Skip to content

শোনায় সমস্যা- তরুন ইউসুফ

ইদানিং আমার শোনায় সমস্যা হচ্ছে। এই কথা জানার পরে অনেকে মুচকি হেসে বলবেন এই বয়সেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে কেমনে বাকি জীবন চলবে। শত্রুরা অবশ্য খুব একটা স্বস্তি নিয়ে বলবে যা শালা উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। খোঁড়া হয়েছিস তো একদম মোক্ষম জায়গায়। একদম ঝাড়ে বংশে নির্বংশ হবি। অনেকে যারা শুভাকাঙ্ক্ষী তারা অবশ্য খানিকটা সান্ত্বনা দিয়ে বলবেন আরে চিন্তা করো না আজকাল অনেক হারবাল টারবাল বের হয়েছে। শুনেছি ওসবে নাকি কাজ হয়। একটু চেষ্টা চিকিৎসা কর, ঠিক হয়ে যাবে। আসলে শত্রু মিত্র উভয়েই আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমি আসলে যে সমস্যার কথা বলেছি সেটা ওই সমস্যা না আমি বুঝিয়েছি শোনায় সমস্যা অর্থাৎ হিয়ারিং প্রবলেম।
এখন প্রশ্ন হল আমি কি তবে কানে কম শুনি? মোটেও না। দুএকবার এই সন্দেহ আমারও হয়েছে। তাই বেশ বড়সড় বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছি। তারা বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রায় দিয়েছে আমার কানে কোন সমস্যা নেই। তবে সমস্যা কি? সমস্যা হল আমি শুনি ঠিক আছে তবে ভুল শুনি।
কি ধরনের ভুল। একটু উদাহরণ দেই। আমার বড়মা মানে আমার বাবার নানী কিছুদিন আগে বয়সের দিক থেকে সেঞ্চুরি হাকিয়ে গত বছর গত হয়েছেন। খুব স্নেহ করতেন আমাদের। তারই কোলেপিঠে মানুষ হয়েছি আমি। আমার সেই বড়মা শেষ দিন পর্যন্ত বেশ সুস্থভাবে হাঁটাচলা করে গেছেন। তার সবদিকেই ঠিক ছিল শুধু সমস্যা ছিল চোখে। তবে তার কান ছিল টনটনে। রাতের বেলা তার ঘুম হত কম। একটু টুকটাক শব্দ হলেই উনি বুঝতে পারতেন। তবে শুনতেন ঠিক কিন্তু ভুলভাল।
বড়মার ঘর লাগোয়া ঘরে যিনি তখন থাকতেন তার নাম আমজাদ হোসেন। সম্পর্কে আমার ভাই হন। উনি স্কুলের দপ্তরির চাকরি করেন মানে ঘণ্টা বাজান। যেহেতু ইনকাম কম তাই চাকরির পাশাপাশি নানা কিছু করার চেষ্টা করেন। যেমন মুদি দোকান দিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর সে দোকানের চালান হারিয়ে লালবাতি জ্বলে গেল। তারপর শুরু করল হাঁস পালন। সে হাসের দলের ডায়রিয়া হয়ে পুরো পাল শেষ হয়ে গেল। এখন হোমিওপ্যাথ প্র্যাকটিস করেন। গ্রামের লোকের ছোটখাট সমস্যায় টুকটাক ওষুধ দেন। তো একদিন রাত্রে গ্রামের এক লোক তার কাছে এসেছেন সমস্যা নিয়ে। সমস্যাটা অবশ্য জটিল। অন্ডোকোষে ব্যাথা। হোমিওপ্যাথের ডাক্তাররা সাধারণত কোন রোগের বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ননা শোনে। সে অনুযায়ী আমজাদ ভাইও রোগীর অণ্ডকোষ বিষয়ে বিস্তারিত শুনে ওষুধ দিলেন। বড়মা যেহেতু লাগোয়া ঘরে থাকেন তাই ডাক্তার এবং রোগীর কথোপকথনের বিস্তারিত বড়মার কানে গেল। পরদিন সকালে আমজাদ ভাইয়ের সাথে বড়মার দেখা হতেই বড়মা খানিকটা রাগত স্বরে বললেন ‘কি বাপু তোরা রাতভর নন্দকোষ নন্দকোষ করিস, এমনি ঘুম কম হয় তারপর তোদের এইসব নন্দকোষের জ্বালায় ঘুমাইবার পারি না।
যাইহোক শুনতে ভুলকরায় এবং বুঝতে ভুল করায় অণ্ডকোষ হয়ে গেছে নন্দকোষ।
এইরকম অণ্ডকোষ থেকে নন্দকোষ জনিত ভুল না করলেও মাঝে মাঝেই অন্য ধরনের ভুল করে বসি
যেমন ধরুন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি হুট করে নিজের নাম শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি অপরিচিত লোক। তার দিকে এগিয়ে কিজন্য ডাকলেন জিজ্ঞেস করতেই ভুল ভাঙ্গে। উনি আসলে ডেকেছেন ধরেন মোকছেদকে আমি শুনেছি আমার নাম। একবার তো বিপদেই পরে গেছিলাম। এক মহিলার কণ্ঠে আমার নাম শুনে হাসিমুখে এগিয়ে যেতেই কেস খেয়ে গেলাম। ভদ্র অভদ্র সহ যা বলার নয় সেসব তো বললই সাথে শুনিয়ে দিল আমাদের মত বেলেহাজ মানুষের জন্য জাতির এই দশা। সে যাত্রায় কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছিলাম। এরপর এইধরনের ডাক শুনে আর কান দেই না। এতে অবশ্য অন্য ধরনের সমস্যা হয়। অনেক সময় কেউ আসলেই আমার নাম ধরে ডাকে আমি না শোনার ভান করে চলে যাই। যে ডাকে সে যদিও রাগ করে। তা করলে করুক আমি তো বিপদ থেকে বেঁচে যাই।
রাস্তায় না হয় বেঁচে গেলাম কিন্তু ঘরের ভেতরেই যখন হাইকোর্ট তখন কি আর সবসময় বাঁচা যায়? আমি কোন কাজে ঢুকে গেলে সে যাই করি না কেন দিন দুনিয়ার খেয়াল থাকে না। এটাই হয় কাল। বউ ধরেন রান্না করছে রান্না ঘরে। আমি হয়ত শোবার ঘরে বসে কাজ করছি। বউ ডাকছে শুনছি না। শুনব কি করে মাঝখানে আস্ত একটা দেয়াল। কিন্ত একবার দুইবার ডাকার পর না শুনলে ব্যাস বউয়ের মেজাজ তেড়িয়া। রান্না ঘর থেকে অগ্নিশর্মা হয়ে মা কালী আমার সমুখে। চিল্লায়া চিল্লায়া গলা ফাটায়া ফেললাম কানের কি মাথা খাইছ। এভাবে মাঝে মাঝেই বউয়ের কল্যাণে কানের মাথা খেতে হয় আমাকে।
তবে সবচেয়ে বেশি শুনতে যা ভুল করি তার গল্প এখন বলছি

সকালে নাস্তা করছিলাম। ড্রইং রুমে গান চলছিল। নতুন হোম থিয়েটার কিনেছি। ব্লু টুথ সুবিধে সম্বলিত সাউন্ড বক্স। বেশ আরাম আয়েশ করে গান শোনা যায়। রুমের এক কোনায় সাউন্ড বক্স। নো প্রবলেম। অন্য কোনা থেকে ফোন টিপে দিলেন। ব্যাস গান চালু হয়ে গেল। গান চলছিল বাংলা গান। আমি খোলা জানালা, তুমি ওই দখিনা বাতাস আমি নিঝুম রাত তুমি কোজাগরী আকাশ । গান শোনার এক পর্যায়ে বউ জিজ্ঞেস করল ‘ আচ্ছা কোজাগরী মানে কি? একটু বিপদে পরে গেলাম। কোজাগরী শব্দটির সাথে আমি অপরিচিত। তাই আমতা আমতা করে বললাম কোজাগরী বলে কি কোন শব্দ আছে? বউ বেশ কনফিডেন্টের সাথে বলল আরে আছে আমি কোথায় যেন পড়েছি। আমি শব্দটা একটু ভালোভাবে শুনতে বউকে বললাম গানটা প্রথম থেকে চালু করতে বললাম। হ্যাঁ কোজাগরই শোনা যায়। তবে এটা নিয়ে আমি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেললাম। বললাম এটা আসলে হবে তুমিকো জাগরি আকাশ। গানে একসাথে গায় বলে তুমিকো জাগরি শোনা যায় কোজাগরী হিসেবে। বউ খানিকটা সন্দেহ নিয়েই আমার এই গাঁজাখুরি ব্যাখ্যাটা মেনে নিল। বউ মেনে নিলেও আমার মনে খুতখুত করছিল। কোজাগরী শব্দ বলে শব্দ থাকতেও তো পারে। যেহেতু গুগোল মহাশয় হাতের কাছেই আছে তাই সন্দেহ কাটাতে সার্চ দিলাম এবং আমার ভুল ভাঙ্গল। কোজাগরী শব্দ আসলেই আছে এবং এর চমৎকার একটা অর্থও আছে। কোজাগর বা কোজাগরী শব্দের আক্ষরিক অর্থ “কে জেগে আছ?”
শরৎকালের পূর্ণিমার রাত্রি বৎসরের সবচেয়ে উজ্জ্বল রাত্রি। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই রাতে ধনসম্পদ, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী বিষ্ণুলোক হতে পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে “কে জেগে আছ?” এই প্রশ্ন করেন (নিশীথে বরদা লক্ষ্মী কোজাগর্তিভাষিণী- অর্থ নিশীথে বরদাত্রী লক্ষ্মীদেবী কে জেগে আছ বলে সম্ভাষণ করেন)। যে সেই রাতে লক্ষ্মীব্রত করে জেগে থাকে দেবী তার কাছ থেকে সাড়া পান এবং তার গৃহে প্রবেশ করে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করেন। কোজাগর বা কোজাগরী শব্দের আক্ষরিক অর্থ “কে জেগে আছ?” তবে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি এবং ঐ তিথিতে অনুষ্ঠিত লক্ষ্মীপূজাকে যথাক্রমে কোজাগরী পূর্ণিমা এবং কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা বলে অভিহিত করা হয়। তাহলে কোজাগরী আকাশ হল ঐ সময়কার আকাশ। যাক ভুল ভাঙ্গল।
বউকে কথাটা বলতেই হই হই করে উঠল। বলল আমি না জেনেও তাকে ভুলভাল বুঝাই এইসব আরকি। অভিযোগ মাথা পেতে নিলাম। তবে গানের এই ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে। গান শুনতে গিয়ে আমি প্রায়শই ভুলভাল শুনি। দুএকটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। শাহ আব্দুল করিমের একটি বিখ্যাত গান আছে
তুমি বিনে আকুল পরাণ
থাকতে চায় না ঘরে রে
সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে

ঐ গানের একটা লাইন আছে “তোমার প্রেম-সাগরে তোমার করিম যেন ডুবে মরে”। আমি প্রায় বছর দুয়েক এই লাইনটি শুনেছি এরকম ভাবে “তোমার রুপে মশা ঘোরে…। কই প্রেম সাগরে, কই মশা ঘোরে। বোঝেন তাইলে কি অবস্থা। ছোটবেলা থেকে অবশ্য আমার একটু শোনায় সমস্যা অর্থাৎ হিয়ারিং প্রবলেম। খুব মন দিয়ে শুনলেও অনেক কিছু ভুল শুনি তাই এরকম হয়েছে। যাই হোক ভুল ভাঙল যখন বিষয়টা আমার ইউনিভার্সিটি’র রুমমেটকে বললাম। সে বেশ একচোট হেসে নিল। তারপর বলল ওটা মশা ঘোরে হবে না হবে প্রেম সাগরে। তাই বলি যার রূপে মশা ঘোরে তার রূপ নিয়ে আব্দুল করিমের এত আকুলি বিকুলি যাবেন কোন দুঃখে। রুচিরও তো একটা ব্যাপার আছে।
এবার আমার রুমমেট আরেকটা গান নিয়ে তার সংশয়ের কথা জানালো। এটাও তখনকার সময়ের বেশ হিট গান। কোন এক বাংলা সিনেমায়ও সেটা যুক্ত করা হয়েছিল। গানের কথা গুলো এরকম ‘ ভালো বাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে…। ঐ গানের একটা লাইন আছে এরকম ‘দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা। এই লাইন নিয়ে আমার রুমমেট বলল আচ্ছা রুমমেট এই যে গানে বলে ‘‘দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ কেন চোষ না’ এই লাইনের মাহাত্ম কি? এবার ঠা ঠা করে আমি এক চোট হেসে নিলাম। তারপর বললাম ওটা হবে ‘রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা’। রুমমেটও একচোট হেসে নিয়ে বলল ‘ আমি ভাবলাম যৌবনের ব্যাপার স্যাপার হতেও পারে রূপ কেন চোষ না।

বুঝলাম আমার একার শুধু শোনায় সমস্যা না অনেকেই শোনার সমস্যায় ভোগেন অর্থাৎ হিয়ারিং প্রবলেম।

মন্তব্য করুন