Skip to content

দুটি প্রবন্ধ -বিচিত্র কুমার

(০১)
প্রতিহিংসা
-বিচিত্র কুমার

প্রতিহিংসা — শব্দটির মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত উত্তাপ, যা মানুষকে নীরব আগুনের মতো জ্বালিয়ে দেয়। প্রতিহিংসা কোনো বাহ্যিক অস্ত্র নয়, এটি মানুষের মনের গভীরে সঞ্চিত এক ধরনের মানসিক আগ্রাসন, যা একসময় অন্যের ক্ষতির মাধ্যমে নিজের অপূর্ণতা ঢাকতে চায়। কিন্তু বাস্তবে এই প্রতিহিংসার শিকার হয় সেই মানুষটিই, যে তার বুকে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে রাখে।

প্রতিহিংসার সূচনা সাধারণত ঘটে অপমান, অবিচার কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হবার একধরনের মানসিক আঘাত থেকে। যখন মানুষ নিজেকে দুর্বল, পরাজিত বা প্রতারিত মনে করে, তখন সেই বেদনা থেকে জন্ম নেয় প্রতিহিংসার বীজ। এই বীজ ধীরে ধীরে মনের ভেতরে শিকড় বিস্তার করে এবং এক সময় তা একটি বিষবৃক্ষে পরিণত হয়, যার ছায়ায় মানুষ নিজেই আশ্রয় নেয়।

বাংলার গ্রামাঞ্চলে তাকালেই আমরা প্রতিহিংসার বহু বাস্তব ছবি দেখতে পাই। জমি-জায়গা নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে শুরু হয় সামান্য বিরোধ। সেই বিরোধই ধীরে ধীরে রূপ নেয় আদালত পর্যন্ত গড়ানো মামলা-মোকদ্দমায়। একসময়ের আদরের ভাইটি পরিণত হয় চরম শত্রুতে, যাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্কের চেয়ে প্রতিশোধের আগুনই প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু যে জমির জন্য তাদের এত দ্বন্দ্ব, সেই জমি একদিন পড়ে থাকে ফাঁকা। কারণ প্রতিহিংসার যুদ্ধে দু’জনেই পরাজিত হয়, হারায় পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক মর্যাদা এবং শান্তিপূর্ণ জীবনের অধিকার।

শহরাঞ্চলের মধ্যেও প্রতিহিংসার চিত্র ভিন্ন নয়। অফিসে কর্মরত সহকর্মীদের মধ্যে পদোন্নতি নিয়ে হিংসা-বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়, কেউ কারও প্রতি মিথ্যা অভিযোগ তোলে, কেউ আবার সুযোগ বুঝে ফাঁদ পেতে সহকর্মীর কর্মজীবন ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। এই ক্ষুদ্র প্রতিহিংসার ঘটনাগুলো প্রথমে অবহেলিত হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বৃহৎ সমস্যায় রূপ নেয়। একজন ব্যক্তি যখন অন্যের ক্ষতি করতে সচেষ্ট হয়, তখন সে নিজের মনোজগতেই অশান্তি সৃষ্টি করে। সে প্রতিনিয়ত নিজের মধ্যে অপরাধবোধ, দ্বিধা ও অস্বচ্ছ মানসিকতা পুষে রাখে, যা ধীরে ধীরে তার আত্মবিশ্বাস, কর্মক্ষমতা এবং চরিত্রকে গ্রাস করে।

প্রতিহিংসার সবচেয়ে বিষাক্ত রূপ ফুটে ওঠে পারিবারিক সম্পর্কগুলোতে। একজন স্বামী যখন স্ত্রীর কোনো কথায় আঘাত পেয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে, তখন তা দাম্পত্য জীবনে বিষ ছড়িয়ে দেয়। স্ত্রীর প্রতি নির্দয় ব্যবহার, অবহেলা কিংবা প্রতিশোধমূলক মানসিক নিপীড়ন একটি সম্পর্ককে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। একইভাবে স্ত্রীও যদি আঘাতের প্রতিদান দিতে প্রতিহিংসার পথ বেছে নেয়, তবে সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা ও বিশ্বাসের স্থান দখল করে নেয় ঘৃণা ও প্রতিহিংসা। অথচ এইসব সম্পর্কই যদি ক্ষমা, সহানুভূতি ও মন খোলা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেত, তাহলে হয়তো বহু পরিবার ভাঙনের হাত থেকে বেঁচে যেত।

প্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্কেও প্রতিহিংসার নির্মমতা অস্বীকার করা যায় না। যখন প্রেমিক বা প্রেমিকা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়, তখন অনেকে সেই দুঃখ ভুলতে না পেরে প্রতিহিংসার পথ ধরে। সামাজিক মাধ্যমে গুজব রটানো, ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য ফাঁস করা, এমনকি সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার মতো জঘন্য কাজের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু এই প্রতিহিংসার পথ ধরতে গিয়ে মানুষ নিজেকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। প্রতিহিংসার আগুনে অন্যকে পোড়াতে গিয়ে সে নিজেও জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রতিহিংসার প্রভাব সুস্পষ্ট। ক্ষমতার লোভ, পরাজয়ের অপমান, অথবা প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থান সহ্য করতে না পেরে অনেকে প্রতিহিংসার পথে নামে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে জন্ম নেয় হানাহানি, দাঙ্গা এবং সংঘর্ষ। অথচ রাজনীতির আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দেশের উন্নতি ও জনগণের কল্যাণ। কিন্তু সেখানে প্রতিহিংসার বিষবৃক্ষ রোপণ হলে তা সমাজকে বিভক্ত করে দেয়।

প্রতিহিংসা শুধুমাত্র ব্যক্তি বা সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সমাজব্যাপী তার ছায়া বিস্তার করে। ধর্ম, জাতি, বর্ণভিত্তিক বিভাজনেও প্রতিহিংসার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এক ধর্মের অনুসারীরা অন্য ধর্মের উপর প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব পোষণ করে; এক জাতির মানুষ অন্য জাতির প্রতি ঘৃণা লালন করে; এইসব প্রতিহিংসার বীজই একদিন রূপ নেয় দাঙ্গা, সংঘর্ষ, এমনকি যুদ্ধের মতো ভয়াবহ ঘটনায়।

মানুষ যখন প্রতিহিংসার আবেগে অন্ধ হয়ে যায়, তখন সে নৈতিকতা, মানবিকতা এবং নিজের আত্মমর্যাদাকেও বিসর্জন দেয়। অথচ প্রতিহিংসা শেষ পর্যন্ত কাউকেই শান্তি দেয় না। সাময়িক একধরনের আত্মতৃপ্তি দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা মানসিক অস্থিরতা, অপরাধবোধ এবং নিঃসঙ্গতার শিকলে বেঁধে ফেলে মানুষকে।

প্রতিহিংসার প্রকৃত প্রতিষেধক হলো ক্ষমা। ক্ষমা করার মধ্যে এমন এক অদ্ভুত শক্তি রয়েছে, যা প্রতিহিংসার সমস্ত তীব্রতা নিস্তেজ করে দিতে পারে। কেউ যদি আমাদের আঘাত দেয়, এবং আমরা তাকে ক্ষমা করতে পারি, তবে সেই মানুষটির উপর আমাদের চেয়ে বড় বিজয় আর কিছু হতে পারে না। ক্ষমা করা কোনো দুর্বলতার চিহ্ন নয়, বরং এটি সাহস এবং শক্তির প্রকৃত প্রকাশ।

মানুষের জীবনে প্রতিহিংসার পরিবর্তে ক্ষমা ও সহানুভূতির চর্চা শুরু হলে ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজ পর্যন্ত শান্তির ছায়া নেমে আসবে। পরিবারে ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির সময় প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব পরিত্যাগ করে ক্ষমার হাত বাড়িয়ে দিতে পারলে সম্পর্কগুলো অটুট থাকবে। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত না হয়ে তার সাফল্যের গল্প থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে ব্যক্তিগত উন্নতিও সম্ভব হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু মনে না করে মতপার্থক্যকে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা তৈরি হলে সমাজ হবে আরো ঐক্যবদ্ধ।

জীবনের ছোট ছোট ঘটনাতেই প্রতিহিংসার বীজ রোপিত হয়। তাই এই বিষবৃক্ষের শিকড় কেটে ফেলতে হলে ছোটবেলা থেকেই মানুষকে ক্ষমা করার শিক্ষা দিতে হবে। শিশুকে বোঝাতে হবে, প্রতিশোধ নয়, ক্ষমাই প্রকৃত বীরের পরিচয়।

একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলেছিলেন, “প্রতিহিংসা হলো আগুনের মতো। তুমি কারো উপর আগুন নিক্ষেপ করলে তার আগে তোমার হাতটাই পুড়ে যায়।” এই কথাটি প্রতিহিংসার প্রকৃত চিত্রকেই তুলে ধরে।

শেষ কথা হলো, প্রতিহিংসা মানুষের জন্য আত্মঘাতী। এটি সম্পর্ক নষ্ট করে, মানসিক শান্তি কেড়ে নেয়, এবং শেষ পর্যন্ত মানুষকে একাকিত্ব আর গ্লানির অন্ধকারে নিয়ে যায়। তাই প্রতিহিংসার পথ পরিহার করে যদি মানুষ ক্ষমা, সহানুভূতি এবং মানবিকতার পথে অগ্রসর হয়, তবে সমাজ হবে আরো সুন্দর, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধশালী।

(০২)
আত্মসম্মানবোধ
-বিচিত্র কুমার

মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদগুলোর একটি হচ্ছে আত্মসম্মানবোধ। এটি এমন একটি অদৃশ্য শক্তি, যা মানুষকে নিজেকে মূল্যায়ন করতে শেখায়, অন্যের সম্মানের জন্য উদ্বুদ্ধ করে এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আত্মবিশ্বাসী হতে সহায়তা করে। আত্মসম্মানবোধ কেবল ব্যক্তিগত গুণ নয়, এটি মানুষের চারিত্রিক দৃঢ়তা, মানসিক শৃঙ্খলা এবং সামাজিক মূল্যবোধের গভীরতম প্রকাশ। বর্তমান সময়ে যখন মানুষ বহির্জাগতিক মোহে বিভ্রান্ত হয়ে আত্মসম্মানবোধের মূল জায়গা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, তখন এই বিষয়টির গুরুত্ব নতুন করে বুঝে নেয়া প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আত্মসম্মানবোধের প্রথম পাঠ শুরু হয় পরিবার থেকে। শিশুকালে মা-বাবার আচরণ, পরিবারের পরিবেশ এবং মূল্যবোধ গঠনের ধরণই একটি শিশুর মনে আত্মসম্মানবোধের বীজ বপন করে। একজন মা যখন সন্তানের প্রতি সম্মানবোধ দেখায়, তার মতামতকে গুরুত্ব দেয় এবং তাকে ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়, তখনই সেই শিশুর ভিতর আত্মসম্মানবোধ জন্ম নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সমাজের অনেক পরিবারেই সন্তানদের মতামতকে অবজ্ঞা করা হয়, তাদের সম্মান না দিয়ে শাসনের নামে বারংবার অপমান করা হয়। এর ফলে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মায় না, আত্মসম্মানবোধও বিকশিত হয় না। এই শিশুরাই বড় হয়ে সমাজে সম্মান করার, সম্মান পাওয়ার সঠিক পথ খুঁজে পায় না।

আত্মসম্মানবোধের সত্যিকারের মূল্য বোঝা যায় তখন, যখন মানুষ বাস্তব জীবনের নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। কর্মক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির যোগ্যতা তখনই স্বীকৃতি পায়, যখন সে নিজেকে যথাযথ মর্যাদার আসনে স্থাপন করতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, অনেকেই নিজের মূল্য নিজেই বোঝে না। তাই সামান্য সুযোগের জন্য তারা নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। বসের কাছে অতি বিনয়ী হয়ে অপমান সহ্য করা, সহকর্মীদের অন্যায় আচরণে চুপ থেকে যাওয়ার প্রবণতা, নিজের মেধা ও পরিশ্রমের মূল্য নির্ধারণে অনাগ্রহ — এগুলো আত্মসম্মানবোধের ঘাটতির স্পষ্ট উদাহরণ। অথচ যারা নিজেদের মূল্য জানে, তারা কখনোই অপমানকে সহজভাবে মেনে নেয় না। তারা শান্তভাবে, কিন্তু দৃঢ়তার সাথে নিজেদের অধিকার আদায়ের পথ খোঁজে।

বাস্তব জীবনের এক গভীর উদাহরণ হলো— এক সময়ের নামকরা একজন শিক্ষক, যিনি বছরের পর বছর স্কুলে পড়িয়েছেন কিন্তু কোনদিনই নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি। শিক্ষার্থীরা তাকে ভালোবাসলেও স্কুলের কতৃপক্ষ তার প্রতি ছিলো উদাসীন। বেতন বৃদ্ধি থেকে শুরু করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত কোথাও তার মতামতের মূল্য ছিলো না। প্রথমদিকে তিনি চুপ ছিলেন, ভেবেছিলেন সময়ের সাথে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তন হয়নি, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। একদিন তিনি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন— যদি নিজেকে সম্মান করতে না শিখি, তাহলে কেউ আমাকেও সম্মান করবে না। তিনি চাকরি ছেড়ে দিলেন এবং নিজের উদ্যোগে একটি কোচিং সেন্টার খুলে ফেললেন। শুরুটা কঠিন ছিলো, কিন্তু ধীরে ধীরে তার অধ্যবসায় ও আত্মসম্মানবোধের উপর ভর করে তিনি সফল হলেন। আজ সেই শিক্ষকই এলাকায় এক সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। এই ঘটনা প্রমাণ করে— আত্মসম্মানবোধ মানুষকে নিজের শক্তি দিয়ে লড়াই করতে শেখায়, অন্যের করুণা নয়, নিজের যোগ্যতা দিয়েই সম্মান অর্জন করতে হয়।

আত্মসম্মানবোধ কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সামাজিক পর্যায়েও সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটি জাতি তখনই উন্নত হতে পারে, যখন তার নাগরিকরা নিজেদের প্রতি, নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসের প্রতি গভীর সম্মানবোধ রাখে। আমাদের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ যে আত্মত্যাগ করেছে, তার পেছনে ছিলো দৃঢ় আত্মসম্মানবোধ। তারা পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে। কিন্তু আজকের প্রজন্মের অনেকেই নিজেদের সংস্কৃতিকে লজ্জার বিষয় মনে করে, বিদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে গর্ববোধ করে। এটা আত্মসম্মানবোধের ভয়াবহ অবক্ষয়ের লক্ষণ। যারা নিজের শিকড়কে অবজ্ঞা করে, তারা কখনোই বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।

আত্মসম্মানবোধের চর্চা শুরু হয় ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে। একজন মানুষ যখন নিজের কাজ নিজে করার চেষ্টা করে, অন্যের দয়ার উপর নির্ভর না করে নিজের পরিশ্রমে এগিয়ে চলে, তখন তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধ গড়ে ওঠে। আবার বিপরীত পরিস্থিতিতেও এটি দেখা যায়— কেউ যখন নিজের ভুল স্বীকার করে তা সংশোধনের জন্য সাহস দেখায়, তখনও তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধের প্রকাশ ঘটে। আত্মসম্মানবোধ মানে অহংকার নয়, এটি নিজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের সূক্ষ্ম অনুভূতি। অহংকার মানুষকে নিজেকে বড় ভাবতে শেখায়, অন্যকে ছোট করে দেখতে শেখায়; কিন্তু আত্মসম্মানবোধ মানুষকে শেখায়, নিজেকে বড় করার জন্য অন্যকে ছোট করার প্রয়োজন নেই।

বাস্তব জীবনের এক আরেকটি চিত্র তুলে ধরা যায় একজন সাধারণ গৃহকর্মীর গল্প দিয়ে। সে দীর্ঘদিন একটি বাড়িতে কাজ করে আসছিলো, যেখানে তার প্রতি কোনো সম্মান ছিলো না। বাড়ির সদস্যরা তার সাথে রূঢ় ভাষায় কথা বলতো, কোনো উৎসবে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো না, বরং দয়া করে কিছু পুরনো কাপড় দিলেই যেন বড়ো উপকার করলো এমন ভাব প্রকাশ করতো। কিন্তু সেই গৃহকর্মী চুপ থাকেনি। সে নিজের কাজের দক্ষতা বাড়িয়ে অন্য একটি পরিবারে চাকরি নিয়ে নেয়, যেখানে তাকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে দেখা হতো। পরে সেই পরিবারটির সদস্যরাই তাকে নিজেদের পরিবারের অংশ করে নেয়। এখানেই আত্মসম্মানবোধের জয়, যেখানে একজন মানুষ নিজের অবস্থান নিজেই তৈরি করে নেয়, অন্যের করুণা নয়।

বর্তমান ডিজিটাল যুগে আত্মসম্মানবোধের সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কৃত্রিম দুনিয়ায় মানুষ লাইক, শেয়ার, ফলোয়ারের সংখ্যার উপর নিজেদের মান-মর্যাদা নির্ধারণ করছে। কেউ যদি বেশি জনপ্রিয় হয়, তাহলে সে নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে। আবার কেউ যখন কম জনপ্রিয় হয়, তখন নিজেকে তুচ্ছ মনে করে হতাশায় ডুবে যায়। অথচ আত্মসম্মানবোধ শেখায়— মানুষের মর্যাদা বাইরের বাহ্যিক পাল্লায় মাপা যায় না, এটি তার ভিতরের গুণ, সততা ও আচরণেই প্রকাশ পায়।

আত্মসম্মানবোধের একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে— আত্মসমালোচনার ক্ষমতা। আত্মসম্মানবোধের প্রকৃত মূল্যায়ন তখনই সম্ভব, যখন মানুষ নিজের ভুলগুলো সঠিকভাবে বুঝতে পারে এবং তা শুধরানোর সাহস রাখে। যারা নিজেদের ভুল কখনোই স্বীকার করতে চায় না, বরং নিজেদের ভুল ঢাকতে অন্যকে দোষারোপ করে, তারা প্রকৃতপক্ষে আত্মসম্মানবোধহীন। কারণ, আত্মসম্মানবোধ মানে নিজেকে নিখুঁত ভাবা নয়, বরং নিজের ত্রুটিগুলো চিনে নিয়ে তা কাটিয়ে ওঠার দৃঢ় মানসিকতা তৈরি করা।

আত্মসম্মানবোধের গুরুত্ব সম্পর্কেও একটি ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, আত্মসম্মানবোধ মানেই সব সময় উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করা, সবকিছুতে “না” বলা। আসলে আত্মসম্মানবোধ কখনোই উদ্ধত হওয়া শেখায় না, এটি শেখায় কখন চুপ থাকতে হবে, কখন কথা বলতে হবে এবং কিভাবে বললে নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়— একজন সাংবাদিক যখন অন্যায় ঘটনা প্রকাশ করে, তখন তার মধ্যে প্রতিবাদী মনোভাব কাজ করে, কিন্তু সেই প্রতিবাদে কখনোই ব্যক্তিগত আক্রমণ বা অশালীনতা থাকে না। তার প্রতিবাদের পেছনে থাকে সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং আত্মসম্মানবোধের নির্ভুল প্রকাশ।

একজন শিক্ষকের আত্মসম্মানবোধ যেমন শিক্ষার্থীদের সামনে আদর্শ স্থাপন করে, তেমনি একজন ব্যবসায়ীর আত্মসম্মানবোধ তার সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত গড়ে তোলে। একজন শিল্পীর আত্মসম্মানবোধ তার সৃষ্টিশীলতাকে বিশুদ্ধ করে, যা কৃত্রিমতার ছাপমুক্ত। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আত্মসম্মানবোধের অবদান অপরিসীম। আত্মসম্মানবোধ ছাড়া একটি সভ্য সমাজের কাঠামো কল্পনাই করা যায় না।

আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য আত্মসম্মানবোধের গুরুত্ব আরও বেশি। কারণ, তারা যদি নিজেরা নিজেদের মূল্য বোঝে, তাহলে তারা অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করবে না। আত্মসম্মানবোধ তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেবে, নিজের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখাবে এবং নিজের জাতিসত্তার গৌরব ধরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে। আত্মসম্মানবোধহীন মানুষ সহজেই ভুল পথে চলে যায়, অন্যের কথায় প্রভাবিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। তাই প্রতিটি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনের উচিত— আত্মসম্মানবোধের উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।

শেষ কথায় বলা যায়, আত্মসম্মানবোধ কোনো বাহ্যিক অলংকার নয়, এটি মানুষের ভিতরের সবচেয়ে বড়ো গৌরব। যারা নিজের সম্মান করতে জানে, তারাই প্রকৃত অর্থে অন্যকে সম্মান করতে পারে। আত্মসম্মানবোধ মানুষকে শুধু ব্যক্তি হিসেবে মহান করে তোলে না, বরং পুরো সমাজের মান-মর্যাদা এবং সভ্যতার স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মসম্মানবোধের চর্চা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753

https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL

মন্তব্য করুন