Skip to content

অপেক্ষার বাতায়নে দক্ষিণা হাওয়া – অরণ্য মজিদ

একটা চিঠি আসবাব কথা ছিলো। পাঁচ দিন অতিবাহিত হলো। দিনগুলো যেন পাথরের চেয়েও ভারী। দিগন্ত জানালায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবে হয়তোবা চিঠিটা আর আসবেনা। আকাশে কালো মেঘ ঘুরপাক খাচ্ছিলো। একটু পরেই হয়তো ঝড় উঠবে। মাসটা ছিল বৈশাখ। বৈশাখের প্রথম ঝড় এখনও ফসলের মাঠ, গাছের ডালপালা, মানুষের ঘর উঠোনকে ছুঁয়ে যায়নি। ক্রমশই বাতাস জোরদার হচ্ছে। কালো ছায়ায় ঢেউ যাচ্ছে পৃথিবীর আঙ্গিনা। হঠাৎ করেই বাড়ির সদর দরজার গেইটের কলিংবেলটা বেজে উঠলো। দিগন্ত দরজাটা খুলে দিতেই দেখলো, একটি নীল খাম হাতে দাড়িয়ে আছে পোস্টম্যান। দিগন্ত অল্প কিছুক্ষণ অবাক বিশ্বয়ে তাকিয়ে থাকে নীল খামের দিকে। তবে এটাই কী বরুণার চিঠি! উৎসুক তিনটি আঙুলে চিঠিটা স্পর্শ করলো। আর পোস্টম্যানকে ধন্যবাদ জানালো। রুমে ফিরে এসে লাইটটা জ্বালিয়ে দিলো। ততক্ষণে বৈশাখী বাতাস তাঁর শরীর পালটিয়ে দূর্দান্ত ঝড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁর বুকে ও মস্তিষ্কের স্নায়ুতে স্নায়ুতে চলছে অন্য এক ঝড়। কী লেখা আছে ওই চিঠিতে! বরুণা কী গ্রহণ করেছে তাঁর প্রস্তাব! নাকি অন্য কিছু। ভাবতে ভালো লাগছেনা আর। খুব দ্রুতই খামটা ছিড়ে চিঠিটা বের করে। চিঠিটা পড়তেই আঁতকে উঠে তাঁর দুটি চোখ। বৈশাখী ঝড় যেন ঘরের জানালা, দেয়াল ভেঙে ফেলে এখন তাঁর বুকটাই ভাঙতে চলেছে। কেননা চিঠির প্রথম শব্দটিই ছিলো দুঃখীত। এই একটি শব্দ তাঁর বুকে যেন ধারালো তরবারীর মতো চেপে বসেছে। তাঁর চোখ দু’টোর আর সাহস হলোনা পরের শব্দগুলো পড়তে। চিঠিটা টেবিলেই রেখে দিলো। ছুটে চলে গেল বারান্দায়। সেখানেও দাঁড়াতে পারলোনা৷ বৃষ্টির ঝাপটা তাঁকে আবারও ফিরে পাঠালো রুমের ভেতরে। দিগন্তের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম৷ অপেক্ষার এ বিষাক্ত ছোবল আর সইতে পারছেনা সে। মনের বিরুদ্ধেই চোখ রাখলো আবারও চিঠিতে। ” আসলে মানুষ হিসেবে তুমি অনেক ভালো। যেকোনো মেয়েই তোমাকে ভালোবাসতে চাইবে। পুরুষের কৈশোরে যতোটা ভালোলাগা থাকলে একটা নারীর চোখ তা এড়িয়ে যেতে পারেনা। সে সৌন্দর্য তোমার শরীরে অফুরান। তবুও কথাটা জানাতে কষ্টকর হলেও এটাই সত্য যে, যে ভালোবাসাকে সাথে নিয়ে দু’জন মানুষ একটি স্বপ্নের ঘর বাঁধে। তেমন ভালোবাসার বন্ধনে আমি তোমাকে বাঁধতে পারছিনা৷ কারণ তুমি শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তোমার বুদ্ধিমত্তা ক্লাসের সবাইকেই হার মানাই কিন্তু তোমার ক্ষিন শ্রবণশক্তি সবাইকেই হাসাই। সত্যি বলতে কী তোমাকে যারা বাড়ির জামাই করে আনবে তাঁরা বারবার লজ্জিত হবে। কেননা তুমি সেদিন ভুল শব্দটিকে ফুল ভেবে আমার জন্য একটা গোলাপ এনেছিলে। আর জানতে চেয়েছিলে আমিও তোমাকো একটা গোলাপ দিবো কিনা। তুমি দুঃখ পাবে বলে ওই হাস্যকর ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছিলাম। বিষয়টা জেনে আমার বান্ধবীরা অনেক হাসাহাসি করেছিল। আসলে আমি তোমাকে হাসিহাসির মধ্যে বাঁধতে চাচ্ছিনা। আশাকরি উত্তরটা বুঝতে পেরেছো। ভালো থেকো। তুমি মেধাবী। আমি না এলেও হয়তো একদিন অন্য কেউ আসবে। মন থেকে স্বপ্নগুলো মুছে ফেলো। ইতি বরুণা “। কিংকর্তব্যবিমুড় দিগন্ত অপেক্ষার সিড়ি ভাঙতে ভাঙতে যখন এসে থামলো তখন মনে হলো বাইরের প্রচন্ড বৈশাখী ঝড়ের মতো সে ও হারিয়ে ফেলেছে বৃক্ষের মতো, তরুর মতো স্বপ্নের ডালপালা। জানালাটা খুলতেই দেখলো প্রচন্ড বৈশাখ তাঁর উঠোনে দাড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছটির মাথা দুমড়েমুচড়ে নুইয়ে দিচ্ছে। মনে হলো ওই গাছটাই যেন তাঁর হেরে যাওয়া শরীর। জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। মস্তিষ্কে এসে ভীড় জমাই আরও পুরনো কিছু স্মৃতি। কানে কম শোনার কারণে বন্ধু, বান্ধবীরা তাঁকে নিয়ে যেভাবে তাচ্ছিল্য, উপহাস আর হাসাহাসি করতো সেসব দুঃখ জাগানিয়া স্মৃতিগুলো এক এক করে দাড়িয়ে যায় ভাবনার দেয়ালে। আকাশের চেয়েও বিশাল তাঁর হৃদয়টা মূহুর্তেই ছোট হতে হতে জলে ডুবে যাওয়া দ্বীপের মতো ছোট হয়ে যায় তাঁর হৃদয়টা৷ মনে পড়ে একবার প্রতিবেশী স্নিগ্ধা তাঁকে বরুণার মতোই আকষ্মিক দুঃখ দিয়েছিল। স্নিগ্ধা তাঁর শৈশবের বন্ধু ছিল। ফুল, পাখি, নদী, প্রজাপতি একসাথে ভাগ করে নিতো খেলাময় দিনগুলোতে। স্নিগ্ধার চোখে চোখ রেখে দিগন্তের চোখেও জমা হয়েছিল ভালোবাসার সাহস। স্নিগ্ধার চোখ দু’টো ছিল আকাশের মতোই নীল। ওখানে তাকালেই যেন ভালোবাসার নীল বন্যায় হারিয়ে যেত দিগন্তের চোখ দু’টো। যখন একজন পুরুষের বয়স নারীকে তাঁর শরীরের ভেতরে অংশীদারীত্ব দিতে চাই তেমনই একটা বয়সে একদিন গোধুলি বেলায় দিগন্ত স্নিগ্ধার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ” তোর চোখ দু’টো আমাকে দিবি? কী করবি তুই ওই চোখ দু’টো দিয়ে? ওখানে আকাশ আছে, নক্ষত্র আছে। ওখানে ভালোবাসার বাড়ি বানাবো “। তারপর কী যে হলো স্নিগ্ধার সেই আকাশ নীল চোখ দুটো আর খুঁজে পেলোনা দিগন্ত। তাঁকে দেখলেই স্নিগ্ধা পালিয়ে যেত। এরপর থেকে দিগন্ত বুঝতে পেরেছিল স্নিগ্ধা শুধুই তাঁর বন্ধু ছিল। স্নিগ্ধার ভালোবাসা দিগন্তের স্বপ্নকে ভালোবাসার বাড়ি বানানোর সাহসটাকে বরুণার মতোই অস্বীকার করেছিল। ২য় পর্ব : দেখতে দেখতে জুন মাস চলে আসলো। ১৭’ই জুন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হলো দিগন্ত। দিনে দিনে মস্তিষ্কে বড় হচ্ছে পরিচিতির তহবিল। নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয়ের আনন্দটা মনকে বসন্তের বাগানের মতো ফুটিয়ে তুলেছে। অনেক চেনা জানার মাঝে দু’জন বন্ধুকে ভালোলেগে গেল তাঁর। অয়ন আর পার্থ ভালোলাগা আর অধিকারে মিশতে মিশতে এতোটাই কাছাকাছি হলো যতোটা দূরত্ব নিয়ে পরিবারের লোকজন নিজস্ব জীবনের ফ্রেমে বাঁধা থাকে। কলেজ ছুটি হয়ে গেলেও রাতে বিছানায় শুয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে তাদের সাথে মোবাইলে কথা চলে। হঠাৎ করেই আরও একজন নতুন মেয়ে বন্ধু জুটে যায় তাদের পরিচিতির অঙ্গনে। সঞ্চিতা খুব মিষ্টি একটি মেয়ে। ঠোঁটের ওপর সবসময় ভাসতে থাকে প্রাণময় হাসি। দেখলেই মনেহয় তাঁর লাল দু’টো চোখ গোলাপ কুড়ির মতো সবেমাত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে। যাকে দেখলেই প্রতিটি পুরুষের চোখ কিছুক্ষণের জন্য হলেও দাঁড়াতে চাই সে চোখের পাপড়ি তলে। দিন যতোই গড়িয়ে যায় দিগন্ত অয়ন আর পার্থের সাথে সঞ্চিতার সম্পর্ক যেন এক হয়ে মিশে যায় নদীতে গড়িয়ে আসা সব জলের মতো। এই চারটি প্রাণ যেন বৃক্ষের একটি কান্ডের ছড়িয়ে যাওয়া চারটি শাখা। কলেজের অন্যান্য ছাত্র ছাত্রীরা অবাক হয়ে দেখে তাদের প্রাণবন্ত মেলামেশা। অধিকাংশ সময় তাঁরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়। কলেজে পুকুর পাড়ে বসে দীর্ঘক্ষণ গল্প করে। এভাবেই কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে চলতে চলতে তাদরে প্রতিটি অনুভবের ভেতর জমতে থাকে ভালোবাসার স্বপ্ন। একদিন পার্থ, অনয়, দিগন্ত সঞ্চিতাকে বললো, ” আমি একটা বিষয় নিয়ে ভেবেছি। সঞ্চিতা বললো কী বিষয়? বিষয়টা বলবো কলেজের পুকুর পাড়ে। আজ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঠিক বেলা ১২টায় ওখানে যাবো আমরা। অনয় বললো, আমাকে বলবিনা? পার্থ বললো, এটা একা বলা যাবেনা৷ বিষয়টা ভাগাভাগির তাই একসাথে বসে সবাই মিলে একটা বিষয় ভাগ করে নেবো। সঞ্চিতা বললো, কী আশ্চর্যময় কথা বার্তা বলছো তুমি। কী ভাগ করবে তুমি? পার্থ বললো, ধরে নাও তোমাকেই ভাগ করবো “। পার্থের কথা শুনে বাকি তিনজন উচ্চস্বরে হাসিতে ফেটে পড়লো। ১২টা বাজলো চারজন হাঁটতে হাঁটতে এসে পুকুর পাড়ের এক পার্শ্বে গোল হয়ে বসলো। সঞ্চিতা বললো, কই কী ভাগ করবে, ভাগ করে ফেলো৷ আবারও সবাই হাসিতে ফেটে পড়লো। পার্থ বললো, বিষয়টা অত্যান্ত সিরিয়াস। যা আমাদের মধ্যে ভাগাভাগির সময় একটা বিভেদ ও ফাটল ধরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু প্রত্যেককেই হাতে হাত রেখে কথা দিতে হবে, সঞ্চিতা এ বিষয়ে যা সিদ্ধান্ত দেবে তা সবাইকে মেনে নিতে হবে। প্রথমে সঞ্চিতা মাটির উপর হাত রাখলো। তারপর তার হাতের উপর পড়তে থাকলো আরও তিনটি হাত। পার্থ বললো, তাহলে আমরা ওয়াদাবদ্ধ হলাম সঞ্চিতা যা সিদ্ধান্ত নেবে তা আমরা মেনে নেবো। অয়ন বললো, এবার বিষয়টা বলো, তোমার ভাগাভাগির সেই সম্পদটা কী? পার্থ বললো, আসলে সম্পত্তি হলে আমরা তিন বন্ধুই সমান ভাগে ভাগ করে নিতাম। কিন্তু আমি যেটা ভাগ করবো সেটা হচ্ছে একটা সম্পদ। যে সম্পদ তিনজন একসাথে ভোগ করতে পারেনা৷ দিগন্ত বললো, তোমার সেই মহামূল্যবান সম্পদের নামটা তে বলো। পার্থ বললো, সেই সম্পদটা হচ্ছে সঞ্চিতা। সঞ্চিতা বিষ্ময়ের সাথে বললো, আমি? আমি সম্পদ হলাম কীভাবে? পার্থ বললো, হ্যা তুমি আমাদের সেই মহা সম্পদ৷ যা খুব তাড়াতাড়ি একজনের জন্য নির্বাচিত হওয়া উচিত। কেননা, আমাদের এই চার বন্ধুর মাঝে সম্পর্কটা এমনই যে কেউ একজন কাউকে না জানিয়ে তোমাকে চুরি করে নিলে সে অপরাধটা যত বড় হবে তাঁর চেয়ে বড় কষ্ট হবে সেই চুরি করাটাকে মেনে নেওয়া। সঞ্চিতা বললো, আমিতো তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছিনা৷ পার্থ বললো, আমার বিশ্বাস তোমাকে আমার যতোটা ভালোলাগে অয়ন এবং দিগন্তের কাছেও তুমি ততটাই ভালোলাগার স্বীকার। কী অয়ন সঞ্চিতাকে তোমার ভালো লাগেনা? অয়ন কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বললো, হ্যা ভালো লাগে৷ পার্থ তাঁর পর প্রশ্নটা দিগন্তের দিকে ছুঁড়ে দিলো। সত্য বলবো? আমার খুব ভালো লাগে। পার্থ বললো, সঞ্চিতা তুমি এখন আমাদের তিনজনের ভালোলাগার বিচারক আমরা প্রত্যেকেই তোমার ভালোলাগার স্বীকার। আর তুমি জানো ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসার জন্ম হয়৷ একসময় হয়তো আমাদের তিন জনের ভেতর কেউ একজন তোমাকে গোপনে ঢেকে বলবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর তুমিও হয়তো বলবে আমিও তেমনটাই বলতে চেয়েছিলাম। পার্থ আরও বললো, আমাদের বন্ধুত্ব এতোটাই প্রগাঢ় বিশ্বাসে ভরা যেখানে কেউ একজন কাউকে ফাঁকি দেওয়ার অধিকার রাখেনা৷ তাই আজ সঞ্চিতা নিজ মুখেই বলে দিবে, সে কার ভালোবাসা তাঁর নিজের জন্য নির্বাচিত করবে। সঞ্চিতা বললো, কিন্তু ব্যাপারটা খুব বেশি খোলাখুলি আর বিশ্রী হয়ে যাবে না? অয়ন বললো, না বিশ্রী দেখাবেনা বরং ব্যাপারটা আরও মজাদার হবে। অল্পক্ষণ বাক্য বিনিময়ের পর সঞ্চিতা বললো, তাহলে এ বিষয়ে আমি আমার মতামত তুলে ধরছি। কেউ ই দুঃখ বা কষ্ট পাবেনা৷ যেহেতু তোমাদের এক বন্ধুর প্রতি অন্য বন্ধুর ত্যাগ বিষয়টিকে বেশি মর্যাদাশীল করে তুলবে। আমার চোখে আমার জন্য নির্বাচিত পুরুষ হচ্ছে পার্থ৷ কেননা সে দিগন্ত এবং অয়নের চেয়ে একটু কম মেধাবী হলেও সে খুব বেশি বাস্তববাদী, অনূভুতি প্রবণ এবং তাঁর স্রবণ শক্তি এতো জোরালো যে সে মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া অস্ফুট ক্ষিন শব্দ গুলো সে খুব সহজেই শুনতে পাই। এ কথা কেন বলছি জানো? গত টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় পার্থ তোমাদের থেকে অনেক দূরে বসেছিল। আমি যখন তোমাদের খুব হাল্কা স্বরে একটা প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞেস করি তখন তোমরা বারবার বলেছিলে আমরা শুনতে পাচ্ছিনা৷ কিন্তু পার্থ তোমাদের থেকে দূরে বসলেও আমার সেই ক্ষিন শব্দটা শুনতে পেয়েছিল এবং উত্তরটা দিয়েছিল। স্টুডেন্ট লাইফে এমন বন্ধুর সাথে সম্পর্ক থাকলে পরীক্ষা গুলোতে নিয়মিত সাহায্য পাওয়া যাবে। অয়নের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি যদিও সে সর্ব বিষয়ে চৌকস তবুও একজনকে বেছে নিতে হয়েছে বলে তাঁকে নির্বাচিত করতে পারছিনা৷ আর দিগন্তের ক্ষেত্রে যেটা সত্য সেটা হলো যদি তাকে নির্বাচন করি তাহলে ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর হয়ে যাবে একারণেই যে তাকে নুন আনতে বললে সে আসলে চুন এনে বসে থাকবে। এ ধরনের লোককে বন্ধু বানানো গেলেও ভালোলাগার মানুষ হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাথে রাখা যায়না৷ কিন্তু সে আমার একজন ভালো বন্ধু এবং প্রাণবন্ত বন্ধু। অয়ন বললো, যেহেতু আমরা আমাদের ওয়াদাগুলো আঙ্গুলের উপর ছড়িয়ে দিয়েছি আর মাটি যার সাক্ষী সেক্ষেত্রে আমার পক্ষ থেকে পার্থ ও সঞ্চিতাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। পার্থ দিগন্তকে উদ্দেশ্য করে বললো, তুমি কষ্ট পাচ্ছোনাতো বন্ধু? আমি কোনো ব্যাপারেই উন্মোচিত ভাবে কিছু বলতে ভালোবাসি না৷ তবে তোমাদের জন্য দোয়া রইলো। সঞ্চিতা বললো, তাহলে এবার ওঠা যাক। কিন্তু পার্থ সঞ্চিতাকে থামিয়ে বললো, স্বামী স্ত্রীরা যেমন বিয়ের পর হানিমুনে যায় প্রেমিক, প্রেমিকাদের ও ভালোবাসাকে প্রাণবন্ত করার জন্য বিশেষ কোনো জায়গায় হানিমুনে যাওয়া উচিত। অয়ন বললো, ভারি চমৎকার আইডিয়া। এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু দেখছিনা৷ অনেকদিন কোথায় বেড়াতে যাওয়া হয়নি৷ সঞ্চিতা বললো, ঠিক আছে কবে, কখন, কোথায় যেতে চাও? কারণ আমাকে তো বাসা থেকে অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে অনুমতি নিতে হবে। পার্থ বললো, পরশুদিন সকাল ১০টায় আমরা পদ্মা নদীর ভাঙ্গন দেখতে যাবো। ওখানে এখন জল আর মানুষের উৎসব। স্পিডবোটে অনেকক্ষণ ঘোরা যাবে। আর পাড়ে বসে অনেক গল্প করা যাবে। অয়ন বললো, তাহলে এখন ওঠা যাক। পরশুদিন সবাই সময় মতো তৈরি হয়ে থাকবো। ৩য় পর্ব : ১০টা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি আছে। সঞ্চিতা এখনও এসে পৌঁছায়নি। কলেজ প্রাঙ্গণে সঞ্চিতার জন্য ওরা তিনজন অপেক্ষা করছে। অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই অয়ন বললো, ওইতো সঞ্চিতা এসে গেছে। সঞ্চিতা আসার পর তারা পায়ে পায়ে গিয়ে মেইন রোডে তাদের জন্য অপেক্ষীত মাইক্রোটিতে তারা উঠে বসে। সবার চোখে মুখে আনন্দের বন্যা উপচে পড়ছে৷ আকাশ থেকেও উপচে পড়ছে কালো কালো মেঘের ডানা৷ কখনও রোদ কখনও ছায়া। এই রৌদ্র ছায়া যুক্ত দিনে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই তারা এসে পদ্মা পাড়ে নামলো। এ যেন অনেক মানুষের মিলন মেলা। পদ্মা উত্তাল জলরাশি আর তার বুকের ভাঙ্গন দেখার জন্য এখানে এখন প্রতিদিন অনেক লোক জড় হয়৷ পার্থরা চারজন ছোট্ট ছোট্ট পায়ে পদ্মার জলের বুকে চোখ রাখতে রাখতে হাঁটছে। ভিষণ ভালো লাগছে তাদের। জেলেদের দুই একটা নৌকা জলের তরঙ্গে লাফিয়ে আবারও নিচে নেমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই ডুবে যাবে। সঞ্চিতা পার্থকে বললো, দেখো আমার মনে হচ্ছে ওই নৌকাটা এখনই ডুবে যাবে। পার্থ বললো, আরে না। জলের দোলায় দুলতে দুলতে মাঝিদের মতো ছোট নৌকারাও ভালো সাঁতার শিখে ফেলে। হাঁটাহাঁটির এক পর্যায়ে দিগন্ত সবার থেকে একটু দূরে চলে যায়। অয়ন পার্থ আর সঞ্চিতা পাড়ের ভাঙ্গন দেখবার জন্য নদী তীরের খুব কাছাকাছি ভেঙে যাওয়া পাড়গুলো দেখতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই একটি ভেঙে যাওয়া পাড়ের উপর সঞ্চিতা ভুল করে পা রাখতেই পাড়টি ভেঙে মাটিতে তলিয়ে যায় আর বিশাল জলরাশীর উত্তাল তরঙ্গ সঞ্চিতাকে জলের ডানায় বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যায় স্রোতের কুন্ডলীর দিকে। পার্থ অয়ন সঞ্চিতার নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে। সঞ্চিতা স্রোতের দূর্বিনীত বুক ভেঙে পাড়ের দিকে আসার জন্য জলের সাথে যুদ্ধ চালাতে থাকে আর পার্থ পার্থ বলে চিৎকার করতে থাকে। পার্থ তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেনা দেখে অয়নের নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে। তখন জলের স্রোত তাকে অনেকটাই বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। নদী পাড়ের সমস্ত লোক দৌড়ে আসছে ঘটনা স্থলের দিকে৷ দূরে দাড়িয়ে থাকা দিগন্ত ডান পাশে চোখ ফেরাতেই দেখে সঞ্চিতা পানিতে ডুবে যাচ্ছে। সে ঘটনাস্থলের দিকে দৌড় দেয়৷ সঞ্চিতা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দিতে থাকে এবং হাত পা ছুড়ে ছুড়ে ভেসে থাকবার চেষ্টা করে। তার চোখ থেকে পার্থ এবং অয়নের প্রতি জমে ওঠা বিশ্বাস নদী ভাঙনের পাড়ের মতোই ভেঙে পড়ে। সে পানির ওপর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা৷ ততক্ষণে অনেক জল সে খেয়ে ফেলেছে। হঠাৎ করেই দিগন্ত সঞ্চিতার নাম ধরে চিৎকার করে বলে সঞ্চিতা ভয় পেওনা আমি আসছি। এই বলে সে জলে লাফিয়ে পড়ে। জলের দূর্দান্ত ঢেউকে দু-হাতে পাশ কাটিয়ে পিছু ফেলে খুব কম সময়ের মধ্যে পৌঁছে যায় সঞ্চিতার কাছে। অবশন্য ক্লান্ত সঞ্চিতার হাত গুলো দিগন্তের কাঁধ এবং শরীর স্পর্শ করে৷ দিগন্ত এক হাত দিয়ে সঞ্চিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় তার শরীরের সাথে এবং দূর্দান্ত ঢেউ কৌশলে ঠেলতে ঠেলতে কূলের দিকে আসতে থাকে। নির্বাক পার্থ এবং অয়ন অন্য দশজন দর্শকের সারিতে দাড়িয়ে সে দৃশ্য দেখতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঞ্জিন চালিত একটি নৌকা সঞ্চিতাকে বাঁচাতে তাদের খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। দিগন্ত নৌকার গোলুইটা চেপে ধরে। নৌকার মাঝি আর অন্যান্য যারা সাথে ছিল সবাই মিলে সঞ্চিতা আর দিগন্তকে টেনে নৌকায় তোলে। নৌকাটি কূলে ভিড়লেই পার্থ ও অয়ন দৌড়ে সেখানে যায় এবং নৌকা থেকে সঞ্চিতাকে উপরে উঠায়। ততক্ষণে সঞ্চিতার ক্লান্ত চোখের দৃষ্টি এতোটাই ঝাপসা হয়ে ওঠে যে তাঁর চোখের সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোকেও চিনতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক মানুষের ভীড় ঠেলে একজন বিশেষ ব্যক্তি ছুটে আসে এবং সে দু-হাত দিয়ে লোকজনকে সরিয়ে সঞ্চিতার কাছে যায় আর তাঁর পেটে ছোট ছোট চাপ দিয়ে মুখ দিয়ে পানি বের করতে থাকে। ওদিকে দিগন্ত ও তার ক্লান্ত শরীর নিয়ে পাড়ের ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। একটু সুস্থতা বোধ করতেই ছুটে এসে জনতার ভীড় ঠেলে সঞ্চিতার সামনে দাঁড়ায়। ততক্ষণে সঞ্চিতাও তাঁর শরীরে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। দৃষ্টি থেকে দূর হয়েছে ক্লান্তির ঝাপসা আবির। ভালো করে তাকিয়ে দেখে জলে ভেজা দিগন্তের সর্বাঙ্গ শরীর। আরও তাকিয়ে দেখে সুসজ্জিত পোষাকে দাড়িয়ে থাকা অয়ন ও পার্থ। সঞ্চিতা পার্থর দিকে তাকিয়েছে এটা বুঝতে পেরেই সঞ্চিতার খুব কাছে বসে পড়ে এবং মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করে এখন কেমন লাগছে তোমার? সঞ্চিতা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। পার্থ তার দুটি আঙুল দিয়ে সঞ্চিতার চিবুক স্পর্শ করে আবারও জিজ্ঞেস করে, খুব খারাপ লাগছে তোমার? সঞ্চিতা কোনো উত্তর দেয়না৷ অয়ন পার্থকে বললো, আমার মনেহয় ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভালো। কেননা ও অনেক ক্লান্ত। ওর ভালো চিকিৎসা দরকার। সবাই মিলে সঞ্চিতাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়৷ শেষ পর্ব : দুই দিন পর পার্থ এবং অয়ন কলেজের করিডোরে দাড়িয়ে সঞ্চিতার জন্য অপেক্ষা করছে। গতকাল সঞ্চিতা কলেজে আসেনি৷ তাই পার্থের মনটা খারাপ। অয়ন বললো, হয়তো সঞ্চিতা আজও আসবেনা৷ চল পুকুর পাড়ে গিয়ে বসি৷ তাই চল। ওরা দু’জন এসে পুকুর পাড়ে বসে। অনেক আগে থেকেই দিগন্ত ওদের থেকে একটু দূরে এসে বসে আছে। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই পার্থ বলে উঠলো ওইতো সঞ্চিতা আসছে। এ কথা বলেই খুব দ্রুত সঞ্চিতার দিকে হাঁটতে থাকে। সঞ্চিতা কাছে পৌঁছিয়ে বলে, কেমন আছো সঞ্চিতা? ভালো আছি আর কিছু? পার্থ পকেট থেকে একটা গোলাপ বের করে এবং সঞ্চিতাকে দেওয়ার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দেয়৷ সঞ্চিতা অবাক হয়ে ফুলটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পার্থ বলে, অমন করে কী দেখছো! সঞ্চিতা বললো, আমাকে ফুল দিচ্ছো যে? পার্থ বললো, তুমি মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছো তাই তোমাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। সঞ্চিতা বললো, আসলে তুমি ভুল করেছো৷ কোনো ঘটনায় যে বেঁচে যায় তাকে শুভেচ্ছা জানাতে হয়না৷ বরং তাকে যারা বাঁচায় তাদেরকে শুভেচ্ছা জানাতে হয়৷ তুমি কী জানো এই ফুলটা কার জন্য প্রাপ্য? পার্থ আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে কার জন্য? এটা শুধুই দিগন্তের প্রাপ্য। সঞ্চিতা আরও বললো, আমি দুঃখিত তোমার ফুলটা নিতে পারছিনা৷ এ কথা বলেই সঞ্চিতা সম্মুখের দিকে হাঁটতে থাকে। পার্থ বলে, ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? দিগন্তের কাছে যাচ্ছি। কিন্তু কেন? কিছুটা পিছু ফিরে স্থির হয়ে দাড়িয়ে সঞ্চিতা পার্থকে বললো, তোমাকে কয়েকটা কথা বলা দরকার। সেদিন যখন জলের দূর্বার স্রোত আমাকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো আর আমি বাঁচার জন্য আকাশ বাতাস ফাটিয়ে তোমার নাম ধরে চিৎকার করছিলাম সেদিন কিন্তু তুমি আমার কান্না জড়ানো সেই ডাক শুনতে পাওনি। পাশে দাড়িয়ে থাকা অয়নে উদ্দেশ্য করে বলে, এবং অয়ন তুমিও শুনতে পাওনি৷ পার্থ, জানতাম তুমি কানে সবার থেকে অনেক বেশি শুনো। কিন্তু ওইদিন দেখলাম তোমার শ্রবণশক্তিটা এতো খাটো যে তুমি আমার আকাশ ফাটানো ডাকটাও শুনতে পাওনি৷ তুমি বলো এই বিশাল ডাককে যে বা যারা শুনতে পাইনা বা এড়িয়ে যায় তাদেরকে নিয়ে কী জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যাওয়া যায়৷ আর তাঁদের জন্য কী মাটির ওপর বিছিয়ে হাতগুলোর সেই ওয়াদা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়? দুঃখীত আমি আসছি৷ কিন্তু কোথায় যাচ্ছো? কেন যে আমাকে বাঁচিয়েছে। তাকে শুভেচ্ছা জানাবোনা আমি? সঞ্চিতা দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে দূরে বসে থাকা দিগন্তের কাছে যাচ্ছে। পার্থ এবং অয়ন নির্বাক চোখে তাকিয়ে দেখছে সঞ্চিতা হাতে একটা গোলাপ নিয়ে দিগন্তের মুখোমুখি বসে। দিগন্তের মুখে কোনো শব্দই ছিলোনা৷ সে এক দৃষ্টে সঞ্চিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন দিগন্তের চোখের দৃষ্টি সঞ্চিতার চোখের ওপর সাতার কাটছিলো তখন তাদের মাথার ওপর দীর্ঘ সারীর কালো মেঘ ওড়াউড়ি করছিল। আর ধীরে ধীরে বয়ে আসা বাতাসটা হঠাৎ করেই জোরদার হয়ে উঠলো। সঞ্চিতা দিগন্তকে বললো, কিছু বলছোনা যে? হঠাৎ করেই প্রকান্ড একটা বাতাস এসে সঞ্চিতার লম্বা চুলগুলো কাঁধের দুপাশে থেকে উড়িয়ে এনে দিগন্তের মুখটা ঢেকে দিলো। দিগন্ত বললো, তোমার চুলগুলো সামলাও। সঞ্চিতা বললো, সেদিন আমাকে যেভাবে সামলিয়ে ছিলে ওদেরকেও আজ তুমি ওভাবেই সামলাও।।

মন্তব্য করুন