অভিলাষ – মোঃ ইব্রাহিম হোসেন (দ্বিতীয় পার্ট শেষ পার্ট)
জাবেদ, কামাল ও জালাল সারাদিন সে পথের ধারে বসে বসে প্রহর গুনছে। কিন্তু শাপলা তো আসে না।
আর আসবেই বা কীভাবে? সে তো আর বাইরে নাই অন্য রাস্তা দিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেছে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, মাগরিবের আযান দিলো। শাপলার কোনো খবর নাই।
পথিমধ্যে এডভোকেট ইউসুফ তাদেরকে দেখে বললো,
এই ভাই! আপনাদের তো চেনা চেনা লাগছে। আপবাদের বাড়ি কোথায়?
জাবেদঃ ভাই! আমাদের বাড়ি দূরে নয়, খুব কাছেই। ও পাড়ায় আমাদের বাড়ি।
ইউসুফঃ ও পাড়ায় আপনাদের বাড়ি, তো এ পাড়ায় কী করছেন ভাই?
আপনাদের আব-ভাব তো ভালো লাগছে না। আপনারা কোনো খারাপ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য সম্ভবত এখানে এসেছেন।
জাবেদঃ ভাইজান! আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন। আমাদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নাই। আমরা একটা মহাপাপ করেছি! আর সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমরা সারাদিন এখানে তপস্যা করছি।
ইউসুফঃ তাহলে যখন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই এসেছেন, তবে চলুন আগে মাগরিবের নামাজ পড়ে আসি। তারপর আমরা পাপের প্রায়শ্চিত্তের কথা বলবো।
তারা চারজন মিলে মাগরিবের নামাজ পড়ে আসলো এবং ইউসুফ আবার তাদের জিজ্ঞেস করলো।
ভাইজান! পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আপনারা এখানে রৌদ্র তাপে কষ্ট করে তপস্যা করতে করতে সারাদিন পার করে দিলেন। তার ঘটনা আমাকে বিস্তারিত বলেন।
জাবেদঃ তার আগে আপনি আপনার পরিচয় দিন।
আপনাকে চেনাচেনা লাগছে। আপনি কি ইয়াকুব চাচার ছেলে না? সম্ভবত বেশ কিছুদিন বিদেশে ছিলেন।
ইউসুফঃ আপনি ঠিকই বলেছেন। দীর্ঘ দশ বছর বিদেশে ছিলাম সেখান থেকে লেখাপড়া করে, উকালতি পাশ করে কিছুদিন হলো বাড়ি ফিরেছি।
জাবেদঃ আনন্দ চিত্তে, আরে বন্ধু! তুই কি আমাকে চিনতে পারছিস না। আমি তো সেই জাবেদ। আমরা উচ্চ বিদ্যালয়ে একসাথে লেখাপড়া করে ছিলাম। তুই, আমি, কামাল ও জালাল।
মনে করে দ্যাখ তো, চিনতে পারিস কিনা ?
দীর্ঘদিন থেকে দেশের বাইরে ছিলি, চেহারাও অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই আমাদেরও চিনতে একটু কষ্টই হলো।
ইউসুফঃ হ্যাঁ বন্ধু, মনে পড়েছে। আমরা একসাথে কত খেলাধুলা করেছি, করেছি কত দুষ্টুমি !
যাইহোক, তোর কী সমস্যা বল?
আমি যথাসাধ্য তোর সমস্যা দূর করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
জাবেদঃ দোস্ত! আর বলিস না। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তোদের এ পাড়ার শাপলা নামের একটা মেয়েকে শয়তানের প্ররোচনায় উত্ত্যক্ত করেছিলাম। মেয়েটি খুব সুন্দর। আমাদের উত্ত্যক্ততায় খুব ক্ষিপ্ত হয়ে এমন একটা কথা বলেছে, যা আমাদের জীনটাকেই পাল্টে দিয়েছে। তাই তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য আমরা তিন বন্ধু এ রাস্তার ধারে, সারাদিন ধরে তার অপেক্ষায় অপেক্ষমান ।
ইউসুফ মুচকি হেসে বললো,
পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা তো ভালো কথা।
কিন্তু আবার অন্য কিছু তো হয়নি?
জাবেদঃ কী বলিস দোস্ত!
তোর কথা তো কিছুই বুঝলাম না। একটু ক্লিয়ার করে বল।
কামাল ও জালাল সমস্বরে বললো,
বন্ধু! তুই বুঝতে পারিসনি?
ইউসুফ ভাই তোকে বলছে, তুই কি তার প্রেমে পড়েছিস ?
জাবেদঃ চুপ কর বেয়াদব! সবসময় এমন কথা বলা ঠিক নয়। আমরা যার জন্য এসেছি, আগে সেটার সমাধান হোক। প্রেম-প্রীতি তো পরের কথা।
ইউসুফঃ আজকে তোরা চলে যা। আজ সে এ পথ দিয়ে আর আসবে না।
কেননা, সে অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছে।
জাবেদ ইউসুফকে বললো,
দোস্ত! তাদের বাড়ি কি তুই চিনিস?
আমাকে একটু দেখাবি?
ইউসুফঃ হ্যাঁ চিনি, দেখবি? চল যাই সামনের দিকে।
জাবেদঃ কিন্তু সন্ধ্যা লেগে গেলো। আজকে তবে যাই। আরেকদিন সময় করে দেখে নিবো। আর তুই যদি পারিস আমার পক্ষ থেকে তার কাছ ক্ষমা চেয়ে নিস। সে যেন আমাদেরকে মাফ করে দেয়।
ইউসুফঃ ঠিক আছে দোস্ত, দেখা হলে বলবো। এখন আসি – আল্লাহ হাফিজ।
জাবেদঃ আল্লাহ হাফিজ। আমার জন্য দোয়া করিস বন্ধু। আল্লাহ যেন আমার মনের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্খা পূরণ করেন।
ইউসুফঃ ওয়াফ্ফাকাকাল্লাহ। আল্লাহ যেন তোর মনের নেক আশা পূরণ করেন – আমিন।
বন্ধু! তোরাও আমার জন্য দোয়া করিস। আল্লাহ যেন আমারও মনের আশা, স্বপ্ন পূর্ণ করেন।
জাবেদঃ অবশ্যই দোস্ত। আল্লাহ যেন তোর সব স্বপ্ন ও মনের আশা পূরণ করেন এবং নেক হায়াত দান করেন।
ইউসুফঃ আমিন ইয়া রাব্বুল আলামিন জাযাকাল্লাহ খাইরান হে প্রিয় বন্ধু আমার!
সেখান থেকে জাবেদ ও তার বন্ধুরা সে স্থান ত্যাগ করে নিজ নিজ বাড়ি চলে গেলো।
সন্ধ্যা শেষে গভীর নিশি আসলো। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করে উঠলো। জাবেদ যেন সত্যি সত্যি শাপলার প্রেমে পড়ে গেলো।
তাকে নিয়ে তার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন মনে জাগলো; সে যেন তার মাঝে জীবনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পেলো।
চাঁদনি রাতে জাবেদ একাকী স্বপ্নে বিভোর। কত কল্পনা, কত জল্পনা মনের ভেতর!
তার কথা ভাবতে ভাবতে চোখে তন্দ্রা চলে আসে। এক সময় গভীর ভাবনায় দু’চোখ জুড়ে ঘুম চলে আসে। স্বপ্নে দেখে শাপলা তার কাছে হাজির হয়ে গেছে ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে।
জাবেদ তাকে দেখে বিস্মিত হয় এবং বলে,
শাপলা! সে দিনের আচরণে সত্যি আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও অনুতপ্ত।
অনুগ্রহ করে আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। আমাকে সত্যের পথে ধাবিত করেছেন। আপনার মত মহীয়সী নারী আমি আমার জীবনে এটাও দেখিনি।
শাপলাঃ এত প্রশংসা করতে হবে না। আমি তাতে কিছুই মনে করিনি। আমি সবাইকে ক্ষমার দৃষ্টিতেই দেখি।
কারণ, আমি জানি, এ শয়তানি আপনাদের ইচ্ছায় হয়নি, হয়েছে ইবলিশ শয়তান আযাযীলের প্ররোচনায়।
জাবেদঃ শাপলা! সত্যি আমাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পেরেছেন তো?
শাপলাঃ মুচকি হেসে, জি, সত্যি আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি এই ফুলের তোড়া আপনার জন্য নিয়ে এসেছি। আপনি তা গ্রহণ করুন।
জাবেদ মুচকি হাসতে হাসতে ফুলের তোড়া নিয়ে বললো,
আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আসুন প্লিজ, আমরা কিছুক্ষণ গল্প করি।
জি না, এখন গল্পের সময় না। অন্য এক সময় গল্প করবো। ভালো থাকবেন। এখন আসি। আল্লাহ হাফিজ।
জাবেদ কিছু না বলে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার চলে যাওয়ার পথপানে। সে স্বপ্নের মাঝে রাত জেগে জেগে তাকে নিয়ে গান লিখতে লিখতে শুরু করলো,
অন্তরে অন্তরে
যাদু করে মন্তরে
হৃদয়ের মণিকোঠে দিয়েছি যে ঠাঁই,
আজ এই সংগীতে
দু’জনার সন্ধিতে
ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতি খুঁজে খুঁজে পাই।।
ও প্রিয়া! ও প্রিয়া!
দেখো চোখ মেলিয়া,
তুমি ছাড়া এ জীবন আঁধারে হারায়!
দূর দূর দূর দূর দূর নীলিমায়।
তুমি সুখ আর দুখ
সবচেয়ে প্রিয় মুখ
কাছে এসে ভালোবেসে নাও বুকে নাও,
যত প্রেম পৃথিবীর
দানে ওই নিয়তির
উজাড় করে ঢেলে সবই মোরে দাও।
ও প্রিয়া! ও প্রিয়া!
শোনো মনো দিয়া,
ইহ-পরকালে পরকালে তোমাকেই চাই।
তুমি ছাড়া এ জীবন আঁধারে হারায়!
দূর দূর দূর দূর দূর নীলিমায়।
বসন্ত শরতে
পরতে পরতে
স্নিগ্ধ প্রেমে তব ব্যাকুল এই দিল,
জীবনে মরণে
তোমারই কারণে
সঁপিলাম নিজেকেই মেরে প্রেম সিল।
ও প্রিয়া! ও প্রিয়া!
শোনো মনো দিয়া,
চাওয়া পাওয়ার শেষ আর কিছু নাই।
তুমি ছাড়া এ জীবন আঁধারে হারায়!
দূর দূর দূর দূর দূর নীলিমায়।
লিখতে লিখতে জাবেদের হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। সকালও হয়ে যায়। দৌড় দিয়ে সে দরজার বাইরে যায়। পাগলের মত তাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু তার দেখা না পেয়ে সেই খুব সকালে ছুটলো তার পাশের গ্রামে শাপলাদের ঠিকানায়।
কিন্তু জাবেদ তো আর শাপলাদের বাড়ি চিনে না।
এদিকে এডভোকেট ইউসুফ নামাজ পড়ে সকাল বেলায় হাঁটতে বের হয়েছে। পথিমধ্যে৷ হঠাৎ করেই তার সাথে দেখা হয়ে যায় জাবেদের।
ইউসুফ তাকে জিজ্ঞেস করে,
কী হয়েছে জাবেদ? এত সকাল বেলায় আনন্দ চিত্তে দৌড়তে দৌড়তে আমাদের গ্রামে তোর দেখা। আমি তো অবাক!
জাবেদঃ আজ রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি বন্ধু। সে স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে যায় এবং ঘুম থেকে উঠেই দৌড়তে দৌড়তে তোদের গ্রামে চলে আসি।
দোস্ত! এই পৃথিবীতে আমার আপন বলতে কেউ নাই। আমি এতিম, অসহায়। আমার মা বাবাও নাই। আমি ছোটবেলাতেই তাঁরা পরলোক গমন করেছেন। আমার মনের কথা বলার মত বিশ্বাসী বন্ধু তুই ছাড়া আর কেউ নাই। আজ তোকে এমন একটা কথা বলবো, তুই চমকে উঠবি। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি !
ইউসুফ: জাবেদ! তোর কোনো ভয় নাই বন্ধু। তুই নির্ভয়ে আমাকে তোর মনের কথা খুলে বল।
আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো তোর সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে।
জাবেদ: দোস্ত! তার আগে তোর কাছে একটা জিজ্ঞাসা, তুই যদি উত্তর দিস, তবেই আমি আমার মনের কথাগুলো তোর সামনে প্রকাশ করার সুযোগ পাবো নির্ভয়ে ও নির্লজ্জায়।
ইউসুফঃ আরে বন্ধু এ কী বলিস!
ভয় না হয় বুঝলাম কিন্তু লজ্জা আবার কীসের?
এটাই তো বুঝলাম না।
জাবেদঃ না দোস্ত আগে তোকে উত্তর দিতে হবে, নইলে আমি তা বলার কখনোই সাহস পাবো না।
ইউসুফঃ আচ্ছা ঠিক আছে বল তোর প্রশ্ন কী?
জাবেদঃ সত্যি করে বলতো বন্ধু, তুই কি কখনো কাউকে ভালোবেসেছিস ; কখনো কি কারও প্রেমে পড়েছিস?
ইউসুফঃ এ কেমন কথা বন্ধু? তোর এ কথার অর্থ কিছুই বুঝলাম না। আমার প্রেম ভালোবাসার সঙ্গে তোর প্রশ্নের কী সম্পর্ক?
জাবেদঃ দোস্ত! অনেক সম্পর্কই আছে বন্ধু।
প্লিজ তুই আমাকে বল।
ইউসুফঃ তাহলে শোন বন্ধু আমার প্রেম ভালোবাসার কাহিনিঃ
আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন পঞ্চম শ্রেণির একটা মেয়েকে আমার খুব ভালো লেগে যায়। আমি তাকে চুপি চুপি একা নিরালায় চোরের মত করে ফুল বাগানের আড়াল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখতাম রাস্তায় তার পথচলার মাঝে।
সে যে কী মিষ্টি মেয়ে, আর কী দারুণ দেখতে তার মুখের হাসি! হাসলেই যেন মুক্তা ঝরে। দীঘল কালো চোখদুটো, যত দেখি আরও যেন ততই দেখতে ইচ্ছে করে। এভাবে কাটে আমার দিনকাল ক্ষণ। যখন আমি এস এস সি পাশ করলাম, তখন আমার বাবা মা আমাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেন। যেদিন আমি বিদেশের পানে পাড়ি দেই, সেদিন এ গ্রাম ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছেই করছিলো না। তবুও যেতে হয়েছে মা বাবার ইচ্ছা পূরণের জন্য। আমি পাড়ি দিলাম বিদেশের মাটিতে। সেখানে লেখাপড়া করতে থাকি আর তার কথায় মনে মনে ভাবি। আঁকি দু-চোখে হাজরও স্বপ্ন। এভাবেই বছরের পর বছর আমার দিন কাটে শুধু তার ভাবনায় একা নিরালায়। একটা পলক দেখার জন্য কতই না ছটফট করেছি, কতই না ব্যাকুল চিত্তে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে মোনাজাত প্রার্থনায় মগ্ন ছিলাম, ছিলাম তার প্রেমে বিভোর। কিন্তু বিদেশে থাকাকালীন সময় তকে একটা নজরও দেখতে পাইনি।
জাবেদ: আরে দোস্ত! এ কী বলিস? এখন তো মোবাইল ইন্টারনেটের যুগ। যে কোনো সময়, যে কোনো মূহুর্তে, চোখের পলকে এক দেশের সাথে আর এক দেশে যোগাযোগ করা সম্ভব। যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমু, হোয়াটসঅ্যাপ ও আরও বিভিন্ন মাধ্যম।
আচ্ছা যাইহোক, তারপর এ পর্যন্ত কী অবস্থা বল?
ইউসুফ: দোস্ত! তারপর বেশ কিছুদিন বিদেশে থেকে উকালতি পাশ করে মা মাটির প্রেম ও নাড়ীর টানে নিজের দেশে ফিরে আসলাম।
এসেই খোঁজ নিলাম মা বারা কাছে, সে মেয়েটা কোথায় আছে, কেমন আছে?
মা বললো, আজব ব্যাপার তো! আজও সে মেয়েটাকে মনে রেখেছিস? আজও তার কথা ভুলতে পারিস নি ?
আমি মনে মনে মাথা নিচু করে বললাম,
না মা, আজও ভুলতে পারিনি সে-ই ছোট্ট বেলার অবুঝ মেয়েটাকে।
কারণ, তার মাঝেই যে আমার স্বপ্নবিলাসী মন হারিয়ে গেছে। আমার নীরবতা দেখে মা আবারও বললো, কিরে খোকা? এখনো জবাব দিলি না যে!
আমি বললাম, না মা, একসাথে লেখাপড়া করেছি, একসাথে খেলাধুলা করেছি তো, তাই এখানে এসেই তার কথা মনে পড়ে গেলো।
মা বললো, সে খুব ভালো আছে, তার বাবা মাও অনেক ভালো মানুষ, তারাও ভালোই আছেন। মেয়েটা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তুই দেখলে চিনতেই পারবি না।
আমি বললাম, তাই নাকি মা?
মা বললো, হ্যাঁ বাবা, সত্যি তাই।
তারপর আমি কলাকৌশল করে মা বাবাকে না জানিয়ে তাদের বাড়ি গিয়ে নিজের চোখে একটা নজর দেখে আসলাম।
মায়ের কথা সত্যি সে অনেক সুন্দর হয়েছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করে মধুর সুরে। তার বাবা মায়ের সাথেও অনেক কথা হলো। উনারাও আমাকে দেখে অনেক খুশি হলো, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলো, সুখে থেকো বাবা , সুখে থেকো। আল্লাহ তোমার মনের সকল নেক আশা পূরণ করুন – আমিন।
জাবেদঃ দোস্ত! দারুণ তো তোর সেই বাল্যপ্রেমের কাহিনি!
তো দোস্ত, যার কথা এতক্ষণ বর্ণনা করলি, যার প্রেমে তোর এতো বিভোর মন। তার নামটা তো এখনো বললি না।
দোস্ত! তার নাম কী বল শুনি?
ইউসুফঃ নামটা না হয় পরেই বলবো, এখন থাক। এবার বল তোর মনের লুকায়িত গোপন কাহিনি।
তোর মনে জমে থাকা সেই না বলা ভাষা।
জাবেদঃ না দোস্ত, আগে বলতে হবে, তোর সেই প্রেয়সীর নাম কী? কোথায় থাকে, তার বাড়িঘরই বা কোথায়?
ইউসুফঃ মাথা নাড়া দিয়ে বললো,
না বন্ধু, এখন তার নাম বলা যাবে না
আগে বল তোর মনে জমে থাকা, ব্যাকুলতার অপরিস্ফুট, অস্কুট বাক।
জাবেদঃ দোস্ত! বলতে ভয় লাগে, আবার লজ্জাও লাগে। কীভাবে তা বলি? আমি কোনো শুরুটাই খুঁজে পাচ্ছি না।
ইউসুফঃ তাহলে থাক, পরে অন্য কোনো একদিন বলিস, এখন যাই।
জাবেদঃ না দোস্ত! যাসনে একটু দাঁড়া।
আমার মনের গহীনে জমানো না বলা কথাগুলো না বলা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছি না।
আবার কাউকে সাহস করে বলতেও পারছি না। এটা যে মনের গহীন বনের লুকায়িত গোপনীয় কথা। যা বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছাড়া কাউকে বলা যায় না দোস্ত।
কাকে বলবো, কে শুনবে? তুই ছাড়া তেমন বিশ্বাসী কোনো বন্ধুও আমার নাই।
আর আমি না বললেও মনে স্বস্তি পাচ্ছি না।
ইউসুফঃ তাহলে লজ্জা না করে, মনের ভেতরে শঙ্কা না পুষে বীর পুরুষের মত বলে ফেল শুনি।
জাবেদঃ হ্যাঁ দোস্ত, অবশ্যই বলবো এবং তোকেই বলবো।
কারণ, তুই ছাড়া আমার বিশ্বাসী বন্ধু আর কেউ নাই। আমি জানি, তুই আমাকে অনেক ভালোবাসিস। আমার জন্য তুই তোর জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত এ আমি বিশ্বাসী।
ইউসুফ: আর এতো আদিখ্যেতা করা লাগবে না বন্ধু। যা বলার দ্রুত নির্ভয়ে, নির্লজ্জায় বলে ফেলো।
জাবেদঃ দোস্ত! তার আগে আরেকটা কথা,,,,,
ইউসুফঃ কী কথা দোস্ত, বল।
জাবেদঃ দোস্ত! তুই আমাকে কতটুকু ভালোবাসিস?
ইউসুফঃ দোস্ত! তোকে আমি অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি। তুই যে আমার সেই ছোট্টবেলার একমাত্র সবথেকে বিশ্বস্ত প্রিয় খেলার সাথী ছিলি।
জাবেদঃ তাহলে কি আমি তোর সেই প্রেয়সীর চেয়েও অনেক বেশি প্রিয় বন্ধু?
ইউসুফঃ প্রেয়সী, প্রেমিক- প্রেমিকা এক জিনিস,
আর বন্ধু এক জিনিস।
প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে বন্ধুর তুলনা হয় না।
প্রেমিকার স্থানে প্রেমিকা, বন্ধুর স্থানে বন্ধু, মা-বাবার স্থানে মা-বাবা, আর ভাই বোনের স্থানে ভাই-বোন।
সবার প্রেম-ভালোবাসা এক রকম নয়।
কাল, স্থান ও সম্পর্ক ভেদে একেক জনের প্রেম-ভালোবাসা একেক রকমের হয়।
তবে মনে রাখিস, আমি তোকে অনেক ভালোবাসি। আমার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে। তোর সুখ মানে আমার সুখ, তোর কান্না-হাসি মানে আমার কান্না-হাসি।
বন্ধু! বল বল নির্ভয়ে ও নির্দ্বিধায়,
তোর সুখ ও হাসিমুখ দেখতে চাই।
জাবেদঃ তাহলে শোন বন্ধু তোকো বলি মনানন্দে ছন্দে ছন্দেঃ
বন্ধু তোদের বাড়ির পাশে একটা মেয়ের বাস,
প্রথম তারে দেখার পরেই খাইছে মনে ক্রাশ!!
কাঁপে যে মন দুরুদুরু
বল কীভাবে করবো শুরু ??
না পেলে তার ভালোবাসা জীবন সর্বনাশ!
বন্ধু তোদের বাড়ির পাশে একটা মেয়ের বাস,
প্রথম তারে দেখার পরেই খাইছে মনে ক্রাশ!!
চলার পথে হঠাৎ দেখে হারায় অবুঝ মন,
ঘুম আসে না চোখের পাতায় ভাবনা সারাক্ষণ।।
দে দে আমায় দে না বলে
দ্যাখ না ভাসি নয়ন জলে,,
সঙ্গতে তার বাঁধবো যে ঘর এ মনেরই আশ।
বন্ধু তোদের বাড়ির পাশে একটা মেয়ের বাস,
প্রথম তারে দেখার পরেই খাইছে মনে ক্রাশ!!
কোথায় গেলে কেমন করে পাবো তারে বল ?
বন্ধুরে তোর বিনয় করি সঙ্গে আমার চল্ ।।
প্রেমের জ্বালা জ্বলছে মনে
কেউ দেখে না সঙ্গোপনে,,
সেই মেয়েটাই রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমার দেহের শ্বাস।
বন্ধু তোদের বাড়ির পাশে একটা মেয়ের বাস,
প্রথম তারে দেখার পরেই খাইছে মনে ক্রাশ!!
জাবেদ তার মনের গহীনে জমানো না বলা কথাগুলো ছন্দ সুরে বলেই খুব লজ্জা পেয়ে ভোঁ দৌড় দিলো।
ইউসুফ চিৎকার করে বলতে লাগলো,
এই জাবেদ! দাঁড়া দাঁড়া, আমার কথা শুনে যা। তুই এতক্ষণ ছন্দ তালেতালে যার কথা বললি, তার নামটা বলে যা।
জাবেদ দূর থেকে দৌড়তে দৌড়তে বললো,
না বন্ধু, বলা যাবে না এখন। মনে কর এটা একটা প্রতিশোধ। তুইও তো আমাকে তোর মনের মানুষের কথা বলে তার নাম বলিসনি, হাহাহাহাহাহ।
ইউসুফ এ কথা শুনে মনে মনে হাসতে থাকে।
কী পাগল! পাগলটা বুঝি খু লজ্জা পেয়েছে?
সেও মনে মনে হাসতে হাসতে তার বাড়ির দিক রওনা দিলো। যেতে যেতেই পথিমধ্যে দেখে শাপলাদের বাড়ির সামনে অনেক লোকজনের ভীড়। চারিদিকে হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে। আসছে কান্নার আওয়াজ।
ইউসুফ খুব চিন্তিত! কী হলো ওখানে? এতো লোকজন কেন? কেনোই বা এতো আর্তনাদে কান্নার আওয়াজ ? সে দ্রুতগতিতে শাপলাদের বাড়ির দিকে এগুতে লাগলো।। রাস্তায় একজনের সাক্ষাৎ পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
ভাইয়া! ওখানে কী হয়েছে, এতো লোকজনের ভীড় ও বিকট কান্নার আওয়াজ কেনো?
লোকটি বললো,
ভাইরে! খুবই করুণ অবস্থা! এমন দূর্ঘটনা যেন কারোই কখনো না হয়।
ইউসুফঃ ভাইয়া! কী হয়েছে আমাকে খুলে বলুন, প্লিজ।
লোকটিঃ ভাই! সন্ত্রাসীদের হামলায় শাপলার বাবা মা কেউ জীবিত নাই। বাড়িঘর রক্তে রক্তাক্ত! শাপলা ও তার ছোট ভাই জিয়াদ বাড়িতে না থাকায় কোনো রকমে বেঁচে গেছে। এখন মা বাবাহীন এতিম মেয়েটার কী হবে? তা আল্লাহই ভালো জানেন।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা যেন মেয়েটার উপর খাস রহমত নাজিল করেন – আমিন।
এ কথা শুনে ইউসুফের মাতায় যেন সাত আসমান ভেঙে পড়লো! সে সেখানে গিয়ে দেখে সত্যি বাড়িঘর রক্তে রক্তাক্ত! শাপলার মুখের দিকে তাকানো যায় না। বিষণ্ণতার ছাপ, চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে আর ছিলবিল করে কান্নায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। তার মা ও বাবার রক্তাক্ত দেহ বুকে জড়িয়ে কান্না করায় তার সর্বাঙ্গেও রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে।
ইউসুফ যেন একেবারে নীরব হয়ে গেছে। তারও চোখ দিয়ে ঝরছে ঝরঝর করে পানি। সে শাপলাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে? তার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে।
এদিকে খবর পেয়ে তার বড় বোন চম্পা, মেজো বোন জবা ও বড় দুলাভাই সোলায়মানও ছুটে আসলো তাদের বাড়িতে। সবার চোখ দিয়েই ঝরছে অঝোর ধারায় লোনাজলের বৃষ্টিপাত।
শাপলা তার বড় বোন চম্পাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো এই বলে,
আপু! এমন কেন হলো, কেনো আমার উপর এমন অবিচার হলো? মা বাবা একসঙ্গে চলে গেলো আমাকে এতিম করে দিয়ে।
আপু! আমি এ পৃথিবীতে আর কী নিয়ে বাঁচবো?
পৃথিবীতে যে আমার আর কেউ রইলো না।
চম্পাঃ সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
শাপলা! তুই আর কাঁদিস না, তোর কান্না আমি আর সইতে পারি না রে বোন, আর সইতে পারি না।
আজ থেকে মনে কর আমি চম্পা-ই তোর আম্মু, আমি চম্পা-ই তোর আব্বু।
শাপলার দুলাভাই সোলায়মান, ছোট ভাই জিয়াদ ও ইউসুফ সবাই মিলে শাপলার মা ও বাবার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করলো। মা ও বাবাকে একসাথে পাশাপাশি সমাধিস্থ করলো।
পরিবারে শোকের ঢল নামলো! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। তার বোন ও দুলাভাই তাদের বাড়ি চলে যেতে চাইলে শাপলা বলে,
আপু! তুমি আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো। আমি এই শূন্য মরুভূমির গহীন বনে একা নিভৃতে কীভাবে রাতযাপন করবো, কীভাবে একা থাকবো?
তার দুলাভাই সোলায়মান তার স্ত্রী চম্পাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
চম্পা! শাপলা তো ঠিকই বলেছে। কীভাবে এখানে এ নির্জনে শূন্য বাড়িতে সে একা থাকবে? আর জিয়াদ তো সবার ছোট। সেও তো উপযুক্ত হয়ে উঠেনি। এমন বিপর্যয়ে তাদেরকে এখানে কীভাবে একা রেখে যাবো?
তারপরও শাপলা মেয়ে মানুষ, যুবতী নারী। আর মেয়ে মানুষের শত্রুর অভাব নাই। চোর না শুনে ধর্মের কাহিনি। তার পক্ষে তো একা থাকা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। বরং চলো তাকে আমরা আমাদের সাথেই নিয়ে যাই।
হাঠাৎ করে ছোট ভাই জিয়াদ বলে উঠলো,
দুলাভাই! আমিও আপনাদের সাথে যাবো। আমি যে শাপলা আপুকে ছাড়া এক মূহুর্তের জন্যেও একা থাকতে পারবো না। শাপলা আপু আমার জান, আমার প্রাণ। বড় আপু ও মেজো আপু পরের ঘরে চলে যাওয়ার পর শাপলা আপুই আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। আমিও তাকে ছাড়া, তোমাদেরকে ছাড়া একা থাকতে পারবো না।
আমিও তোমাদের সাথে যাবো।
চাম্পাঃ ঠিক আছে ভাই, তোরও কোনো ভয় না।
চল্, তোরা সবাই আমাদের সাথে চল্। আমরা একই শহরে এক পরিবারে সবাই একই সাথে থাকবো এবং তোকে শহরের কোনো একটা ভালো কলেজে ভর্তি করে দেবো।
কথা যা-ই কাজ তা-ই। তার দুলাভাই চম্পার কথা মত শাপলাকে ও জিয়াদকে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে লাগলো। ইউসুফ যেন কিছুই বলতে পারছে না। তার বুকটাও যেন ফেটে যাচ্ছে। নাই মুখে কথা, অপলক দৃষ্টিতে থাকে তাদের চলে যাওয়ার পথপানে।
হঠাৎ শাপলার দৃষ্টি তার দিকে পতিত হয়। তার চোখদ্বয় অশ্রুতে সিক্ত। চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছে নোনাজল।
শাপলা রাস্তায় থমকে দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে ইউসুফকে বললো,
আপনি কাঁদছেন কেন? চোখের পানি মুছে ফেলুন আর শুনুন। এই নভস্থল ও নভোমণ্ডল আমার জন্য গাছপালা ও পশু-পাখিহীন শূন্য মরুভূমি। আর কখনো হবে না বৃষ্টিপাত, হবে না ফসল উৎপন্ন।
কথায় না বলে, অভাগিনী যেদিকে চায়, সাগর সেদিকেই শুকায়। আমার বেলাতেও তাই। আমার জন্য আপনি কখনো মন খারাপ করবেন না।
আর হ্যাঁ, আপনার সাথে একটু খামখেয়ালি হয়েছে আমার। আশা করি বুঝতল পেরেছেন। আমার এ দুষ্টুমির জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর আমার আব্বা আম্মার জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাদেরকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন – আমিন।
ইউসুফঃ শাপলা! আমার একটা কথা ছিলো, যদি শুনতে,,,
শাপলাঃ জি বলেন আপনার কথা, আমি শুনবো।
ইউসুফঃ শাপলা! এ বিষাদের মুহূর্তে তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত ভাষা আমার জানা নাই।
তবে কিছুদিনের মধ্যে আমি তোমার কাছে যাবো আমার আব্বু ও আম্মুকে সাথে নিয়ে। তাই আপুদের বাসার ঠিকানাটা দাও, প্লিজ।
শাপলা কাঁদতে কাঁদতে,,,,,,,,,,
চম্পা আপু! তোমাদের ঠিকানটা লিখে দাও।
চম্পা তাদের ঠিকানা লিখে দিয়ে ইউসুফকে বললো,
এই নাও ভাই ঠিকানা।
ভালো থেকো আর আমাদের জন্য দোয়া করিও।
ইউসুফঃ ঠিক আছে আপু।
আপনারাও আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
আর একটা কথা আপু, শাপলার মনের অবস্থা খুবই খারাপ। তার দুনিয়াতে আপনারা ছাড়া আর কেউ নাই। তাকে চোখে চোখে রাখবেন। তার প্রতি খেয়াল রাখবেন। বাইরে কোথাও একা যেতে দিবেন না। এটা কোনো উপদেশ নয় আপু, ছোট ভাই হিসেবে আমার বিনয় অনুরোধ। আমি খুব শীঘ্রই আপনাদের বাড়ি আসবো ইনশাআল্লাহ।
শাপলার বড় আপু চম্পাঃ ঠিক আছে ভাই। তুমিও ভালো থেকো। আল্লাহ হাফিজ।
ইউসুফঃ ফী আমানিল্লাহ। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
শাপলাঃ ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু – আল্লাহ হাফিজ।
তারা বিদায় নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো তাদের গন্তব্য স্থলে। ইউসুফও তাদের বাড়ি চলে গেলো নীরবে অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে,,,
কিছুক্ষণ পর খবর পেয়ে জাবেদও ছুটে আসলো শাপলাদের বাড়ি। এসে দেখে এখানে কেউ নাই। বাড়ির দরজায় তালাবদ্ধ। চারিদিক অন্ধকার। এশার নামাজের সময় হয়ে গেছে। সে মসজিদে ছুটে গেলো নামাজের জন্য। এশার নামাজন্তে মসজিদের ঈমাম সাহেবকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
ঈমাম সাহেব! আপনাদের এলাকায় কী ঘটনা ঘটেছে, দয়া করে আমাকে একটু বলবেন?
ঈমাম সাহেবঃ জি অবশ্যই বলবো। তবে এ কাহিনি জানলে আপনি তা সহ্য করতে পারবে না ? আর আমারও সমস্যা হতে পারে। তবু্ও তো সত্য গোপন রাখা যায় না। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে চেপে রাখ মহাপাপ!
জাবেদঃ না ঈমাম সাহেব, আপনি বলুন, কী এমন ঘটনা ঘটেছে? যা আমি সহ্য করতে পারবো না। আর আপনারও সমস্যা।
এর মাঝে এমন কী কাহিনি লুকায়িত আছে? প্লিজ আমাকে বলুন ঈমাম সাহেব, আমাকে বলুন।
ঈমাম সাহেবঃ এর মাঝে অনেক গোপন কাহিনি লুকায়িত আছে জনাব!
যা আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি কেউ অবগত নাই। আমি এ কথা আজ পর্যন্ত কাউকেই বলতে পারিনি। কারণ, বারণ ছিলো তাই।
কেননা, শাপলা মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর ও সুদর্শন! সততার সাথে সমাজের ন্যায়-অন্যায় বিভেদে বিশেষ ভূমিকা আছে সে মেয়েটার।
তার বাবা মসজিদে নামাজ পড়তে এসে মাঝে মাঝেই আমাকে বলতেন।
জাবেদঃ (খুব আগ্রহের সাথে)
বলুন ঈমাম সাহেব বলুন, তার বাবা আপনাকে কী এএমন বলতেন ?
ঈমাম সাহেবঃ শুনুন তাহলে,
নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাবাকে বলা হয় সংসারের বটবৃক্ষ। জীবন যুদ্ধে অক্লান্ত পরিশ্রম, সংসারে দুঃখ- কষ্ট, বিরহ-বেদনার সাথে লড়াই করে সংসারের ঘানি টানার নির্ভীক সাহসী লড়াকু যোদ্ধা, বিদ্রোহী বীর সৈনিক একমাত্র বাবা।
জীবনে যত কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণাই আসুক না কেন, সবার অগোচরে সেই কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণাকে মুখ বুজে সহ্য করে জীবন নামের তরীর হাল ধরে অকুল দরিয়ার মাঝে পাড়ি দেয় একমাত্র সংসারে সুখ-সাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনার জন্য। পরিবারের মানুষগুলোকে সুখী রাখার জন্য। নিজের জীবনের উপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেলেও তা পরিবারের সদস্যদের কাউকে একটুও বুঝতে দেয় না। যাতে করে পরিবারের সদস্যদের আগামীর অগ্রযাত্রায় কোনো ব্যঘাত ঘটে।
শাপলার বাবা আঃ রহিম সাহেবও তাদের মধ্যে ছিলেন একজন অন্যতম সৎ সাহসী নির্ভীক ব্যক্তি। তিনি আল্লাহ ছাড়া কাউকেই ভয় পেতেন না।
তার পরিবারে হাজারও ঝড়-ঝঞ্ঝা এসেছে, এসেছে জীবন নাশের মহাপ্লাবন! তিনি ঢালের মত তার নিজের পরিবারকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু পরিবারের কাউকে বুঝতেই দেননি যে, তার পরিবারে ঝড় এসেছিলো, এসেছিলো মহাপ্লাবন! তিনি একা একা ডুকরে ডুকরে কাঁদতেন। কিন্তু পরিবারে কেউ তা জানতো না, কাউকে বলতেন না। তার মনের ভেতরে কী জ্বালা-যন্ত্রণা! তিনি সব যন্ত্রণাগুলোকে হাসিমুখে সহ্য করে নিতেন, হৃদয়ের গহীনে কবর দিয়ে রাখতেন। পরিবারের সুখ-সাচ্ছন্দ্যের জন্য সবসময়ই হাসিমুখে থাকতেন।
তিনি এসব কথা কাউকে বলতেন না। কারণ, তিনি তার মনের মত বিশ্বস্ত লোক খুঁজে পেতেন না। তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন এবং খুব বিশ্বাস করতেন। আর আমিও তার ভালোবাসার সম্মান দিতাম, করতাম না বিশ্বাসের অমর্যাদা।
তিনি আমাকে প্রায়ই সময়ই বলতেন তার কষ্টের কথাগুলো,তার বিপদের কথাগুলো।
এই তো গত পরশুদিনও সকালেও ফজরের নামাজ পড়ে আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে গেলেন,
ঈমাম সাহেব! আমার মনে হয় আর বেশিদিন পৃথিবীতে আয়ু নাই। খুব শীঘ্রই হয়তোবা এ পৃথিবীর মায়া-মমতার বন্ধন ছিন্ন করে, আপন স্বজনদের ছেড়ে চলে যেতে হবে চিরতরে পরপারে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
আ: রহিম সাহেব! কী হয়েছে আপনার? আমাকে খুলে বলুন। এমন কথা বলছেন কেনো ?
তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন,
ঈমাম সাহেব! আপনাকে তো মাঝে মাঝেই বলতাম, আমার পেছনে শত্রু আছে, আছে মহাবিপদ!
আমি বললাম আঃ রহিম চাচা! আজকে আবার নতুন করে কী বিপদের সংকেত পেলেন?
তিনি বললেন, ঈমাম সাহেব! আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম, পাড়ার কিছু ধনাঢ্য বখাটে ছেলের দল এসে আমাকে অনেক সময় হুমকিধামকি দেয় শাপলার বিষয়ে। তাদের মধ্যে শীর্ষ নেতা ছিলো এমপি এরফান সাহেবের কুখ্যাত সন্ত্রাসী ছেলে কালু মাস্তান।
সে আমার মেয়ে শাপলাকে খুব পছন্দ করে। সে আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলো তার সাথে আমার মেয়ে শাপলার বিয়ে দিতে।
কিন্তু আপনি বলেন তো ঈমাম সাহেব!
যতই ধনাঢ্য ও অর্থশালী লোক হোক না কেনো, পৃথিবীর কোন্ বাবা এমন কুখ্যাত সন্ত্রাসী ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দেবে? কোন্ বাবা তার মেয়েকে জেনেশুনে কুখ্যাত সন্ত্রাসীর হাতে তুলে দেবে?
এমন কোনো নজির কি কখনো শুনেছেন বা দেখেছেন?
আমি বললাম, জি না চাচা, এটা কখনোই হতে পারে না। পৃথিবীর কোনো বাবাই এমনটা চায় না।
তিনি বললেন, সেই কালু মাস্তান আজকেও আমাকে হুমকি দিয়েছে ২৪ ঘন্টার মধ্যে শাপলার সাথে বিয়ের ব্যবস্থা না করলে আমার পরিবারের সবাইকে হত্যা করবে। কিন্তু আমি এখন কি করতে পারি বলেন?
আমি বললাম, চাচা! আপনি থানায় গিয়ে প্রশাসনের আশ্রয় নিন।
তিনি বললেন, এর আগেও কয়েকবার থানায় গিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো ফলাফল পাইনি। বরং উনারা বলেছেন, চাচা তার সাথে আপনার মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিন। সে খুব খারাপ ছেলে।
অর্থশালী, দলীয় ক্ষমতাসীন এমপি এরফান সাহেবের দুশ্চরিত্র সন্তান কালু মাস্তান। আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আপনি তার সাথে আপনার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেই আপনি /আপনারা নিরাপদে থাকবেন। এটাই সব থেকে ভালো হবে।
আমি বলেছিলাম, আমার জীবনে একবিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত আমি তার সাথে কখনোই আমার মেয়ের বিয়ে দেবো না।
যাইহোক ঈমাম সাহেব! আমি এখন গেলাম। আমাদের জন্য দোয়া করবেন মহান আল্লাহ তা’য়ালার সমীপে। আল্লাহ যেন আমাকে সমস্ত বিপদাপদ থেকে তার কুদরতি রহমতের দ্বারা রক্ষা করেন – আমিন।
হয় তো আপনাদের সাথে আর দেখা নাও হতে পারে। আমাকে মাফ করে দিয়েন। আল্লাহ হাফিজ।
জাবেদ চমকে উঠে বললো,
কী বলেন ঈমাম সাহেব!
তাহলে কি এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সাথে এমপি এরফান সাহেবের ছেলে কালু মাস্তানের হাত রয়েছে ?
ঈমাম সাহেবঃ জনাব! যেহেতু আমি নিজের চোখে তা দেখিনি, সেহেতু আমি নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। তবে হলে হতেও পারে। আর একটা কথা, আমি যে আপনাকে এসব কথা বললাম, তা কখনোই অন্য কারো কাছে জাহির করবেন না। এটা আপনার নিকট আমার অনুরোধ রইলো। তবে আমি যা বলেছি তা সত্য বলেছি, এতে এক তিল পরিমাণও মিথ্যা নাই।
জাবেদঃ ঈমাম সাহেব! আপনি কি কোর্টে সাক্ষী দিতে পারবেন যে, শাপলার বাবা আ: রহিম সাহেব আপনাকে এমন ঘটনা ঘটে যাওয়ার ভবিষ্যৎ বাণী বলে গেছেন ?
ঈমাম সাহেবঃ দেখুন জনাব, আমাকে এসবের মধ্যে না জড়ানোই সর্বাপেক্ষা উত্তম বলে মনে করছি।
জাবেদঃ তাহলে কি আপনি চান না? সত্যিকারের অপরাধীর সাজা হোক, হোক অপরাধ নির্মূল সমাজ থেকে।
ঈমান সাহেবঃ জি অবশ্যই আমরা চাই দেশ থেকে সমস্ত অপরাধ, অপকর্ম, দুর্নীতি বিনাশ হোক, হোক প্রতিষ্ঠিত সত্য ও ন্যায়-নীতি। ফিরে পাক সমাজ ও দেশ পাক তার সৎ স্বাধীনতা।
জাবেদঃ তাহলে আপনি ভয় করছেন কেন ঈমাম সাহেব? আপনার মত পরহেজগার, সত্যবাদী, ঈমানী বলের নির্ভীক, সৎ সাহসী, লড়াকু সৈনিকের একটা সক্ষীই পারে এমন কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের মাথায় পরাজয়ের মুকুট পরাতে। আপনি শুধু একটা সাক্ষী দেবেন, যা করার তা আমি / আমরা করবো ইনশাআল্লাহ।
আপনি জানেন না, এ এলাকায় আমার এক এডভোকেট বন্ধু আছে। সে আমেরিকা থেকে উকালতি পাশ করে কিছুদিন হলো দেশে ফিরে এসেছে। আপনি শুধু এ সত্যটা কোর্টে বলবেন। আর আপনি যদি এ বিষয়টা গোপন রেখে সাক্ষী না দেন, তাহলে তো আপনি দেশ, সমাজের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগনিত হবেন। মহান আল্লাহর কাছেও অপরাধী হয়ে যাবেন।
আপনার কি জানা নাই, কখনো পড়েন নাই?
আমরা সেই ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি,
“যে অন্যায় করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে”
অন্যায়কারী আর অন্যায় সহ্যকারী, দু’জনেই সমান অপরাধী। আর আপনি তো ভীতু না, কাপুরুষও না। আপনি একজন বীর পুরুষ। রাসুলের সৎ সাহসী বীর সৈনিক।
আমি উদ্যোগ নিয়েছি এর প্রতিশোধ নেবোই নেবো ইনশাআল্লাহ। তবে এখানে আপনার সহযোগিতা বাঞ্ছনীয়, আবশ্যক।
কারণ, এ হত্যা ষড়যন্ত্রের পেছনের মূল রহস্য উদঘাটনে একমাত্র আপনিই সহায়ক। যে তথ্য আপনি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি জানে না।
প্লিজ ঈমাম সাহেব প্লিজ! আপনি আমাকে / আমাদেরকে এ সত্য উদঘাটনে এবং দেশ ও সমাজ থেকে দুর্নীতি ও অন্যান্য অপকর্ম নির্মূলে সহযোগিতা করুন। এদের এহেন দুষ্কর্ম্মের সাজা না হলে অপরাধীরা আরও বেড়ে যাবে, আরও খুন, হত্যা, ধর্ষণ, অন্যায় ও অপকর্ম করার সাহস পাবে। এরা মানুষ না। এরা মানুষ নামের অমানুষ, চতুষ্পদ জন্তু। এদের মনটা খুব লোভাতুর। এদের হৃদয়ে অন্যের জন্য তিল পরিমাণ স্নেহ মায়া-মমতা, ভালোবাসা নাই। এরা বড়ই নিষ্ঠুর, নরপিশাচ! নিজের স্বার্থের জন্য এরা সব কিছু করতে পারে। এরা দেশ ও সমাজের কীট ! এদেরকে কীটনাশক ঔষধ প্রয়োগ করে বিনাশ করা আবশ্যক।
ঈমাম সাহেবঃ আপনার সব কথাই ঠিক আছে এবং আমি তা এক বাক্যে মেনে নিলাম। কিন্ত একটা কথা জানেন জনাব?
এদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলে আমার কী হবে?
ঠিক আ: রহিম সাহেবের মত আমাদেরকেও খুন হতে হবে, হতে হবে নরপিশাচদের হাতে বলিদান!
জাবেদঃ ঈমান সাহেব! জীবনটা কয়দিনের বলতে পারেন? এক সেকেন্ডের নাই ভরসা। এই যে আমি আপনার সাথে কথা বলছি, এ কথা বলার পর আমি আমার নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবো কিনা তার কোনো নিশ্চিতা আছে?
ঈমাম সাহেবঃ জি, কোনো নিশ্চয়তা নাই।
এখান থেকে বাড়ি যাওয়া তো দূরের কথা,
আপনার আমার সাথে যে কথোপকথন হচ্ছে এ কথোপকথন শেষ করতে পারবো কিনা তারই তো কোনো নিশ্চয়তা নাই।
জাবেদঃ তাহলে মানুষকে ভয় না করে আল্লাহকে ভয় করুন এবং সত্যটা তুলে ধরুন। আমি ইয়াকুব চাচার ছেলে আমার বন্ধু এডভোকেট মোঃ ইউসুফকে এ সমস্ত কথা খুলে বলবো এবং অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ। যাতে করে আর কোনো অপরাধীই দেশ- সমাজে এমন জঘন্য কাজ করার কখনো কোনদিন সাহস না পায়।
ঈমাম সাহেবঃ একদম ঠিক বলেছেন। আমি অন্যায়ের বিপক্ষে লড়াই করবো এবং সমাজে সবার সামনে তাদের মুখোশ খুলে দেবো ।
আমি এতদিন চুপ ছিলাম কারণ,
এর বিরুদ্ধে লড়াই করার মত আমার কোনো সহযোগী বন্ধু ছিলো না। তাই সব নীরবে সয়েছি। আজ আমি আপনার মত সৎ সাহসী লোক খুঁজে পেয়েছি ।
আমি কথা দিলাম আসল ষড়যন্ত্রকারীসহ তাদের সহযোগীদের সকলকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার জন্য যতটা সাহায্য করার প্রয়োজন, আমি যতটুকু জানি সবই কোর্টে পেশ করবো। আপনারা দ্রুত মামলা দায়ের করেন। আমিই এর সাক্ষী দেবো অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করার জন্য। কথা দিলাম।
জাবেদঃ আলহামদুলিল্লাহ। ঠিক আছে ঈমাম সাহেব। সবই হবে ইনশাআল্লাহ। শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাহলে আমি এখন আসি, আবার দেখা হবে। আল্লাহ হাফিজ।
ঈমাম সাহেবঃ আল্লাহ হাফিজ। আল্লাহ আপনাদের সৎ উদ্দেশ্য পূরণ করুন – আমিন।
জাবেদ ঈমাম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। রাত তখন ১২টা বেজে গেছে। ওদিকে তার বড় আপু শাবানা জাবেদের জন্য অপেক্ষা করছে। এত রাত হয়ে গেলো, জাবেদ কেন এতক্ষণও বাড়ি আসলো না? কোথায় গেলো? কী হয়েছে তার। চিন্তায় বিভোর। সে কখনো কোনদিন তার ছোট ভাই জাবেদকে ছাড়া খাওয়া দাওয়া করে নি। যেখানেই যাক, যখন আসে তখন দুই ভাই বোন মিলে একই টেবিলে বসে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে। এ ভাবতে ভাবতে আরও কিছু সময় কেটে গেলো। রাত বেজে গেলো১ টা।
জাবেদ দরজায় টোকা দিলে শাবানা বলে কে? এত রাতে দরজায় টোকা দিচ্ছে।
জাবেদ বললো আপু আমি জাবেদ দরজা খোলো।
শাবানা দ্রুত দরজা খুলে প্রাণের ছোট ভাই জাবেদকে বললো,
ভাই তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি ? তোর মুখটা মলিন কেনো? কী হয়েছে ভাই তোর, এতো রাত হলো কেনো বাড়ি ফিরতে?
জাবেদঃ আপু! মন ভালো নাই। কিছুই যেন ভালো লাগছে না।
শাবানাঃ কেনো, কী হয়েছে ভাই? আমাকে খুলে বল।
জাবেদঃ আপু! তুমি হয় তো চিনবে। আমাদের পাশের গ্রাম ইসলামপুরের শাপলা নামের একটা মেয়েকে। সে সমাজ সেবামূলক কার্যক্রমে লিপ্ত ছিলো। সবসময় গরিব দুখীদের বিপদাপদে ছুটে আসতো।
শাবানাঃ হ্যাঁ ভাই, ঠিক বলেছিস। সে তো কয়েকদিন আগেও আমাদের গ্রামে এসেছিলো। তার ব্যবহার, আচার-আচরণ খুবই ভালো। মেয়েটা দেখতেও অনেক সুন্দর।
জাবেদঃ আজকে তার বাবা ও মা দু’জনেই সন্ত্রাসীদের হামলায় শহিদ হয়ে গেছেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে শাপলা ও জিয়াদ কোনরকমে বেঁচে গেছে – আলহামদুলিল্লাহ।
আমিও জানতাম না। একজনের মুখে শুনলাম, তারপর ছুটে গেলাম ততক্ষণে তার বাবা মাকে দাফন করে সন্ধ্যার দিকে শাপলা ও তার ছোট ভাই জিয়াদ তার বড় আপুর সাথে শহরে চলে গেছে। আমি সেখানে গিয়ে কাউলে দেখতে পাইনি। তাদের বাড়ি ছিলো তালাবদ্ধ।
শাবানাঃ ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।
তারপর,,,,,
জাবেদঃ তারপর ভাবলাম আমার ছোটবেলার বন্ধু ইউসুফ এর সাথে দেখা করবো। তাদের বাড়ির দিকে যেতে যেতে এশার আযান হয়ে গেলো। তাই তার সাথে দেখা করা হয়নি রাত হয়েছে বলে। তার বাবা মা যদি কিছু বলে এ বিষয়ে। তাই তাদের বাড়ি না গিয়ে চলে গেলাম মসজিদে। সেখানে এশার নামাজ আদায় করে ঈমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি এ হত্যা সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা?
এসব বিষয়ে কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গেছে আপু। এ জন্য আমি দুঃখিত। আমাকে মাফ করো। নিশ্চয়ই তুমি খাওয়া দাওয়া করোনি। এসো আমরা আগে খেয়ে নিই, তারপর কথা বলবো।
শাবানাঃ ঠিক আছে ভাই, চল্ আগে খেয়ে নিই।
এক টেবিলে দু’ভাইবোন খেতে বসলে জাবেদের আর খাওয়া হয় না। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরে।
শাবান জিজ্ঞেস করলো, কি ভাই, তুই খাচ্ছিস না কেন? কাঁদছিস কেন ভাই? কী হয়েছে তোর? তারা তো আমাদের কোনো আত্মীয় না।
জাবেদ খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে তার ঘরে বিছানায় গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো। শাবান তার পিছু পিছু গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
কী হয়েছে ভাই? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু খুলে বল ভাই, প্লিজ।
জাবেদ তার বোনের গলা ধরে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো এই বলে,
আপুরে আপু! আমার কান্নার কারণ তুই বুঝবি না। শাপলার মনে কি যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা শাপলা ছাড়া আর কেউ জানে না !
শাবানাঃ পৃথিবীতে কেউ চিরদিন বেঁচে থাকে না। আর আল্লাহ নিজের দোষ দিয়েও তাঁর কোনো বান্দাকে নেন না। যে কোনো অজুহাতে তার বান্দাদেরকে নেন। শাপলার মনের অবস্থা তো খারাপ হবেই। এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মনেও তো কষ্ট লাগছে। কিন্তু তোর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
জাবেদঃ আপু! তুমি জানো না। আমিও জানি না। কেন শাপলার জন্য আমার মন কাঁদছে। তার বাবা মায়ের হত্যার বদলা নিতে প্রতিশোধের স্পৃহা মনে জাগছে। বাজছে রণাঙ্গনের দামামা।
শাবানাঃ মাথা থেকে এসব আজেবাজে বুদ্ধি মুছে ফেল ভাই। পৃথিবীতে তোর আর আমার আর কি কেউ আছে? তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারিস?
জাবেদঃ আপু! শাপলার কিছু হলেও যে আমি বাঁচবো না।
শাবানাঃ এমন কথা বলিস না ভাই, আমার মনে কষ্ট লাগে। তুই কি শাপলাকে পছন্দ করিস?
আমাকে বল কিছুদিন পর আমি নিজেই তোর সম্বন্ধ নিয়ে শহরে তার দুলাভাই এর বাড়ি যাবো।
জাবেদঃ সত্যি আমি তাকে অনেক পছন্দ করি আপু। আমি তাকে এই অল্পদিনের মধ্যে দুষ্টুমি করতে করতে তার কথাবার্তা শুনে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। সে আমাকে খারাপ পথ থেকে ভালো পথে নিয়ে এসেছে। আমার মাঝে যেন আমি নাই, আমি তার মাঝেই হারিয়ে গেছি।
আপু! তুমি আমার জন্য দোয়া করো, আমি যেন তাকে এ বাড়িতে চিরদিনের জন্য লাল বেনারসি পরিয়ে আনতে পারি।
শাবানাঃ ঠিক আছে ভাই, এখন খেয়ে নে। আমি এক সময় নিজেই তাদের বাড়ি যাবো শুধু তোর জন্য।
জাবেদঃ আপু! এখন না। আগে তার বাবা মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে নিই। আমি তার বাবা মায়ের হত্যাকারীর সন্ধান পেয়েছি। আমার প্রথম কাজ হবে তার বাবা মা’র হত্যাকারীকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে সমাজ তথা এ পৃথিবী থেকে অপসারণ করা।
চিরতরে নির্মূল করা। যাতে আর কেউ কখনো ভবিষ্যতে এমন জঘন্যতম কাজ করার সাহস না পায়।
শাবানাঃ কী সন্ধান পেয়েছিস ভাই ?
তার বাবা মা’র হত্যাকারী কে বা কারা ?
জাবেদঃ ঈমাম সাহেবের মুখে করুণ বর্ণনা শুনেই বুঝতে পারলাম তার বাবা মায়ের হত্যাকরী দলীয় ক্ষমতাসীন এমপি এরফান সাহেবের কুখ্যাত সন্ত্রাসী ছেলে কালু মাস্তান।
শাবানাঃ না ভাই, এ কাজে তুই যেতে পারবি না। আমি তোকো কিছুতেই যেতে দেবো না। ওরা খুবই ভয়ংকর, অর্থশালী, ধনাঢ্য ও শক্তিশালী ব্যক্তি। ওদের সাথে লড়াই করার মত তোর আমার সাহস নাই। এর পরিণাম খুবই ভয়াবহ! এ খবর জানতে পারলে ওরা তোকে বাঁচতে দেবে না ভাই।
জাবেদঃ না আপু, তুমি আমাকে বাধা দিও না।
মরতে হলে বাঘের মত গর্জন দিয়েই মরবো। কাপুরুষের মত লেজ গুটিয়ে না। সকাল হলেই আমি আমার বন্ধু এডভোকেট ইউসুফ এর কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলবো এবং এর রহস্য উদঘাটন করে অপরাধীদের ফাঁসির মঞ্চে ঝুলাবো। এ আমার বদ্ধপরিকর। তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করবে আপু, শুধু দোয়া করবে। নিশ্চয়ই আমিই জয়ী হবো। পরাজিত হবে শত্রুসেনার দল।
শাবানাঃ ঠিক আছে ভাই, আমি তোর জন্য সবসময়ই দোয়া করি, তুই যেন তোর এহেন চমক উদ্যোগী কর্মে সফলতা লাভ করিস এ দোয়াই মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট রইলো।
ভাই! তুই এখন ঘুমিয়ে যা। অনেক রাত হলো
কখনো দুশ্চিন্তা করবি না। মনে রাখিস আল্লাহ যা করেন, তা মঙ্গলের জন্যই করেন। এতে তোর মঙ্গল না হলেও তোর কাজের দ্বারা যার মঙ্গল হবে চিরদিন অম্লান রয়ে যাবি তার কাছে। আর এটাই হবে তোর জীবনের সেই মঙ্গলজনক কাজের ফলাফল, অবিস্মরণীয়, চিরস্থায়ী।
জাবেদঃ ঠিক আছে আপু, যাও, তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। এরপর তার আপু শাবানা তার ঘরে চলে গেলো। জাবেদও ঘুমিয়ে পড়লো।
জাবেদ ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখে,
শাপলা তার কাছে ফুলের তোড়া নিয়ে উপস্থিত।
শাপলা বলে জাবেদ! তোমার জন্য একটা উপঢৌকন নিয়ে এসেছি।
জাবেদ (মনে মনে খুব আপ্লূত ও অভিভূত!
হে আল্লাহ! এ কী দেখছি আমি, সত্যি, না স্বপ্ন?)
সে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে শাপলার দিকে।
শাপলা বলে জাবেদ! তোমার জন্য কি উপঢৌকন নিয়ে এসেছে জানো?
জাবেদঃ জি না, আমি তো তা জানি না। কী নিয়ে এসেছেন আমার জন্য?
শাপলাঃ পাগল নাকি? দেখতে পাচ্ছো না, কী নিয়ে এসেছি?
জাবেদঃ জি, দেখতে পাচ্ছি যে, আপনি আপনার হাতে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছেন।
শাপলাঃ হ্যাঁ এ দিয়ে কী হয় জানো জাবেদ?
জাবেদঃ জি না, তা তো জানি না।
শাপলাঃ আমি তোমাকে এ ফুলের তোড়ার দ্বারা শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি। তোমার সে দিনের দুষ্টুমিতে আমি সত্যি সত্যি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি জাবেদ, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
আই লাভ ইউ মাই জান কলিজা
ছুমন্তর ছু জাবেদের মনটা গলে যা।
এই নাও একগুচ্ছ লাল গোলাপের শুভেচ্ছা,
জনম জনম রয়ে যাক তোমার আমার প্রেমের কেচ্ছা।
জাবেদ ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে বললো,
আপনি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন?
শাপলাঃ ধুর বোকা ছেলে, ভালো না বাসলে কি আর এমনি এমনি তুমি করে সম্বোধন করছি?
জাবেদঃ এ কী বলছেন! আমি বোকা! আমি কি সত্যি বোকা?
শাপলাঃ (মিষ্টি হাসি দিয়ে )ইয়েস, হ্যাঁ, তুমি সত্যি একটা বোকা ছেলে, উম্মাদ ছেলে। যে কিছুই বুঝে না। সে পাগলের থেকেও পাগল।
তা না হলে সেই কখন থেকে আমি তোমাকে তুমি বলে ডাকছি। আর তুমি আমাকে আপনি আপনি আপনি আপনি করেই যাচ্ছেন। এটা কি পাগলের প্রলাপ নয়?
জাবেদঃ জি, মানে ঠিকই বলেছেন। আমি আসলে মেয়েদেরকে দেখলে খুব লজ্জা পায়। আমি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি না তাদের সামনে।
শাপলাঃ (মনে মনে হেসে জোর গলায়)
চুপ বেআক্কেল, একদম চুপ। আবার বলে আপনি?
জাবেদঃ ধিড়কে উঠে, মানে চমকে উঠে আমতা আমতা করে বলে,
জি, মানে হ্যাঁ, মানে আপনি, মানে আপনি।
শাপলাঃ জি, মানে হ্যাঁ, মানে আপনি।
আপনি কী? ননসেন্স কোথাকার ?
বলো তুমি, তুমি শুধু তুমি।
জাবেদঃ জি আচ্ছা। তুমি, শুধু তুমি।
জানো শাপলা? আমি প্রথম দিন দেখেই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। হৃদয়ের মণিকোঠে ঠাঁই দিয়েছি। কিন্তু কখনো প্রকাশ করতে পারিনি। তুমি যে আমার কাছে আসবে, আমায় ভালোবাসবে; আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। আমার কাছে মনে হচ্ছে পূর্বের সূর্য পশ্চিমে গেছে। নদীর জল উজানে বইছে। সত্যি আমি পাগল হয়ে গেছি তোমাকে দেখে। হারিয়ে ফেলেছি আমার মুখের ভাষা, লুকিয়ে গেছে না বলা কথা। আমি আর আমার মাঝে নাই, তোমাতে হয়ে গেছি বিভোর।
শাপলাঃ সত্যি তাই? এসো আমার বুকে এসো। আমাকে জড়িয়ে ধরো। হারিয়ে যাও আমার মাঝে, আকাশের নীলিমায় সাগরের মোহনায়।
জাবেদ আর নিজে ধরে রাখতে পারলো না। শাপলার প্রেমে বিভোর হয়ে আহ্লাদিত চিত্তে গেয়ে উঠলোঃ-
জাবেদঃ
এ জগতে চাওয়া পাওয়ার আর কিছু নাই
শাপলা তোমাকে পেয়ে দিলাম হৃদে ঠাঁই।।
এসো এসো কাছে প্রিয়া ধরো দু’টি হাত
এভাবেই কেটে যাক আজ সারারাত।।
তুমি আশা ভালোবাসা হৃদ মোহনায়
শাপলা তোমাকে পেয়ে দিলাম হৃদে ঠাঁই।
শাপলাঃ
ভাবিনি তোমাকে পাবো আঁকিনি ছবি!
আঁধারের আলো তুমি সোনালী রবি,
আমার জীবন নদে সুখের ভেলা
রাত জেগে কবিতার রচিত কবি।
এ ভুবনে চাওয়া পাওয়ার আর কিছু নাই,
বারেবারে মন শুধু তোমাকেই চায়। ঐ
জাবেদঃ
কত আশা সাধ জাগে আমার এ হিয়ে
রাঙা বধূ সেজে তুমি আসবে প্রিয়ে,
আজ সেই সাধ আশা হলো যে পূরণ
কবুল কবুল বলে করবো বিয়ে।।
অতৃপ্ত মন সুখ পেলো দুনিয়ায়
শাপলা তোমাকে পেয়ে দিলাম হৃদে ঠাঁই। ঐ
শাপলাঃ
সুখে-দুখে থেকো পাশে যুগ যুগ ধরে
ভালোবেসে প্রেমাদরে রেখো বাহুডোরে,
পৃথিবীর কোলাহল যাবে সব থেমে
তোমার আমার এই পাগলামি ঘোরে।।
বর কনে একসাথে রবো দু’জনায়
নিশি রাতে রাত জাগা চাঁদের ছোয়ায়।
হে প্রিয় তোমাকে পেয়ে দিলাম হৃদে ঠাঁই। ঐ
তাদের কথোপকথন শেষের মূহুর্তে কারা একদল গুণ্ডা এসে তাদেরকে আক্রমণ করলো। জাবেদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। শাপলাকে তারা জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শাপলা চিৎকার দিয়ে বলছে,
বাঁচাও জাবেদ বাঁচাও। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। তুমি আমার জীবন, তুমি আমার মরণ। তুমি আমার শত জনমের সাধনা।
জাবেদ তখন তাদের পিছু পিছু ধাওয়া করলো। দৌড়ে তাদের ধরতে পারলো না। তারা শাপলাকে নিয়ে এক হলরুমে ঢুকে পড়লো। জাবেদ হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে গিয়ে লাথি মেরে হলরুমের দরজা ভেঙে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে হলরুমের ভেতরে শাপলা তাদেরকে কাকুতি মিনতি করে বলছে আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে যেতে দিন জাবেদের কাছে। দোয়াই লাগে আপনাদের। আমাকে সর্বনাশ করবেন না। আমার ইচ্ছাকে ধর্ষণ করবেন না। আপনাদেরও তো মা বোন আছে। মনে করেন আমিও আপনাদের মায়ের উদরে জন্মানো এক বোন।
তাদের মধ্যে দলনেতা অট্টহাসি দিয়ে বলে,
হাহাহাহা —— হাহাহাহ। সবাই যদি মা বোন হবে, তবে ঘরের বৌ হবে কে লক্ষ্মী সোনা পাখি।
শাপলাঃ ভাইয়া! ঘরের বৌকেও তো কেউ সবার সামনে এভাবে বে-ইজ্জত করে না।
প্লিজ আপনি আমাকে ছেড়ে দিন। আমাকে যেতে দিন।
গুণ্ডাদের দলনেতাঃ হাহাহাহা, তোমাকে তো ছেড়ে দেবোই কিন্তু তার আগে আমাদের মনস্কামনা পূরণ করেই ছাড়বো সুন্দরী। হাহাহাহাহাহা।
চলো, সবার সামনে না, আমার অন্দরমহলে চলো সোনা পাখি।
এবার জাবেদঃ (দরজার সামনে থেকে চিৎকার দিয়ে) ঐ শয়তানের বাচ্চা শয়তান! জীবনে যদি বাঁচতে চাস, তবে শাপলাকে এক্ষুনি ছেড়ে দে। নইলে তোদের সবাইকে একে একে জ্যান্ত এখানেই মাটিতে পিষে মাটিতেই গেঁড়ে দেবো। এমন সময় গুণ্ডারা শাপলার দিকে একটু বেখেয়াল ছিলো। শাপলা দৌড় দিয়ে জাবেদের বুকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক তখনই গুণ্ডাদের দলনেতা জাবেদকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লো এবং সে গুলি শাপলার গায়ে লাগলো। শাপলা ও জাবেদ উল্টে হলরুমের বাইরে রাস্তায় পড়ে গেলো। শাপলা রক্তাক্ত হয়ে জাবেদের কোলে ঢলে পড়লো। জাবেদের দেহও রক্তাক্ত হয়ে গেছে। এমন সময় রাস্তার ধারে পুলিশের গাড়ির শব্দ ও বাঁশির আওয়াজ শুনা যায়। গুণ্ডারা ভাবলো পুলিশ টের পেয়ে তাদেরকে ধরতে আসছে। তাই তারা পুলিশের ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো।
জাবেদ শাপলাকে নিয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। শাপলা, শাপলা বলে চিৎকার করে বললো,
শাপলা! কথা বলো, কথা বলছো না কেন? তোমার কিছুই হয়নি।
শাপলা! তুমি একবার চোখ খোলো।
জাবেদ তাকে কোলে করে মেডিকেল নিয়ে যেতে যেতেই রাস্তার মাঝেই শাপলা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
জাবেদ খুব জোরে চিৎকার দিয়ে বললো শাপলা!
ঠিক এমন সময় জাবেদের ঘুম ভেঙে যায়।
তার ঘুমের ঘোরে বিকট চিৎকারে তার বড় আপু শাবানারও ঘুম ভেঙে যায়।
শাবানা তার ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে এসে জাবেদকে বলে,
কী হয়েছে ভাই, বল তোর কী হয়েছে? তুই এতো রাতে শাপলা বলে চিৎকার দিলি কেনো ভাই?
জাবেদঃ আপু! আজ স্বপ্নে দেখলাম শাপলা আর নাই। আমার সামনে গুণ্ডাদের সর্দারের বুলেটের আঘাতে আমারই কোলে ঢলে পড়ে শাপলার তরতাজা দেহটা নিথর অবশ হয়ে পড়ে রইলো!
আপু! শাপলার জীবনেও অনেক শত্রু আছে। ওরা ওকে বাঁচতে দেবে না।
শাবানাঃ দুশ্চিন্তা করিস না ভাই। স্বপ্নের কথা সব সময় সত্য হয়, কে বলেছে তোকে?
জাবেদঃ সেই আদিকাল থেকেই মা দাদির মুখে শুনে আসছি আপু, ভোর বেলার স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়?
শোনো ঐ মিনারে মুয়াজ্জিনে ফজরের আযান দিচ্ছে।
আপু! আমি আজ শাপলার সাথে দেখা করতে যাবো।
শাবানাঃ সে নাকি এখানে নাই, তার দুলাভাই এর বাড়িতে আছে তার ছোট ভাই জিয়াদসহ?
তুই কি তার দুলাভাই ঠিকানা চিনিস ?
জাবেদঃ না আপু, আমি চিনি না। তবে আমার বন্ধু এডভোকেট ইউসুফকে সাথে করে যাবো।
ফজরের আযান হলো। এখন যাই মসজিদে নামাজ পড়ে তার বাবার কবর জিয়ারত করে আসি।
শাবানাঃ ঠিক আছে ভাই, যা নামাজ পড়ে আয়।
ফজরের নামাজ পড়ে সকাল বেলা জাবেদ শাপলার বাবার কবর জিয়ারত করে ইউসুফ এর সাথে দেখা করার জন্য তাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
পথিমধ্যে এমপি এরফান সাহেবের ছেলে কালু মাস্তান তার দলবল নিয়ে জাবেদকে রাস্তায় ঘেরাও করে বললো,
এই! দাঁড়া। কোথায় যাস? গত রাতে তুই নাকি ঈমাম সাহবের সাথে রাত ১২টা পর্যন্ত আলাপ করছিলি, কী আলাপ করছিলি বল?
জাবেদঃ এমনি হাদিস কোরআন সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম ঈমাম সাহেবের সাথে।
কালু মাস্তানের এক সহযোগী রাসেল বললো,
না ওস্তাদ, আমি তাদের কথোপকথন শুনছিলাম মসজিদের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, তারা শাপলার মা বাবা হত্যাককারীদের সনাক্ত করার বিষয়ে কথাবার্তা বলছিলো।
কালু মাস্তানঃ এই জাবেদ শোন! জীবনের যদি মায়া থাকে, যদি পৃথিবীর আলো বাতাসে মুক্তভাবে ঘুরতে চাস, তবে এখানেই ফুলস্টপ দিয়ে দে। সামনের দিকে আর এগুস না। নইলে শাপলার বাবা মা’র মতই তোর পরিবারেরও অবস্থা একই রকম হবে। আর ঈমাম সাহেবকে দেখছি, সে কত বাড় বেড়েছে?
শুনেছি বাড়িতে তো তোর মা বাবা কেউ নাই, আছে শুধু একটা বড় বোন। আর তার কাছেই তুই লালি-পালিত হয়েছিস। তোর বড় বোন নাকি খুব সুন্দরী? বুঝতে পারছিস কী অবস্থা হতে পারে?
যা শুনেছিস এক্কেবারে মুখে টেপ মেরে দে। নইলে তো বুঝতেই পারছিস। বাকিটা আর বললাম না। যা, কোথায় যাবি যা ?
ঐ! তোরা ওকে ছেড়ে দে।
জাবেদ নীরব হয়ে সব সহ্য করে ইউসুফ এর বাড়ির দিকে রওনা দিলো। বাড়ির দরজার টোকা দিতে যাবে ঠিক এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে কথার শব্দ শুনতে পেয়ে জাবেদ সেখানেই থমকে দাঁড়ায়।
ইউসুফ তার মাকে বলছে,
মা আজকে তোমাদের কাজ না থাকলে চলো শাপলার দুলাভাই এর বাড়ি যাই।
ইউসুফ এর বাবা ইয়াকুব বললো,
এতো সকাল সকাল! কেন বাবা?
ইউসুফঃ (মাথা নিচু করে) বাবা! তোমাদেরকে আমার একটা কথা বলা-ই হয়নি।
ইয়াকুবঃ কী কথা বাবা?
ইউসুফ চুপ, কিছু বলে না। তার আম্মা বললো,
জানো না? আমাদের ইউসুফ তো অনেক বড় হয়ে গেছে। তার একটা শুভ কাজ বাকি আছে না?
ইউসুফ ছোট বেলা থেকেই তাকে (শাপলাকে) অনেক পছন্দ করে। এখন তার বাবা মাও নাই। মেয়েটা একেবারেই এতিম হয়ে গেছে। আর আমিও চাই ছেলের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে।
ইউসুফঃ জি বাবা, মা ঠিকই বলেছে। আমরা সবাই মিলে এখন সেখানেই যাবো। তাকে দেখে আসাও হবে, আমাদের কথাবার্তাও বলা হবে।
এমন সময় জাবেদ সালাম দিয়ে বললো,
কেউ আছেন বাড়িতে?
ইউসুফ দরজা খুলে জাবেদকে দেখে বললো,
আরে দোস্ত! এত সকাল সকাল আমাদের বাড়িতে? কেনো, কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?
জাবেদ সেখানে শাপলার বিষয়ে কোনো কথা না বলে বললো,
দোস্ত! তোর সাথে অনেক কথা আছে।
ইউসুফঃ বল দোস্ত, কী কথা আছে? আমরা একটু শহরে যাবো মা বাবাসহ।
জাবেদের মন খুব খারাপ। মুখটা মলিন হয়ে আছে। ওদিকে শাপলার বাবা মায়ের খুনীদের আতঙ্কের ভয়, আবার এদিকেও শাপলাকে না পাওয়ার ভয়। সে কী বলবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না।
শেষমেশ বললো,
দোস্ত! এখানে বলা যাবে না। চল ঘরের ভেতরে যাই। তারা দুজনেই ইউসুফের ঘরে চলে গেলো এবং জাবেদ শাপলার মা বাবা হত্যাকারীর বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিলো। তাকে রাস্তায় আক্রমণ করেছিলো কালু মাস্তান, সেটাও বললো।
ইউসুফের মন বেজায় খারাপ। সে নিজেকে আর স্থীর রাখতল পারছে না। সে মনস্থির করলো এখনই শহরে যাবে এবং শাপলাকে বাদী করে শাপলার বাবা মা হত্যাকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি কোর্টে মামলা দায়ের করবে।
জাবেদ বললো দোস্ত! আমাকে তোর সাথে নিয়ে যাবি?
ইউসুফঃ হ্যাঁ, তুই গেলে অবশ্যই নিয়ে যাবো।
ইউসুফও তার বাবা মাকে এসব খুলে বললো এবং তারা চারজন মিলে শহরের দিকে রওনা দিলো শাপলার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে।
এদিকে কালু মাস্তানের সহযোগী রাসেল তা দেখলো এবং দৌড়তে দৌড়তে কালু মাস্তানের কাছে হাজির হয়ে বললো।
ওস্তাদ! জাবেদ, এডভোকেট ইউসুফ ও তার বাবা মা সহ কোথায় যেন গেলো?
কালু মাস্তানঃ কোথায় গেলো জানিস?
আর একজন বললো,
ওস্তাদ! মনে বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেছে।
আমাদের বুঝি আর নিস্তার নাই। আমরা মনে হয় ধরা পড়েই যাবো।
কালু মাস্তানঃ আরে রাখ, আমার উপর দিয়ে এ এলাকায় কেউ আর আছে? এমন তেমন হলে শাপলার বাবা মা’র মতই ক্রস ফয়ারে কেল্লা খতম করে দেবো।
ওরা জানে না, আমার হাত কতটা লম্বা? থানা পুলিশ আমার কিছুই করতে পারবে না৷
তার বাবা মা আমার কথায় রাজি না হওয়ায় এমন করুণদশা হয়েছে! কত বললাম, মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দেন, শালা শুনলোই না।
সহযোগী রাসেলঃ আরে ওস্তাদ! আপনার না হবু শ্বশুর? হবু শ্বশুরকে কেউ শালা বলে?
কালু মাস্তানঃ (ধমক দিয়ে) চুপ কর বেয়াদ!
ওস্তাদের মুখের উপর কেউ এমন কথা বলে?
তোর সাহস তো কম না !
সহযোগী রাসেলঃ ওস্তাদ! এভাবে কাজ হবে না। চলুন শাপলাকে উঠিয়ে নিয়ে আসি।
কালু মাস্তানঃ কিন্তু সে তো এখানে নাই।
রাসেলঃ চলুন, শহর থেকেই উঠিয়ে নিয়ে আসবো।
কালু মাস্তানঃ না, এতো ধৈর্যহারা হলে চলবে ন। ধীরে ধীরে কাজ করতে হবে।
রাসেলঃ ওস্তাদ! তার আগে যদি শহরে অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে যায়।
কালু মাস্তানঃ চুপ রাস্কেল! ওর দিকে যে হাত বাড়াবে, তার হাতকে গুঁড়ো করে ফেলবো।
সে শুধু আমার।
আর ক’দিন পরেই তো তার বাবার চল্লিশা হবে। সে সময় তারা সবাই এখানে আসবে। তখন ফাইনাল ব্যবস্থা করবো। আর ক’টাদিন ধৈর্য ধর। তারপর খেলা দেখিস।
রাসেলঃ ওস্তাদ! আমার মনে হয় তার বাবা মাকে হত্যা করা আমাদের ঠিক হয়নি।
কালু মাস্তানঃ এই! পিস্তল দেখছোস, পিস্তল। পিস্তলের গুলি একদম মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে দেবো। খুব বেশিই বুঝোস না?
রাসেলঃ সরি ওস্তাদ, সরি। আর কোনো কথাই বলবো না। এই মুখে টেপ মেরে দিলাম।
অন্যদিকে এডভোকেট ইউসুফ শাপলাদের শহরের বাসায় পৌঁছে গেছে। ইউসুফ শাপলাকে ডেকে বললো,
শাপলা! তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো।
শাপলাঃ জি বলুন, কী বলতে চান?
ইউসুফঃ তোমার বাবা মায়ের হত্যার পেছনে কে বা কারা জড়িত বলতে পারো?
শাপলাঃ আসলে আমি এ সবের কিছুই জানি না। কখনো মা বাবাও বলে নাই, আমাদের কোনো শত্রু আছে কিনা? তবে বাবা সবচেয়ে বেশি কথা বলতেন আমাদের মসজিদের ঈমাম সাহেবের সাথে। তিনি বলতেন তার বিশ্বস্ত লোক নাই বললেই চলে। তবে ঈমাম সাহেবকে তিনি খুব বিশ্বাস করতেন এবং সমস্ত সুখ-দুঃখের কথা তার সাথেই আলোচনা করতেন, তাকেই বলতেন।
ইউসুফঃ আচ্ছা, তোমাকে কি কেউ উত্যক্ত করতো রাস্তা ঘাটে বা কেউ কি কখনো কোনো কুপ্রস্তাব দিয়েছিলো ?
শাপলাঃ (একটু মুচকি হেসে) এ সব কি বলছেন? আমাকে কয়েটা ছেলে উত্যক্ত করতো, তার মধ্যে আপনার সামনেই একজন দাঁড়িয়ে আছে।
ইউসুফঃ আমার সামনে মানে, কই কে আমার সামনে? আমি তো এখানে জাবেদ ছাড়া কাউকে দেখছি না।
শাপলাঃ উনারা কয়েকজন বন্ধু মিলেই আমাকে একদিন রাস্তার মাঝে বিরক্ত করেছিলো। আমি তাদেরকে উচিৎ জবাব দিয়েছিলাম।
ইউসুফঃ আমি কিন্তু উনার কথা বলছি না। আমি এ রহস্যটা খুঁজছি তোমার বাবা মা’র হত্যাকারীকে সনাক্ত করার জন্য।
শাপলাঃ জি না, আমাকে কেউ কখনো সেভাবে জ্বালতন করেনি। জি, মনে পড়েছে।
ইউসুফঃ কী মনে পড়েছে শাপলা!
তাড়াতাড়ি বলো, কী মনে পড়েছে তোমার?
শাপলাঃ আমাদের এমপি সাহেবের ছেলে কালু মাস্তান আমাকে বলেছিলো সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।
ইউসুফঃ তারপর,,,,
শাপলাঃ আমি বলেছিলাম, আমি কখনোই আপনার মত একটা গুণ্ডাকে বিয়ে করতে পারবো না। সে বলেছিলো, যদি তোমার বাবা মা আমার সাথে তোমার বিয়ে দেয়?
আমি উত্তরে বলেছিলাম,
আমার বাবা মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ আমার শুভাকাঙ্ক্ষী নাই। তাই আমার বাবা মা যা করবে, তা আমার ভালোর জন্যই করবে। আর আমি বাবা মা’র ইচ্ছাকে সাচ্ছন্দ্যে স্বাগত জানাবো।
ইউসুফঃ বুঝতে পেরেছি।
আর সে জন্যই সম্ভবত তোমার বাবা মা তার প্রস্তাবে অসম্মতি জানালে তাদের মনে অসৎ বিদ্রোহী ক্ষোভ ওঠে এবং তাদের হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আর তা করেও ফেলে, যা কেউ জানে না।
আচ্ছা ঠিক আছে শাপলা। এখন চলো কোর্টে গিয়ে মামলা করে আসি।
শাপলাঃ কিসের মামলা, কার নামে মামলা? আমি তো কিছুই বুঝলাম না।
জাবেদঃ এমপি এরফান সাহেবের ছেলে কালু মাস্তানের নামে। তারাই তোমার বাবা মাকে হত্যা করেছে।
ওহ সরি শাপলা! আপনাকে মনের আবেগে তুমি বলে ফেললাম।
শাপলাঃ না, না কোনো সমস্যা নাই। তাছাড়া তো আমরা প্রায় একই সমবয়সী।
এমন সময় ইউসুফের বাবা মা এবং শাপলার দুলাভাই ও আপু অন্য রুম থেকে তাদের কাছে আসলো।
ইউসুফের আম্মা বললো,
ইউসুফ! তোমাদের কথাবার্তা শেষ হয়েছে? আমাদের কথাবার্তা ফাইনাল।
ইউসুফঃ ফাইনাল মানে ?
তার বাবা আব্দুর রহিমঃ ফাইনাল মানে আমরা ইতিমধ্যেই শাপলা মা-মণি ও তোমার শুভ কাজের কথাবার্তা পাকা করে ফেললাম। তার বাবা মায়ের চল্লিশার পরেই তোমাদের শুভ কাজটা সম্পূর্ণ করবো ইনশাআল্লাহ।
এ কথা শুনে জাবেদর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আর ইউসুফ বললো,
বাবা! আগে চলো শাপলার মা বাবার হত্যাকারীকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলাই, তারপর কোনো কথা।
তারা শাপলাকে সাথে নিয়ে গিয়ে কোর্টে কালু মাস্তানের বিরুদ্ধে শাপলার বাবা মা’র হত্যা মামলা করে বাড়ির দিকে রওনা দিবে ঠিক এমন সময় জাবেদ ইউসুফকে বললো,
ইউসুফ! আমি শাপলার সাথে কিছু কথা বলবো।
ইউসুফঃ ঠিক আছে বল, কী কথা বলবি ?
জাবেদঃ (মলিন বদনে, কান্নাভিজা কণ্ঠে)
শাপলা! একটু ঐ দিকে চলো না প্লিজ। আমি তোমাকে কিছু কথা বলবো।
শাপলা: ঠিক আছে, চলুন।
জাবেদঃ (চোখের পানি ফেলতে পেলতে)
শাপলা! আমি সেদিনের আচরণে সত্যি অত্যন্ত দুঃখিত ও অনুতপ্ত। আমাকে মাফ করে দাও।
শাপলাঃ এ জন্য আপনি কাঁদছেন কেন?
আমি তো সেদিনই আপনাদের সবাইকে মাফ করে দিয়েছি এই জন্য যে, আপনারা আপনাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন।
জাবেদঃ ঠিক আছে শাপলা, আমি স্বস্তি পেলাম যে, তুমি আমার উপর রাগ করোনি।
শাপলা! আর একটা কথা বলবো? তুমি অভয় দিলে বলতে পারি।
শাপলাঃ ঠিক আছে বলেন।
জাবেদঃ তুমি কি ইউসুফকে ভালোবাসো, মানে পছন্দ করো। না অন্য কাউকে পছন্দ করো ?
শাপলাঃ ইউসুফ আমাকে ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করে। তবে আমাকে আজ পর্যন্ত কিছুই বলেনি।
জাবেদঃ তুমি কি তাকে পছন্দ করো?
শাপলাঃ জি, আমিও তাকে পছন্দ করি। তারপরও আমাদের পরিবারেরও সম্মতি ছিলো।
জাবেদঃ আচ্ছা শাপলা! এখন যদি তুমি জানতে পারো যে তোমাকে অন্য একজন ইউসুফের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, তখন তুমি কী করবা?
শাপলাঃ আসলে দেখুন, এ বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না৷ তবে যেখানে আমার বাবা মা’র সম্মতি ছিলো, তাদেরও সম্মতি আছে। আর আমিও তাকে পছন্দ করি, সে-ও আমাকে খুব পছন্দ করে। আমি এর বাইরে কোনো কাজ করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী নই।
যাইহোক, আপনি কাঁদছেন কেন?
জাবেদঃ তোমাকে কথাটা না বলতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাবো না শাপলা!
আমি মরেও শান্তি পাবো না।
শাপলাঃ কী কথা বলেন ?
জাবেদঃ শাপলা! যেদিন তুমি আমাকে ভুল পথ থেকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছো। আমাকে ভালো পথে ফিরিয়ে এনেছো,
বিশ্বাস করো, সেদিনই আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তোমাকে আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।
আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না শাপলা!
আমি এখন কী করবো?
তুমিই বলে দাও।
শাপলাঃ আমার এখন কী করার আছে বলেন?
আমার দুঃখের কপাল। যখন যেদিকে যাই, তখন সেদিকেই দুঃখের ঢেউ বয়। আসে সর্বনাশা সাইক্লোন, ঝড়, তুফান। এসে আমার জীবনকে তছনছ করে দেয়।
আসে বিপদের উপর বিপদ!
অনুগ্রহ করে আমাকে মাফ করবেন, আমাকে মাফ করবেন। আমি আপনার জন্য দোয়া করি, আপনি জীবনে সুখী হন।
চলুন ঐদিকে উনারা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
জাবেদঃ এটাই কী তোমার ফাইনাল কথা?
শাপলাঃ জি, এটাই আমার ফাইনাল কথা। আমাকে নিয়েও তার অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা।
আমি তার মনের মাঝে লালন করা স্বপ্ন, আশাগুলো কীভাবে ভাঙি বলেন?
আপনি যদি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন, তবে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসার বাঁধেন। তার মাঝেই আমাকে খুঁজে পাবেন। এটা আমার আকুল অনুরোধ রইলো আপনার প্রতি।
এমন সময় ইউসুফ জাবেদ বলে ডাক দেয়,
জাবেদ! তোদের কথা বলা হলো। চল যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
জাবেদঃ আসছি একটু দাঁড়া বলে দুজনই তাদের কাছে উপস্থিত হলো এবং বললো,
চল, আমরা এখন রওনা দেই।
ইউসুফঃ তোদের কথা শেষ হলো?
জাবেদঃ হ্যাঁ শেষ হয়েছে বন্ধু, চল যাই।
ইউসুফ, তার মা বাবা ও জাবেদ তাদের কাছে, (শাপলাদের কাছে) বিদায় নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিলো। শাপলারা তাদের বাসায় ফিরে গেলো।
জাবেদঃ বাড়িতে এসেই তার আপু শাবানাকে বললো,
আপু! গেছিলাম শাপলাদের বাসায় ইউসুফ ও তার বাবা মা সহ। সেখানে শাপলাকে সাথে নিয়ে শয়তানটার বিরুদ্ধে মামলা করে আসলাম।
কিন্তু আপু, আমার জন্য একটা খুব কষ্টের খবর আছে। আমি মনে হয় পৃথিবীতে আর বেশিদিন বাঁচবো না।
শাবানাঃ কেন, কী হয়েছে ভাই? এমন কুলক্ষণে কথা বলতে নাই। তোর কিছু হলে আমি কী নিয়ে বাঁচবো বল। তুই ছাড়া যে আমার পৃথিবীতে আর কেউ নাই ভাই !
জাবেদঃ আমি জানতে পারলাম শাপলার সাথে ইউসুফের বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল।
আমি শাপলার সাথে কথা বলেছি। তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। তাদের দুই পরিবারের সম্মতিও আছে।
আমি শাপলার সাথে কথা বলেছি। কিন্তু সে আমার ভালোবাসায় সাড়া দেয়নি আপু।
আমার অভিলাষী জীবনের সব স্বপ্ন আশা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো আপু, সব চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো!
আমি কী নিয়ে বাঁচবো?
জাবেদ তার আপুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
শাবানাঃ এমন পাগলামি করিস না ভাই। আমি শাপলার থেকে সুন্দর মেয়ে দেখে তোর বিয়ে দিয়ে দেবো। দেখবি তুই সব ভুলে যাবি। তোর মনে আর কোনো কষ্ট থাকবে না। দুনিয়াতে শাপলার থেকেও আরও অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে ।
আমি পছন্দ করে, মহা ধুমধাম করে তোর বিয়ে দিয়ে দেবো ভাই। এমন পাগলামি করিস না।
জাবেদঃ না আপু, আমি এ পৃথিবীতে আর বাঁচতে চাই না। যাকে নিয়ে সুন্দর সুখের ঘর বাঁধার রঙিন স্বপ্ন দেখলাম। জীবনকে সাজিয়ে তুলার অনুপ্রেরণা পেলাম। আর সেই না কি লাল বেনারসি অঙ্গে জড়িয়ে যাবে অন্যের ঘরে, এ আমি সহ্য করতে পারবো না আপু, এ আমি সহ্য করতে পারবো না।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আত্মহত্যা করবো!
শাবানাঃ (চট করে গালে একটা সজোরে থাপ্পড় মেরে কেঁদে কেঁদে )
কী বললি! তুই আত্মহত্যা করবি!
আমি যে তোকে সারাজীবন বাবা মায়ের স্নেহ মমতায় ঘিরে, বুকে আগলে রেখে, নিজের সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে কোলে পিঠে করে লালন-পালন করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করলাম ; তার প্রতিদান এই দৃশ্য দেখার জন্য? এই দিনটির জন্য ?
তুই কী করে পারলি এ সিদ্ধান্ত নিতে ? কী করে পারলি আমার মুখের সামনে এমন মহাপাপের কথা উচ্চারণ করতে ?
এই! তুই কি জানিস না ? আত্মহত্যা করা মহাপাপ!
তুই কি জানিস না ? এর পরিণাম জাহান্নাম!
আত্মহত্যা প্রসঙ্গে কোরআন ও হাদিসে কী বলেছে জানিস? শোন,
কোরআনের বাণীঃ
(এক) আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে এরশাদ করেছেন, ‘আর তোমরা আত্মহত্যা কর না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল। (সুরা নিসাঃ ২৯)
(দুই) আল্লাহ আল কোরআনে বলেছেন- ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না।’ (সূরা বাকারাঃ ১৯৫ আয়াত)।
(তিন) আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে জগতে বিপর্যয় সৃষ্টি বা হত্যার শাস্তি ব্যতিরেকে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে জীবন্ত রাখে সে যেন সব মানুষকেই জীবন্ত রাখে। (সূরা মায়িদাঃ ৩২ আয়াত)।
হাদিসের আলোকে আত্মহত্যা প্রসংগে হাদিসের বাণী হলো কি জানিস? শোন,
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরূপভাবে আত্মহত্যা করতেই থাকবে এবং এটিই হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে সর্বক্ষণ বিষ পান করে আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর এটা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। আর যে ব্যক্তি লৌহাস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে লৌহাস্ত্রই তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সে তা নিজ পেটে ঢুকাতে থাকবে, আর সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)
এখন বল, এর পরেও তুই আত্মহত্যা করবি?
আমাকে এতিম করে কান্নার সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে চলে যাবি?
তুই চলে গেলে আমার কী হবে, একবার ভেবে দেখেছিস?
জাবেদঃ (এবার তার আপু শাবানার পা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো)
আপু! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কেউ ভালো শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছো আপু, তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছো। আল্লাহর কাছে দোয়া করো, আল্লাহ যেন আমাকে ধৈর্য দেন, আমাকে ধৈর্যধারণ করার তৌফিক দান করেন।
শাবানা: (জাবেদকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে)
ওঠ ভাই! আর কাঁদিস না। তোর কান্না আমি সইতে পারছি না । সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। এখন মাগরিবের আযান হবে। অজু করে আয়, নামাজ পড়ে নে। দেখবি শরীরটা অনেক হালকা হবে, মনটা পাতলা হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে ভাই, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সন্ধ্যার পর রাত হলো, ওদিকে ইউসুফও খুব চিন্তিত।
মামলা হলো, পুলিশ আসবে কালু মাস্তানকে গ্রেফতার করতে। আবার কোনো অঘটন ঘটে কিনা?
খুব চিন্তায় বিভোর, মনস্তাপ।
শাপলাও খুব চিন্তা করছে বিছানায় শুয়ে শুয়ে।
হে আল্লাহ! আমি কী করবো? আমার চারিদিকে বিপদ! আজ আমার জন্য আমার বাবা খুন!
আমার প্রেমে জাবেদ উন্মাদ। ইউসুফ আমাকে ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করে, খুব ভালোবাসে। আমি কোনদিকে যাবো? এ কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ জুড়ে ঘুম চলে আসে শাপলার।
শাপলা রাতে স্বপ্নে দেখে ইউসুফ ও শাপলা একটা বাগানে গল্প করছে খুব আনন্দের সহিত। তারা দু’জন দু’জনার প্রেমে বিভোর। কোনোদিকে খেয়াল নাই। হঠাৎ পেছন দিক থেকে জাবেদ তার দলবল নিয়ে তাদেরকে হামলা করে। তাদের আঘাতে ইউসুফ অচেতন হয়ে মাটিতে লুকিয়ে পড়ে যায় এবং জাবেদ তাকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ের পিঁড়িত বসায়। বিয়েতে রাজি না হলে তাকে খুব মারধর করে জাবেদ।
শাপলা একটা ধারালো অস্ত্র দিয়ে জাবেদকে হত্যা করে পালিয়ে আসে। ঠিক এমন সময় শাপলার ঘুম ভেঙে যায়। সকাল হলে শাপলা তার আপুকে জানিয়ে ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তার নিজের গ্রামে ইউসুফের বাড়ি চলে আসে এবং দরজায় নক করে বলে,
ইউসুফ! তাড়াতাড়ি দরজা খুলুন। আমাকে খুব ভয় লাগছে! আমাকে বাঁচাও।
ইউসুফ শাপলাকে কণ্ঠস্বর বুঝতে পারে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখে শাপলা ভয়ে কাঁপছে।
তার এ অবস্থা দেখে ইউসুফঃ
শাপলা! তাড়াতাড়ি ভেতরে এসো। মা বাবা বাড়িতে নাই । একটু বাইরে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে। এক কাজ করো। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসি।
শাপলা! না, শুনুন, নাস্তা আনতে হবে না। আমার একা ভয় লাগবে। এক কাজ করো না প্লিজ।
সরি ইউসুফ, তুমি বলে ফেললাম। আমাকে মাফ করে দিন।
ইউসুফঃ আরে কী বলো? কোনো সমস্যা নাই । কিছুদিন পরেই তো তুমি বলেই ডাকতে হবে, তাই না? আজ থেকে তুমি আমাকে তুমি বলেই ডাকবে। তাতেই আমি খুশি হবো। ঠিক আছে ?
শাপলাঃ জি, মানে হ্যাঁ, হ্যাঁ মানে জি ঠিক আছে।
ইউসুফঃ তাহলে ‘তুমি’ বলো। তোমার মুখ থেকে ‘তুমি’ ডাক শুনতে চাই।
শাপলা: (কাঁদতে কাঁদতে ইউসুফের বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে)
তুমি আমাকে বাঁচাও ইউসুফ, তুমি আমাকে বাঁচাও। আমি সারাজীবন তোমার বুকে এভাবে মাথা রেখে তুমি তুমি বলে পার করে দিতে চাই।
আমার জন্য আমার মা বাবা খুন হয়েছে। আমার জন্য আবার নতুন করে কেউ খুন হোক এ আমি চাই না ইউসুফ, এ আমি চাই না।
চলো আমরা এখনই বিয়ে করে ফেলি। তাহলে আমাকে নিয়ে আর কারও কোনো সমস্যা থাকবে না।
ইউসুফঃ এ কী বলো শাপলা?
তোমার জন্য আবার কে খুন হবে?
তুমি এ কী আবোল তাবোল বলছো ? তোমার মাথা কি ঠিক আছে?
শাপলাঃ আমি আজ স্বপ্নে দেখেছি, তুমি খুন হয়েছো জাবেদর হাতে। সে আমাকে জোর করে বিয়ে করতে চাইলে আমিও তাকে হত্যা করি।
এ দুঃস্বপ্ন দেখে আপুকে অনেক কষ্ট করে মেনেজ করে তোমার কাছে চলে এসেছি ইউসুফ। চলো আমরা আজই বিয়ে করে ফেলি।
ইউসুফঃ আজ পুলিশ আসবে তোমার বাবা মা হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ প্রস্তুত করে ফেলেছি।
শাপলাঃ ইউসুফ! দেখো, আমি মা বাবার হত্যার বদলা চাই না। আমি চাই না আবার রক্তের ঝর্ণাধারা দেখতে। তা ছাড়া আমরা সঠিকভাবে জানিও না, কে বা কারা হত্যা করেছে ?
এ সব বাদ দাও, আমার খুব ভয় হয়! বাবা মাকে হারালাম, আবার যদি তোমার কিছু হয়, আমি কী নিয়ে বাঁচবো? কোথায় যাবো বলো? তুমি ছাড়া যে আমার পৃথিবীটাই অন্ধকার!
এমন সময় বাইরে গোলমালের শব্দ। কালু মাস্তান তার দলবল নিয়ে আসছে ইউসুফের বাড়ি ঘেরাও করতে।
কারণ, যখন শাপলা ইউসুফের বাড়ি আসে, তখনই কালু মাস্তানের সহযোগী রাসেল দেখতে পায় এবং কালু মাস্তানকে অবগত করে। এ সংবাদ শুনেই সে তার তার দলবল নিয়ে এদিকে ছুটে আসছে শাপলাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
জাবেদও ইউসুফ এর বাড়ির দিকে যাচ্ছে।
ইউসুফ শাপলাকে বললো,
দেখো তুমি কোনো টেনশন করো না। আমাদের আল্লাহ আছেন। সত্যের জয় হবে, আমাদের জয় হবে। তোমার বাবা মায়ের হত্যাকারী গ্রেফতার হবে, ফাঁসির মঞ্চে ঝুলবে। ওদেরকে পৃথিবীর কেউ রক্ষা করতে পারবে না। খুব শীঘ্রই ওদের ফাঁসি হবে। সমাজ ও দেশ থেকে দূর হবে অপরাধী, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস। আজকেই পুলিশ আসবে তাদেরকে গ্রেফতার করতে।
তুমি ঘরে চুপ করে বসে থাকো। আমি বাইরে থেকে আসছি। ইউসুফ বাড়ির দরজা খুলে দেখে বাইরে কালু মাস্তান দলবদ্ধভাবে তাদের বাড়ি ঘেরাও করে আছে।
এডভোকেট ইউসুফ কালু মাস্তানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
আপনারা আমাদের বাড়ি এভাবে ঘেরাও করে রেখেছেন কেন?
কালু মাস্তানঃ (অট্ট হাসি দিয়ে)
হাহাহাহা হাহাহোহো। বুঝো নাই সোনা বন্ধু!
একেই বলে ভাগ্য। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! ওয়াও, কী দারুণ! হাহাহাহাহা।
এই! শোন, তোর ঘরে কে আছে? তাকে বের করে আমাদের হাতে তুলে দে।
তোর তো সাহস কম নয়। আমার এলাকায় যুবতী নারী নিয়ে একাকী ফষ্টিনষ্টি করছিস ?
ইউসুফঃ এই কালু মাস্তান! তোকে আমি এতক্ষণ খুব সম্মানের সহিত কথা বলেছি আপনি আপনি করে। একটা ধৈর্যের সীমা আছে। তোরা তা অতিক্রম করেছিস। ভালোই ভালো এখান থেকে চলে যা। নইলে তোদের ভাগ্যে আজ শনি আছে।
কালু মাস্তানঃ ঐ দু’টাকার এডভোকেট ইউসুফ! না গেলে কী করবি? চিনোস আমাকে, আমি কে?
(এদের কথা শুনে শাপলা বাড়ির ভেতর থেকে দরজার ছিদ্র দিয়ে ক্যামেরা অন করে রেখেছে। বাইরে যা হচ্ছে সবই ভিডিও হচ্ছে।)
ইউসুফঃ তোকে কে না চিনে? তুই একটা ভণ্ড, প্রতারক,বেইমান। তুই একটা মানুষ রূপি শয়তান।
যার ভেতর মনুষ্যত্ব, বিবেক নাই। তুই একটা খুনী, সন্ত্রাস। আর তোর মত খুনী, সন্ত্রাস, শয়তানদেরকে শায়েস্তা করার জন্যই আমার মত এডভোকেট ইউসুফ এর জন্ম হয়েছে।
কালু মাস্তানঃ আরে বন্ধু রাগছো কেন? তুমি তো আমার এলাকারই ভাই। সুন্দরভাবে বিড়ালের মত চলে যাবো। তোমার ঘরে আশ্রিত ঐ সুন্দরী রূপসীকে আমার হাতে তুলে দাও।
তাকে বিয়ে করে আমার মনের জ্বালা নিবারণ করি। অনেক দিন থেকে এ দিনটার অপেক্ষায় আছি। আজ সেই দিন এসেছে। হাহাহাহাহা।
ইউসুফঃ এই! তোর ঘরে কি মা বোন নাই? এতই যখন মনের খায়েস, যা সেখানে গিয়ে তোর লোলুপ মনের জ্বালা নিবারণ কর।
কালু মাস্তানঃ এই ফকিন্নির পূত! আজকে তোরও সেই অবস্থা করবো, আমার কথায় রাজি না হওয়ায় যে অবস্থা হয়েছিলো শাপলার বাবা মা’র।
কত করে বুঝালাম, শ্বশুর মশাই আপনার মেয়েটারে আমার হাতে তুলে দিন। রাজরানির হালে থাকবে। সারাজীবন সুখ-শান্তি ও আরাম-আয়েশে থাকবে। সে শুনলোই না। তাদেরকে কুত্তার মত গুলি করে হত্যা করেছে এই কালু মাস্তান।
যার কোনো সাক্ষী নাই । আজ তোকেও গুলি করে হত্যা করে শাপলাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো।
যদি প্রাণে বাঁচতে চাস, শাপলাকে আমার হাতে তুলে দে।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখ তো কেউ আছে কিনা?
কেউ নাই। এখানে তোকে গেঁড়ে দিলেও কেউ সাক্ষী থাকবে না।
এ কথা বলেই কালু মাস্তান ইউসুফের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। শুরু হলো তুমুল লড়াই।
জাবেদ দূর থেকে দেখে ইউসুফের বাড়ির চারিদিক ঘেরা কালু মাস্তানের পোষা গুণ্ডাদের দ্বারা।
দৌড়ে এসে সেও ঝাঁপিয়ে পড়লো ইউসুফ এর পক্ষে। লড়াই করতে করতে দুজনেই ক্লান্ত। শত্রুপক্ষেরও কেউ কেউ আহত হয়েছে। মাটির সাথে লটপট করছে।
ঠিক সেই মুহুর্তেই পুলিশের গাড়ির এসে উপস্থিত।
পুলিশের গাড়ি দেখে কালু মাস্তান তার পকেট থেকে গুলিভরা পিস্তল বের করে ইউসুফকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। ভাগ্যক্রমে সে পিস্তলের গুলি জাবেদের বক্ষ ভেদ করে। জাবেদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কালু মাস্তান পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ সদস্যরা তাদের সবাইকে ঘেরাও করে ফেলে। তাদের সবার হাতে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে উঠায়।
ইউসুফের বাবা মা-ও চলে আসে ঘটনাস্থলে।
তারাও হাও মাও করে কাঁদছে।
জাবেদ রক্তক্ত দেহ নিয়ে মাটিতে ছটফট করছে। ইউসুফও তাকে হাঁটু গেঁড়ে বুকের সাথে জড়িত ধরে হাও মাও করে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
বন্ধু! তুই কথা বল, চোখ খোল বন্ধু। আমার জন্য তোর এ অবস্থা। আমিই হতভাগা, কপালপোড়া !
শাপলাও তার কাছে ছুটে এসে ইউসুফের পাশে জাবেদের মাথার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। খবর পেয়ে জাবেদের বোনও ছুটে আসলো।
জাবেদের বোন শাবানা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো,
ভাইরে! তোকে আমি কত নিষেধ করলাম বাইরে যাসনে। তবুও তুই চলে আসলি। আমার কথা শুনলি না। আমি জানতাম, তোকে কালু মাস্তানেরা বাঁচতে দেবে না। আমাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিলি। এতিম করে দিলি ভাই। আমার যে আর পৃথিবীতে আপন কেউ রইলো না।
ইউসুফ! ভাই আমার , চলো তাড়াতাড়ি মেডিকেল নিয়ে যাই। জাবেদকে বাঁচাই।
জাবেদ কথা বলতে পারছে না। মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করছে। খুব কষ্ট করে বললো,
আপু! আমাকে মেডিকেল নিয়ে যাওয়া লাগবে না। আমার চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার সময় খুব কম। আমি দেখতে পাচ্ছি, আজরাইল আমার অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ।
তোমাকে অনেক, অনেক কষ্ট দিয়েছি আপু। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। নইলে আমি মরে গিয়েও শান্তি পাবো না। সারাজীবন জ্বলতে হবে জাহান্নামে।
ইউসুফ! তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস বন্ধু, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস।
শাপলা! তুমি কই? আমাকে ক্ষমা করে দাও। দেখি তোমার হাতটা।
জাবেদ শাপলা ও ইউসুফের হাত একসাথে করে দিয়ে বললো,
ইউসুফ! তোকে একটা শেষ কথা বলবো বন্ধু।
আমি তোকে অনেক ভালোবাসি। আমার জীবনের সব দুঃখ কষ্টের কথা তোর কাছেই ব্যক্ত করেছি সেই ছোটবেলা থেকেই।
মানুষের সব চাওয়া পাওয়া পূরণ হয় না। আমার এ অন্তিমকালে অভিলাষী মনের একটাই চাওয়া পাওয়া। তোরা, তোরা সুখে থাকিস, চিরসুখে।
আমার, আমার একটা কথা রাখিস বন্ধু!
শাপলাকে সারাজীবন তোর বাহুডোরে ভালোবাসার অটুট বন্ধনে চিরদিন বেঁধে রাখিস। তার মনে কখনো, তার মনে কখনো ভুলে করেও কষ্ট দিসনা বন্ধু, ভুল করেও না।
সে তোর কাছে, সে তোর কাছে সুখে থাকলে আমি ওপারে গিয়েও সুখে থাকবো, পাবো অনন্তকাল সুখের স্থান।
আর একটা কথা বন্ধু! আমার আপুর তো কেউ রইলো না । আপু যে এতিম হয়ে গেলো।
আপু তুমি কই, আপু তুমি কই? তোমার হাতটা দাও। আমাকে ক্ষমা করে দাও আপু।
আপুকে তুই দেখে রাখিস বন্ধু, আপুকে তুই দেখে রাখিস।
কথা দে বন্ধু! কথা দে, আমাকে তুই কথা দে। এ কথা শুনে আমি মরতে চাই।
ইউসুফ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে,
বন্ধু! আমি তোকে কথা দিলাম, আমার জীবনে ঝড় বয়ে গেলেও আমি শাপলার মনে একটা ফুলের আঁচড়ও লাগতে দেবো না। আমি তাকে সারাজীবন ভালোবাসার অটুট বন্ধনে বাহুডোরে বেঁধে রাখবো।
আর তোর আপু মানে আমারও যে আপুরে বন্ধু। আমি তোর আপুকে নিজের বড় বোনের থেকেও সম্মানের সহিত রাখবো। আমি তোকে কথা দিলাম বন্ধু, কথা দিলাম।
জাবেদঃ শাপলা, শাপলা! আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি আর কথা বলতে পারছি না।
তুমি, তুমি, তুমি আমাকে কালিমা পড়াও।
তুমি সঠিক পথের দিশা দিয়েছো আমায়। ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছো। আমাকে আমার জীবনের শেষ সময়ে পবিত্র কালিমাটা পড়িয়ে দাও।
আমি তোমার মুখের শেষ কালিমাটা পড়া শুনে বিদায় নিতে চাই, শেষ বিদায়!
আমাকে, আমাকে বিদায় দাও শাপলা, আমাকে বিদায় দাও।
শাপলা! আমাকে কালিমাটা পড়াও।
শাপলাঃ (কাঁদতে কাঁদতে)
পড়ুন – লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
জাবেদঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
জাবেদ কালিমা পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।
———————সমাপ্ত——————–