গাঁও গ্রামের গরীব শমসের আলী, বয়স তাঁর ষাটেরও বেশি, দুই দুইটা মেয়ের দরদী, বউ তাঁহার ঘরের লক্ষ্মী, বড়ো সিদে সাদা মানুষ উনি৷
ভোর সকালে উঠিয়া, লাঙ্গল জোয়াল মই কাঁধে নিয়া, গরু দুই খানি, হাতে ধরি দড়ি, ছুটিতো গ্রামের বাড়ি বাড়ি৷
ডাকিতো যিনি তাঁকে, থেমে যেতো সেখানে, গরু দুইটা বাঁধিয়া গাছে, পাকাপোক্ত আলাপে, রোজের বায়নাটা সেরে ফেলে৷
একদিন খুব ভোরে, ঝিরিঝিরি বর্ষায় ভিজে ভিজে, বাবু মহাশয় ছুটিলেন পথে পথে, পাটের বীজ বুনিতে, ছয় শতক জমিতে, শীতে কাঁপছিলেন হালের খোঁজে৷
আধা ক্রোশ পথ দূরে, আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, গামছায় ভেজা মাথার জল মোছে, সাক্ষাৎ মেলে শমসের আলীর সাথে৷
পাইয়া তাঁহারে ক্ষণায়, বলিলেন বাবু মহাশয়, ওহে শমসের আলী চলো মোর জমিন খানায়, হাল জুড়িবে কতিপয়, দু ছটাক পাটের বীজ বুনিবো সেথায়!
আজ্ঞে, বাবু জানেন তো রোজ মোর কত? দুপুরে ঘন্টা আধেক বিশ্রাম নেবো? বেলা শেষে পরিশোধ করিবেন মুল্যপনেরো টাকা !
ওহে শমসের আলী বলি তো শোনো? দরাদরি কেন কর এত ? কমেই বা তোমায় দিয়েছিলাম কবে কখনো? হাসিমুখে তাহাই তো তুলে নিয়েছ!
বাবুর কথাখানা খুব মধুর, নিয়ে যায় হাল শমসের হুড়হুড়, মুখে আনন্দ গানের তোলে সুর, অভাব ঘরে তাঁর আজ বহুদূর, জমি বয়ে শেষ তিন শতক গড়িয়েছে দুপুর৷
দুপুরে বাবু আসিয়া কহিলেন উনি, ওহে শমসের আলী? আরো এভাবে কত শুনি? করিবে ধ্যানে রোজ চুরি?
দৈনিক তো পনেরো টাকাই নাও? কেন তবু সে খেয়াল ভুলে যাও? গতিখানা হালের এবার তো বাড়াও?
বাবু কি যে সব উদ্ভট কথা বলেন, আপনার কথাখানা আসিয়া পাঁজরে হানিলেন! কবে করেছি রোজ চুরি কহেন? কেমনে এ কথাখানা কহিতে পারিলেন?
রোজ চুরি মোর নাই ভাবনায়, দেই নাই খেতে গরু দুটায়, সকালে ঘরের লক্ষ্মী জল দেয় চাড়িখানায়, পলের ঢিপিটাও গিয়েছে পঁচে বর্ষায়৷
ঐযে ভোর সকালে পরিয়েছি গরু দুয়ের মুখে টোনা জোড়া, দুপুর হয়েছে বাঁচা মরা, এখনো টোনা জোড়া হলো না খোলা, কত আর জুড়িবে বলেন বাবু দুই গরু তো অবলা?
দুটো হাতের ভরে দেখেছ? হাল জুড়েছিল কেহ? এ স্বভাবখানা রেখেছ এখনো? শুধু গরুই কি ওহে শমসের কষ্ট পায় বলো?
ছয় শতক জমি মোর মাত্র, বিকেল তো ঘনিয়ে এলো! জুড়িবে কবে আর বাকি তিন শতক আরো?
ওহে শমসের আলী, এই নাও লরি, মাঝেমধ্যে লেজ দুটো ধরি ধরি, ডানে বায়ে মুখে হাঁট-হৈ বলি বলি, শুনিও কথা মোর যাহাই বলেছি!
হালের হাতলটা শক্ত করে ধর, দুই গরুর পীঠে মনে চাহে লরিখানা আস্তে মাড়িও, তবেই তো ছয় শতক জমি মোর জুড়ে শেষ করিতে পার?