সেজন বাঁধিঘর
——- (ছোটগল্প)
রমেন মজুমদার
তারিখ:২২/০৪/২৩
——-
পেটের জ্বালায় কামলা দিতে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে গোয়ালন্দঘাট।
রহিমার অসুস্থ স্বামী হারেজকে নিয়ে। হারেজ রহিমাকে যখন বিয়ে করে,তখন রহিমার বয়স পনের।
বাবা গিয়াসউদ্দিন অত্যন্ত গরীব।
দুই মেয়ের মধ্যে রহিমা ছোট। বড়টি করিমন পালিয়েগিয়ে স্বামীরঘর করছে।সে ভালো আছে।
গিয়াসউদ্দিন মানুষের জমিক্ষেতে কাজকরে সংসার চালায়।
তারই সাথে একদিন কাজের সুবাদে পরিচয় হয় হারেজের সাথে।
হারেজ এক বস্তির ঘরের ছেলে।গিয়াসউদ্দিনের সাথে ঠিকায় কামলা দেয়।
একদিন রহিমাকে দেখে হারেজ মনে মনে ভাবল, হায়রে আল্লাহ ! মেয়ে মানুষ এতো কাল হলে কেডায় হ্যারে বিয়া করব ?
আল্লায় ক্যান হ্যারে এত কালো বানাইল ?
চাচায় দেহি ফর্সা।
হারেজ গিয়াসউদ্দিনকে চাচা কইরা ডাকত।
একদিন হারেজ চাচারে বলল, চাচা তোমার মাইয়াডা এতো কালো ক্যান ?
— ধুর, তোর চাচী আম্মাও কালো ছিল।মাইনসে কইত কোকিল ছানা।
তোর চাচীর ল্যাহাল রহিমাও কালো অইছে।
কি করুম,মাইয়াডারেতো আর ফালাইয়া দিবার পারিনা(?)
তয়,অহন একটু আগের চাইতে ভালো দেহায়।
হারেজ, চাচার কথাগুলো মন দিয়ে শুনছে।
গিয়াসউদ্দিন বলল,
বুঝলি হারেস, শরীরে যৌবন আইলে চেহারা ফিরে। আমার মাইয়া কালা অইলে কি অইব;অহন হ্যার চেহারা ফিরতাছে।
— হ’চাচা, ঠিক কইছ।
একদিন দুইদিন করে হারেজ রহিমাকে দেখতে দেখতে মনে ধরছে।
রহিমার যৌবনের মধ্যে একটা চান্দের জুতি দেখতে পেল হারেজ।
গিয়াসউদ্দিন মনে মনে অনুমান করল,মাইয়াডারে হারেজ পছন্দ করছে।
একদিন হারেজকে বলল,
আমার শরীর ভালো যাইতাছেনা।
আমি যদি না থাহি তাইলে তুই আমার মাইয়াডারে দেহিস।
—-
কিছুদিন পর হারেজ রহিমাকে বিয়ে করল। গিয়াসউদ্দিন আর বেঁচে নেই।অভাবের সংসার।
হারেজ একদিন রহিমাকে বলল, বউ আমার নগে যাবি? আমি একটা কামের সন্ধান পাইছি।
রহিমা বলল কোনহানে ?
গোয়ালন্দঘাট।
হেই জায়গায় বিদেশি প্রজেক্টের কাজ । কুরিয়ান কোম্পানীর মাইনসে বড় বড় রাস্তার কাম করাইতাসে।
হাজার হাজার মাইনসে কমলা দিতাছে।ভাল পয়সা দেয় ওরা।
মাঠের কাজে মুজুরী দেড়শ টাকা,আর ওরা দেয় তিনশ টাকা।
হারেজের কথা শুনে রহিমা রাজি হইল।
ওরা কাপড় চোপড় গুছিয়ে চলে এলো গোয়ালন্দঘাট।
পদ্মার এপারে ফরিদপুর জেলা। এখানে মানুষ চব্বিশ ঘণ্টা কাজকরে অনেক টাকা ইনকাম করে। সেই খবর পেয়ে হারেজ রহিমাকে নিয়ে চলে এলো গোয়ালন্দঘাটে।
ওরা কামলা দিতে এলো ঠিক,এখন কোথায় থাকবে রহিমাকে নিয়ে,সেটাই ভাবছে।
—–
গোয়ালন্দঘাটের নিকটেই ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর সারিবদ্ধ ভাবে বস্তির মত বসতি। দেখে মনে হয় একটি সদ্যগ্রাম।
এখানে গরু,ছাগল,মুরগি পালন করে অনেকেই।
হারেজ রহিমাকে নিয়ে এলো সেখানে ঘরভাড়া পাওয়া যায় কিনা (?)
এসে এক মোটামত মহিলার সাথে আলাপ হল। সবাই তাকে মাসী বলে ডাকে।
হারেজের সাথে মাসী জুলেখার পরিচয় হয়।
শেষে ওদের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা হয়েযায়।
ছোট একটি ঝুপড়িঘর ভাড়া মাসে এক হাজার টাকা।
কদিন পরে হারেজ জানতে পারল যে, এটা বস্তিগ্রাম হলেও আসলে এখানে সবকিছুই হয়।
প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি,ট্রাক এই ঘাট দিয়ে ফেরি পারপার হয়।
ওপারের ঘাট আরিচা। দিনরাত বুঝার কায়দা নেই। সারারাত, সারাদিন এই গোয়ালন্দ ঘাট থেকে আরিচা, নগরবাড়ি ঘাটে যাত্রীবাহী বাস,মালবোঝাই লরী পারাপার হয়।
সবসময় একটা জমজমাট ভাব।
এতদিনে হারেজ বুঝতে পারল তারা যেখানে ঘর ভাড়া নিয়েছে,সেখানে মেয়েরা শরীর দিয়ে টাকা কামাই করে।অর্থাৎ এটা দেহ ব্যবসার কেন্দ্রস্থল।
হারেজ ভাবল, এখানে থাকলে আমার বউডাও নষ্ট হইয়া যাবে।
কিন্তু ততদিনে মাসীর নির্দেশে রহিমাকেও গতর মেলে দিতে হয়েছে।
রাতে চারপাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে ফেরি পারাপার হতে, মাইলের পরে মাইল গাড়ির লাইন।
তাই অধিকাংশ লরির ড্রাইভার এখানে এসে মনোরঞ্জন করে।পিপাসার্ত মন ভিজিয়ে তারা পদ্মানদীর ওপার যায়।
—
হারেজ এখানে এসেছে এই একবছর হলো।
ইদানিং হারেজের শরীর তেমন ভালো নেই। আগের মত কাজ করতে পারেনা।
গতরে শক্তি কমে গেছে।
রহিমা এতদিনে প্রায় লক্ষাধিক টাকা জমিয়ে হারেজের হাতে দিল।
পদ্মার চরে অদূরে অনেকেই চর কিনে ঘর তুলে বসবাস করছে।
হারেজও সেই টাকা দিয়ে দুকাঠা জায়গা কিনে ঘরতুলে থাকতে শুরু করল।
রহিমার যৌবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে এই গোয়ালন্দঘাটে।
শরীরে আরও তাগুদ আছে, যৌবনের সিড়ি শেষ হয়নি।
কাঁচা টাকার লোভ সামলাতে পারেনা অনেকেই।
রহিমাও না। তারপর আরও একটি বছর পরে রহিমা স্বামীকে বলল, এবার তুমি ইট সুরকি সিমেন্ট কিনে লেবারমিস্ত্রি খাটাও।
বস্তির মত করে নয়,বাড়িতে দালান তুলতে হবে।
জীবনে যে কটা দিন বাঁচব,আরাম করেই বাঁচি।
পরদিন রহিমার নির্দেশ মত হারেজ গেল ইট সিমেন্ট এর অর্ডার দিতে।।
—– শব্দ সাংখ্য -৬১৫
———-