রাজা। এখনো অনেক ভাঙা বাকি, তুমিও তো আমার সঙ্গে যাবে নন্দিনী, প্রলয়পথে আমার দীপশিখা?
নন্দিনী। যাব আমি।
ফাগুলালের প্রবেশ
ফাগুলাল। বিশুকে ওরা কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। এ কে! এই বুঝি রাজা? ডাকিনী, ওর সঙ্গে পরামর্শ চলছে! বিশ্বাসঘাতিনী!
রাজা। কী হয়েছে তোমাদের? কী করতে বেরিয়েছ?
ফাগুলাল। বন্দীশালার দরজা ভাঙতে,মরি তবু ফিরব না।
রাজা। ফিরবে কেন? ভাঙার পথে আমিও চলেছি। ঐ তার প্রথম চিহ্ন– আমার ভাঙা ধ্বজা, আমার শেষ কীর্তি।
ফাগুলাল। নন্দিনী, ভালো বুঝতে পারছি নে। আমরা সরল মানুষ, দয়া করো, আমাদের ঠকিয়ো না। তুমি যে আমাদেরই ঘরের মেয়ে।
নন্দিনী। ফাগুভাই, তোমরা তো মৃত্যুকেই পণ করেছ, ঠকবার তো কিছুই বাকি রাখলে না।
ফাগুলাল। নন্দিনী, তুমিও তবে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলো।
নন্দিনী। আমি তো সেইজন্যই বেঁচে আছি। ফাগুলাল, আমি চেয়েছিলুম রঞ্জনকে তোমাদের সকলের মধ্যে আনতে। ঐ দেখো, এসেছে আমার বীর মৃত্যুকে তুচ্ছ ক’রে।
ফাগুলাল। সর্বনাশ! ঐ কি রঞ্জন! নিঃশব্দে পড়ে আছে!
নন্দিনী। নিঃশব্দ নয়। মৃত্যুর মধ্যে তার অপরাজিত কণ্ঠস্বর আমি যে এই শুনতে পাচ্ছি। রঞ্জন বেঁচে উঠবে– ও কখনো মরতে পারে না।
ফাগুলাল। হায় রে নন্দিনী, সুন্দরী আমার! এইজন্যই কি তুমি এতদিন অপেক্ষা করে ছিলে আমাদের এই অন্ধ নরকে!
নন্দিনী। ও আসবে বলে অপেক্ষা করে ছিলুম, ও তো এল। ও আবার আসার জন্যে প্রস্তুত হব, ও আবার আসবে। — চন্দ্রা কোথায় ফাগুলাল?
ফাগুলাল। সে গেছে গোকুলকে নিয়ে সর্দারের কাছে কাঁদাকাটি করতে। সর্দারের পরে তাদের অগাধ বিশ্বাস। — কিন্তু মহারাজ, ভুল বোঝ নি তো? আমরা তোমারই বন্দীশালা ভাঙতে বেরিয়েছি।
রাজা। হাঁ, আমারই বন্দীশালা। তোমাতে আমাতে দুজনে মিলে কাজ করতে হবে। একলা তোমার কাজ নয়।
ফাগুলাল। সর্দাররা খবর পেলেই ঠেকাতে আসবে।
রাজা। তাদের সঙ্গে আমার লড়াই।
ফাগুলাল। সৈন্যেরা তো তোমাকে মানবে না।
রাজা। একলা লড়ব, সঙ্গে তোমরা আছ।
ফাগুলাল। জিততে পারবে?
রাজা। মরতে তো পারব। এতদিনে মরবার অর্থ দেখতে পেয়েছি — বেঁচেছি।
ফাগুলাল। রাজা, শুনতে পাচ্ছ গর্জন?
রাজা। ঐ-যে দেখছি, সর্দার সৈন্য নিয়ে আসছে। এত শিগ্গির কী করে সম্ভব হল? আগে থাকতেই প্রস্তুত ছিল, কেবল আমিই জানতে পারি নি। ঠকিয়েছে আমাকে। আমারই শক্তি দিয়ে আমাকে বেঁধেছে।
ফাগুলাল। আমার দলবল তো এখনো এসে পৌঁছল না।
রাজা। সর্দার নিশ্চয় তাদের ঠেকিয়ে রেখেছে। আর তারা পৌঁছবে না।
নন্দিনী। মনে ছিল, বিশুপাগলকে তারা আমার কাছে এনে দেবে। সে কি আর হবে না।
রাজা। উপায় নেই। পথ ঘাট আটক করতে সর্দারের মতো কাউকে দেখি নি।
ফাগুলাল। তা হলে চলো নন্দিনী, তোমাকে নিরাপদ জায়গায় রেখে এসে তার পরে যা হয় হবে। সর্দার তোমাকে দেখলে রক্ষা থাকবে না।
নন্দিনী। একা আমাকেই নিরাপদের নির্বাসনে পাঠাবে? ফাগুলাল, তোমাদের চেয়ে সর্দার ভালো, সেই আমার জয়যাত্রার পথ খুলে দিলে। সর্দার! সর্দার! — দেখো, ওর বর্শার আগে আমার কুন্দফুলের মালা দুলিয়েছে। ঐ মালাকে আমার বুকের রক্তে রক্তকরবীর রঙ করে দিয়ে যাব। — সর্দার! আমাকে দেখতে পেয়েছে। জয় রঞ্জনের জয়!
[ দ্রুত প্রস্থান ]
রাজা। নন্দিনী!
[ প্রস্থান ]
অধ্যাপকের প্রবেশ
ফাগুলাল। কোথায় ছুটেছ, অধ্যাপক?
অধ্যাপক। কে যে বললে, রাজা এতদিন পরে চরম প্রাণের সন্ধান পেয়ে বেরিয়েছে — পুঁথিপত্র ফেলে সঙ্গ নিতে এলুম।
ফাগুলাল। রাজা তো ঐ গেল মরতে, সে নন্দিনীর ডাক শুনেছে।
অধ্যাপক।
তার জাল ছিঁড়েছে! নন্দিনী কোথায়?
ফাগুলাল।
সে গেছে সবার আগে। তাকে আর নাগাল পাওয়া যাবে না।
অধ্যাপক।
এইবারই পাওয়া যাবে। আর এড়িয়ে যেতে পারবে না, তাকে ধরব।
[ প্রস্থান ]
বিশুর প্রবেশ
বিশু। ফাগুলাল, নন্দিনী কোথায়?
ফাগুলাল। তুমি কী করে এলে?
বিশু। আমাদের কারিগররা বন্দীশালা ভেঙে ফেলেছে। তারা ঐ চলেছে লড়তে। আমি নন্দিনীকে খুঁজতে এলুম। সে কোথায়?
ফাগুলাল। সে গেছে সকলের আগে এগিয়ে।
বিশু। কোথায়?
ফাগুলাল। শেষ মুক্তিতে। — বিশু, দেখতে পাচ্ছ ওখানে কে শুয়ে আছে?
বিশু। ও যে রঞ্জন!
ফাগুলাল। ধুলায় দেখছ ঐ রক্তের রেখা?
বিশু। বুঝেছি, ঐ তাদের পরমমিলনের রক্তরাখী। এবার আমার সময় এল একলা মহাযাত্রার। হয়তো গান শুনতে চাইবে! আমার পাগলি! আয় রে ভাই, এবার লড়াইয়ে চল্।
ফাগুলাল। নন্দিনীর জয়!
বিশু। নন্দিনীর জয়!
ফাগুলাল। আর, ঐ দেখো, ধুলায় লুটচ্ছে তার রক্তকরবীর কঙ্কণ। ডান হাত থেকে কখন খসে পড়েছে। তার হাতখানি আজ সে রিক্ত করে দিলে চলে গেল।
বিশু। তাকে বলেছিলুম, তার হাত থেকে কিছু নেব না। এই নিতে হল, তার শেষ দান।
[ প্রস্থান ]
দূরে গান
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে,
আয় আয় আয়।
ধুলার আঁচল ভরেছে আজ পাকা ফসলে,
মরি হায় হায় হায়।
—–সমাপ্ত—–