(০১)
হাতি ও বাঘের সত্যিকারের বন্ধুত্ব
-বিচিত্র কুমার
একদিন গভীর জঙ্গলে বাস করত এক দুষ্টু বাঘ, নাম তার রাজন। রাজন ছিল ভীষণ অহংকারী। সে ভাবত, জঙ্গলের সব জানোয়ারই তার ভয়ে কাঁপে। কিন্তু রাজনের মনে ছিল একাকিত্বের কষ্ট। তার কোনো বন্ধু ছিল না, কারণ সে সব সময় নিজের শক্তি দেখিয়ে অন্যদের ভয় দেখাতো।
অন্যদিকে, জঙ্গলের এক কোণে থাকত এক শান্ত স্বভাবের হাতি, নাম গগন। গগন ছিল সবাইকে সাহায্য করতে ভালোবাসে এমন এক উদার প্রাণী। সবাই গগনকে ভালোবাসত, কিন্তু গগনও বুঝত, রাজনের একাকিত্বের কথা। সে ভাবত, “রাজন যদি একটু বন্ধুত্বের মূল্য বুঝতো, তাহলে তার মনটাও নরম হতো।”
একদিন গগন জলের ধারে পানি খাচ্ছিল। হঠাৎ সে দেখল রাজন দূর থেকে তাকিয়ে আছে। গগন হেসে বলল, “এসো রাজন, একসাথে পানি খাই।” রাজন অবাক হয়ে বলল, “তুমি আমাকে ডেকেছ? তুমি কি আমাকে ভয় পাও না?” গগন শান্ত কণ্ঠে বলল, “ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বন্ধুত্বের ডাকে ভয় লাগে না রাজন।”
রাজন প্রথমে একটু কুণ্ঠিত হলো, কিন্তু গগনের নম্রতা তাকে টানল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে গগনের পাশে বসে পানি খেল। সেদিনের পর থেকে রাজন আর গগনের দেখা-সাক্ষাৎ বাড়ল। রাজন ধীরে ধীরে বুঝতে লাগল, বন্ধুত্ব মানে কেবল শক্তি দেখানো নয়, বরং একজন অন্যজনকে ভালোবাসা, সম্মান করা।
কিন্তু রাজনের পুরনো স্বভাব মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। একদিন সে মজা করে গগনের লম্বা শুঁড় ধরে টান দিলো। গগন কিছু বলল না, শুধু মুচকি হেসে বলল, “বন্ধু হওয়া মানে একে অপরকে কষ্ট দেওয়া নয়, বরং একে অপরকে বুঝে চলা।” রাজন লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলল। সেদিন সে প্রথমবার উপলব্ধি করল, অহংকারে নয়, বিনয়ে মানুষ জয়ী হয়।
এদিকে জঙ্গলে একদিন বড় বিপদ দেখা দিল। জঙ্গলের এক কোণে আগুন ধরে গেল। সব পশুরা আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু করল। রাজনও ভয় পেয়ে গগনের কাছে ছুটে গেল। গগন ঠান্ডা মাথায় বলল, “চলো রাজন, আমরা সবাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করি।”
গগনের বিশাল শরীর দিয়ে সে ছোট পশুদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে লাগল। আর রাজন তার ধারালো নখ দিয়ে গাছের ডাল ভেঙে আগুন নেভাতে সাহায্য করল। তাদের একজোট প্রচেষ্টায় জঙ্গল রক্ষা পেল।
এই ঘটনা জঙ্গলের সবার মনে গেঁথে গেল। সবাই বুঝল, বন্ধুত্ব মানে কেবল একসাথে খেলা নয়, বরং বিপদের সময় একে অপরের পাশে দাঁড়ানো। রাজনও সেদিন থেকে বদলে গেল। অহংকারের মুখোশ খুলে সে সত্যিকারের বন্ধু হয়ে উঠল।
রাজন ও গগনের বন্ধুত্বের গল্প আজও জঙ্গলে ছড়িয়ে আছে। সবাই বলে, “বাঘের যদি বন্ধু হতে পারে হাতি, তবে পৃথিবীতে কোনো শত্রু নেই, যদি থাকে ভালোবাসার মন।”
(০২)
চিল ও ঘুঘুর শান্তির বার্তা
-বিচিত্র কুমার
এক ছিল বনের রাজকন্যা ঘুঘু, নাম তার গীতালি। ছোট্ট, কোমল গলা, সারাদিন গাছের ডালে বসে গান গাইত। বনজুড়ে তার সুরের জাদু ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু সেই বনে ছিল এক চিল, নাম তার দুর্জয়। তার ডানা ঝাপটালে আকাশ কাঁপত। দুর্জয় ছিল সাহসী, কিন্তু মেজাজ ছিল রুক্ষ। সে ভাবত, শক্তিই সব।
দুর্জয় যখন উড়ে বেড়াত, ছোট পাখিরা ভয়ে কাঁপত। গীতালি কখনো তার ভয় পেত না, বরং ভাবত—“শক্তি যদি মধুর সুরে বাঁধা থাকত, তবে বনটা আরও সুন্দর হতো।”
একদিন দুপুরবেলা গীতালি গান গাইছিল— “মিলন যেখানে, শান্তি সেখানে…”
ঠিক তখনই দুর্জয় এসে ঝড়ের মতো গাছের ডালে বসে পড়ল। গাছের পাতা ঝরে গেল, গীতালির গান থেমে গেল।
—“তুমি কী সারাদিন গান গাও গাও করো? কাজের কিছু করো না?”—দুর্জয় তাচ্ছিল্য করল।
গীতালি মুচকি হেসে বলল, “তুমি যেটা কাজ মনে করো, সেটা হয়তো অন্য কেউ আনন্দ মনে করে। গানও কাজ, শান্তির কাজ।”
—“শান্তি দিয়ে কি ক্ষুধা মেটে?”—দুর্জয় গর্জে উঠল।
—“ক্ষুধা মেটানোর জন্য যদি সবাই ঝগড়া করে, তাহলে বনেই বা থাকবে কে?”—গীতালি শান্তভাবে বলল।
কথাগুলো দুর্জয়ের মনে একটু হলেও ঢুকে গেল। সে উড়তে উড়তে ভাবল—“গীতালির কথায় কি সত্যিই কোনো শক্তি আছে?”
তখনই হঠাৎ একটা বিপদ ঘটল। বনপাড়া গ্রামের কিছু লোক জাল নিয়ে বন থেকে পাখি ধরতে এল। ছোট পাখিরা সবাই গাছের আড়ালে লুকাল, কিন্তু দুর্জয়কে কেউ ভয় পেত না, কারণ সে সব সময় শুধু নিজের শক্তি দেখাত, কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করত না।
গীতালি ধীরে ধীরে ডাকে ডাকে সব পাখিদের একত্র করল। সে দুর্জয়ের কাছে গিয়ে বলল—“এই প্রথম তোমার শক্তিকে আমাদের জন্য ব্যবহার করো। সবাইকে বাঁচানোর সময় এসেছে।”
দুর্জয়ের মনটা কেমন নরম হয়ে গেল। সে বলল, “তুমি যে শান্তির গান গাও, আজ আমি তার শক্তির রূপ দেখাব।”
তারপর দুর্জয় আকাশে উড়ে গিয়ে ডানা ঝাপটাতে লাগল। তার ছায়া দেখে গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাল। দুর্জয় প্রথমবারের মতো বুঝল, শক্তি শুধু ভয় দেখানোর জন্য নয়, রক্ষা করার জন্যও প্রয়োজন।
সেদিনের পর দুর্জয় আর গীতালি একসঙ্গে বনের পাহারাদার হয়ে উঠল। দুর্জয় আকাশ থেকে পাহারা দিত, আর গীতালি তার সুরে বনের পাখিদের শান্তির গান শোনাত।
বনের সবাই বলত—“শক্তি আর শান্তি যদি বন্ধুত্ব করে, তবে পৃথিবীটা স্বর্গ হয়ে যায়।”
এভাবেই চিল ও ঘুঘুর শান্তির বার্তা বনের গণ্ডি পেরিয়ে দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল।
নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753
https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL