বাসরে নিভেগেল প্রদীপ
————————
কবি :–রমেন মজুমদার
ছোট গল্প:–বাসরে নিভেগেল প্রদীপ
তারিখ:—-৩/৮/১৯
মা মরা একমাত্র সন্তান বৃষ্টিকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন
আকাশের ঘুড্ডির মত উড়ে বেড়ায় ! জীবনে দ্বিতীয় বিবাহ করাও পাপ ভেবে বৃষ্টির বাবা রহমত আলী আর বিবাহ করলেন না। তারও ধারণা,জীবনে একবারই মানুষ বিবাহ করে… ।
বিমাতা ঘরে তুললে হয়তো বৃষ্টির আদর থাকবেনা তেমনটাই ধারণা নিয়ে রহমত আলী দ্বিতীয় বিবাহে সায় দিলেন না ।
রহমতের কাছে সোনার টুকরোর মতন একখণ্ড ভূস্বর্গ হলো তার মেয়ে– বৃষ্টি !
শাহজাহানের মত করে ,ভালোবাসতে না পারলেও
জামিলাকে প্রাণদিয়ে ভালোবাসত রহমত ।
জামিলা ছিল রহমতের কাছে প্রাণকুঠুরির একমাত্ৰ
ভালোবাসার টিয়া পাখি ! আদরের বউ।
তাই সে জামিলাকে টিয়া বলে সম্ভোধন করতো !
অষ্টাদশী টিয়ার গর্ভে যখন বৃষ্টির আবির্ভাব তখন রহমত স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিল, জীবনে আর পাপ কাজ করবেনা ; আর তাদের সন্তান যাই আসুক তাকে মানুষের মত মানুষ করে সমাজে দেখিয়ে দিবে রহমত অন্যদের মত তার সন্তানও মানুষের মত মানুষ করতে পারে,
……আর সে মানুষ হয়েছে ।
দিন গড়িয়ে যায় দিনের গর্ভে,তার চলমান পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায় না—সন্ধ্যা পেরিয়ে সকাল,আবার সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা গড়ায় রাত্রির কোলে !
একদিন হঠাৎ টিয়ার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলে রহমত পাগলের মত ছুটাছুটি শুরু করে দিলেন।তখনকার সময় তেমন ডাক্তার পাননি হাতের কাছে।
সুদূর গ্রামথেকে উইনিয়ন বোর্ড আবার উইনিয়নবোর্ড থেকে থানা শহর,
থানা শহর ডিঙিয়ে তবেই জেলা শহরে পাওয়া যেত ভালো ডাক্তার !
কিন্তু অতো দূর থেকে ডাক্তার আনা সম্ভব নয় সুদূর গ্রামের বাড়িতে —।
তখন সবে মাত্র ব্রিটিশদের তাবেদারী শেষ হয়ে গান্ধীজী ও সুভাষ বোসের চরম আন্দোলন তুঙ্গে!
দেশ স্বাধীনতা পাওয়ার একটা নতুন সূর্য উঠি উঠি ভাব করছে পূবাকাশে !
তখন উইনিয়ন বোর্ডের কাছ থেকে একজন হাতুড়ি ডাক্তার আমরা যাকে বলি কোয়াক ডাক্তার! তাকেই নিয়ে এলেন রহমত টিয়ার চিকিৎসা করার জন্য !
টিয়ার গর্ভে যে সন্তান তার আকৃতি ও সাইজে অনেক বড় বলে ডাক্তার এসে ব্যাখ্যা করলেন।
দশ মাস দশ দিনের প্রবাদ বাক্য থাকলেও এখন সন্তান আগেই বেরিয়ে এসে পৃথিবীর আলো দেখতে চায় সে কথা জানাও ছিলনা রহমতের।
নয় মাস অতিক্রান্ত হতেই টিয়ার গর্ভব্যাথ্যা প্রচণ্ড ভাবে তাকে দৈহিক কাতর করে দিয়েছে।
ডাক্তার কয়েকটা টেবলেট ও বোতলে গোলানো লাল রঙের দাগকাটা জলা ঔষধ দিয়ে চলে গেলেন,
যাবার সময় বলে গেলেন চিন্তা নেই রাত্রের মধ্যেই ডেলিভারি হয়ে যাবে।
টিয়া অনেক কষ্ট করে গভীর রাতে সন্তান জন্ম দিলেন মৃত্যুর নিশানা উড়িয়ে —–
নিস্তেজ হয়ে গেল টিয়ার শরীর, একদিকে আকাশে কালমেঘের অপয়া শক্তি যেন বিদীর্ণ করে যায় পৃথিবীর বুকে চিরে !
অন্য দিকে সোনালী রোদ্দুর যেন পূবাকাশে আলোকিত করে ধরণী মাতাকে বলছে,আমি এসেছি শান্তির বাতাস নিয়ে, মা’তুমি শান্তিতে ঘুমাও— ঘুমাও!
ভোর হতেই টিয়ার জানাজার আয়োজন করা হলো,
এক চিলতে সন্তান বুকে নিয়ে রহমত স্ত্রীর কবরে নিজহাতে মাটি দিয়ে ঘরে ফিরলেন !!
হায়রে সংসার ! হায়রে জীবন ! এত ব্যথার মধ্যে এত সুখ রহমত চায়নি—।
সে চেয়েছিল সন্তান প্রতিপালন করবে তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীই !
একজন নারীর পক্ষে যে কাজটা করা সম্ভব,একজন পুরুষের পক্ষে সেটা কোনদিনই সম্ভভ হয় না—।
কিছু কিছু শূন্যস্থান জীবনেও পুরন করা যায় না
তা’শূন্যই থেকে যায় ।
মা’মরা দুধের শিশু বৃষ্টির দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন তার একমাত্র চাচাতো বোন বিধবা রামিলা খাতুন !
অনেকেই রহমতকে দ্বিতীয় বিবাহ করার জন্য অনেক অনুরোধ করলেন, রামিলাও বলেছিল ভাইজান তুমি আবার সাদী করে নাও !বৃষ্টিকে আমি নিজে হাতে মানুষ করে তুলতে পারবো।
—-তা’আর হয় নারে রামিলা !
তোর ভাবীকে স্পর্শ করে কথা দিয়েছি,আমি আর জীবনে দ্বিতীয় বিবাহ করবোনা….তোমার কিছু হয়ে গেলেও (!)
নিতুই নদীতে জোয়ার ভাটা আসে ! কিছু ভাসিয়ে নেয় ধূলিকণা,কিছু রেখেযায় তার স্মৃতি-দুঃখ!
তাই বলে তোমার সন্মুখে অনন্ত পথ চলার সময় পড়ে রয়েছে,তুমি বিয়ে করে নাও; সংসার মানুষের জন্যই ! তোমার সে স্ত্রীও বৃষ্টিকে মানুষ করবে দেখে নিও….
আরষ্ঠ গলায় কথাগুলো রামিলা ধীরে ধীরে রহমতকে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করলো;-
সে হয়তো ভেবেছিল এই বিধবার একটা কুলকিনারা হবে (?)
রামিলাও সতেরো বছর বয়সে বিবাহ করে নয় বৎসেরের মাথায় বিধবা হয়েছে, সেও এখন নিঃসন্তান!
পাড়ার অনেক লোকে রহমতকে বুঝিয়ে বাগে আনতে পারলোনা, তারাও ভেবেছিল যাক রামিলার একটা গতিপথ খুঁজে পাওয়া গেল, কিন্তু না…..
যে কথা সেই কাজ !
রহমত কোরআন শরীফ ছুঁয়ে প্ৰতিজ্ঞা করেছে,
ভালোবাসার স্ত্রীকে ছুঁয়ে একদিন যে কথা দিয়েছিল রহমত, সে সেই কথাকে কোরআন শরীফের মতোই আজও মনে করে ।
একদিন রামিলার কোলজুড়ে বৃষ্টি ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো, মাতৃত্বের স্বাদ রামিলার নিকট থেকেই বৃষ্টি সবটাই পেতে লাগলো……
দিন গড়িয়ে মাস ,আবার মাস গড়িয়ে হু হু করে বছর ঘুরতে ঘুরতে বৃষ্টির বয়স এখন প্রায় চৌদ্দ বছর হয়ে গেল।
রামিলার ইচ্ছা বৃষ্টিকে ভাইজান এখন পাত্রস্থ করুক ।
….ড্যাব ড্যাব করে বাড়ন্ত শরীর হয়ে উঠলো বৃষ্টির ! পাড়ার সকলে চায় ও’পাড়ার আই এ পাশ করা হারুনের সাথে বৃষ্টির বিবাহ দেউক রহমত।
ছেলে হিসাবে হারুনের মত এত ভদ্র আর দু’চারটি নেই সাত গ্রামের মধ্যে । ইতি মধ্যে হারুন এন জিও করে সামাজিক কিছু উন্নয়ন মূলক কাজ করে দুটি পয়সা রোজগারও করছে—–।
এমন পাত্র হাত ছাড়া করতে চায় না রামিলা ! তাই
রহমতকে অনেক বোঝাতে লাগলেন।
একদিন বৃষ্টির কানে রামিলা বিবাহের কথা তুললে বৃষ্টি নাকচ করে দিলো, কারণ সে জানে মেয়েদের কিছুটা স্বাবলম্বী হতে হয় । তা’ছাড়া বিবাহের বয়স
আঠারো না হলে সে বিয়েই করবে না ।
সাফ কথা জানিয়ে দিল তার ফুফুআম্মাকে ।
আঠারো বছর পূর্তি হয়ে যাবার পরে একদিন সকলের মতামতে খুব ধুমধাম করে বিবাহ হয়ে গেল হারুন ও বৃষ্টির !
সংসারে কেউ জানেনা বিনা মেঘেও কখনো আকাশে ঝড় বয়ে যেতে পারে,সমুদ্রের অতলে জমে থাকা সুনামিও কুণ্ডুলি পাকিয়ে আসতে পারে তট অতিক্রম করে !
হারুনের জন্মের পরে তার দাদু যে কষ্টি করে রেখে গেছেন,সে কথা আজ এত বছর পরে আর কারও মনে নেই ।
একসময় ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় বলে দিতে পারতেন রুগীর মুখ দেখে যে তার কি অসুখ! কীসে তার বিপদমুক্ত !!
হারুনের তা’জানা নেই কিছু ! ঘরের পাশে থাকা পাকা কলার কাঁদি থেকে হারুন কলা খেয়েছিল বাসর ঘরে প্রবেশের কালে।
দাদুর কষ্টি জানা থাকলেও হয়ত সে বিপদ এড়িয়ে চলা যেত ।
নিয়তির উপর কারো হাত নেই,
সংসার পরিমণ্ডলে তাই নিয়মের খেলাঘরে যা হবার তাই হলো—-
বাসরের প্রদীপ নিভে গেছে হয়তো,আর সে প্রদীপ জ্বলে ওঠবেনা কোনোদিন !!
বিষাক্ত কলার কালনাগিনীর ছোবলে হারুনের সমস্ত শরীর বিষে বিষে জর্জরিত হয়ে ভোর রাত্রে নিস্তেজ হয়ে গেল সুখের জ্বলন্ত প্রদীপ !!
অকালে বৈধব্য হলেন বৃষ্টি ।
কলকাতা।