১.
১৯ শে আগস্ট ২০১৮, ইন্দিরা সোসাইটি
রাত ২.৪৪, বেশ কিছুক্ষন আগে বৃষ্টি হয়েছে। আমি একটা ফ্লাটের পাচ তালায় থাকি। ঘুমিয়ে যেতে চেস্টা করছিলাম। অস্থির লাগছিল। কেন অস্থির লাগছিল নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। একটা ফোন আসল। একটু অবাক’ই হলাম। অচেনা নাম্বার। ফোন ধরেই কন্ঠটা চিনতে পারলাম।আমার বন্ধু রাশেদ। ও চার তালায় থাকে। আমাকে ছাদে ডাকছে। ও ঢাকায় আসল অথচ আমায় জানাল না। ব্যাপারটা বেশ খটকা লাগল। জানিয়ে রাখা ভাল রাশেদ বেশ কয়দিন যাবত গ্রামে বাড়িতে চলে গিয়েছে। একবার ভাবলাম রাশেদ কি আমার সাথে মজা করছে? নাহ, ওর কথা শুনে মনে হল ও সিরিয়াস। এত রাতে প্রায় সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে তাই বাধ্য হয়ে আমি একাই ফোনের টর্চ জালিয়ে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠলাম। উঠতেই একটা হালকা বাতাস আমার শরীর ছুয়ে গেল। জোছনা রাত ছিল তাই সব পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। ছাদের ডান দিকটায় তাকাতেই দেখলাম কেউ নেই। বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠল। কেমন ভয়টা আরও চাড়া দিয়ে উটহল। এরপর সাহস করে ছাদের বাম দিকটায় গেলাম কারন মাঝ বরাবর সিড়িঘর থাকার কারনে বাদিকটা দেখা যায় না। বা দিকে যেতেই দেখলাম ও একেবারে ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মজা করে বললাম উপরে যাওয়ার সখ হয়েছে? ও একটা হাসি দিয়ে সামনের দিকে তাকাল। এরপর যা ঘটল তা বলার মত না। ও এক ঝটকায় রেলিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে গেল। রেলিংয়ের উপর দাড়িয়েই আমাকে ওকে অনুসরণ করতে ইশারা করল। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত রেলিংয়ের দিকে হাটতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল অন্য কেউ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এরপর আমার নিজেকে আবিস্কার করলাম রেলিঙয়ের ধারে। কিভাবে এ জায়গাটুকু হেটে আসলাম তা আর মনে নেই। সামনে তাকাতেই দেখলাম কেউ নেই। তখন আমার শরীর এত বেশি কাপছিল যে কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সাহস করে সিড়ির দিকে দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে ফ্লাটে চলে আসলাম। রুমে এসে দেখলাম রুমমেট জেগে গেছে। বলল আমার ফোনে নাকি ফোন এসেছে। বলেই ও ফোনটা বাড়িয়ে দিল। কিন্তু ফোন নিয়েই তো আমি ছাদে গেলাম। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। আমি বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রুমমেটকে সব খুলে বললাম। মনে হল ঘটনাটা ও নিজে শুনেও ভয় পেয়েছে। এরপর কল লিস্ট চেক করে রাশেদের নাম্বারটা পেলাম না। কিছুক্ষন আগে যে নাম্বার থেকে কল এসেছিল সেটায় কল ব্যাক করলাম। একটা কান্না করা গলা বলল রাশেদ আর নেই। আমি বললাম নেই মানে? কে আপনি? লোকটি কাদতে কাদতে বলল ”আমি রাশেদের মামা। আজ দুপুরে ওরে সাপে কাটছে। ঘন্টাখানেক আগে মেডিকেলে ও মারা গেছে।” আমি কি বলব কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার হাত থেকে ফোনটা পাকা ফলের মত খসে পরে গেল। আমি ধপ করে ফ্লোরে বসে পরলাম। কিছুক্ষণ আগে ছাদের ঘটনাটা না ঘটলে রাশেদের মৃত্যুর কথা শুনে এতক্ষনে হয়তো আমি হাউমাউ করে কাদতে শুরু করে দিতাম। কিন্তু আমার কাছে তখনও সবকিছু অবিশ্বাশ্য লাগছিল। মানুষ ভয় পেলে সব কিছুই ভুলে যায়। কারণ মানুষ তখন নিজের অজান্তেই নিজেকে জীবনকে ভালোবাসতে শুরু করে। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগে এক সেট শার্ট প্যান্ট, নিরাপত্তার কিছু সরাঞ্জাম, হেডফোন আর পানির বোতল চাপিয়ে ফ্ল্যাট থেকে লিফটে পা বাড়ালাম। বোতাম টিপতেই হালকা আলোয় খালি লিফটটা দেখে শরীরটা ছ্যাত করে উঠল। লিফটে পা বাড়ানোর সাহস হলো না, সিড়ি দিয়েই নিচে নামলাম। এই গভীর রাত্রে ইন্দারা সোসাইটির রাস্তায় রিক্সা পাওয়ায় বেশ কঠিন। বাধ্য হয়ে হাটতে হাটতে মেইন রাস্তায় পৌছালাম। পুরোটা হাটা পথে রাস্তার ধারে কুকুরগুলোকে দেখেও আলাদা সাহস পাচ্ছিলাম। এই রাতে আমি, কাধে ব্যাগ, আর মাঝেমধ্যে দু একটা কুকুরের সঙ্গ। হাটতে হাটতে মনে হলো কেউ আমাকে অনুসরণ করছে নীরবে। মেইন রোডের পাশেই কয়েকটি রিক্সা দেখে ধরে প্রাণ ফিরে পেল। রিক্সা ধরে সোজা কাউন্টার। রাতেই বাসে উঠলাম। উদ্দশ্য রাশেদের গ্রামের বাড়ি।
২.
বাসে উঠে মনে হলো যাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাশেদের গ্রামের বাড়ি এখনো বহুদুর। কখন ঘুমিয়েছি খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল ভোর চারটায়। তখনো অন্ধকার। বাসটা অনেক জোড়ে ছুটছিল। খোলা জানালা দিয়ে বাতাসের তীব্র আলোড়ন তারপর একটা কড় কড় শব্দ। হঠাৎ বাসটার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে। কিন্তু গতি থাকায় কিছুক্ষন গিয়ে থেমে গেল। সামনে তাকাতেই দেখলাম রেল লাইন। আমাদের অবাক করে দিয়ে সাই করে একটা ট্রেন চলে গেল। অথচ হাইওয়ের উপর দিয়ে রেললাইন চলে গেলে সেখানে ট্রেন আসার আগে ব্যারিগেড দেয়ার কথা। ট্রেনটা যাওয়ার পর দেখলাম লাইনম্যান ঘুম ঘুম চোখে রুম থেকে বেড়িয়ে আসছে। ততক্ষণে বাস শুদ্ধো যাত্রীদের চিতকার চেচামেচিতে ভরে গেল। সবার ক্ষোভ উগড়ে পড়তে লাগল ড্রাইভারের উপর। ড্রাইভার বেশ উদ্বিগ্ন। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এটা রাশেদের কাজ নয় তো। সে আসলে আমার কাছে কি চায়? তখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না রাশেদ মারা গিয়েছে। ধীরে ধীরে ড্রাইভারের সিটের পাশের বক্স সিটে গিয়ে বসলাম। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম
– ভাই এই রকম ঘটনা কি আগেই ঘটছে?
– কি কন ভাই? গাড়ি চালালে টুকটাক এই রকম হয়
– আমি কিন্তু জেগে ছিলাম ভাই। দূর থেকে কোন রেল লাইন দেখি নাই
– ভাই কিছু জিনিস ভেতরে রাখতে হয়। প্রকাশ পাইলে বিপদ বাড়ে। যান নিজের সিটে যান
গাড়ি তখনও সা সা করে ছুটে চলছিল। তবে ঘটনাটা এখানেই শেষ হলে ভাল হত। কিন্তু ঘটনা এখান থেকেই শুরু।
#গল্প_চক্র
#পর্ব_২
ভোর বেলা। আমাদের বাসটা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে আমাকে হাইওয়ের পাশে নামিয়ে দিয়ে আবার যাত্রা শুরু করল। বাসটা যাবার পর চারদিকে নীরবতা আর অন্ধকার দানা বাধল। কালো পিচের হাইওয়ে থেকে একটা কাচা রাস্তা সোজা গ্রামের দিকে চলে গেছে। বাস থেকে নেমেই আবার বুকটা কেমন ধক করে উঠল। কারন সামনে তাকাতেই দেখলাম, ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছে চারদিক। পুরো রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। একটু সামনে এগুতেই একটা গ্রাম্য বাজার পেয়ে গেলাম, তবে সুনসান নীরব নিস্তব্ধতা ভর করেছে চারদিকে। দোকানগুলোর সাটারে তালা লাগানো, একটা বৈদ্যুতিক বাতিও চোখে পড়ল না। তবে রাশেদ এত বেশি ওর গ্রামের গল্প করেছিল যে, মনে হচ্ছিল সব আমার চেনা। হঠাৎ জনশুন্য হাটের মধ্যে ঢুকে কেমন ভয় ভয় করছিল। এলাকাটা এত বেশি নিরব যে হাটতে গিয়ে আমার জুতার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ পাচ্ছিলাম না। বাজারে গিয়ে একটা ভ্যান রিক্সাও তো দুরের কথা একজন মানুষকেও পেলাম না। সম্ভবত আনেক আগেই সব দোকান পাট বন্ধ করে দোকানীরা বাড়ি চলে গেছে। রাস্তার সাথে লাগোয়া সারি সারি দোকান। সব দোকান বন্ধ। মনে হচ্ছে ভুল করে ভুল জায়গায় এসে পরেছি। দূর থেকে ভেষে আসছিলো “হুশিয়ার সাবধান”, কথাগুলো যে ভাবে ধীরে আসছিল ঠিক সে ভাবেই ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম একা একা এতটা পথ হেটে যাব। কতই ভালো হতো যদি চৌকিদার ব্যাটার কোন হেল্প পাওয়া যেত! আচমকা পেছন থেকে কে যেন বলল, “রিক্সা খুজছেন?” পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি টর্চ হাতে এক লোক দাঁড়িয়ে। প্রথমে হুট করে কথা বলায় ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরে একটু স্বস্তি পেলাম একজন মানুষ পেয়ে। লোকটা দেখতে বৃদ্ধ। গায়ে চৌকিদারের ইউনিফর্ম। লোকটা ভারি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— পলাশ ডাঙা যাইবেন তো?
-হ্যা কিন্তু আপনি কি করে জানেন।
–বুঝবার পারি। বুইঝতে হয়।
বলেই লোকটা হাত দিয়ে ইশারা করে ওনাকে অনুসরন করতে বলল। আমিও লোকটার পেছন পেছন হাটলাম। সামনে এগুতেই একটা ভ্যান দাড়ানো দেখলাম। বেশ পুরনো, দেখে মনে হলো ভাঙাচোরা ভ্যান।
– ভ্যান কি আপনি চালাবেন তাহলে বাজার পাহাড়া…
ভ্যান কাচা রাস্তা দিয়ে চললেও কোন শব্দ, কাপাকাপি হচ্ছিলো না। মনে হলো একেবারে ফ্লাট কোন নতুন পিচ ঢালাই করা সড়ক ধরে যাচ্ছি। লোকটি আমাকে কথা শেষ না করতে দিয়েই গমগমে গলায় বলল-
— এই হাট পাহাড়া দেওন লাগেনা।
আমি পেছনে তাকাচ্ছিলাম৷ লোকটা সামনের দিকে তাকিয়েই বলল,
— সাবধান কইলাম, খবরদার পেছনে তাকাইবেন না।
– কেন? কোন সমস্যা?
— গ্রাম গঞ্জে সমস্যা আওন লাগে না। কিছু জিনিস না জানোনই ভালা।
লোকটার কথা বেশি সুভিদাজনক না হওয়ায় আমি আর কথা বাড়ালাম না। ভ্যানে চড়ে বসতেই ভ্যান চলতে শুরু করল। আশপাশ থেকে ঝিঝি পোকাদের কিরকির শব্দ ভয়ার্ত রাতের নিস্তব্ধতাকে খানিকটা ম্লান করে দিচ্ছে। গ্রামের মেঠোপথ ধরে ভ্যান চলতে লাগল। কোন রকম সমস্যা ছাড়াই ভ্যান একেবারে রাশেদের বাড়ির সামনে নামতেই দেখলাম বাড়ি থেকে দুজন লোক বেড়িয়ে আসছে লাইট হাতে। আমি সামনে যেতেই ওরা বলল,
–আপনি শাওন? রাশেদের বন্ধু?
-হ্যা
–কিসে এলেন?
-ভ্যানে
বলতেই মনে হল ভাড়া দেওয়া হয় নি। পেছনে তাকাতেই দেখি ভ্যানটা নেই। ওরা বলল,
– ভ্যানে আসছেন, ভ্যান কই?
আমি ওনাদের বাজারের পাহাড়াদারের কথা বলতেই ওরা জানাল বাজারে কোন পাহাড়াদার থাকে না। আমি এবার আরেকটা ভয়ের ধাক্কা খেলাম। পরে জানতে পারলাম একাত্তরে যুদ্ধের সময় বাড়ি ঘর ছেড়ে সবাই পালিয়ে গেলেও এক চৌকিদার পালান নি। মানুষের ফেলে যাওয়া দোকান পাট পাহাড়া দিতেন। চৌকিদার যুদ্ধের কিছুদিন পর যখন মানুষ দুরভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেল চৌকিদারের চাকুরী থাকলে বেতন থাকল না। বিনা বেতনের চাকুরী চলতে লাগল। জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বেড়ে গিয়েছিল। অসংখ্য মানুষ না খেতে পেয়ে রাস্তা ঘাটে মরে পড়ে থাকত। দুরভিক্ষের এক রাতে না খেয়ে জ্বরে পুড়ে হাটের মাঝেই একাকি মৃত্যু হয় তার। তার মৃত্যুর পর এই হাটে রাতের বেলা কোন চোর ঢুকতে পারতো না।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম আঙিনার মাঝখানে একটা চৌকিতে রাশেদেকে শোয়ানো। বারান্দায় কেউ কুরান পড়ছে, কেউ নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। একটু অবাক হলাম এই ভেবে যে রাশেদের মা ছাড়া কারই চোখে মুখে শোক দেখতে পেলাম না বরং সবার মুখেই কেমন একটা আতংকের ছাপ। জানতে পারলাম রাশেদের মা যখনই জ্ঞান ফিরছেন রাশেদ বলে চিৎকার দিয়ে আবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। ওর বাবা আর চাচা আমাকে দেখার সাথে সাথে আমাকে একটা আলাদা ঘরে নিয়ে বসালেন। আমি একটু অবাক হতে যাচ্ছিলাম কিন্তু সেটাকে আবার একটা ধাক্কায় পরিনত করলেন রাশেদের বাবা।
–বাবা, রাশেদের গায়ে ওসব কিসের উল্কি আকা?
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– ”কিসের উল্কি? আমারা অনেকদিন যাবত এক ঘরেই থাকি কই কোন দিন তো কিছু দেখিনি।”
আমি এবার খানিক ভেবে যোগ করলাম,
– “অবশ্য ও মাসখানেক হল সব সময় রুমে টিশার্ট নয়তো শার্ট পরে থাকত। বিষয়টা আমার কাছেও খটকা লেগেছিল।”
ওর বাবা এবার আমাকে রাশেদের গায়ের উলকি গুলো দেখালেন। উলকিগুলোর প্রত্যেকটি কোন না কোন সিম্বল বহন করে বলে বোঝা যাচ্ছিল। রাশেদের মুখের দিখে তাতেই গা’টা কেমন শিউড়ে উঠল। মনে হল ও আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইছে।
ওর বাবা আর আমি আবার ওই রুমে ফিরে আসলাম। ওর বাবা কাদতে কাদতে বলল,
– ছেলেটে আমার এত ভদ্র ছিল শেষে কিনা ওর মৃত্যুর পর পাড়ার লোকেরা ওকে সন্দেহ করছে? বলছে ওগুলো নাকি কোন খারাপ চিন্হ।
— বললাম আমাকে কিছু ঘন্টা সময় দিন।
এরপর আমি চিন্হ গুলোর ছবি তুলে নেটে ইমেজ ম্যাচ সার্চে ক্লিক করতেই গুগল যে সার্চ রেজাল্ট টা দেখাল তাতে আমি ভিমড়ি খাওয়ার জোগার। রাশেদের বাবা আর চাচাকে ডেকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে দুজনকেই প্রথমে শান্ত থাকতে বললাম। তারপর বললাম,
– ‘চাচা ওগুলো লুসিফারের সিম্বল। ‘
ওর চাচা জিজ্ঞেস করল ‘লুসিফারটা কে?’
আমি বললাম,
– ‘লুসিফার শয়তানের আরেক নাম। রাশেদ সম্ভবত মাসখানেক হল কোন শয়তান পুজারীর খপ্পরে পরেছে।”
ওর বাবা বলল,
– এখন উপায়?
আমি বললাম, গ্রামের সবাইকে বলবেন ওর একটা অসুখ সারাতে কবিরাজের পরামর্শে ও একাজ করেছে। আর ওর কবর দেওয়ার পর ওর কবরের আসেপাসে কড়া পাহাড়ার ব্যবস্থা করুন।”
কথা বলা শেষ করতেই একটা বাতাস এসে দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে গেল। যেন বাইরের কেউ আমাদের উপর ভীষন ক্ষিপ্ত। তার ক্ষোভের বহি:প্রকাশের সামান্য নিদর্শন এই হঠাৎ দমকা হাওয়া। লোকজন সন্দেহ করতে পারে তাই দুজনই বাইরে বেরিয়ে এলাম। গভীর রাতেই ওর জানাজা, কবরস্থের কাজ শেষ করা হল। গ্রামে ওদের পারিবারিক কবরস্থানই হলো ওর চিরকালের আশ্রয়স্থল। একেকজন শুভ্র সাদা পোশাকের মানুষ একটু একটু করে রাশের কবরের উপরে মাটি জমাচ্ছিল আর গোরস্থানের জনসংখ্যা কমছিল। ধীরে ধীরে কুড়ি, পনেরো, দশ শেষে চার। একজন মানুষ কবরের উপরের শেষ কাজটুকু করছিলেন। উঁচুনিচু মাটির অংশগুলো সমান করছেন। রাশেদের বাবা নীরবে এক মনে তাকিয়ে ছিলেন কবরের দিকে। কাজ শেষ হলে আমরা তিনজন হাটতে শুরু করলাম। দূর থেকে পাখির পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ ভেসে এলো। চারদিকে শুনশান নীরবতা, রাতের গভীরতাকে আরও বাড়িয়ে দিল। এবার রাশেদ একা হবে, একেবারেই একা। এখন তার সাক্ষাৎকার চলবে। দুনিয়ার সাক্ষাৎকার থেকে যা একেবারেই ভিন্ন একেবারেই আলাদা। ভীষণ রকম আলাদা।
কিন্তু এখানে রাশেদের জীবনের শেষ কাজটা শেষ করে সব কিছুর অবসান হয়েছে মনে হলেও সম্ভবত এই ঘটনাটা যেন এরপর থেকে আরও বেশি জ্যান্ত, ভয়ানক আর মারাত্মক হয়ে উঠল। শোকের বদলে আমার শরীরে দানা বেধেছিল ভয় আর রাশেদের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করার চিন্তা। আমার বার বার মনে হচ্ছিল সাপের কামড়টা একটা নিছক খেলা, মুল ঘটনাটা এই ঘটনার আড়ালে চাপা পড়েছে। রাশেদ সম্ভবত খুন হয়েছে!!
#গল্প_চক্র
#পর্ব_৩_অন্তিমপর্ব
ভোর হতে হতে রাশেদের জানাজা, কবর দেওয়া সব শেষ হয়ে গেল। দিনের বেলা অনেকেই ঘুমিয়ে নিল। আমি সে সময়টা জুড়ে ইন্টারনেটে অনেকগুলো বই পড়লাম যেগুলো রাশেদের সমস্যার সমাধান দিতে পারে। রাতে হন্তদন্ত হয়ে রাশেদের বাবা ছুটে এলেন। রাশেদের মা নাকি কি একটা স্বপ্ন দেখেছেন। কয়েকজন কালো ঝাপসা মানুষ ‘বইটা দে’ ‘বইটা দে’ বলে চিৎকার করছিল।মনে হচ্ছিল তাদের গায়ের চামড়া কেউ খুলে নিয়েছে। স্বপ্নটা দেখার পর রাশেদের মা এত বেশি ভয় পেয়েছেন যে গত এক ঘন্টায় উনি স্বাভাবিক হতে পারেন নি।
আমার ঘুমোতে গিয়ে প্রায় রাত দুটো বেজে গেল। মনে হচ্ছিল এবার আমার পালা। দেখি আমার জন্যে কি অপেক্ষা করছে। গা’টা বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুম ডুবে গেলাম। এবারের সপ্নটা একটু আলাদা। রাশেদ একটা সাদা পাঞ্জাবি পরা।ও বলা শুরু করল, ‘তোকে আমি সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম যে ‘ওর সাথে আমার সম্পর্ক আছে’। সত্যটা হল, জয়েতি জানে না আমি ওকে ভালোবাসি। আমি বুঝতে পারছিলাম ও তোর প্রতি দুর্বল। তাই ওকে তোর থেকে দূরে রাখতেই মিথ্যেটা বলেছিলাম। আমার শেষ কথাটা ওকে জানিয়ে দিস। রাশেদ কথাগুলো শেষ করতেই ওর শরীরটা ধীরে ধীরে মিশে গেল’। এরপরই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। মনে মনে একটু হাসলাম এই ভেবে যে, মানুষ মৃত্যুর কি স্বার্থপর থেকে যায়! ভোরবেলা কারো দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। দরজা খুলতেই ফটোকপি করে বাধানো একটা বই হাতে ঢুকলেন রাশেদের বাবা। উনি বললেন রাশেদের ব্যাগ থেকে এই বইটা পেয়েছি। বইটা খুলতেই রাশেদের গায়ে যে গ্রাফিতিগুলো ছিল একই গ্রাফিতি এই বইয়েও। সব পৃষ্ঠা জুড়ে অদ্ভুত সব চিহ্নে ভরা। ভাষাটা সম্ভবত ল্যটিন। বইটা সম্পর্কে একজনই বলতে পারবে। হুমায়ুন কবির। বইটা ড্রয়ে রেখে আমি যোগাযোগ করলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতাত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডঃ হুমায়ুন কবিরের সাথে। রাশেদের ব্যাপারটা জানার পর উনি নিজেই আসতে চাইলেন। ওনার অতি আগ্রহের কারন উনি প্রাচিনকালের প্রচলিত গড, ডেভিলদের নিয়ে পি এইচ ডি করেছেন এবং এখনো তার এব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ।
প্রফেসর দুপুর বেলাতেই এসে পৌছালেন।প্রফেসর ঘটনাটা আবার রাশেদের বাবার কাছে শুনলেন। এরপর উনি বলা শুরু করলেন বিশাল এক ইতিহাস।
“ কোডেক্স গিগাক্স, বাংলায় যার অর্থ বিশাল আকার বই। বিশ্বের বৃহত্তম মধ্যযুগীয় পাণ্ডুলিপি। ধারনা করা হয় যে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে তৃতীয় ভাগের মধ্যে বোহেমিয়ার (চেক প্রজাতন্ত্র) বেনেডিক্ট পোডলাজাইসের আশ্রমে এটি তৈরি করা হয়েছিল। এতে ভালগেইট বাইবেলের পাশাপাশি অনেক ঐতিহাসিক নথি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা সম্পূর্ণ লাতিন ভাষা লেখা হয়েছে। ১৬৪৮ সালে, ত্রিশ বছরের যুদ্ধের সময় সুইডিশ সৈন্যবাহিনীরা একে যুদ্ধের লুণ্ঠিত দ্রব্য হিসেবে নিয়ে যায়। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এটি সুইডেনের জাতীয় গ্রন্থাগার স্টকহোমে সংরক্ষিত ছিল। আমার বিশ্বাস পরে এটি চুরি হয়ে গেছে। এটি শয়তানের বাইবেল হিসেবেও পরিচিত, কারণ এর ভিতর অশুভ চিত্রণ রয়েছে এবং এর কাহিনীতে বর্ণিত রয়েছে যে, লেখক এটি লেখার জন্য শয়তানের সাহায্য চেয়েছিল। আসলে লেখক ছিলেন একজন মোনাকো, সে তার ঘরে বসে মনোযোগ দেয় এক রাতেই বই লেখার কাজ শেষ করার জন্য যাতে তার আশ্রমের নাম সুখ্যাতি হয়। সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার হচ্ছে এর ৫২টি পৃষ্ঠা খুজে পাওয়া যায় নি। এই পাণ্ডুলিপির লেখক ছিলেন একজন মোনাকো, যে তার মোনাকোর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে যার ফলে তাকে শাস্তি হিসেবে তাকে জীবিত দেওয়াল গেঁথে বুজিয়ে দেওয়া হয়। এই কঠোর শাস্তি থেকে নিবৃত্তি পাওয়ার জন্য তিনি বইটি লিখবেন। যেখানে মানুষের সমস্ত জ্ঞান থাকবে। তিনি মধ্যরাত্রি কাছাকাছি নিশ্চিত হন, যে তিনি একা এই কাজের সম্পূর্ণ করতে পারবেন না, তাই তিনি একটি বিশেষ প্রার্থনা করেন দেবদূত শয়তানের কাছে। তার আত্মার বিনিময়ে বইটি সম্পূর্ণ করার সাহায্য প্রার্থনা করেন। বইটি সম্পূর্ণ করার পর উনি আশ্রমের শাস্তির হাত থেকেও মুক্তি পেলেও শয়তানের হাতেই তার মৃত্যু হয়।
আমি প্রশ্ন করলাম, তাহলে এই বইয়ের কপি যাদের কাছে ছিল তারা রহস্যময় ভাবে মারা যাচ্ছে কেন?
উনি বললেন, ধারনা করা হয় জীবন্ত মানুষের চামড়া ছাড়িয়ে এই বইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই অবস্থায় যে মানুষগুলির মৃত্যু হয়েছে। তাদের আত্না প্রতিশোধ স্বরুপ বই থেকে যারা মন্ত্র নিয়ে শক্তিশালী হতে চায় তারা ব্যার্থ হলে তাদের নৃশংসভাবে খুন করে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে চুরি হবার পর বইটি চলে যায় শয়তান পুজারিদের দখলে। ওরাই বইটির স্ক্যান করে কয়েকশ কপি বিভিন্ন দেশের নিজেদের গুপ্ত কমিটির কাছে পাঠায়। নিজেদের অজান্তেই ওরা একটা মারাত্তক ভুল করে ফেলে। এরপর থেকে যারাই ওই বই থেকে মন্ত্র সাধনা করার চেস্টা করেছে তারাই মারা পরেছে”।
রাশেদের বাবা কিছুটা ভয় মুখে বললেন, ‘বইটা থেকে বাচার কি কোন উপায় আছে?’
‘উত্তরে উনি বললেন, উপায় আছে একটাই। বইটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে’। তারপর আমি ড্রয় থেকে বইটা বের করে প্রফেসরের হাতে দিলাম। উনি একটা পৃষ্ঠা উল্টোতেই আমরা বোকা বনে গেলাম। কারন বইয়ে একটা লেখাও নেই। পুরো সাদা। মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করেই সব মুছে দিয়েছে।
এরপর প্রফেসর নিজে হাতে বইটা পুড়িয়ে দিলেন। প্রফেসরের সাথে আমিও ঢাকায় ফিরলাম। ফিরবার সময় রাশেদের বাবা আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে কেদেই ফেললেন। ঢাকায় ফিরেই দেখা করলাম জয়েতির সাথে। জয়েতি পড়ত ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে। একটা সাংস্কৃতিক ক্লাবে যোগ দিয়ে রাশেদ আর আমার সাথে জয়েতির পরিচয় হয়। সেদিন রাসেদ আমার লেখা একটা গান ক্লাবের সবাইকে শুনিয়েছিল। জয়েতি রাশেদের কাছে সেদিন গান শুনে ওর মুগ্ধতা জানাতে এসেছিল। সেখানেই আমাদের পরিচয়। এরপর আমাদের তিন জনাতেই নিয়মিত আড্ডা হত। রাশেদ যখন ওর সাথে জয়েতির সম্পর্কের কথা বলেছিল তারপর থেকে জয়েতির সাথে আর দেখা করিনি। আজ বহুদিন পর ওর সাথে দেখা হল। ও কিছুটা অভিমান কন্ঠে ঝাঝের সাথে বলল, এতদিন পর? আমি উত্তর না দিয়েই রাশেদের একটা ডায়েরির পাতা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম।
জিজ্ঞেস করল -কার এটা?
আমি বললাম,– রাশেদের।
-রাশেদ কই?
–মারা গ্যাছে।
এরপর ঘটনাটা ওকে খুলে বললাম। ততক্ষনে বন্ধু বিয়োগের আচমকা খবর শুনে ওর চোখে পানি এসে গ্যাছে। সে অবস্থায় বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই আমি ওখান থেকে উঠে এলাম। কি কারনে জানা নেই। সম্ভবত বন্ধুর জন্যে।
আরও কিছুদিন পর একটা খবরে বেশ বিস্মিত হলাম। সেই প্রফেসর হুমায়ুন কবির আজ রাতে রহস্যজনক ভাবে মারা গেছেন। ইচ্ছে করেই ওনার জানাজায় যাই নি। চাইছিলাম না আবার নতুন কোন রহস্যের জালে জড়াতে। অনেক তো হল।
এরপর ঈদের ছুটি চলে এল। আমিও বাড়ি ফিরছি। ট্রেন চলছে। বহুদিন হল ডায়েরিটা কলমের ছোয়া পায়নি। লেখা শুরু করলাম।
.
শহরের বুকে ট্রাম লাইন….
ইচ্ছে নিয়ে ছুটছে ।
গ্রীষ্মের রোদে বৃষ্টি…
আর কবিতারা রাত গুনছে।
পাহাড়ি হাওয়া তোলে সুর…
চুরি কেউ ঠিক শুনছে।
শহরের বুকে ট্রাম লাইন….
ইচ্ছে নিয়ে ছুটছে।
.
রাশেদ থাকলে গানটা ওকে দিয়েই গাওনো যেত। কিন্তু নিয়তি বড্ড রহস্যময় আর বেমানান।