***মেয়েদের বাড়ি থাকতে নেই***
……………..আজিজুল হক
কোনদিন বুঝতে পারিনি বাড়িটা আমার নয় ,
যে বাড়িতে আমি সেই জন্মলগ্ন থেকে বড় হলাম, আমার
শৈশব, কৈশোর, আমার যৌবনের একটা বিশেষ সময় যে বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে,
আমার আবেগ আর ভালোবাসায় তাকেই আমার স্বপ্ন ভেবে ছিলাম!
হঠাৎ একদিন সানাই এর বিষণ্ণ সুরে সে বাড়ি থেকে আমায় বুঝিয়ে দেওয়া হলো ,
এই বাড়িটা তোমার বাপের বাড়ি!
তুমি এবার নিজের বাড়ি যাচ্ছো, শ্বশুরবাড়ি।
সমস্ত আবেগ ভালোবাসা স্বপ্নগুলো চোখের সামনে কেমন যেন ভেসে যাচ্ছিল উন্মুক্ত হওয়ায়,
ছড়িয়ে যাচ্ছিল আমার সেই ছোট্টবেলা,
আমার সেই স্মৃতিগুলো ,
আমার সেই ছোট্ট পড়ার টেবিলটা,
আমার সেই পথটা, যে পথে রোজ আমি স্কুলে যেতাম ফিরতাম ,
আমার বন্ধু বান্ধবী, সবাই যেন আজ আমায় আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে ,এই বাড়িটা আমার নয় ,আমার ছিল না কোনদিন….
তারপর একটা নতুন মানুষ ,একটা নতুন পরিবেশ, একটা অচেনা মন,
তাকে মন থেকে মেনে নিয়েই যে বাড়িতে এলাম, বিশ্বাস করুন, সে বাড়িতে কেউ কোনদিনও আমার পরিচিত ছিল না…
তারপর একদিন সময়ের তালে তালে বুঝতে শিখলাম,
এ বাড়িটা আমার শ্বশুর বাড়ি !
এই বাড়িতেই জীবনের বাকি সময়টা আমায় কাটিয়ে দিতে হবে,
ভালোবাসলাম ,ভালবাসতে শিখলাম,
নিজের সমস্ত ভালবাসা আর আবেগ দিয়ে বাড়িটাকে সাজালাম,
মনে হল, সত্যিই তো, এটাই আমার নিজস্ব বাড়ি!
এভাবে কেটে গেল অনেকদিন,
শশুর মশাইও গত হলেন,
আমার স্বামী আর আমি সমস্ত শোক ভুলে
আবার ও নতুন করে শুরু করলাম ,ভালোবাসলাম ,
আরো, আরো, নিজের সমস্ত মন, প্রাণ আবেগ…
আমার যা কিছু ছিল, তা দিয়ে আমার বাড়িটা আমি সাজালাম ,
কিন্ত বিশ্বাস করুন ,হঠাৎ বাড়িতে যদি কখনো ওর সঙ্গে আমার টুকটাক সাংসারিক কথা কাটাকাটি হতো ,
ও আমাকে বলতো ,আমার বাড়িতে এ সব চলবে না,
আমার বাড়ি? আমার নয় ?
তাহলে আমি কে? আমি কে? এই বাড়িতে আমার কিসের অধিকার ?
ভেঙ্গেচুরে শেষ হয়ে যেত আমার ভালোবাসা দিয়ে গড়া আমার স্বপ্নমহল!!
যে বাড়িতে আমি বড় হয়েছি, সেটা আমার নয় ,
স্বামীর সঙ্গে হাত ধরে প্রবেশ করা বাড়িটা,
যাকে আমি জীবনের সমস্ত আশ্রয় ভেবেছি, কথায় কথায় আমায় শুনতে হয় বাড়িটা আমার নয়…..
না, এখন আর তিনি নেই ,গত হয়েছেন কয়েক বছর হল,
ছেলেটা আমাদের অনেক বড় হয়েছে ,
নামিদামি একটা বেসরকারি কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ,
এই বাড়িটা থেকে তার কর্মক্ষেত্র অনেকটা দূর,
সেও একদিন আমায় বললো, মা এখান থেকে আমার চাকরি করা অনেক কষ্টকর,
চলো ,আমি বড় ফ্ল্যাট পেয়েছি,
তুমি আমার ফ্ল্যাটে চলো…
মনটা উল্লসিত হলো, হ্যাঁ যাবো তো, আমার ছেলে ,বড় চাকরি পেয়েছে ,বড় ফ্ল্যাট পেয়েছে …
কিন্তু পরক্ষণে বিষন্ন হয়ে উঠলো আমার মন। আমার ফ্ল্যাট মানে ?
মানে ছেলের ফ্ল্যাট ,আমার নয়??
জানিনা, সেদিন যখন বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে আমি এসেছিলাম নবসাজেসজ্জিত হয়ে,
তারপর যখন স্বামীর হাত ধরে ,স্বপ্ন দিয়ে যে ঘর আমি সাজিয়েছিলাম ,সে ঘরটা আমার ছিল না। আর আজ পুত্র সুখের এই সুদিনেও সে বাড়িটা আমার নয়!!!
মেয়েদের বাড়ি নেই ,
মেয়েদের যেন বাড়ি থাকতে নেই!!!
কিন্তু কেন বলুন তো? যে বাড়িটা আমি আবার শ্রম দিয়ে, আমার ভালোবাসা দিয়ে আমি গড়ে তুলেছি ,
সেই বাড়িতে আমাকে কেন বার বার শুনতে হয় আমার বাড়িতে এ সব চলবে না ??
কার বাড়ি? কিসের বাড়ি?
যদি সে বাড়িতে ভালোবাসাই নাই থাকে ?
বাড়ি কেন মেয়েদের হয় না??
আসলে ভালোবাসাতে বোধহয় মেয়েদের কোন অধিকার থাকে না ,
জোর করে , ইচ্ছে না হলেও প্রতিদিনই যেমন
নিজের শরীরটাকে বিসর্জন দিতে হয় উন্মত্ত বিছানায়… ইচ্ছে না হলেও মেটাতে হয় অনেক অনাকাঙ্খিত আবদার ,
কেননা,মেয়েদের ইচ্ছে থাকতে নেই ,
একুশ শতকের মেয়েরা যতই আধুনিক সাজবার চেষ্টা করুন,
তাদেরকে ও বাপের বাড়ি, শশুর বাড়ি, স্বামীর ঘর ,
তারপর ছেলের বাড়িতে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে হয়।
আসলে দেশটাতে মায়ের পূজো হয় অহরোহ,
সেই দেশের প্রতিটি বাড়িতেই মায়ের বিসর্জন হয় প্রতিনিয়ত,
প্রতিনিয়ত মেয়েদের ইচ্ছে গুলো অনিচ্ছায় পরিনত হয়,
মেয়েদের ইচ্ছে গুলো পুরুষের ইচ্ছেয় পরিচালিত হয় ….
সেজন্যই মেয়েদের হয়তো মন থাকতে নেই,
নিজের হয়তো একটা বাড়ি থাকতে নেই…………..
…………………..আজিজুল হক