নন্দিনীর প্রবেশ
নন্দিনী। দেখতে দেখতে সিঁদুরে মেঘে আজকের গোধূলি রাঙা হয়ে উঠল। ঐ কি আমাদের মিলনের রঙ। আমার সিঁথের সিঁদুর যেন সমাপ্ত আকাশে ছড়িয়ে গেছে। (জানলায় ঘা দিয়ে) শোনো, শোনো, শোনো। দিনরাত এখানে পড়ে থাকব, যতক্ষণ না শোনো।
গোঁসাইয়ের প্রবেশ
গোঁসাই। ঠেলছ কাকে।
নন্দিনী। তোমাদের যে-অজগর আড়ালে থেকে মানুষ গেলে তাকে।
গোঁসাই। হরি হরি, ভগবান যখন ছোটোকে মারেন তখন তার ছোটোমুখে বড়োকথা দিয়েই মারেন। দেখো নন্দিনী, তুমি নিশ্চয় জেনো, আমি তোমার মঙ্গল চিন্তা করি।
নন্দিনী। তাতে আমার মঙ্গল হবে না।
গোঁসাই। এসো আমার ঠাকুরঘরে, তোমাকে নাম শোনাইগে।
নন্দিনী। শুধু নাম নিয়ে করব কী।
গোঁসাই। মনে শান্তি পাবে!
নন্দিনী। শান্তি যদি পাই তবে ধিক্ ধিক্ ধিক্ আমাকে। আমি এই দরজায় অপেক্ষা করে বসে থাকব।
গোঁসাই। দেবতার চেয়ে মানুষের ‘পরে তোমার বিশ্বাস বেশি?
নন্দিনী। তোমাদের ঐ ধ্বজদণ্ডের দেবতা, সে কোনোদিনই নরম হবে না। কিন্তু জালের আড়ালের মানুষ চিরদিনই কি জালে বাঁধা থাকবে। যাও যাও, যাও। মানুষের প্রাণ ছিঁড়ে নিয়ে তাকে নাম দিয়ে ভোলাবার ব্যবসা তোমার।
[ গোঁসাইয়ের প্রস্থান ]
ফাগুলাল ও চন্দ্রার প্রবেশ
ফাগুলাল। বিশু তোমার সঙ্গে এল, সে এখন কোথায়। সত্য করে বলো।
নন্দিনী। তাকে বন্দী করে নিয়ে গেছে।
চন্দ্রা। রাক্ষসী, তুই তাকে ধরিয়ে দিয়েছিস! তুই ওদের চর।
নন্দিনী। কোন্ মুখে এমন কথা বলতে পারলে।
চন্দ্রা। নইলে এখানে তোর কী কাজ। কেবল সবার মন ভুলিয়ে ভুলিয়ে ঘুরে বেড়াস।
ফাগুলাল। এখানে সবাই সবাইকে সন্দেহ করে, কিন্তু তবু তোমাকে আমি বিশ্বাস করে এসেছি। মনে মনে তোমাকে– সে কথা থাক্। কিন্তু আজ কেমনতরো ঠেকছে যে।
নন্দিনী। হবে, তা হবে। আমার সঙ্গে এসেই বিপদে পড়েছে। তোমাদের কাছে নিরাপদে থাকত, সে কথা নিজেই বললে।
চন্দ্রা। তবে কেন আনলি ওকে ভুলিয়ে। সর্বনাশী!
নন্দিনী। ও-যে বললে, ও মুক্তি চায়।
চন্দ্রা। ভালো মুক্তি দিয়েছিস ওকে।
নন্দিনী। আমি তো ওর সব কথা বুঝতে পারি নে, চন্দ্রা। ও কেন আমাকে বললে, বিপদের তলায় তলিয়ে গিয়ে তবে মুক্তি। ফাগুলাল, নিরাপদের মার থেকে মুক্তি চায় যে-মানুষ, আমি তাকে বাঁচাব কী করে।
চন্দ্রা। ও-সব কথা বুঝি নে। ওকে ফিরিয়ে যদি না আনতে পারিস মরবি, মরবি। তোর ঐ সুন্দরপানা মুখখানা দেখে আমি ভুলি নে।
ফাগুলাল। চন্দ্রা, মিছে বকাবকি করে কী হবে। কারিগরপাড়া থেকে দলবল জুটিয়ে আনি। বন্দীশালা চুরমার করে ভাঙব।
নন্দিনী। আমি যাব তোমাদের সঙ্গে।
ফাগুলাল। কী করতে যাবে।
নন্দিনী। ভাঙতে যাব।
চন্দ্রা। ওগো, অনেক ভাঙন ভেঙেছ মায়াবিনী! আর কাজ নেই।
গোকুলের প্রবেশ
গোকুল। সবার আগে ঐ ডাইনীকে পুড়িয়ে মারতে হবে।
চন্দ্রা। মারবে? তাতে ওর শাস্তি হবে না। যে রূপ নিয়ে ও সর্বনাশ করে, সেই রূপটা দাও ঘুচিয়ে। খুরপো দিয়ে যেমন করে ঘাস নিড়োয়, তেমনি করে ওর রূপ দাও নিড়িয়ে।
গোকুল। তা পারি। একবার তুই হাতুড়ির নাচনটা–
ফাগুলাল। খবরদার! ওর গায়ে হাত দাও যদি তা হলে–
নন্দিনী। ফাগুলাল, তুমি থামো। ও ভীরু, আমাকে ভয় করে তাই আমাকে মারতে চায়। আমি ওর মারকে ভয় করি নে। কী করতে পারে করুক কাপুরুষ।
গোকুল। ফাগুলাল, এখনো তোমার চৈতন্য হয় নি! সর্দারকেই তুমি শত্রু বলে জান! তা হোক যে শত্রু সহজ শত্রু তাকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তোমাদের ঐ মিষ্টিমুখী সুন্দরী–
নন্দিনী। সর্দারকে তোমার শ্রদ্ধা! পায়ের তলাটাকে পায়ের তলার কাদার শ্রদ্ধা যেরকম। যে দাস সে কখনো শ্রদ্ধা করতে পারে?
ফাগুলাল। গোকুল, তোমার পৌরুষ দেখাবার সময় এসেছে। কিন্তু বালিকার কাছে নয়। চলো আমার সঙ্গে।
[ ফাগুলাল চন্দ্রা ও গোকুলের প্রস্থান ]
একদল লোকের প্রবেশ
নন্দিনী। ওগো, কোথায় চলেছ তোমরা।
প্রথম। ধ্বজাপুরের নৈবেদ্য নিয়ে চলেছি।
নন্দিনী। রঞ্জনকে দেখেছ?
দ্বিতীয়। তাকে পাঁচদিন আগে একবার দেখেছিলুম, আর দেখি নি। ঐ ওদের জিজ্ঞাসা করো, হয়তো বলতে পারবে।
নন্দিনী। ওরা কারা|
তৃতীয়। ওরা সর্দারের ভোজে মদ নিয়ে যাচ্ছে।
[ এই দলের প্রস্থান ]
অন্য দলের প্রবেশ
নন্দিনী। ওগো লালটুপিরা, রঞ্জনকে তোমরা দেখেছ?
প্রথম। সেদিন রাতে শম্ভুমোড়লের বাড়িতে দেখেছি।
নন্দিনী। এখন কোথায় আছে সে?
দ্বিতীয়। ঐ-যে সর্দারনীদের ভোজে সাজ নিয়ে চলেছে, ওদের জিজ্ঞাসা করো, ওরা অনেক কথা শুনতে পায় যা আমাদের কানে পৌঁছয় না।
[ এই দলের প্রস্থান ]
অন্য দলের প্রবেশ
নন্দিনী। ওগো, রঞ্জনকে এরা কোথায় রেখেছে তোমরা কি জান।
প্রথম। চুপ চুপ।
নন্দিনী। তোমরা নিশ্চয় জান, আমাকে বলতেই হবে।
দ্বিতীয়। আমাদের কান দিয়ে যা ঢোকে মুখ দিয়ে তা বেরোয় না, তাই টিঁকে আছি। ঐ-যে অস্ত্রের ভার নিয়ে আসছে, ওদের জিজ্ঞাসা করো।
[এই দলের প্রস্থান ]
অন্য দলের প্রবেশ
নন্দিনী। ওগো, একটু থামো, বলে যাও রঞ্জন কোথায়।
প্রথম। শোনো বলি, লগ্ন হয়ে এসেছে। ধ্বজাপূজায় রাজাকে বেরোতেই হবে। তাঁকেই জিজ্ঞাসা করো। আমরা শুরুটা জানি, শেষটা জানি নে।
[প্রস্থান]