পঞ্চবটি গ্রামটা যেন জন্ম থেকেই একটু বাঁকা। সোজা কথা সোজা ভাবে বললে নাকি গলার ব্যায়াম হয় না— এই যুক্তিতে এ গ্রামের লোকজন এমন সব প্যাঁচাল পাড়ে, শুনলে গরুও হাসতে হাসতে দুধ দেওয়া ভুলে যায়! আর গ্রামটার সর্বকালের সেরা পাঁচ প্যাঁচাল হল— গব্বর, চোঙ্গা, বিছুটি, ফটকু আর ঢেঁকি। পাঁচজনের মাথায় এত প্যাঁচ, যে তাদের কথার ঘূর্ণি থামাতে গেলে টাইফুনও মাথা নত করে পালায়।
একদিন সকালবেলা গব্বর ঘোষণা দিল, পঞ্চবটির উন্নতির জন্য “সমস্যা সমাধান কমিটি” গঠন করা হচ্ছে। চোঙ্গা গলা চড়িয়ে বলল, যেহেতু তার নাম চোঙ্গা, তাই বক্তৃতা দেওয়া একমাত্র তার অধিকার। বিছুটি তখন চুলকোতে চুলকোতে বলল, সে তো বিছুটি, তাই গায়ের জ্বালানি দিয়ে সমস্যার মূলে আগুন লাগানোর কাজটা তার। ফটকু ফটফটিয়ে বলল, যে দরজা খুলে সমস্যাকে ঢুকিয়ে দিবে সে-ই তো সে! ঢেঁকি দাঁত কেলিয়ে বলল, আর শেষে সে এসে সব সমস্যাকে পিষে একেবারে চ্যাপ্টা করে দেবে। এমন সিরিয়াস ভাব নিয়ে পাঁচজন মঞ্চে দাঁড়াতেই পঞ্চবটির লোকজন হাঁফ ধরে হাসতে লাগল। কারন তারা জানত, আজ মহা বিপর্যয়ের দিন!
প্রথমে এলেন গ্রামের এক বুড়ো মামা। তার অভিযোগ, তার হাঁস পুকুরে নামতে চায় না। গব্বর চিন্তায় পড়ে গেল, সে তো বড়ই দুঃখের কথা! হাঁসকে সোয়েটার পরানো ছাড়া উপায় নেই। চোঙ্গা তখন গলা উঁচু করে বলল, হাঁসের জন্য হেয়ার ড্রায়ার কিনতে হবে, যাতে গোসলের পরপরই শুকিয়ে যায়। বিছুটি বলল, গামছা পেঁচিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। ফটকু বলে উঠল, হাঁসের জন্যে গরম পানির জার রাখতে হবে। আর ঢেঁকি রায় দিল, হাঁসকে পিষে পেঁপে বানিয়ে দিলেই ঠান্ডা লাগার কোনো ভয় নেই। বুড়ো মামা হাঁস নিয়ে পালিয়ে গেল, আর জনতা লুটোপুটি খেতে লাগল।
এরপর এল এক পিচ্চি, তার কাকটা ঘুঘু হয়ে গেছে। শুনে চোঙ্গা বলল, কাকেরও তো উন্নতি দরকার! গব্বর বলল, কাককে ঘুঘুর কোর্সে ভর্তি করাও। বিছুটি বলল, আমি তো ঘুঘুর রং এনেই ফেলেছি, রঙচঙ করে দিলেই কাক ফুরফুরে ঘুঘু হয়ে যাবে। ফটকু বলল, কাকের সাথে ঘুঘুর বিয়ে পড়ালে নামটাই বদলে যাবে। ঢেঁকি আবার সেই চিরচেনা সমাধান দিল— কাকটাকে পিষে ঘুঘু বানিয়ে দিতে হবে। পিচ্চি কান্না চেপে সেখান থেকে দৌড় লাগাল।
তৃতীয় জন এল গাধার মালিক, তার প্রশ্ন— গাধা দুধ দেয় না কেন? গব্বর বলল, গাধাকে কবিতা শোনালে সে আবেগে দুধ দেবে। চোঙ্গা বলল, দুধ দোয়ানোর গান শোনাতে হবে গাধাকে। বিছুটি বলল, গাধার ঘাড়ে চিমটি কাটলে দুধ ঠিক বেরোবে। ফটকু বলল, দুধ বের করার জন্য গাধার জন্য স্পেশাল ফটক বানাতে হবে। আর ঢেঁকি বলল, গাধাটাকে পিষে দিলে দুধও আসবে, সঙ্গে ঘি-বাটার ফ্রি! মালিক হতাশ হয়ে গাধা নিয়ে সোজা পালিয়ে গেল।
এরপর এল এক বুড়ি, তার অভিযোগ— আমড়ার গাছে কলার মোচা ধরেছে। গব্বর দারুণ উত্তেজনায় বলল, এটা তো উন্নত প্রযুক্তির ফসল। আচার বানানো উচিত। চোঙ্গা বলল, নাম হবে ‘মোচা-আমড়া স্পেশাল’, বিদেশে রপ্তানি হবে। বিছুটি বলল, নাম আরও আধুনিক করতে হবে— ‘প্যাঁচাল পিকল’! ফটকু বলল, ফটকে ফেস্টুন টাঙাতে হবে, “দেখুন পঞ্চবটির প্যাঁচালো আচার!” ঢেঁকি তো আবার সেই পিষেই সমস্যার সমাধান দেখতে পেল। বুড়ি একটুও না হাসে পালিয়ে গেল, আর দর্শকরা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি।
সবশেষে এল এক পাগল। তার দাবি— পিঁপড়েদের জন্য ফ্রিজ কিনবে। গব্বর বলল, ফ্রিজ কিনলে পিঁপড়া বরফ হয়ে যাবে। চোঙ্গা বলে উঠল, তবে ওদের জন্য হিটার ফ্রিজ বানাতে হবে। বিছুটি বলল, পিঁপড়ার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিলে আর ঠান্ডা লাগবে না। ফটকু বলল, ফ্রিজের দরজা খোলা রাখলেই চলবে। আর ঢেঁকি তো সেই পুরনো পদ্ধতিতেই পিঁপড়াকে পিষে বরফ বানানোর কথা বলল। পাগলটা হাত তুলে বলল, “তোমরা পাঁচ প্যাঁচাল আসলে পঞ্চবটির পাঁচ প্যাঁচানো স্ক্রু।”
সেদিনের পর থেকে গ্রামে কেউ আর সমস্যার সমাধান চাইতে যায় না, কারণ “সমস্যা সমাধান কমিটি” মানেই প্যাঁচালের খনি। তবে গ্রামের একটাও মানুষ নেই, যে পাঁচ প্যাঁচালের নাম শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় না। পঞ্চবটির গল্প এখন দেশের সব প্যাঁচা-কুমিরেরও মুখে মুখে!
দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।