Skip to content

চারটি শিশুতোষ গল্প – বিচিত্র কুমার

(০১)
ঘোড়া ও বাঘের দ্রুতগতির বন্ধুত্ব
-বিচিত্র কুমার

ঘন সবুজে ঘেরা এক বন ছিল যেখানে পাখিরা গান গাইতো, হরিণেরা লাফিয়ে বেড়াতো আর গাছেরা আপন খেয়ালে দুলতো। এই বনেরই রাজা ছিল বাঘ রাজু। গম্ভীর গর্জনে সে ঘোষণা করতো তার উপস্থিতি। রাজু ছিল সাহসী, শক্তিশালী এবং তার চোখে ছিল জঙ্গলের জন্য গভীর ভালোবাসা। অন্যদিকে, গ্রামের ধারে ছিল এক টগবগে ঘোড়া, নাম তার টগর। টগরের গতি ছিল আশ্চর্য, যেন ঝড়ের গতিকে হার মানায়।

তবে রাজু আর টগরের দেখা কখনো হয়নি। রাজু ভাবত, “ঘোড়া তো শুধু সমতলে ছুটে বেড়ায়, জঙ্গলের রাজত্বের বোঝে কী?” আর টগর ভাবত, “বাঘ শুধু ভয় দেখিয়ে রাজত্ব করে, প্রকৃত বন্ধু কি সে হতে পারে?”

কিন্তু প্রকৃতি কখনো অহংকার পছন্দ করে না। এক দুপুরে হঠাৎ করে বনে আগুন ধরে যায়। আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ছোট প্রাণীরা ছুটোছুটি শুরু করে, কিন্তু ধোঁয়ার ঘন পর্দায় কেউ পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না। গ্রামের মানুষরা এসে দাঁড়ালেও, আগুনের ভয়াবহতায় তারা অসহায়।

ঠিক তখন রাজু বুঝলো, এই আগুন নেভানো তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে সাহায্য করতে পারে কেবল টগরের গতি। রাজু ছুটে গেল গ্রামের ধারে টগরের কাছে। দু’চোখে দৃঢ়তা নিয়ে বলল, “টগর, আজ আমাদের আলাদা থাকার দিন নয়। আমার গর্জন আর তোমার দৌড় এক করলে বন বাঁচবে। তুমি কি প্রস্তুত?”

টগরের চোখ যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে বললো, “চলো রাজু, আজ দেখিয়ে দিই বন্ধুত্ব মানে কী!”

তারপর শুরু হলো তাদের যুদ্ধ। রাজু গর্জন করে প্রাণীদের পথ দেখাতো, ধোঁয়া কেটে পরিষ্কার করতো, আর টগর সেই পথ ধরে ঝড়ের বেগে ছোট প্রাণীদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতো। আগুনের তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু তাদের বন্ধুত্বের তাপ আগুনকেও হার মানালো।

মানুষরাও তাদের দেখাদেখি সাহস পেলো। তারা মিলে আগুন নিভানোর কাজে লেগে পড়লো। রাজু আর টগরের সমন্বয়ে, গ্রামের মানুষের পরিশ্রমে, শেষমেশ আগুন নেভানো গেল। বনের প্রতিটি প্রাণী বেঁচে গেলো, প্রকৃতি ফিরে পেলো তার হাসি।

সেদিনের পর রাজু আর টগর আর কখনো নিজেদের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে দেখেনি। তারা বুঝেছিল—গতি আর শক্তি এক হলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। গ্রামের মানুষ আর বনবাসীরা তাদের ডাকতো ‘দ্রুতগতির বন্ধুত্ব’।

এই বন্ধুত্বের গল্প ছড়িয়ে পড়লো দূর-দূরান্তে। সবাই শিখলো—প্রতিযোগিতা নয়, সত্যিকারের বন্ধুত্ব মানে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো, বিপদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করা।

পাহাড়, জঙ্গল, গাছপালা আর পাখিরা তখন গুনগুন করে গাইতো—”গতি আর গর্জনের বন্ধুত্বই প্রকৃত বন্ধুত্ব।”

(০২)
সিংহ ও বানরের বন্ধুত্বের শক্তি
-বিচিত্র কুমার

জঙ্গলের গভীরে ছিল এক বিশাল সিংহ, নাম তার সিংহরাজ। বনের সব পশুরা তাকে ভয় করত, কারণ সে ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী ও গম্ভীর স্বভাবের। অন্যদিকে, গাছের ডালে ডালে লাফিয়ে বেড়াত এক চঞ্চল বানর, নাম ঝুনু। সে ছিল ছোটখাটো, দুরন্ত আর খেয়ালি। সিংহরাজ আর ঝুনুর মধ্যে কোনও মিলই ছিল না, তাই তারা কখনও কথা বলত না।

একদিন বনে এল এক অচেনা বিপদ। দূর দূরান্ত থেকে একদল শিকারি এসে বনের প্রাণীদের ফাঁদ পেতে ধরার পরিকল্পনা করল। শিকারিরা বিশেষ করে সিংহরাজকে ধরার জন্য বড়ো বড়ো লোহার খাঁচা আনল, আর ছোট প্রাণীদের জন্য পাতলা জাল বিছিয়ে রাখল।

সিংহরাজ গর্জন করে বলল, “আমি এত বড়ো শক্তিশালী, শিকারিরা আমার কিছুই করতে পারবে না।” কিন্তু সে বুঝতেই পারল না শিকারিরা ফাঁদ পেতে রেখেছে তার চলার পথে।

ঝুনু বানর গাছের উপর থেকে সব দেখছিল। সে জানত, শুধু শক্তি দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হয় না, বুদ্ধিও দরকার। সে দৌড়ে সিংহরাজের কাছে গিয়ে বলল, “সিংহরাজ, চলুন আমরা একসাথে কাজ করি। শিকারিদের ফাঁদে পা দিলে আপনার বিপদ হবে।”

সিংহরাজ গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি এত ছোট, তোমার সাহায্যের দরকার আমার নেই। আমি একাই সামলাতে পারব।”

কিন্তু ঝুনু নাছোড়বান্দা। সে বলল, “আমি ছোট, তাই শিকারিরা আমাকে গুরুত্ব দেয় না। এটাই আমাদের সুযোগ। আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস করেন, আমি আপনাকে পথ দেখাবো।”

সিংহরাজ একটু ভেবেই বলল, “ঠিক আছে, দেখি তোমার বুদ্ধি কেমন।”

ঝুনু গাছের ডালে ডালে লাফিয়ে শিকারিদের ফাঁদগুলো ভালোভাবে দেখে নিল। তারপর সে সিংহরাজকে বলল কোন কোন জায়গায় ফাঁদ আছে আর কোন পথে গেলে নিরাপদ থাকবে। সিংহরাজ সতর্ক হয়ে সেই পথেই হাঁটল। শিকারিরা ফাঁদে পেলে তাকেই ধরতে পারল না।

এরপর ঝুনু বানর গাছের উপর থেকে শিকারিদের দিকে কলা ছুঁড়তে লাগল, গাছের ডাল ভেঙে তাদের উপর ফেলল। শিকারিরা অস্থির হয়ে পড়ল। সিংহরাজ সেই সুযোগে গর্জন দিয়ে পুরো বন কাঁপিয়ে দিল। শিকারিরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলো।

বনের সব প্রাণীরা জড়ো হয়ে সিংহরাজ আর ঝুনুকে অভিনন্দন জানাল। সিংহরাজ মাথা নিচু করে বলল, “আজ বুঝলাম, শুধু শক্তি দিয়ে বড়ো হওয়া যায় না, বন্ধুত্ব আর বুদ্ধি থাকলে তবেই প্রকৃত শক্তি তৈরি হয়। ঝুনু আমার সত্যিকারের বন্ধু।”

ঝুনু হাসতে হাসতে বলল, “আর আমি শিখলাম, বড়ো না হলে মন বড়ো রাখতে হয়। বন্ধুত্বে ছোট-বড়ো বলে কিছু নেই।”

এরপর থেকে সিংহরাজ আর ঝুনুর বন্ধুত্ব হয়ে গেলো অটুট। তারা একসাথে বন রক্ষা করত, আর সবাইকে শিখাত, “বন্ধুত্বের শক্তি হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো শক্তি।”

(০৩)
কাঠবিড়ালি ও বানরের বন্ধুত্ব
-বিচিত্র কুমার

বনভূমির ধারে ছিল এক পুরনো বটগাছ। তার ডালে বাস করত এক চঞ্চল কাঠবিড়ালি, নাম তার টুনটুনি। সে ছিল খুবই কর্মঠ, ডালডালে ছুটোছুটি করত, শীতের জন্য বাদাম, ফল সংগ্রহ করত। আর ঠিক গাছের মাঝখানে বাস করত এক অলস বানর, নাম ঝুঁপঝুঁপ। ঝুঁপঝুঁপ সারাদিন গাছের ডালে বসে ঘুমাতো আর ফলের জন্য অপেক্ষা করত, যদি কেউ এনে দেয়!

টুনটুনি ছিল ব্যস্ত, ঝুঁপঝুঁপ ছিল অলস। দুজনের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ আলাদা হলেও তাদের মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব। টুনটুনি প্রতিদিন সকালে ঝুঁপঝুঁপের কাছে গিয়ে বলত, “চলো, ঝুঁপঝুঁপ, আজ আমরা মিলে বাদাম সংগ্রহ করি।” ঝুঁপঝুঁপ তখন হাই তুলত, “উফ! তুমি তো সারাদিন কাজের কথা বলো টুনটুনি, বিশ্রাম করো, জীবনটাকে উপভোগ করো।”

কিন্তু টুনটুনি জানত, কাজ ছাড়া ভবিষ্যৎ নিরাপদ হয় না। সে একাই বন থেকে বাদাম, বুনো ফল সংগ্রহ করত, শীতের জন্য গাছের কোটরে রেখে দিত।

দিন যেতে লাগল। একদিন হঠাৎ বনে ঝড় বয়ে এলো। বাতাসে গাছের ডালপালা দুলে উঠল, পাতা উড়ে গেল, ফল ঝরে পড়ল মাটিতে। ঝুঁপঝুঁপের আরামকেদারা ডালও ভেঙে গেল। ঝড়ের পর বনে খুঁজে পাওয়া গেল না কোনো ফল, কোনো বাদাম। তখন ঝুঁপঝুঁপ পড়ল বিপদে। সে টুনটুনির কাছে গেল, “বন্ধু, তুমি তো অনেক সংগ্রহ করেছ, আমাকে কিছু দেবে?”

টুনটুনি একটু হাসল, “তুমি তো বলেছিলে কাজ না করলেও চলে, সব সময় বিশ্রাম করো, তাই না?” ঝুঁপঝুঁপ মাথা নিচু করল, “হ্যাঁ, বুঝেছি, কিন্তু এখন আমি সত্যিই বিপদে।”

টুনটুনি দয়া করে ঝুঁপঝুঁপকে বলল, “বন্ধু বলে কথা! আমি তোমার জন্য বাদাম রেখেছি। তবে শর্ত একটাই, কাল থেকে তুমি আমার সাথে কাজ করবে, নিজেদের খাবার নিজেরাই জোগাড় করব।”

ঝুঁপঝুঁপ লজ্জায় মাথা নাড়ল, “তুমি ঠিক বলেছো, অলসতা আমার বড় ভুল ছিল।”

এরপর দিন থেকে ঝুঁপঝুঁপ আর অলস থাকেনি। সে টুনটুনির সাথে মিলে বাদাম সংগ্রহ করতে শুরু করল। তারা একসাথে কাজ করত, খেলত, গাইত। ঝুঁপঝুঁপ শিখে ফেলেছিল, বন্ধুত্ব মানে শুধু আরাম করা নয়, পরিশ্রমে পাশে থাকা, সাহায্য করা। আর টুনটুনি খুশি হয়েছিল, কারণ তার প্রিয় বন্ধুটি অলসতা ছেড়ে সত্যিকারের বন্ধুত্বের মূল্য বুঝেছিল।

বনের অন্য প্রাণীরাও দেখল, টুনটুনি ও ঝুঁপঝুঁপের বন্ধুত্ব কেমন দৃঢ় আর শিক্ষণীয়। শীত এলেও তাদের খাবারের কোনো অভাব হয়নি, কারণ তারা দুজনেই জানত, বন্ধুত্ব মানে একে অপরের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া।

এভাবেই টুনটুনি আর ঝুঁপঝুঁপের বন্ধুত্ব হয়ে উঠল বনভূমির আদর্শ—যেখানে পরিশ্রম, সহযোগিতা আর ভালোবাসার জয়গান বাজত প্রতিদিন।

(০৪)
প্যাঁচা ও কবুতরের বন্ধুত্বের পরীক্ষা
-বিচিত্র কুমার

দূরের এক শান্ত গ্রামে থাকত বুড়ো প্যাঁচা টুনটুনি আর তরুণ কবুতর শুভ্র। টুনটুনি ছিল বুদ্ধিমান, অভিজ্ঞ আর ধীরস্থির। আর শুভ্র ছিল চঞ্চল, কৌতূহলী আর সদা হাস্যমুখর। দু’জনের বয়সের ব্যবধান হলেও, তাদের বন্ধুত্ব ছিল বড়োই মজবুত।

টুনটুনি রাতে জেগে থাকত, আর শুভ্র দিনের আলোয় উড়াউড়ি করত। তবুও দিনের শেষে কিংবা রাতের শুরুর দিকে তারা দু’জন একসাথে বসে গল্প করত। শুভ্র বলত, “বন্ধুত্ব মানে দু’জনের হাসি ভাগাভাগি করা।” টুনটুনি হেসে বলত, “আর দুঃখের সময় পাশে দাঁড়ানোই বন্ধুত্বের আসল পরীক্ষা।”

একদিন গ্রামে এল এক ঝড়ো রাতের বার্তা। বলা হল, গভীর রাতে এক ভয়ানক ঝড় আসছে। গাছের ডালপালা ভেঙে পড়বে, পাখিদের বাসা উড়ে যাবে। সবাইকে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে বলা হলো।

শুভ্র ভয় পেয়ে গেল। সে বলল, “টুনটুনি দাদা, তুমি তো রাতে জাগো, দয়া করে আমার বাসার দিকে খেয়াল রেখো। আমি তোমার ওপর ভরসা রাখছি।” টুনটুনি চোখ মিটমিট করে বলল, “নিশ্চয়ই রাখবো, কিন্তু বন্ধু, বন্ধুত্বের মানে শুধু ভরসা করা নয়, বরং নিজের কর্তব্যও পালন করা। তাই আমিও চাই তুমি তোমার বাসা নিজে শক্ত করে গড়ে তুলো।”

শুভ্র একটু কষ্ট পেল। সে ভেবেছিল টুনটুনি তার জন্য সবকিছু সামলাবে। কিন্তু সে মন খারাপ না করে নিজের বাসার কচি ডালপালা জড়ো করতে লাগল, গিঁট দিতে লাগল, যেন ঝড়ের রাতে বাসা উড়ে না যায়।

রাত এল। আকাশ কালো হয়ে এল, বাতাস ধেয়ে এলো, ঝড় শুরু হলো। শুভ্র তার বাসায় বসে ভাবল, “টুনটুনি দাদা কি দেখছে আমাকে?” হঠাৎ সে দেখতে পেল, ঝড়ের ভেতর টুনটুনি উড়ে এসেছে তার বাসার কাছে। টুনটুনি বলল, “দেখো, আমি কথা রেখেছি। কিন্তু তুমি নিজেও নিজের দায়িত্ব পালন করেছো, এটাই বন্ধুত্বের সত্যিকারের পরীক্ষা।”

ঝড় শেষে সকালের আলোয় দেখা গেল, শুভ্রর বাসা অটুট আছে। আর টুনটুনি হাসছে তার পাশেই। শুভ্র বুঝল, বন্ধুত্ব মানে শুধু ভরসা করে বসে থাকা নয়, বরং একে অপরকে নিজের কাজ নিজে করতে শেখানো এবং বিপদের সময় পাশে থাকা।

সে দিন থেকে প্যাঁচা টুনটুনি আর কবুতর শুভ্র আরও দৃঢ় বন্ধনে জড়িয়ে গেল। তারা বুঝল, বন্ধুত্বের আসল পরীক্ষা আসে দায়িত্বের মুহূর্তে।

গল্পের শিক্ষা— বন্ধুত্ব মানে শুধু সাহায্য নেওয়া নয়, বরং একে অপরকে দায়িত্ব নিতে শেখানো এবং সেই দায়িত্বের পাশে থেকে বন্ধুত্বের আসল মানে বুঝে চলা।

তাদের সেই বন্ধুত্ব গ্রামের অন্য পাখিদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বলত, “টুনটুনি আর শুভ্র— বন্ধুত্বের পরীক্ষায় যারা পাশ করেছে, তারাই সত্যিকারের বন্ধু।”

নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753

https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL

মন্তব্য করুন