প্রত্যহ দিন নেই রাত নেই, খাওয়া আছে কী নেই..! ঘুম আছে কী নেই..!
ফাহিম ছেলেটা বড্ড মোবাইলের সঙ্গে বেশ পাকাপোক্তভাবেই জড়িয়ে পড়েছে।
মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতে রাখতে তার চোখের নিচটা ইদানীং কালো হয়ে গেছে। সে সবে বালাই নেই তার।
তাকে ঘায়েল করে রেখেছে এক স্বপ্নকন্যা। তাকে নিয়ে আবছা স্বপ্ন দেখে ফাহিম। তার মনটা খিঁচড়ে উঠে। সে চায় পৃথিবীর সব নিয়ম ভেঙ্গে ছুটে যেতে কোন এক অজানা স্বপ্নময় রাজ্যের সেই জানা কিন্তু অদেখা রাজকন্যাটির কাছে। ফাহিম জানে না তা আদৌ সম্ভব কিনা।
সেদিন ঝুম বৃষ্টিতে একটি চা দোকানে আঁটকে গেলো ফাহিম। চা দোকানে খদ্দের ছিলো না কেউ।
ফাহিম বেঞ্চের এক কোণায় বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। তার চোখ বৃষ্টির জ্বলে না ভিজে মোবাইলের ছোট্ট স্ক্রিনের মাঝে আটকে থাকলো অনেকক্ষণ।
তাদের মধ্যে কথা হচ্ছে। ভাবের আদানপ্রদান হচ্ছে। মেয়েটা বৃষ্টি বেশ পছন্দ করে।
মেয়েটা…”তোমাদের ওখানে কী বৃষ্টি হচ্ছে..?”
ফাহিম,”হুম,বলতে গেলে ঝুম বৃষ্টি।”
– ” আহ,এমন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রীতিমতো গান গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
– ” বৃষ্টি তোমার অনেক পছন্দের?”
– ” হ্যা ভীষণ..! তোমার?”
– ” আমারও।”
আমারও বলেই থমকে যায় ফাহিম। তার কোন কালেই বৃষ্টি ততোটা পছন্দ ছিলো না। বৃষ্টির সময়টায় তাদের গ্রামের যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়ে যায়। বিদ্যুৎ থাকে না। গ্রামের রাস্তা গুলো আজকাল পাকা হলেও বাজারে যাওয়া যায় না, পাঁকা রাস্তার উপরেই রাজ্যের কাঁদা..! ঠিকমতো পা ফেলার জায়গা নেই। কোথাও ছাতা নিয়ে গিয়েও শান্তি নেই। ভিজে সারা গা একেবারে চুপসে যায়। এই যে এখন সে চা দোকানে আঁটকে গেছে বৃষ্টির জন্য। তা না হলে তো বাসায় গিয়ে রীতিমতো আদো সুয়ে আদো বসে জমিদারি স্টাইলে মেয়েটার সাথে কথা বলা যেতো। সেই সুযোগ টা সে পাচ্ছে না একদমইই।
হঠাৎ ফাহিমের মনে হয়, না তার আসলেই বৃষ্টি অনেক পছন্দ। কারণ মেয়েটা বৃষ্টির মতো। বলতে গেলে ঝুম বৃষ্টির মতো। যখন সে কথা বলে কী চটপটে মনে হয় তাকে। বৃষ্টির জল যেমন অনবরত পড়তেই থাকে। মেয়েটা একবার কথা বলা শুরু করলে কথা বলতেই থাকে…! বৃষ্টির সময় মেঘ যেমন শব্দ করে ডাকে, মেয়েটাও মাঝেমধ্যে রেগে গেলে মেঘের মতো আওয়াজ দেয়। মেয়েটাকে দেখে নি ফাহিম। কিন্তু ফাহিম মনে মনে মেয়েটার ছবি এঁকে রেখেছে। মেয়েটা আসলে দেখতে বর্ষার কদমের মতো! তার ভেজা ঠোঁট যেন জবা ফুলে গড়িয়ে পড়া বর্ষার ধারা। তার পায়ের নূপুর যেন বৃষ্টির টাপুরটুপুর শব্দ। তার এলোকেশী চুল যেন বর্ষার প্লাবন।
এই বৃষ্টিকে ফাহিমের ভীষণ পছন্দ। এই বরষার প্লাবণীর হাত ধরে সে ভেসে যেতে চায় অনন্ত পথ।
ফাহিম “আচ্ছা আমাদের কী কখনো দেখা হবে না?”
মেয়েটা ” পৃথিবী তো গোল। ঘুরতে ঘুরতে একদিন নিশ্চয়ই দেখা হয়ে যাবে।”
“দেখা হলে তুমি আমাকে চিনতে পারবে?”
” কেন পারবো না? অবশ্যই চিনতে পারবো।”
” আমি তো তোমাকে চিনি না। যদি আমরা খুব কাছাকাছি থাকি তুমি আমাকে খেয়াল না করো, তাহলে কী আমাদের দেখা হবে না? ”
” না হলে তো কিছু করার নেই।
মাঝেমধ্যে ফাহিমকে বেশ এড়িয়ে চলে মেয়েটা। খুব সাধারণ কথায় উত্তর দিয়ে দেয় যেকোন প্রশ্নের। কিন্তু ফাহিমের মেয়েটাকে সাধারণ নয়,অসাধারণে ভালো লাগে। মেয়েটার হাজার কথায় একটি উত্তর তার ভীষণ পছন্দের।
কোন কোন দিন ফাহিমের মন খুব খারাপ থাকে। কথা বলতে ইচ্ছে হয় না কারো সাথেই। এমন সময়ে মেয়েটা নক দেয়। ফাহিম মেয়েটাকে কখনোই উপেক্ষা করতে পারে না। মেয়েটা হয় তো বা বুঝেও ফেলে ফাহিমের আজ মন খারাপ।
মেয়েটা ” তোমার কী আজ মন খারাপ?”
ফাহিম ” না।”
– ” আমাকে বলবা না?”
– ” কিছু হলে তো বলবো।”
– ” তুমি ইদানীং খুব বদলে গেছো।”
– ” ওহ”
একটু ভাব মারার চেষ্টা করছে ফাহিম। মেয়েটা তার ভাবকে পাত্তা দেয় কিনা তা ইই পরীক্ষা করছে।
মেয়েটা ” আমার শরীর ভীষণ খারাপ।”
ফাহিম ” ওমা কী হইছে?”
– “ঠান্ডা লেগে গেছে অনেক।”
– “আরো আইসক্রিম খাও বেশি বেশি। বললে তো শুনো না। মেডিসিন খাও তো?”
– ” হ্যা হ্যা।”
– ” এখন কী অবস্থা আগের থেকে একটু ভালো? ”
-” হ্যা অনেকটাই।”
-” যাক আলহামদুলিল্লাহ।”
ব্যাস ফাহিমের সব পার্সোনালিটি জলাঞ্জলি দিলো মেয়েটার অসুখের কাছে।
এভাবেই ফাহিম আর মেয়েটার কথাবার্তা হয় রোজই। ফাহিম মেয়েটাকে অনুভব করে। মেয়েটা ভীষণ অকপটে। মেয়েটা প্রজাপতির মতো। যতোক্ষণ ফাহিমের চোখের সামনে থাকে,সে যেম উড়ে বেড়ায়।
এভাবেই দিন বেশ ভালোই যাচ্ছিলো ফাহিমের। টক ঝাল মিষ্টি যেন একটা প্যাকেজ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ফাহিম মনে মনে ভাবে,এমন দিন কখনো না শেষ হোক…!
হঠাৎ করেই মেয়েটার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ফাহিমের। মেয়েটা আর তার সাথে কথা বলে না। আর তার মেসেজের রিপ্লাই দেয় না। ফাহিমের খুব একা লাগতে শুরু হয়। সে অনলাইনে এসেই মেয়েটার প্রোফাইল ঘাঁটতে থাকে। একবার, দুবার তিনবার, হাজার বার..! তার কিছুতেই কিছু আর ভালো লাগে না। আস্তে আস্তে ফাহিমের মনে হয় মেয়েটা হয়তো বা হারিয়ে গেছে। যাকে নিয়ে এডো ভেবেছে সে,সে আর হয়তো তার নেই। তার একটুকরো ভালো লাগা ফানুস হয়ে উড়ে চলে গেছে। রেখে গেছে বিষন্নতা,টেনে গেছে এক মায়া দেয়াল।
এভাবেই চলে গেলো কয়েক বছর। ইতোমধ্যে মেয়েটাকে ভুলে যেতে চাইলে আবছা মনে থেকে গেছে ফাহিমের। তারপরও সে তার মনটা অনেকটাই শক্ত রাখছে। মেয়েটাই একটা সময় তাকে শিখিয়েছে মনকে শক্তরাখার মায়া মন্ত্র। শিখিয়েছে কীভাবে মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। মায়ার মাঝে কীভাবে দেয়াল তুলতে হয়।
ফাহিম এখন মোটামুটি পড়ালেখা শেষ করে বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরী করে। ধানমন্ডিতে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে তার এক বন্ধুসহ থাকে।
সেই মেয়েটার ততোদিনে অনেকটাই ভুলে গেছে সে..! একাকিত্ব সে অনেকসময়ই অনুভব করতো। কিন্তু কখনো মনে হতো না, ওই মেয়েটি তার একাকিত্বের কারণ। ফাহিম এখন মনে করে যে থাকার সে থাকবে,যে যাবার সে যাবে,এটাইনজীবন,এটাই বাস্তবতা।
তার খুব মন খারাপ হলে সে বাড়িতে নিজের মাকে ফোন দিতো। অনেক কথা বলতো।
নয়তো বা ধানমন্ডি লেকে গিয়ে বসে থাকতো। লেকের সচ্ছ জলে ঢিল ছুঁড়তো।
এভাবেই বেশ ভালোই দিন যাচ্ছিলো ফাহিমের।
একদিন পড়ন্ত বিকেলে,ফাহিমের ভীষণ মন খারাপ,সে বসে আছে লেকের পাশে। সূর্য ডুবু ডুবু। কিন্তু তখনো চারিদিকে বেশ ঝকঝকে আলো। হালকাপাতলা পাখি ডাকছে। লেকের জলে ডুবাডুবি খেলছে এক ঝাঁক শুভ্র হাঁস।
হঠাৎ পেছন থেকে একটি মিষ্টি কন্ঠ ভেসে আসলো। এই কন্ঠ টা ভীষণ চেনা ফাহিমের। সে অনেক আগে হয়তো এটা কোথাও না কোথাও শুনেছে। কিন্তু কিছুতেই তার মনে আসছে না।
হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টি নামলো। ফাহিম পেছনে তাকালো না তখনো। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে সে। তার এলোচুল গুলো আরো বেশি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
পেছন থেকে আবারও সেই কন্ঠ..!
– “ফাহিম..!”
সেই কন্ঠে কী যে মায়া..! কী যে স্নিগ্ধতা..! কী যে আকুতি..! ফাহিম বোঝাতে পারবে না।
সে পেছনে তাকালো। ঝুম বৃষ্টির মাঝে মেয়েটাকে সে দেখলো।
হ্যা মিলছে,মিলছে। মেয়েটা কদমের মতো সুন্দর, মেয়েটার ভেজা ঠোঁট, আসলেই জবায় গড়িয়ে পড়া জলের মতো..! তার পায়ে নূপুর! তার চুল আসলেই বর্ষার প্লাবনের মতো।
ফাহিমের অজান্তেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটি মাত্র শব্দ…
“জিনিয়া…!”
লেখা : আর আই রাতুল