Skip to content

দুটি শিক্ষনীয় প্রবন্ধ -বিচিত্র কুমার

(০১)
ঈর্ষা
-বিচিত্র কুমার

মানুষের মনে যেসব অনুভূতি জন্ম নেয়, তার মধ্যে ঈর্ষা এক গভীর ও প্রাচীন প্রবৃত্তি। এটা এমন এক মানসিক অবস্থা, যা নিঃশব্দে হৃদয়ের গভীরে বিষবৃক্ষের মতো ডালপালা মেলতে থাকে। ঈর্ষা মানুষকে কুরে কুরে খায়, অথচ বাইরে থেকে সহজে ধরা যায় না। বাস্তব জীবনে ঈর্ষার নানা রূপ রয়েছে, যার একটিও নিছক তত্ত্বকথায় আটকে নেই। বরং ঈর্ষা প্রতিদিনের জীবনের এমন এক সঙ্গী, যা মানুষ কখনো মেনে নেয়, কখনো তা অস্বীকার করে নিজের কাছেই।

মানুষ জন্মগতভাবে তুলনামূলক চিন্তাভাবনায় অভ্যস্ত। কে কী পেল, কে কোথায় এগোল, কার কীর্তি কত উজ্জ্বল—এ ভাবনার ভেতর দিয়েই সমাজে এগিয়ে চলার প্রবণতা তৈরি হয়। অথচ এই তুলনার জালেই জড়িয়ে পড়ে ঈর্ষার সূক্ষ্ম তন্তুগুলো। ছোট্ট শিশুও তার সহপাঠীর চকচকে খেলনার প্রতি ঈর্ষান্বিত হতে পারে। আবার বৃদ্ধ বয়সেও কেউ কারো সামাজিক মর্যাদার প্রতি ঈর্ষা অনুভব করতে পারে।

বাস্তব জীবনে ঈর্ষার চেহারা অনেকটাই ছদ্মবেশী। সরাসরি আঘাত করে না, বরং নিঃশব্দে ভেতরে ভেতরে জ্বালাতে থাকে। অফিসে সহকর্মীর পদোন্নতি, পড়শির নতুন বাড়ি, বন্ধুর সফলতা—এসব দেখে অনেকে বাহ্যিকভাবে অভিনন্দন জানায়, অথচ অন্তরে ঈর্ষার আগুনে পুড়ে ছাই হয়। কেউ কেউ মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে, আবার কেউ কেউ সুযোগ পেলেই কুটুক্তি করে, ছোটো করতে চায়।

ঈর্ষা শুধু অন্যের ভালোকে দেখতে না পারার মানসিকতা নয়, বরং নিজের অপূর্ণতাকে মেনে নিতে না পারার প্রতিবিম্বও বটে। যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট, সে অন্যের প্রাপ্তিতে আনন্দ পেতে পারে। কিন্তু যে নিজের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতাকে নিজের ভিতর স্বীকার করতে পারে না, তার কাছে অন্যের উন্নতি একধরনের তিক্ত স্মৃতি হয়ে ওঠে। এই অস্বীকার থেকেই জন্ম নেয় ঈর্ষা।

আজকের সমাজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঈর্ষাকে যেন নতুন রূপ দিয়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের জগতজুড়ে মানুষের জীবন যেন শুধুই সুখ আর সফলতায় ভরা। এই বাহ্যিক চাকচিক্যের ভিড়ে অনেকেই নিজের জীবনের দৈন্যতা অনুভব করে, অন্যের সাফল্যের ছবি দেখে মনে মনে পুড়ে যায়। ফলে ঈর্ষা ছড়িয়ে পড়ে এক ক্লিকের ব্যবধানে, এক স্ক্রলেই মন বিষিয়ে ওঠে।

কিন্তু ঈর্ষার সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, এটা শুধু মানসিক কষ্টই দেয় না, বরং ধীরে ধীরে আচরণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঈর্ষান্বিত মানুষ নিজের কর্মক্ষেত্রে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে, সহকর্মীর সফলতা দেখে বিদ্বেষ জন্মায়। কেউ কেউ প্রতিযোগিতার নামে অসৎ পথ বেছে নেয়, আবার কেউ পরনিন্দা ও পরচর্চায় মেতে ওঠে। এতে সমাজে বিভেদ বাড়ে, সম্পর্ক নষ্ট হয়, কাজের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে ওঠে।

বাস্তব জীবনের উদাহরণ বলতে গেলে দেখা যায়—একজন মেধাবী ছাত্র, যিনি সবসময় সেরা ফলাফল করতেন, হঠাৎ তার সহপাঠী যখন তার চেয়ে ভালো ফল করে, তখন সে সহপাঠীর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়। কিন্তু এই ঈর্ষা তাকে আরও পরিশ্রমী করে তুলতে পারত। কিন্তু সে যদি সেই সহপাঠীর সুনাম ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করে, কিংবা নিজে হতাশায় ডুবে যায়, তবে ঈর্ষা হয়ে ওঠে তার সর্বনাশের কারণ।

অন্যদিকে, অফিসের এক কর্মচারী, যিনি বছরের পর বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করেও পদোন্নতি পাচ্ছেন না, অথচ তারই জুনিয়র সহজেই পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তার মনে ঈর্ষার উদ্ভব হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যদি সে নিজের কাজের দক্ষতা বাড়াতে মনোযোগ দেয়, তবে সেই ঈর্ষা তাকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু যদি সে সেই সহকর্মীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, তাকে ছোট করার পরিকল্পনা করে, তবে সে নিজেই নিজের পায়ের নিচে কুড়োল মারছে।

ঈর্ষা এমন এক আগুন, যা নিজের হৃদয়কেই পুড়িয়ে দেয়। অন্যের ভালো থাকার মধ্যে নিজের অপূর্ণতার ছায়া দেখা শুরু হয়, এবং সেই ছায়ার মধ্যেই ধীরে ধীরে মানুষ ডুবে যায়। তাই ঈর্ষাকে জয় করার একমাত্র উপায় হলো আত্মপরিচয়কে পরিষ্কার করা, নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নেওয়া এবং নিজের লক্ষ্যকে স্পষ্ট করে সামনে এগোনো।

ঈর্ষা কখনোই অন্যের উন্নতিকে থামাতে পারে না, বরং নিজের চলার পথকেই দুর্গম করে তোলে। এই সত্যটি বোঝার জন্য প্রয়োজন আত্মসমালোচনার সাহস। আমাদের সমাজে এই আত্মসমালোচনার চর্চা নেই বললেই চলে। বরং অন্যের ভুল খুঁজে বের করাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে ঈর্ষা পোষণ করা সহজ হয়ে যায়, নিজেকে পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে পড়ে।

তবে মানুষের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে ঈর্ষার নেতিবাচক দিক সম্পর্কে শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষা বলতে শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, বরং নৈতিক শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা, সহনশীলতার শিক্ষা। পরিবারে, স্কুলে, সমাজে যদি শিশুদের শেখানো হয়—অন্যের ভালো দেখে আনন্দিত হওয়া, নিজেদের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে পরিশ্রম করা, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঈর্ষার মতো মানসিক ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।

ঈর্ষার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হলো কৃতজ্ঞতা। যখন মানুষ নিজের প্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞ থাকে, তখন সে অন্যের প্রাপ্তিতে ঈর্ষান্বিত হয় না। কৃতজ্ঞতা মানুষকে শান্তি দেয়, আর ঈর্ষা মানুষকে অস্থির করে তোলে। যারা নিজেদের অর্জনকে ছোট মনে করে, তারাই অন্যের অর্জনে ঈর্ষান্বিত হয়। অথচ প্রত্যেকের জীবনেই কিছু না কিছু অর্জন থাকে, যা হয়তো সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারে না। তাই আত্মবিশ্বাস ও কৃতজ্ঞতাই পারে ঈর্ষার বিষ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে।

ঈর্ষা যে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ঈর্ষার ছায়া বিস্তৃত। এক সমাজ অন্য সমাজের উন্নতি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়, এক রাজনৈতিক দল অন্য দলের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠে। ফলে শুরু হয় অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা। এই ঈর্ষা সমাজের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর।

মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে দেখতে গেলে ঈর্ষা একটি দুর্বলতা। মানুষ যদি এই দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে পারে, তবে সে সত্যিকার অর্থেই উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে পারে। ঈর্ষা মানুষকে ছোটো করে, তাকে সংকীর্ণ করে, তার চিন্তাধারাকে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে। অথচ মহান মনীষীরা কখনোই ঈর্ষাকে প্রশ্রয় দেননি। তারা নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে জেনে, পরিশ্রম করে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে গেছেন।

ঈর্ষা স্বাভাবিক, কিন্তু সেটিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটাই আসল বিষয়। কেউ ঈর্ষাকে শক্তিতে পরিণত করে, কেউ আবার নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। যারা ঈর্ষাকে শক্তিতে পরিণত করে, তারা অন্যের সফলতা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়, নিজেদের ভুল শোধরানোর চেষ্টা করে, নিজেদের উন্নত করে তোলে। অন্যদিকে যারা ঈর্ষাকে পুষে রাখে, তারা ধীরে ধীরে বিষণ্ণতা, হতাশা, হীনমন্যতার জালে আটকে যায়।

পরিশেষে বলা যায়, ঈর্ষা এক অনিবার্য মানসিক প্রতিক্রিয়া হলেও এটি মানুষের জন্য ক্ষতিকর, যদি তা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়। ঈর্ষা থেকে মুক্ত থাকতে হলে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, কৃতজ্ঞতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। ঈর্ষার বিরুদ্ধে সংগ্রাম মানেই নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয় করার সংগ্রাম। যে ব্যক্তি নিজেকে জয় করতে পারে, সে-ই প্রকৃত বিজয়ী। অন্যের আলো দেখে যদি নিজেকে জ্বালানোর সাহস থাকে, তবে ঈর্ষা কখনোই ক্ষতিকর নয়, বরং তা হয়ে ওঠে উন্নতির অনুপ্রেরণা।

মানুষের জীবন যাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ঈর্ষার উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু কোন পথে যাবো, ঈর্ষার জ্বালায় পুড়ে ছাই হয়ে যাবো, না কি সেই আগুনে নিজেকে আরও উজ্জ্বল করে তুলবো—এই সিদ্ধান্ত আমাদের নিজেরই নিতে হবে।

(০২)
অভিযোগ
-বিচিত্র কুমার

মানুষের মনের গভীরতম এক প্রবৃত্তির নাম ‘অভিযোগ’। এটা এমন এক অনুভূতি, যা মানুষ নিজের অজান্তেই লালন করে চলে। কেউ সরাসরি প্রকাশ করে, কেউ আবার চেপে রাখে, কিন্তু অভিযোগের বীজ প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের কোণে রোপিত থাকে। বাস্তব জীবনে এই অভিযোগ কখনও ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে তার ছায়া বিস্তার করে।

একজন শ্রমিক যখন দিনশেষে ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরে, তখন তার মনে জাগে অভিযোগ—তার শ্রমের প্রকৃত মূল্য সে পায় না। একজন ছাত্র, যে বছরের পর বছর পড়ে, অথচ পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল পায় না, তার মনে জন্ম নেয় অভিযোগ—শিক্ষা ব্যবস্থা তার প্রতি সুবিচার করেনি। এক গৃহিণী, যে দিনের পর দিন নিঃশব্দে পরিবারের সেবা করে যায়, সে হয়তো মনে মনে অভিযোগ করে—তার শ্রমকে কেউ মূল্য দেয় না।

অভিযোগের জন্ম হয় তখনই, যখন মানুষ মনে করে সে যে প্রাপ্য, তা সে পায়নি। এটি একধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া, যেখানে মানুষ নিজের অপূর্ণতা, হতাশা কিংবা সীমাবদ্ধতাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। কখনও তা যুক্তিসঙ্গত, আবার কখনও শুধুই মানসিক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ।

সমাজে অভিযোগের সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে পরিবারে। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের অভিযোগ—তারা বুঝতে পারে না, স্বাধীনতা দেয় না, তুলনার চোখে দেখে। আবার সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অভিযোগ—তারা অকৃতজ্ঞ, দায়িত্বজ্ঞানহীন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও অভিযোগের ছায়া পড়ে। স্ত্রী বলে—স্বামী সংসারে মনোযোগী নয়, অনুভূতি বোঝে না। স্বামী বলে—স্ত্রী শুধুই দাবি জানায়, কৃতজ্ঞতা জানায় না। এইসব পারস্পরিক অভিযোগই অনেক সময় সম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে।

কর্মক্ষেত্রেও অভিযোগের শেষ নেই। একজন কর্মচারী মনে করে, তার প্রতিভা মূল্যায়িত হচ্ছে না, তার পরিশ্রমের স্বীকৃতি নেই। আবার মালিকের অভিযোগ—কর্মচারীরা দায়িত্বশীল নয়, কেবল সুবিধা নিতে চায়। এই অভিযোগের পাল্টা অভিযোগের ভেতর দিয়ে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ক্রমশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।

অভিযোগের জগতে সবচেয়ে বড়ো জায়গা করে নিয়েছে রাজনীতি। সাধারণ মানুষের অভিযোগ—রাষ্ট্র তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। রাজনীতিবিদদের অভিযোগ—মানুষ দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আচরণ করে না। প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ অভিযোগ তোলে—দুর্নীতি, হয়রানি, অনিয়ম। আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসে—মানুষ আইন মানে না, শৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে অভিযোগ যেন এক ভয়াবহ মহামারীতে পরিণত হয়েছে। ফেসবুকের পোস্ট, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের স্টোরি—সবখানে মানুষের অভিযোগের ঝড়। কেউ সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে, কেউ ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অথচ খুব কম মানুষই সমাধানের কথা বলে। অভিযোগ শুধু শব্দে সীমাবদ্ধ থাকে, কাজের জায়গায় এসে থামে না।

বাস্তব জীবনের বহু ঘটনা আছে যেখানে অভিযোগই একেকটি বড়ো সংকটের জন্ম দিয়েছে। এক অফিসে সহকর্মীদের মধ্যে অভিযোগ-অভিযোগ করে দলাদলি শুরু হয়। ফলে কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়, উৎপাদন কমে যায়। অন্যদিকে, এক পরিবারে এক ভাইয়ের অভিযোগ ছিল—তার ভাগ্যকে অন্য ভাইয়ের তুলনায় অবহেলা করা হয়েছে। সেই অভিযোগ থেকে জন্ম নেয় দ্বন্দ্ব, যা শেষে সম্পত্তি বিভাজনের মতো কঠিন পরিণতি ডেকে আনে।

অভিযোগ সবসময় অন্যায় নয়, বরং অনেক সময় অভিযোগই পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করে। কিন্তু যখন অভিযোগ কেবল শব্দের স্তরে আটকে থাকে, তখন তা নিজের ক্ষতিই ডেকে আনে। অভিযোগ যদি কর্মে রূপান্তরিত না হয়, তবে তা হয়ে ওঠে শুধু মানসিক বিষ।

অভিযোগের একটি সূক্ষ্ম দিক হলো—মানুষ প্রায়ই নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যের উপর অভিযোগ চাপিয়ে দেয়। নিজের সীমাবদ্ধতা, পরিশ্রমের ঘাটতি, ভুল সিদ্ধান্তের দায় অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া অনেক সহজ। ফলে নিজের মধ্যে আত্মসমালোচনার প্রবণতা তৈরি হয় না। মানুষ ভাবে, “আমার দোষ নয়, পরিস্থিতি দোষী।” এই প্রবণতা থেকে জন্ম নেয় ‘অভিযোগ করার সংস্কৃতি’।

তবে সমাজে এমন মানুষও আছে, যারা অভিযোগকে শক্তিতে পরিণত করে। তারা নিজেদের প্রতি হওয়া অবিচার, অবহেলা, বৈষম্যকে জীবনের অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে। তারা প্রতিবাদ করে, পরিবর্তনের জন্য কাজ করে, নিজেদের উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে। তারা জানে, অভিযোগ করে বসে থাকলে কিছুই পরিবর্তন হবে না।

অভিযোগের একটি ইতিবাচক দিকও রয়েছে—যদি তা যুক্তিসঙ্গতভাবে এবং সমাধানের লক্ষ্যে করা হয়। যেমন, একজন নাগরিক যখন সেবা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এবং কর্তৃপক্ষ সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়, তখন অভিযোগ হয়ে ওঠে উন্নয়নের হাতিয়ার। কিন্তু যদি সেই অভিযোগ শুধু সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা নিজের অস্থিরতাই বাড়ায়।

অভিযোগ অনেক সময় মানুষের আত্মসম্মানবোধের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে। মানুষ মনে করে, অন্য কেউ তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়নি, ফলে মনে মনে সে অভিযোগ করে। এই অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে জমতে জমতে একদিন বিস্ফোরণ ঘটায়। সম্পর্ক ভেঙে যায়, সমাজে অবিশ্বাসের দেয়াল গড়ে ওঠে। অথচ যদি সেই অভিযোগ সময়মতো প্রকাশ পেত, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা যেত, তবে হয়তো অনেক অনর্থক ভাঙন এড়ানো সম্ভব হতো।

অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হলো—নিজেকে জানার ক্ষমতা। আত্মবিশ্বাস, আত্মসমালোচনার মানসিকতা, নিজের দুর্বলতা মেনে নেওয়ার শক্তি মানুষকে অভিযোগ করার প্রবণতা থেকে দূরে রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে অন্যের দোষ খোঁজার সংস্কৃতি এতটাই প্রবল যে, নিজেদের ভুল দেখতে চাই না। ফলে অভিযোগের ফাঁদে আটকে পড়ে জীবন অস্থির হয়ে ওঠে।

পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ যদি শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শেখায়—“অভিযোগ নয়, সমাধান খোঁজো,” তবে একদিন সমাজ বদলাবে। শিক্ষক যদি ছাত্রের অভিযোগ শোনার পাশাপাশি তার সমাধান ভাবতে শেখান, পরিবারে যদি সন্তানের অভিযোগ শোনার পাশাপাশি তার সমস্যার গভীরে যাওয়া হয়, তবে এক নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে যারা শুধু অভিযোগকারী নয়, বরং সমস্যার সমাধানকারী হবে।

মানুষের মনে অভিযোগের জমাট বাঁধা আসলে একধরনের মানসিক ভার। যতক্ষণ না সেই ভার লাঘব করা যায়, ততক্ষণ মন অস্থির থাকবে। তাই অভিযোগ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন—খোলামেলা আলোচনা, সমস্যা বুঝে সমাধানের চেষ্টা এবং নিজের ভিতরে ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করা।

অভিযোগ স্বাভাবিক, কারণ মানুষ চায় সে তার প্রাপ্যটুকু পাক। কিন্তু সেই প্রাপ্য পাওয়ার জন্য প্রয়োজন কাজ, যুক্তি এবং উদ্যোগ। অভিযোগ শুধু মুখে বললে তা অভিযোগই থাকে, কিন্তু যদি তা থেকে কাজের অনুপ্রেরণা আসে, তবে তা হয়ে ওঠে পরিবর্তনের হাতিয়ার।

অভিযোগ নিয়ে জীবন পার করে দেওয়া মানে নিজের সময় নষ্ট করা। বরং অভিযোগকে নিজের শক্তি বানিয়ে, সেই জায়গা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলাই মানুষের উচিত। যে ব্যক্তি নিজের অভিযোগকে জয় করতে পারে, সে-ই নিজের জীবনকে জয় করতে পারে। অন্যের উপর দোষ চাপানোর চেয়ে নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয় করার শক্তিই মানুষকে সত্যিকার অর্থে বড় করে তোলে।

অভিযোগ থেকে মুক্তির প্রথম ধাপ হলো—নিজের সমস্যাকে গভীরভাবে বোঝা। যখন মানুষ বুঝতে পারে, তার সমস্যা কোথায়, তখন সে অভিযোগের বদলে সমাধান খোঁজার পথে হাঁটে। তখন অভিযোগ হয়ে ওঠে শুধু মানসিক চাপ নয়, বরং একধরনের সচেতনতা।

আজকের সমাজে অভিযোগের জাল ছিঁড়ে ফেলে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হলে প্রয়োজন—সহনশীলতা, মানবিকতা, এবং আত্মসমালোচনার চর্চা। যেদিন মানুষ নিজের দিকে আঙুল তুলতে শিখবে, সেদিনই অভিযোগের প্রকৃত মুক্তি ঘটবে। অভিযোগ নয়, সমাধান—এই মনোভাবই পারে মানুষকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753

https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL

মন্তব্য করুন