করছেন কেন? সে কী অপরাধ করেছে? তা আমাকে বলুন। আমি এর সমাধান করে দেবো ইনশাআল্লাহ।
আঃ কুদ্দুসঃ শাপলা! তোকে আর কী বলবো? আমি আজ কয়েকদিন যাবৎ তাকে বলতেছি, আমার দশ হাজার টাকার খুব প্রয়োজন। তুমি তোমার মা বাবার কাছ থেকে যেভাবেই হোক দশ হাজার টাকা মেনেজ করে নিয়ে এসো। সে এর মধ্যে দুই দুই বার তারা বাবার বাড়িও গিয়েছে। কিন্তু কোনো টাকা পয়সা নিয়ে আসেনি।
কেন নিয়ে আসেনি ? সে তার কোনো জবাবও দেয় না। তাই তাকে মারতে উদ্যত হয়েছি। আমার টাকা লাগবে টাকা।
শাপলাঃ কুদ্দুস ভাই! হয়তো তার বাবা মা অর্থের সংকটে আছে, তাই দিতে পারে নাই।
আর সে লজ্জায় ভাবি আপনাকে কিছু বলতে পারে নাই। এটা আপনার বুঝে নেওয়া উচিৎ ছিলো। আর সেই জন্যই কি আপনি ভাবিকে এইভাবে জনসম্মুখে আঘাত করবেন? মেয়েদের গায়ে আঘাত করা মানে নারী নির্যাতন। আর নারী নির্যাতন মানেই গুরুতর অপরাধ। এ অপরাধে সশ্রম কারাদণ্ড এমনকি ফাঁসিও হতে পারে। আপনার কি এ কথা জানা আছে?
তাছাড়া একটা মেয়ের বিয়ের পর তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব তার স্বামীর উপর অর্পিত হয়। পিতামাতার উপর যেমন অর্পিত হয় তার সন্তানদের দায়-দায়িত্ব , লালন-পালন করার ভার। তাদের কীভাবে লালন-পালন করবে? চুরি করে করবে, নাকি ডাকাতি করে করবে? এটা নিতান্তই পিতামাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাদের লালন-পালন করার জন্য পিতামাতা যদি বে-হালাল অর্থ উপার্জন করে, তবে সেই হারাম অর্থের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে সন্তানদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। এর জবাব দেবে তার অভিভাবক বা পিতামাতা।
ঠিক তেমনই বিয়ের পর স্বামীর উপর স্ত্রীর সকল দায়-দায়িত্ব, ভরণপোষণের ভার সারাজীবনের জন্য অর্পিত হয়। আপনি স্বামী, কীভাবে করবেন? তা আপনার স্ত্রীর দেখার বিষয় নয়। আর তাকে তার পিতামাতার বাড়ি থেকে জুলুম করে অর্থ আনার চাপ দেওয়া মানেই যৌতুকের চাপ দেওয়া।
আর এ যৌতুক সামাজিক ব্যাধি, মারাত্মক অপরাধ! এতে সশ্রম কারাদণ্ড ও জেল জরিমানা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আপনি একসঙ্গে দুই দু’টি অপরাধ করেছেন। এর জন্য আপনার দ্বিগুণ সাজা হওয়ায় বাঞ্ছনীয়।
আর আপনারা পুরুষেরা এত লোভী কেনো? মেয়ের বাবা মা’য়ের দিকে এতিমের মত তাকিয়ে থাকেন কেনো?
আপনাদের কি আল্লাহ তায়ালা মিসকিন বানিয়েছেন মেয়ের বাবা মা’য়ের বাড়ির ঘোলাটে পানি খাওয়ার জন্য?
আরে ভাই, আপনাদের তো মেয়েদের বাবা মা’য়ের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা প্রয়োজন। তারা তাদের কলিজা ছেঁড়া ধন, আদরের কন্যাকে সেই ছোটবেলা থেকে, কত কষ্ট সাধন করে, কত টাকা পয়সা খরচ করে জ্ঞান বুদ্ধি দান করে, মানুষের মত মানুষ করে, সকল মায়া-মমতা, ভালোবাসা, স্নেহের বাঁধন বিসর্জন দিয়ে চিরদিনের জন্য আপনাদের হাতে তুলে দেন।
সেই বাবা মা’য়ের এই ঋণ কি কখনো শোধ করার মত? একটু বিবেক বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে দেখুন। বুঝতে পারবেন, আপনারা কতটা অকৃতজ্ঞ!
আর অকৃতজ্ঞ নাফরমান ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ তায়ালা কখনোই ভালোবাসেন না।
আর আল্লাহ যাকে ভালো না বাসেন, তার উপর রবের লানত বর্ষিত হয়।
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর সম্পর্ক। এর চাইতে আপন সম্পর্ক পৃথিবীতে আর কারো সাথে কখনো হতে পারে না, হয় না।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন,
‘তুমি যখন খাবে, তাকেও (স্ত্রীকেও) খাওয়াবে, তুমি যখন পরিধান করবে, তাকেও (স্ত্রীকেও) পরাবে। তার (স্ত্রীর) চেহারায় কখনো প্রহার করবে না। তার (স্ত্রীর) সাথে অসদাচরণ করবে না।’ (আবু দাউদ-২১৪২, মুসনাদে আহমাদ-১৮৫০১)
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন-‘তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের পোশাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোশাকস্বরূপ।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)
আঃ কুদ্দুস ভাই! পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আপনি তো আপনার নিজের গায়ের পোশাক নিজেই ছিঁড়ে ফেলছেন।
আপনি কি পোশাকহীন অবস্থায় কোথাও যেতে পারবেন? ঘরের বাইরে গেলেও তো আপনার পোশাকের প্রয়োজন। মহান আল্লাহ তায়ালা পুরুষদের গতর ঢাকাও ফরজ করে দিয়েছেন। আপনি পুরুষ হলেও তো অনাবৃত শরীরে, পোশাকবিহীন অবস্থায় লোক সমাজে চলাফেরা করতে পারবেন না। পোশাক ছাড়া যারা চলে, তারাকে নগ্ন বলে।
আর নগ্ন অবস্থায় চলাফেরা করে একমাত্র চতুষ্পদ জন্তু ছাগল, গরু, কুত্তা বিড়াল।
এখন আপনিই বলেন, বিনা অপরাধে এমন নির্মমভাবে প্রহার করা কি আপনার উচিৎ হয়েছে?
আঃ কুদ্দুসঃ শাপলা বোন আমার। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। আমার ভুল হয়েছে। আমি মারাত্মক ভুল করেছি। আমি অন্ধকার জগতে ছিলাম। তুই আমাকে অন্ধকার জগত থেকে টেনে এনে আলোর দিশা দিয়েছিস। আমি তোর কাছে কৃতজ্ঞ।
শাপলাঃ ভাইজান! আমি আপনাকে ক্ষমা করার কেউ না। ক্ষমা যদি চাইতেই হয়। আপনার স্ত্রী জায়েদা, আমার ভাবির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন। আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিবেন।
শাপলার কথায় আঃ কুদ্দুস তার স্ত্রীকে বলে,
ওগো জায়েদা! আমি অনেক ভুল করেছি। বিনাকারণে পাষাণের মত তোমার গায়ে হাত তুলে অনেক কষ্ট দিয়েছি। বড় অপরাধ করেছি, বড় অন্যায় করেছি। আমি অপরাধী, মহাপাপী! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি যদি ক্ষমা না করো। আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করবেন না।
জায়েদাঃ তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।
তুমি কোনো অপরাধ করোনি। আমিই অপরাধী ছিলাম। গরিব বাবা মা’য়ের কাছে তোমার দাবিকৃত টাকা আনতে পারিনি। ব্যর্থ হয়েছি। তাই তার সাজা পেয়েছি। তুমিই আমাকে ক্ষমা করে দাও।
শাপলাঃ দেখেন কুদ্দুস ভাই দেখেন, নারীর মন। আপনার দেওয়া এত অত্যাচার, আঘাত পেয়েও নিজেকে অপরাধী ভেবে অনুতপ্ত।
একেই বলে নারী।
আঃ কুদ্দুস হাও মাও করে কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রী জায়েদাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
জায়েদা! আমাকে তুমি মাফ করো। আমি আর এমন ভুল কখনো কোনোদিন করবো।
সবসময় তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করবো। আমি যা খাবো, তোমাকেও খাওয়াবো। আমি যা পরবো, তোমাকেও পরাবো।
আজ থেকে ওয়াদা করলাম,
একটা যদি বাদামের দানা পাই, একটা যদি বুটের দানা পাই ; সেটাই দুইজনে ভাগাভাগি করে খাবো ইনশাআল্লাহ।
শাপলাঃ আব্দুল কুদ্দুস ভাই!
জীবনে যা ভুল করার করেছেন। আর কখনো কোনোদিন ভুল করেও এমন ভুল করবেন না। আপনার প্রতি এ আমার অনুরোধ রইলো।
জায়েদা ভাবি! আপনিও ভাইয়া যেটা বলবে, তা মনপ্রাণ দিয়ে শুনবেন। ভাইয়ার মনে কখনো কষ্ট দেবেন না৷ কষ্ট পায় এমন কোনো কথা বলবেন না। স্বামী স্ত্রীর মধুর সম্পর্ককে কখনো কলুষিত করবেন না।
একটা কথা সবসময় মনে রেখো ভাবি।
আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদিসঃ
একদা এক নারী সাহাবি রাসূল (সঃ) এর কাছে এলেন নিজের কোনো প্রয়োজনে। যাওয়ার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি স্বামী আছে? তিনি বললেন, জী, আছে। নবীজী বললেন, তার সাথে তোমার আচরণ কেমন? সে বলল, আমি যথাসাধ্য তার সাথে ভালো আচরণ করার চেষ্টা করি। তখন নবীজী বললেন, হ্যাঁ, তার সাথে তোমার আচরণের বিষয়ে সজাগ থেকো।
কারণ, সে তোমার জান্নাত বা তোমার জাহান্নাম। (মুআত্তা মালেক, হাদীস ৯৫২; মুসনাদে আহমাদ, ৪/৩৪১ হাদীস ১৯০০৩; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২৭৬৯; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৪৭০৬)
আর এ কথার উপর ভিত্তি করেই বলা হয়,
স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর জান্নাত বা বেহেশত।
আপনারা সবাই ভালো থাকবেন বলে শাপলা সেখান থেকে বিদায় নিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
দুই পরিবারের মীমাংসা করতে করতে সন্ধা লগন ঘনিয়ে এলো। গোধূলির ক্ষণ। পথে যেতে যেতে পেছন থেকে হঠাৎ করেই এডভোকেট ইউসুফ এর নজর পড়ে তার দিকে। সে মনে মনে ভাবে উনাকে তো শাপলার মত লাগে। সে একটু জোরে জোরে হেঁটে এসে তার সাথ ধরে বললো, এক্সকিউজ মি ম্যাডাম!
শাপলাঃ জি বলেন,
ইউসুফঃ আপনি শাপলা না?
শাপলাঃ কোন শাপলা?
ইউসুফঃ আঃ রহিম চাচার মেয়ে শাপলা।
শাপলাঃ জি আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন।
ইউসুফঃ আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
শাপলা চিনেও না চিনার ভান করে বললো,
না তো জনাব। আমি তো আপনাকে চিনতে পারিনি। আপনার বাসা কোথায়, কী নাম আপনার, পরিচয় দিবেন?
তাড়াতাড়ি বলেন। সন্ধ্যা হয়ে গেলো দুই পরিবারের মীমাংসা করতে করতে। বাড়িতে বাবা মা আবার চিন্তা করবেন। সারাদিন কোথায় ছিলো, এত দেরি হচ্ছে কেনো বাড়ি ফিরতে?
ইউসুফঃ জি ম্যাডাম, বাবা মা অবশ্যই চিন্তা করবেন। জামানা ভালো না। তারপরও আপনি মেয়ে মানুষ। চিন্তা করাটা স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক এর কিছুই না।
আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। আজকে আমার পরিচয়টা দেই, পরে একদিন কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।
শাপলাঃ আচ্ছা ঠিক আছে, বলেন আপনার পরিচয়, তাড়াতাড়ি বলেন। এলাকার মানুষ দেখে আবার নানান কথা বলতে পারে।
ইউসুফঃ শাপলা! আপনি আমাকে চিনতে পারলেন না? আমার বাবার নাম মোঃ ইয়াকুব আলী, আমার নাম মোঃ ইউসুফ আলী। সেই ছোটবেলায় একসাথে কত খেলাধুলা করেছি। কত ফাইজলামি করেছি। কত কানমলামলি করেছি। একদিন আমরা খেলতে খেলতে কানমলা দিয়ে আমার কানকে লাল করে দিয়েছিলেন। সেদিন আমার খুব রাগ হয়েছিলো। কিন্তু রাগটাকে সামাল নিয়ে ছিলাম।
কারণ, আমি আপনার সাথে খেলায় হেরে গিয়েছিলাম। কিছু দিন পরে আমার বাবা আমাকে লেখাপড়া করার জন্য বিদেশে পাঠায় । আর আমি সেখানেই লেখাপড়া শেষ করে উকালতি পাশ করে দেশে ফিরেছি। বিদেশে থাকাকালীন অবস্থায় আপনার কথা বারবার মনে পড়েছে। কিন্তু যোগাযোগ করার কোনো পথ ছিলো না।
তাই যোগাযোগ করতে পারিনি।
শাপলা তার ছোটবেলার কানমলার গল্প শুনে মনে মনে হেসে বললো,
থাক জনাব থাক, আর বলতে হবে না।
আমি এখন বাসায় যাই, আমার তাড়া আছে।
ইউসুফঃ ঠিক আছে। আপনি বাসায় যান।
পরে অন্য একদিন কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।
তাদের এ কথোপকথন পাশের গ্রামের দুষ্টু ছেলে জাবেদ, জালাল ও কামাল দেখে ফেলে।
তারা মনে মনে বদ বুদ্ধি আঁটে। তারা বলাবলি করে।
শাপলা! তুমি অনেক জ্ঞান দাও মানুষকে।
তুমি খুব পরহেজগার মহিলা। তোমার নাগাল কেউ পায় না। দাঁড়াও, এবার দেখাবো মজা।
কত ধানে কত চাল? এবার বুঝবা।
এবার তোমার মাতব্বরি ছুটাবো।
জাবেদ ও জালাল কামালকে বলে,
দোস্ত এবার কিছু একটা করতে হবে। এবার শাপলার বিরুদ্ধে কিছু একটা করার সুযোগ এসেছে। এ সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবে না।
কামালঃ দোস্ত! তোরা ঠিকই বলেছিস।
এবার তাকে ঘায়েল করার সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
চল্ আজকে ফিরে যায়, আগামী দিন দেখবো।
সন্ধ্যার লগন। শাপলা দ্রুত বাড়ি ফিরলো।
দরজাায় নাড়া দিতেই তার মা রহিমা বেগম দরজা খুললো।
শাপলা ভেতরে প্রবেশ করলে তার বাবা আঃ রহিম বলেন,
মা শাপলা! আজ সারাদিন কোথায় ছিলে?
তুমি তো কখনো এত দেরি করে বাড়িতে ফিরো না। আজ এত দেরি হলো কেনো?
দুপুরে কী খেয়েছো? তোমার জন্য আমরা এখন পর্যন্ত দুপুরের খাবার খাইনি।
শাপলাঃ কী বলেন বাবা!
আমার জন্য আপনারা এখনো দুপুরের খাবার খাননি! আমি কি আগের মত এখনো সেই ছোট্ট খুকিই আছি?
আমার একটু কাজে দেরি হয়ে গেছে বাবা।
আমাকে মাফ করবেন।
মা এসো আমরা একসাথে খাবার খেয়ে নিই।
শাপলার আম্মা রহিমা বেগমঃ
শাপলা! তার আগে বল, এমন কী কাজ করছিলি? কোন কাজে ব্যস্ত ছিলি যে,
সারাটা দিন শেষ করে আসলি? আর তোর চিন্তায় আমরা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে ব্যতি-ব্যস্ত ছিলাম৷
শাপলাঃ মা! আর বলো না।
আমি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরবো ঠিক সেই মুহুর্ত শুনতে পাই যে, ৫ লাখ টাকা যৌতুক পরিশোধ করতে না পারার কারণে জোরিনার বিয়ে বাতিল করে বরযাত্রীরা বরকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি সেখানে গিয়ে আমার যুক্তি তর্কের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা যৌতুক বাতিল করে তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে বাড়ি ফিরছিলাম। পথিমধ্যে জায়েদা ভাবির কান্না শুনতে পাই। আমি সেখানেও ছুটে যাই। গিয়ে দেখি আঃ কুদ্দুস ভাইও ভাবিকে যৌতুক পণের দাবিতে খুব মারধর করছে জনসম্মুখে, সবার সামনে। আমি তাদেরও মীমাংসা করে দিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেলো। আর এই বিলম্বের কারণে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমাকে মাফ করো মা। আর কখনো এমন বিলম্ব না করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
এ কথা শুনে শাপলার বাবা আঃ রহিম খুব আনন্দ চিত্তে তার স্ত্রী রহিমাকে বলেন,
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এক শ্রেষ্ঠ নিয়ামত দান করেছেন। আর সেই নিয়ামত হচ্ছে আমাদের শাপলা মা-মণি।
ইয়া আল্লাহ! আপনি তাকে দীর্ঘায়ু দান করুন – আমিন।
শাপলার মা রহিমাঃ আল্লাহুম্মা আমিন ইয়া রাব্বুল আলামিন বলে আঃ রহিম তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
আর এ জন্যই শাপলাকে নিয়ে আমার অনেক ভয় হয়, কেনো জানো?
কেননা, এ জগতে ভালো মানুষের শত্রুর অভাব নাই।
শাপলাঃ মা! তুমি এ সব কী আজেবাজে চিন্তা করো। আল্লাহর রহমতে আর তোমাদের দোয়ায় আমার কিছুই হবে না।
তোমাদের দোয়া আমার সাথে আছে না?
তোমরা এ সব নিয়ে কোনো চিন্তা করো না।
আমি কোনোদিন মানুষের উপকার ছাড়া কারো কোনো অপকার বা ক্ষতি করিনি। আমারও কেউ ক্ষতি করবে না বলেই আমি বিশ্বাসী।
মা! তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, বলবে আমায়?
রহিমাঃ কী বলবি বল মা ?
শাপলাঃ ওই যে ইয়াকুব চাচার ছেলে ইউসুফ আছিলো না?
রহিমাঃ হ্যাঁ, আছে তো।
কেনো? তার কী হয়েছে?
শাপলাঃ না, মানে কিছু হয়নি। এমনি জিজ্ঞেস করলাম। আমরা ছোটবেলায় একসাথে কত খেলেছি তো, তাই আর কি?
আঃ রহিমঃ মা-মণি! তোমাকে একটা কথা বলি মনোযোগ সহকারে শোনো।
আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক।
আর তারা অনেক বড়লোক। তাদের সাথে আমাদের কোনো বন্ধুত্ব হয় না, ইচ্ছে থাকলেও হয় না। যদিও তার বাবা অনেক ভালো মানুষ, ছেলেটিও অনেক ভালো।
শাপলাঃ না বাবা, মাকে এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
আঃরহিমঃ তার সাথে কী তোমার দেখা হয়েছিলো?
রহিমাঃ এই! তুমি মেয়েকে কী জিজ্ঞেস করো? বাদ দাও তো ঐ সব প্রসঙ্গ।
এদিকে ইউসুফ রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে খুব চিন্তা করে।
মনে মনে ভাবে, শাপলাকে আমার মনের কথাটা কেমন করে বলবো? শাপলা কি আমার কথার সারমর্ম বুঝেছে? কিন্তু সে আমাকে চিনতে পারলো না কেনো, আমার পরিচয় দেওয়ার পরেও! নাকি সে না চিনার ভান করলো? আমি তো কিছুই বুঝলাম না। তাদের বাড়ি আর আমাদের বাড়িও তো বেশি দূরে নয়, খুব কাছাকাছি। সবাই জানলো আমি বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এসেছি। আর সে-ই জানে না? এ কেমন কথা!
তাকে নিয়ে যে আমার মনের গহীনে জন্মানো দীর্ঘদিনের অভিলাষ, এ অভিলাষের কথা আমি তাকে কীভাবে জানাই? তার চোখে ঘুম নাই।
একবার বিছানায় শুতে যায়, আর একবার বিছানা থেকে উঠে বসে। আবার সে বারান্দায় গিয়ে একাকী তার কথা ভাবে।
আবার কখনো টেবিলে বসে খাতা কলম নিয়ে শুধু তার কথা-ই ভাবে। ভাবতে ভাবতে রাত জেগে জেগে লিখতে শুরু করলো,
“অভিলাষী মন”
শাপলা তোমায় ভালোবাসি বলবো কেমন করে?
দীর্ঘদিনের এই অভিলাষ রইছি মনে ধরে।
ঘর বাঁধিবো তোমার সনে স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া,
দিবানিশি প্রার্থনাতে রব সমীপে দোয়া।
আল্লাহ তুমি দাও মিলিয়ে শাপলা নামের প্রিয়া,
ষোলো বছর অপেক্ষাতে আমার অবুঝ হিয়া।
সব জীবনের চাওয়া পাওয়ার স্বপ্ন থাকে মনে,
মাওলা তুমি দাও বেঁধে মন জোড়া প্রিয়ার সনে।
এই ভেবে আজ দিন গেলো মোর, মাস বছরও গেলো,
অবশেষে হঠাৎ এ মন তোমার দেখা পেলো।
ডাকলাম আমি শুনলে কথা চিনলে না হায় মোরে!
একলা জেগে নিশি কাটে মাথা আমার ঘোরে।
দেশ বিদেশে ঘুরছি কত পাইনি কারো দেখা,
স্বপ্ন দেখে বুঝে নিও তুমি বিনে একা।
তুমি ছাড়া ভাল্লাগে না প্রেম কি বলে একে?
ডাকলে প্রিয়া দিও সাড়া যেও নাকো বেঁকে।
রানির হালে সাজিয়ে রেখে রাখবো ধরে বুকে,
অভিলাষের প্রেমের জ্বরে মরছি ধুঁকে ধুঁকে।
আর থেকো না অভিমানী, আর থেকো না দূরে,
কোমল ঠোঁটের হাসি দিয়ে ডাকো সুরে সুরে।
চাই না আমি এই জীবনে তোমায় ছাড়া কিছু,
দোষ দিও না ঘুরি যদি তোমার পিছু পিছু।
তুমি আমার দুই নয়নে আঁধার ঘরের আলো,
জীবন থেকেও প্রিয়া আমি তোমায় বাসি ভালো।
এভাবে শাপলাকে নিয়ে কবিতা রচনা করতে করতে ফজরের আযান দিলো। ইউসুফ আর দেরি না করে ওজু করে নামাজের জন্য মসজিদ চলে গেলো।
অপরদিকে শাপলারও ইউসুফকে স্বপ্ন দেখে
দেখে হঠাৎ জেগে উঠলো। শাপলার কানেও ভেসে আসলো ফজরের আযানের সুর।
বিছানা থেকে উঠে শাপলা ভাবতে লাগলো। আমি এ কী স্বপ্ন দেখলাম! ইউসুফ আমার জন্য পাগল। তারা অনেক বড়লোক, আর আমরা অনেক গরিব। এটা কখনো সম্ভব নয়।
ইয়া রাব্বুল আলামিন! তুমি এমন কোনো কাজ আমার দ্বারা সম্পাদন করো না, যাতে আমার, আমাদের মান-সম্মানের কোনো হানি হয়। মনে মনে এ প্রার্থনা করতে করতে শাপলাও ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিলো এবং ফজরের নামাজ আদায় করলো।
সকাল হলো।
ইউসুফ ফজরের নামাজ পড়ে শাপলাদের বাড়ির দিকে আস্তে আস্তে রওনা দিলো এবং তাদের বাড়ির নিকটে পৌঁছালো।
ইউসুফ তাদের বাড়ির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। জানালা দিয়ে শাপলা তাকে দেখে বলে,
হায় আল্লাহ! ইউসুফ তো দেখি আমাদের বাড়ি বরাবর চলে এসেছে।
ইয়া আল্লাহ! সে যেন আমাদের বাড়িতে না আসে। নইলে বাবা আমাকে সন্দেহ করবে।
ভাববে হয়তো তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে। উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে বসলে আমি উত্তর দিতে পারবো না। আল্লাহ তুমি মান-সম্মানের মালিক। মান-সম্মান বাঁচাও।
ইউসুফও তাকে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে ফেলেছে। তার চেহেরা সেই ছোট্টবেলায় দেখেছে। আজ তাকে দেখে আরও অবাক!
যেন চাঁদ পরীরাও তার কাছে হার মেনে যাবে। এ যে আল্লাহ নিজের হাতে অতি যত্নসহকারে সৃষ্টি করেছেন।
ছন্দে ছন্দে বলতে থাকে ইউসুফ,
কী অপরূপ সৃষ্টি!
পড়ে না হায় দৃষ্টি,
সুরত ভারি মিষ্টি
মনেরই প্রেম কৃষ্টি।
সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ
জপ করে মন শাপলা শাপলা।
এমন সময় শাপলার বাবা দরজার সামনে দাঁড়ানো ইউসুফকে পেছন থেকে বললো,
বাবা তুমি কে? এখানে এভাবে সকাল বেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে কী দেখছো বাবা ?
ইউসুফ শাপলার বাবাকে দেখে সালাম দেয়,
আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল!
শাপলার বাবা আঃ রহিমঃ
ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু জাযাকাল্লাহ খাইরান হে প্রিয় বৎস!
বাবা তুমি কেমন আছো? তোমাকে তো চেনা চেনা লাগছে। কোথায় তোমার বাড়ি, কোথায় তোমার ঘর ?
ইউসুফঃ জি আঙ্কেল, আমি ইউসুফ।
ইয়াকুব আলীর ছেলে ইউসুফ। দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিলাম। সেখান থেকে উকালতি পাশ করে কিছুদিন হলো দেশে ফিরে এসেছি আঙ্কেল।
ফজরের নামাজ পড়ে ভাবলাম একটু এলাকাটা ঘুরে দেখি। তাই ঘুরতে ঘুরতে আপনাদের বাড়ির সামনে চলে এসেছি।
শাপলা ইউসুফ ও তার বাবার কথোপকথনের দৃশ্য দেখে বলে,
খাইছেরে খাইছে, আজ বাবার মাথা খাইছে।
কাল মায়ের মাথা খাবে। পরশু আমার মাথা,,, তারপর বিয়ের কথা !
কি বলতে কি যে বলবে? আল্লাহই জানেন।
ইস! জঞ্জালটা যাচ্ছে না কেনো? কখন যাবে? কখন যাবে বলে সে দোয়া পাঠ করে শয়তান তাড়ানোর।
লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিউল আজীম।
যাহ্ যাহ্ শয়তান দূর হ।
এ কথা বলার পর শাপলা নিশ্চুপ।
হায় আল্লাহ! এ কী বললাম!
মানুষকে তো কখনো শয়তান বলা যায় না। যদিও তার সামনে নয়, তথাপি আমি ভুল করে ফেলেছি।
আল্লাহ! তুমি আমাকে মাফ করো।
শাপলার বাবাঃ না বাবা, কোনো সমস্যা নাই। ঘুরতে ঘুরতে যখন চলেই এসেছো, ভালোই করেছো। আর এখানে নয়, চলো বাড়ির ভেতরে যাই। আজ তুমি, আমি, শাপলা ও তোমার আন্টি মিলে একসাথে সবাই মজা করে নাস্তা করবো। সেই ছোটবেলায় তোমাকে দেখেছি।
এর মাঝে কতদিন দেখা সাক্ষাৎ নাই।
চলো বাবা, চলো, ভেতরে চলো।
ইউসুফ মনে মনে বলে, সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন যাই। শাপলার সাথে খুব কাছাকাছি দেখা হবে।
ইউসুফ আমতা আমতা করে, না আঙ্কেল আজ থাক, আরেকদিন একসাথে সবাই নাস্তা করবো ইনশাআল্লাহ। আজ আসি।
শাপলার বাবাঃ না বাবা আজকেই চলো। তোমার আন্টি তোমাকে দেখে খুব খুশি হবে।
ইউসুফঃ ঠিক আছে আঙ্কেল, চলুন।
তারা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই শাপলা দাঁত কামড়িয়ে ফিসফিস করে বলে,
জঞ্জালটা শেষ পর্যন্ত বাড়িই এসে পড়লো!
শাপলার বাবা আঃ রহিমঃ
মা শাপলা! কই তুমি কোথায়?
দেখো,দেখো, কে এসেছে আমাদের বাড়ি?
তোমার ইয়াকুব চাচার ছেলে ইউসুফ।
তাড়াতাড়ি নাস্তা নিয়ে এসো। আজ আমরা নতুন মেহমানসহ সবাই মিলে একসাথে নাস্তা করবো।
শাপলাঃ ঠিক আছে বাবা, আপনারা টেবিলে বসুন। আমি এখনই নাস্তা নিয়ে আসছি।
শাপলার মা রহিমাঃ সুবহানাল্লাহ, ইউসুফ কত বড় হয়ে গেছে! তোমার বাবা মা কেমন আছে বাবা?
ইউসুফঃ জি আন্টি, আলহামদুলিল্লাহ।
আপনাদের দোয়া ও আল্লাহর রহমতে
মা ও বাবা সবাই ভালো আছেন।
শাপলাঃ মনে মনে, আজ এমন নাস্তা খাওয়াবো, যা সে দাদারকালেও খায়নি।
চিরদিন মনে রাখবে।
শাপলা নাস্তা প্রস্তুত করে নিয়ে আসলো।
আপেল, কমলা,বেদানা ও লুচি পরোটা হালুয়া। সে ইউসুফের হালুয়ার মাঝে প্রচুর পরিমাণ লবণ এবং পানির গ্লাসে মরিচ গুলে দিয়েছে।
তারা সবাই একসাথে নাস্তা খাচ্ছে। ইউসুফ আপেল কমলা খেয়ে লুচি পরোটা একবার মুখে দিয়েই নাড়াচাড়া করছে।
শাপলাঃ কি ব্যাপার জনাব, আপনি খাচ্ছেন না কেন?
ইউসুফঃ না মানে, আমি লুচি পরোটা খুব কম খাই।
শাপলাঃ বুঝেছি, আমরা গরিব মানুষ তো, তাই আমাদের খাবার আপনার পছন্দ হয়নি। নতুন মেহমান আসলেন, না খেলে হয়, কেমন দেখায় বলেন তো? কষ্ট হলেও খেয়ে নিন, প্লিজ।
ইউসুফঃ না শাপলা। এমনটি কখনো ভাববেন না। অনেক সুন্দর হয়েছে। আমি জীবনেও এমন সুস্বাদু খাবার খাইনি।
চিরদিন মনে থাকবে।
শাপলাঃ তাহলে পানি পান করুন।
পানিতে আরও টেস্ট পাবেন। আমাদের গ্রামের টিউবওয়েলের পরিষ্কার, স্বচ্ছ ঠাণ্ডা পানি। খুব সুস্বাদু ও মিষ্টি। খেলে আত্মা ভরে যাবে। নতুন সতেজতা ফিরে পাবেন।
ইউসুফ পানি পান করতে গেলে এক ঢোক পানি পান করার পর ঝালের চোটে কাশি শুরু হয়ে যায়।
শাপলার আম্মু বলে, কী হলো ছেলেটার?
এমন করছে কেন?
শাপলাঃ না মা, তেমন কিছু না। নতুন পানি তো, গলায় বেধে গেছে হয়তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাই না জনাব?
এবার ইউসুফের বুঝতে আর বাকি রইলো না। এটা নিশ্চয়ই শাপলার দুষ্টুমি ছাড়া আর কিছুই নয়।
শাপলা হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
বাবা! সকাল ৭টা বেজে গেছে কখন আমি টেরই পাইনি ! আমার আবার টিউশনি আছে, আমি চললাম বাবা, আপনারা গল্প করেন।
ইউসুফঃ আঙ্কেল! আমারও একটা জরুরি কাজে তাড়া আছে। আমিও তো সময়ের দিকে খেয়াল করিনি। আপনাদের ভালোবাসায় বিভোর ছিলাম।
আঙ্কেল! আমিও আসি। আবার কথা হবে ইনশাআল্লাহ। আমার জন্য দোয়া করবেন।
এ বলে ইউসুফও ভোঁ দৌড় দিলো শাপলার পিছু পিছু।
শাপলা রিকশা করে কোন দিক যে গেলো আর দেখতে পেলো না। ততক্ষণে শাপলা অনেক দূর চলে গেছে। পথিমধ্যে সেই দুষ্টু তিন ছেলে জাবেদ,কামাল, জালাল শাপলাকে দেখতে পায়। তারাও যেন কোথায় যাচ্ছিলো রিকশা করে ?
শাপলাকে দেখে তারা সবাই সমস্বরে বলতে থাকে,,
বোরখা পরা কন্যা তুমি
যাও গো কোথায় চলে?
প্রেম বিরহ জ্বালায় মোদের
যায় যে এ প্রাণ জ্বলে।
আইসো নাগো একসাথে আজ
খেলবো প্রেমের পাশা,
দেশের ছেলে আমরা তব
মেটায় দেবো আশা।
আমি কামাল, আমি জাবেদ
আমি জালাল ছেলে,
শুনলে কথা ভাগ্য ভালো
না শুনলে’ই জেলে।
শাপলা বলে শয়তানের দল
নাই কি মা বোন ঘরে ?
ইভটিজিং এর মামলা হবে
বেয়াদবির তরে।
থাকতে সময় দিচ্ছি দোহাই
সৎ পথে আয় চলে,
সতী নারীর অভিশাপে
জীবন যাবে গলে।
শাপলার মুখে এমন কথা শুনে জাবেদ যেন তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেলো। তার সাথীদের বললো, সত্য কথা। একদম খাঁটি কথা।
আমাদের সবারই মা-বোন, স্ত্রী, কন্যা আছে।
জালালঃ অট্টহাসি দিয়ে, আরে জাবেদ!
তুই কি শাপলার প্রেমে পড়ে গেলি?
আরে শালা! আমাদের তো বিয়েই হয়নি।
স্ত্রী সন্তান পেলাম কোথায়? আর সবাই যদি মা-বোন,স্ত্রী কন্যা হবে, তবে নিজের বৌ হবে কে? যত্তসব পাগলের আড্ডা!
জাবেদঃ শোন বন্ধু! আমাদের বিয়ে না হলেও যারা অবিবাহিত, তাদের ঘরে নিশ্চয়ই মা- বোন আছে। এতে কোনো সন্দেহ নাই। যেমন দেখ, আমার মা বাবা নাই, কিন্তু একটি বড় বোন আছে। যে বোন আমাকে মায়ের মত স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখে। নিজে না খেয়েও আমার মুখে খাবার তুলে দেয়। তোর ও কামালের দু-জনেরই ছোট বোন আছে। তাদেরকে তোরা কত ভালোবাসিস! কেউ কিছু বললে হিংস্র বাঘের মত হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়িস। বল সত্য কিনা ?
আর স্ত্রী কন্যার কথা বলছিস?
বিয়ে করলেই তো স্ত্রী কন্যা হবে। যেমন তোর মা, আমার মা, আমাদের সবার মা-ই আমাদের বাবাদের স্ত্রী এবং নানা নানি,দাদা দাদির কন্যা সন্তান।
মনে কর আমরা শাপলাকে যেভাবে উত্ত্যক্ত করছি, ঠিক সেভাবে অন্য কেউ যদি আমাদের মা-বোন, স্ত্রী কন্যাকে উত্ত্যক্ত করে, তাহলে তোর আমার কেমন মনে হবে, একটু চিন্তা করে দেখেছিস?
একটু বিবেককে জাগ্রত করে চিন্তা করে দেখ তো। শাপলা যদি আমার অথবা তোর মায়ের পেটের বোন হত, তাহলে তুই বা আমরা কী করতাম? কিল ঘুষি দিয়ে তার চাপাকে থ্যাবলা করে দিতাম।
এছাড়াও এটা ইভটিজিং এর পর্যায়েই পড়ে।
যা বাংলাদেশের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। জেল জরিমানাও হতে পারে।
তাছাড়াও ইসলাম নারীকে যথেষ্ট পরিমাণ সম্মান দিয়েছে।
মা হিসেবে নারীদের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’।
আরও একটি হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার এক লোক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দরবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি অধিকারী কে? নবীজি (সাঃ) বললেন, ‘তোমার মা’।
ওই লোক জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা’।
ওই লোক আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে?
এবারও তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা’। (বুখারি)।
কন্যা হিসেবে নারীর সম্মানঃ
মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘মেয়েশিশু বরকত (প্রাচুর্য) ও কল্যাণের প্রতীক।’
আরও হাদিসে রয়েছে,
‘যার তিনটি, দুটি বা একটি কন্যাসন্তান থাকবে; আর সে ব্যক্তি যদি তার কন্যাসন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিতা করে ও সুপাত্রস্থ করে, তার জান্নাত নিশ্চিত হয়ে যায়।’ – সুবহানাল্লাহ।
বোন হিসেবে নারীর সম্মানঃ
মহানবী (সাঃ) বলেছেন,
‘কারও যদি কন্যা সন্তান ও পুত্র সন্তান থাকে আর তিনি যদি সন্তানদের জন্য কোনো কিছু নিয়ে আসেন, তবে প্রথমে তা মেয়ের হাতে দেবেন এবং মেয়ে বেছে নিয়ে তারপর তার ভাইকে দেবে।’
হাদিস শরিফে আছে, বোনকে সেবাযত্ন করলে আল্লাহ প্রাচুর্য দান করেন।
স্ত্রী হিসেবে নারীর সম্মানঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। এ প্রসঙ্গে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা তোমাদের আবরণ স্বরূপ আর তোমরা তাদের আবরণ।’
(সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)।
কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ করো।’
(সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯)।
স্ত্রীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক।’
(মুসলিম শরিফ)।
তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে–ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি)
রাসুলের (সঃ) এর অন্য একটি হাদিসে এসেছে, নারীকে সম্মান করার পরিমাপের ওপর ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করে। তিনটি বিষয় নবী করিম (সাঃ)-এর জীবনে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। অর্থাৎ তিনি তিনটি জিনিসকে খুবই ভালোবাসতেন।
যথাঃ-
১. নামাজের প্রতি অনুরাগ, তিনি নামাজকে খুব ভালোবাসতেন।
২. ফুলের প্রতি ভালোবাসা, তাঁর কাছে ফুল ছিলো খুব প্রিয় ।
৩. নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
(বুখারি ও মুসলিম)
শাপলা আপু ঠিকই বলেছেন,
সতী নারীর পতী মরে না,
জগত জুড়ে হয় না তাঁর তুলনা।
কাউকে কষ্ট দিলে, কারো মনে আঘাত দিলে, তার কষ্টের নিঃশ্বাসে জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। নেমে আসে জীবনের অধপতন।
এবার কামাল বললো,
দোস্ত জাবেদ! তুই এত কিছু জানিস!
এত কিছু জানার পরেও আগে আমাদেরকে অবগত করিসনি কেন?
জাবেদঃ বিশ্বাস কর বন্ধু, আমি হাদিস কোরআন সম্পর্কে অবগত ছিলাম ঠিকই।
কিন্তু আসলে এসব বয়সের একটা দোষ।
এ সময় খুব কঠিন খারাপ সময়। এ সময়, যৌবনের সময় যে নিজেকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা করতে পারবে, সেই জীবনে সফলকাম হবে।
আর যে শয়তানের কাছে নিজেকে বিলীন করে দেবে, তার জীবনেই ধ্বস নেমে আসবে।
তাই এই কঠিন সময়ে বয়সের কারণে ছেলেমেয়ে অনেকেই শয়তানের প্ররোচনায় একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। হয়তো আমিও সেই রকমই পড়েছিলাম।
আল্লাহ যপন আমাদের ক্ষমা করেন – আমিন।
শাপলা আপুর শিক্ষণীয় ছন্দময় কথায় আমার সব ভুল ভেঙে গেছে। আমার চোখ খুলে দিয়েছে। এই ছন্দময় কথাগুলো সত্যি মারাত্মক এবং বাস্তব।
“শাপলা আপুর মুখের বাণী
নাই কি মা বোন ঘরে ?
ইভটিজিং এর মামলা হবে
বেয়াদবির তরে।
থাকতে সময় দিচ্ছি দোহাই
সৎ পথে আয় চলে,
সতী নারীর অভিশাপে
জীবন যাবে গলে।”
জাবেদের মুখে এমন সুন্দর সুন্দর কোরআন ও হাদিসের উক্তি শোনায় জালালও অনুতপ্ত হয়ে বললো, সত্যি জাবেদ! তুই একদম সত্য ও খাঁটি কথা বলেছিস।
আর এ জন্যই লোকমুখে শোনা যায়,
‘কুসঙ্গে উঠিবসি কাটাই দু’টি কান,
সুসঙ্গে উঠিবসি অকালে যায় প্রাণ।’
অর্থাৎ, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস
অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ, নরক বাস ‘
বন্ধুঃ তুই সত্যি আমাদের কঠিন বিপদের হাত থেকে বাঁচালি। নইলে আমরা আরও কতই পাপের মধ্যে নিমজ্জিত হতাম শয়তানের গোলাম হয়ে।
জাবেদঃ সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা।
আল্লাহ যাকে হেদায়েত দান করেন, সেই হেদায়েত প্রাপ্ত হয়।
কামালঃ তাহলে তো শাপলা আপুর কাছে আমাদের এমন আচরণের জন্য সরি বলা উচিৎ। তার কাছে ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন।
জালালঃ ঠিক বলেছিস। উনি তো এখন টিউশনি করতে গেছেন। আমরা এই পথেই তার আশার অপেক্ষায় থাকবো। যতক্ষণ পর্যন্ত না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখানেই তার অপেক্ষা করবো।,,,
সেই সকাল থেকে তারা তিন বন্ধু মিলে শাপলা আসার পথপানে চেয়ে রইছে এই পথ দিয়ে আসবে বলে। কিন্তু শাপলা তার দৈনন্দিন কাজকর্ম শেষ করে এই পথ দিয়ে না এসে অন্য পথ দিয়ে চলে গেছে।
অথচ শাপলা জানেই না যে, সেই তিনটি ছেলে তাদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অধীর তার অপেক্ষায় পথের ধারে বসে আছে।
[বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। উপরোক্ত লেখায় কোনো প্রকার ভুল থাকলে সকল পাঠকবৃন্দ ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
লেখকঃ মো: ইব্রাহিম হোসেন
কাদিপুর গোদাগাড়ী, রাজশাহী। ]