(০১)
হাতি ও ঘোড়ার বন্ধুত্ব
-বিচিত্র কুমার
এক জঙ্গলের পাশে ছিলো একটি সবুজ তৃণভূমি। সেখানে বাস করত বিশাল এক হাতি, নাম তার গজারু। গজারু ছিলো শান্ত স্বভাবের, তবে তাকে সবাই ভয় পেত তার দৈত্যাকার শরীরের জন্য। অন্যদিকে, পাশের গ্রামে ছিলো এক চঞ্চল ঘোড়া, নাম তার দুরন্ত। দুরন্ত ছিলো দৌড়ে তুখোড়, লাফিয়ে বেড়াতো মাঠে-ঘাটে, কিন্তু সে গজারুকে দেখলেই দূর থেকে হাসি ঠাট্টা করতো, “ঐ মোটা হাতি, তুমি তো এক পা তুলতেই হাঁপিয়ে যাও!”
গজারু কষ্ট পেত, কিন্তু কিছু বলতো না। সে জানতো, দুরন্তের মন খারাপ হলে কেউ তার বন্ধু হবে না। তবুও, সে মনে মনে চাইতো, যদি একদিন দুরন্ত তার বন্ধু হতো!
একদিন বন জঙ্গলে হঠাৎ ভয়ানক আগুন ধরে গেল। সব পশুপাখির মধ্যে হুলস্থুল পড়ে গেল। দুরন্ত ভয় পেয়ে বনে ঢুকে পড়েছিল, আর সে বুঝতেই পারেনি যে আগুন তার চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। ছোটখাটো গাছের ফাঁক গলে সে বের হতে পারছিল না, আগুনের উত্তাপে তার শরীর ঝলসে যাওয়ার উপক্রম। দুরন্ত চিৎকার করে ডাকতে লাগল, “বাঁচাও! কেউ কি আমাকে বাঁচাবে?”
কেউ এগিয়ে এল না। সবাই ভয় পেয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু তখনই গজারু ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এল। তার শক্তিশালী শুঁড় দিয়ে সে দুরন্তকে উঁচু করে নিজের পিঠে বসিয়ে নিলো। তারপর বিশাল শরীর দিয়ে আগুনের মাঝে পথ তৈরি করতে করতে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল। তার মোটা চামড়ার কারণে আগুনের আঁচ সে সহ্য করতে পারছিল, আর দুরন্ত তার পিঠে নিরাপদে ছিলো।
বনের বাইরে এসে দুরন্ত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “গজারু ভাই, আমি তোমার প্রতি কত অন্যায় করেছি, তুমি তবুও আমাকে বাঁচালে!” গজারু হেসে বলল, “বন্ধুত্ব হলো বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোর নাম, দুরন্ত। আজ তুমিও আমার বন্ধু হলে, তাই তো?”
সেই থেকে দুরন্ত আর গজারু দুজনেই অবিচ্ছেদ্য বন্ধু হয়ে গেলো। দুরন্ত শিখল, গায়ের জোর নয়, বন্ধুত্বের আসল শক্তি আসে মনের গভীরতা থেকে। আর গজারুও বুঝল, যাদের মনের খামতি আছে, তাদের কাছে ধৈর্যই হলো সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
তৃণভূমির পশুপাখিরা অবাক হয়ে দেখল, বিশাল হাতি আর ক্ষিপ্র ঘোড়ার বন্ধুত্ব। তারা আর কখনও কাউকে বাহ্যিক রূপ দেখে বিচার করল না। সবাই বলল, “গজারু আর দুরন্ত আমাদের শিখিয়ে দিলো, বন্ধুত্বের মাপকাঠি কখনো উচ্চতা বা গতি নয়, বরং হৃদয়ের বিশুদ্ধতা।”
গল্পের শেষে গজারু আর দুরন্ত দুজনেই বনভূমিতে বন্ধুত্বের এক নতুন অধ্যায় শুরু করল।
(০২)
গরু ও ভালুকের পরিশ্রমের শিক্ষা
-বিচিত্র কুমার
একদিন গভীর জঙ্গলের পাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা খোলামেলা মাঠে দেখা হলো গরু “গোবিন্দা” আর ভালুক “বলাই” এর। গোবিন্দা ছিলো শান্ত-শিষ্ট, পরিশ্রমী আর ধীরস্থির স্বভাবের। আর বলাই ছিলো একটু অলস, কাজকর্মে মন বসতো না, সারাদিন গাছের তলায় বসে ফল খেয়ে আর ঘুমিয়েই দিন কাটাতো।
একদিন বলাই হাঁপাতে হাঁপাতে গোবিন্দার কাছে এল। বলাইয়ের পেটে তখন টান পড়েছে। গাছের ফল ফুরিয়েছে, আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। বলাই গোবিন্দাকে বলল,
— “গোবিন্দা ভাই, তোমার এত ঘাস জমেছে, একটু আমাকে দাও না।”
গোবিন্দা হাসল, বলল,
— “বলাই ভাই, এই ঘাস আমি কষ্ট করে জমিয়েছি। তুমি যদি একটু পরিশ্রম করতে চাও, আমরা একসাথে আরও বেশি ঘাস জমাতে পারি।”
বলাই একটু হেসে বলল,
— “ওসব পরিশ্রম আমার দ্বারা হয় না গো ভাই। তোমার মত ধৈর্য আমার নেই।”
গোবিন্দা বলল,
— “তুমি চাইলেই পারো বলাই ভাই, শুধু একটু চেষ্টা করো।”
কিন্তু বলাই আবার গাছের তলায় গিয়ে আরাম করে বসে পড়ল।
দিন যায়, দিন আসে। গোবিন্দা নিয়ম করে সকালে উঠে মাঠের ঘাস কাটে, শুকিয়ে রাখে, রাতে মাটির খুপরিতে সযত্নে গুছিয়ে রাখে। বলাই তখনও অলস, শুধু খাওয়া আর শুয়ে থাকা তার কাজ। গ্রীষ্মের শেষে বর্ষা নামলো। তখন বনের চারপাশে বন্যার পানি এসে সব ঢেকে দিলো। গাছের ফল ঝরে গেলো, খাওয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। বলাই তখন বুঝলো তার গাফিলতির ফলাফল।
বলাই ক্ষুধায় কষ্ট পেয়ে গোবিন্দার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— “ভাই গোবিন্দা, আমাকে একটু সাহায্য করো। তুমি যেভাবে পরিশ্রম করেছো, আমি তা করিনি। এখন বুঝতে পারছি, অলসতা কেমন শাস্তি দেয়।”
গোবিন্দা মুচকি হেসে বলল,
— “বলাই ভাই, তোমার জন্য আমার কাছে কিছু ঘাস আছে, কিন্তু এই সাহায্য পেলে তোমাকে পরিশ্রমের মূল্য বুঝতে হবে।”
বলাই কৃতজ্ঞ হয়ে মাথা নত করল, বলল,
— “আমি এবার থেকে অলস থাকবো না গো ভাই। আমাকেও শেখাও কীভাবে তুমি এত সুন্দর করে ঘাস জমাও।”
গোবিন্দা বলল,
— “আসো, আগামীকাল সকাল থেকে আমরা একসাথে মাঠে নামবো। তুমি দেখবে, পরিশ্রম করতে করতে নিজের মাঝেই আনন্দ পাবে।”
এরপর দিন থেকে বলাই গোবিন্দার সাথে মাঠে যেতে শুরু করল। প্রথমদিকে খুব কষ্ট হতো, গরমে ঘেমে উঠতো, হাত-পা ব্যথা করতো। কিন্তু গোবিন্দার ধৈর্য আর সাহস তাকে শেখালো— “যদি পরিশ্রম করো, তবে অভাবে পড়বে না।”
কয়েক মাস পর বলাইও নিজের জন্য ঘাস জমাতে পারলো। এবার আর তার মুখে অলসতার হাসি নেই, আছে খাঁটি পরিশ্রমের তৃপ্তি। সে বুঝতে পারলো, “অলসতা ক্ষণিকের সুখ দিলেও পরিশ্রমই জীবনের সত্যিকারের সঞ্চয়।”
জঙ্গলের অন্য পশুরাও বলাইয়ের পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে গেলো। তারা বলল,
— “বলাই, আগে তো তুমি সারাদিন ঘুমাতে, এখন এভাবে খেটে চলেছো কেন?”
বলাই হেসে বলল,
— “গোবিন্দা ভাই আমাকে শিখিয়েছে, অলসতা শুধু ক্ষুধা দেয়, আর পরিশ্রম দেয় সম্মান আর সঞ্চয়। এই শিক্ষা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।”
এভাবেই গোবিন্দা আর বলাইয়ের বন্ধুত্বের মধ্যে পরিশ্রম আর দায়িত্ববোধের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। বলাই বুঝে গেলো, পরিশ্রম ছাড়া জীবনে কিছুই পাওয়া যায় না।
(০৩)
প্যাঁচা ও কবুতরের জ্ঞানের আলো
-বিচিত্র কুমার
অনেক দূরের এক জঙ্গলের কোণে ছিলো এক প্রাচীন বটগাছ। সেই গাছের ডালে বাস করতো প্যাঁচা বুড়ো ধুসরো আর এক সাদা কবুতর, নাম তার শুভ্রা। ধুসরো প্যাঁচা ছিলো প্রচণ্ড জ্ঞানী, সারা রাত জেগে আকাশের তারা দেখে নানা হিসেব কষতো। অন্যদিকে শুভ্রা ছিলো উড়ু উড়ু, সারাদিন আকাশে উড়ে উড়ে আনন্দ খুঁজে বেড়াতো।
ধুসরো সব সময় বলতো, “শুভ্রা, শুধু খেলা আর উড়াউড়ি করলে হবে না। জ্ঞানের আলো না থাকলে মন অন্ধকারেই ডুবে থাকবে।” শুভ্রা মুচকি হেসে বলতো, “জ্ঞান শুধু বইতে নয় বুড়ো প্যাঁচা, প্রকৃতিতেও লুকিয়ে থাকে!”
একদিন সকালে জঙ্গলে হুলস্থুল পড়ে গেল। ঝড়ের রাত কেটে গেলে দেখা গেল নদীর পাড়ে বিশাল এক গর্ত। সবাই বলাবলি করলো, “এটা তো ভূতের গর্ত! এখানে যাওয়া মানে সর্বনাশ!” পাখিরা ভয়ে পালাতে লাগলো।
কিন্তু ধুসরো প্যাঁচা ঠান্ডা মাথায় বললো, “ভয় পেলে চলবে না, আগে বুঝে নিতে হবে আসল ঘটনা কী।” শুভ্রাও বললো, “চলো, বুড়ো প্যাঁচা, আমরা নিজের চোখে দেখে আসি।”
ধুসরো তার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝলো, এটা আসলে বৃষ্টির পানিতে ভেঙে পড়া গর্ত। কিন্তু পাখিরা তো ভূতের গল্প শুনে দিশেহারা! তখন ধুসরো বললো, “তোমাদের ভয় পাওয়ার দরকার নেই। প্রকৃতিকে বুঝতে শিখো, গুজবের পিছনে ছুটো না।”
কিন্তু পাখিরা তখনও ভয় পাচ্ছিলো। শুভ্রা তখন এক দারুণ পরিকল্পনা করলো। সে গাছের ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে গর্তের চারপাশে ছড়িয়ে দিলো, যেন বোঝা যায়, এটা প্রকৃতির খেলা। এরপর সে গর্তের মুখে বসে গান গাইতে শুরু করলো – “ভূতের ভয়, মন থেকে জয়, প্রকৃতির সাথেই খেলো সবার রয়।”
পাখিরা একে একে ফিরে এলো, দেখলো শুভ্রার গান আর ধুসরো প্যাঁচার যুক্তিতে ভয় কেটে যাচ্ছে। ধুসরো বললো, “ভয় তখনই আসে, যখন জানা কম থাকে। আর জানা তখনই বাড়ে, যখন প্রশ্ন করতে শিখো।”
পাখিরা বুঝলো— ধুসরো প্যাঁচার বইয়ের জ্ঞান আর শুভ্রার প্রকৃতির জ্ঞান মিলে সত্যিকারের আলো ছড়ায়। কেউ শুধু বই পড়ে বড় হয় না, আবার শুধু খেলা করেও জ্ঞানী হওয়া যায় না। দুটোকে মিলিয়ে শিখতে হয়।
সেদিন থেকে জঙ্গলের সব পাখিরা ঠিক করলো, তারা শুধু মুখে মুখে শোনা গল্পে ভয় পাবে না। বরং নিজের চোখে দেখবে, নিজের বুদ্ধি খাটাবে। ধুসরো প্যাঁচা আর শুভ্রা কবুতর মিলে তাদের শিখিয়ে দিলো, “জ্ঞানের আলো কেবল বইয়ের পাতায় থাকে না, প্রকৃতি আর অভিজ্ঞতাও আমাদের বড় শিক্ষক।”
সেই থেকে জঙ্গল জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো প্যাঁচা ও কবুতরের জ্ঞানের আলো, আর পাখিরা সবাই মিলে বলতো— “জ্ঞানই আলো, ভয় আর অন্ধকারকে দূর করে দেয়।”
চুপিচুপি হেসে ধুসরো বলতো, “তাহলেই তো শুভ্রা, এবার তোমার উড়াউড়ি আর আমার হিসেব-নিকেশ একসাথে হলো!”
শুভ্রাও পাখা মেলে বলতো, “জ্ঞান মানে একসাথে চলা, একসাথে শেখা।”
এভাবেই তাদের গল্প হয়ে উঠলো জঙ্গলের শিক্ষার আলো।
নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753
https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL