Skip to content

দুটি ছোট গল্প -বিচিত্র কুমার

(০১)
হিংসার বিষবৃক্ষ
-বিচিত্র কুমার

গ্রামের নাম ছিল শান্তিপুর। নাম শান্তিপুর হলেও, গ্রামের ভেতরকার মানুষগুলোর মধ্যে শান্তির বড়োই অভাব ছিল। কারো কারো মনে জমে ছিল পুরোনো বিদ্বেষ, কেউবা কারো প্রতি রাখতেন অহেতুক সন্দেহ। এই সন্দেহ, অহংকার আর হিংসার ছোট ছোট আগুনগুলো মিলেই একদিন গোটা গ্রামটাকে পুড়িয়ে ফেলবে—এ কথা কেউ ভাবত না।

শান্তিপুরের মাঝখান দিয়ে একটানা চলে গেছে একটি পুরোনো পুকুর। সেই পুকুরপাড়েই থাকতেন বৃদ্ধ রাজেন কাকা। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে যাওয়া রাজেন কাকার জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল পাহাড় সমান, কিন্তু গ্রামের মানুষরা তাঁকে গুরুত্ব দিত না। কারণ তিনি কারো সাথে ঝগড়া করতেন না, গায়ের জোর দেখাতেন না, শুধু একাকী বসে পুকুরপাড়ে একটানা গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিতেন।

এদিকে গ্রামের ধনী লোক মহেশ সর্দার ছিলেন ভয়ংকর অহংকারী। তাঁর জমিজমা, টাকা-পয়সার কমতি ছিল না। কিন্তু কারো উন্নতি দেখলেই তার মনে হিংসার আগুন জ্বলে উঠত। সে চাইত গ্রামের সবাই তার পায়ের নিচে থাকবে। যারাই একটু মাথা উঁচু করত, মহেশ সর্দার কৌশলে তাদের ধ্বংস করে দিতো।

একদিন গ্রামের সহজ-সরল কৃষক গোবিন্দ মিয়া নিজের জমিতে নতুন ফসল ফলানোর এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করল। সেই পদ্ধতিতে অল্প খরচে দ্বিগুণ ফসল পাওয়া যায়। গোবিন্দ মিয়ার মুখে মুখে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল গোটা গ্রামে। গ্রামবাসীরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। সবাই তার কাছ থেকে শিখে নিতে চাইলো।

কিন্তু মহেশ সর্দারের গায়ে যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিলো। তার মনে হলো, গোবিন্দ মিয়ার জনপ্রিয়তা তার প্রভাব কমিয়ে দিচ্ছে। হিংসার বিষবৃক্ষ যেন তার মনের ভেতর শেকড় বিস্তার করতে লাগল। সে ঠিক করল, গোবিন্দ মিয়াকে শিক্ষা দেবে।

পরেরদিন মাঝরাতে মহেশ সর্দারের লেলিয়ে দেওয়া কিছু লোক গোবিন্দ মিয়ার খেতের ফসল জ্বালিয়ে দিলো। সকাল হলে গোটা গ্রাম দেখল গোবিন্দ মিয়ার সাধনার ধ্বংসস্তুপ। গোবিন্দ মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল পুড়ে যাওয়া জমির পাশে। কিন্তু গোবিন্দ মিয়া জানত না কে এই সর্বনাশ করল।

গ্রামবাসীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। কারা এই কাজ করল তা জানার জন্য সবাই উঠে পড়ে লাগল। কিন্তু মহেশ সর্দার সবার আগে গিয়ে গোবিন্দ মিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে নকল সমবেদনা দেখাতে লাগল। সে বলল, “দেখো গোবিন্দ, তোমার উন্নতি সহ্য করতে পারছে না কিছু লোক। তাই এসব করছে। আমি তোমার পাশে আছি।”

রাজেন কাকা এই দৃশ্য দূর থেকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হিংসার বিষবৃক্ষের ফল একদিন সবাইকেই খেতে হয়।” কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না।

এরপর থেকে গ্রামের ভেতর সন্দেহের বাতাস আরও ঘনীভূত হতে লাগল। একে অপরকে দোষারোপ শুরু হলো। গ্রামের একদল মনে করত কাজটা করেছে মহেশ সর্দার, আরেকদল বিশ্বাস করত এটি বাইরের শত্রুদের কাজ। এই বিভাজন থেকেই গ্রামে দ্বন্দ্ব শুরু হলো। ছোট ছোট বিষয়েও মানুষ এখন ঝগড়া বাধিয়ে দিচ্ছিল।

এদিকে মহেশ সর্দার মনে মনে খুশি হয়ে ভাবল, তার পরিকল্পনা সফল হয়েছে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি, হিংসার বিষবৃক্ষ সে শুধু গোবিন্দ মিয়ার জন্য রোপণ করেনি, সে গোটা গ্রামের বুকে সেই বিষবৃক্ষ বসিয়েছে।

গ্রামের ঝগড়াঝাঁটি একদিন এমন চরমে পৌঁছল যে, দুই দল গ্রামবাসীর মধ্যে মারামারি বেধে গেল। লাঠি, বাঁশ, ইট-পাটকেল নিয়ে দুইপক্ষ একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আহত হলো অনেকেই, গোবিন্দ মিয়াও মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

সেই সময় রাজেন কাকা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে দেখে বুঝলেন, এই যুদ্ধ কারও ব্যক্তিগত নয়, এটি হিংসার বিষবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “হিংসা কখনো এক জায়গায় আটকে থাকে না। এটা ছড়িয়ে পড়ে, বড়ো হয়, শেষে সবকিছু গ্রাস করে নেয়।”

এরপর একদিন মহেশ সর্দারের বাড়িতে আগুন লেগে গেল। গ্রামের লোকেরা কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না। যে আগুন সে অন্যের জন্য জ্বালিয়েছিল, সেই আগুন এবার তার নিজের গায়ে লাগল। মহেশ সর্দার অসহায় হয়ে চিৎকার করতে লাগল, কিন্তু তার পাশে কেউ দাঁড়াল না।

গ্রামটা এখন এক ধ্বংসস্তূপ। মানুষ মানুষকে সন্দেহ করে, কারো চোখে নেই সেই আগের মায়া। রাজেন কাকা পুকুরপাড়ে বসে পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেন, “যে বীজ তুমি বপন করবে, ফল একদিন তোমাকেই খেতে হবে। হিংসার বিষবৃক্ষ কেউ অন্যের জন্য লাগাতে পারে না, সেটার বিষ সবার মাঝেই ছড়িয়ে পড়ে।”

এই ঘটনার পর গ্রামের মানুষ বুঝতে পারল হিংসা কখনো ব্যক্তিগত থাকে না, তার বিষ ধীরে ধীরে সবাইকে গ্রাস করে। গোবিন্দ মিয়া অসুস্থ শরীর নিয়েও আবার ফসল ফলানোর চেষ্টা করল, আর মহেশ সর্দার হয়ে পড়ল নিঃস্ব।

শান্তিপুরের মানুষরা শিখল, হিংসা একবার মনকে আচ্ছন্ন করলে তা কেবল ধ্বংসই বয়ে আনে। তারা প্রতিজ্ঞা করল, এবার থেকে তারা কারো প্রতি হিংসা নয়, সহযোগিতার হাত বাড়াবে। কারণ, হিংসার বিষবৃক্ষের নিচে কখনো শান্তির ছায়া পাওয়া যায় না।

(০২)
সহানুভূতির অমৃত বৃক্ষ
-বিচিত্র কুমার

গাঁয়ের শেষ মাথায় এক বিশাল অশ্বত্থ গাছ। গাছটি হাজার বছরের বেশি বয়সী—কেউ সঠিক জানে না। গ্রামের পুরনো লোকেরা বলতো, “আমাদের দাদারও দাদার ছোটবেলায় এই গাছটা ছিল।” গাছের ছায়ায় গড়ে উঠেছে বহু মানুষের স্মৃতি, ভালোবাসা আর গল্প।

ঋতু—নতুন আগত এক তরুণী, যার বাবার চাকরির বদলির কারণে শহর থেকে গ্রামে আসতে হয়েছে। শহরের চঞ্চল জীবন ছেড়ে এসে গ্রামটা ওর কাছে যেন শান্ত ও নিষ্প্রাণ মনে হতো। স্কুলের শেষে ঋতু একা পুকুরপাড়ে বসে থাকত। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করত না, কারণ ভাষা, আচরণ সব কিছুতেই তারা ভিন্ন ছিল।

এক বিকেলে ঋতু দেখতে পেলেন গাছের নিচে এক বৃদ্ধ, পায়ে হাঁপিয়ে পড়ে আছেন। তাঁর পাশের ঝুড়ি, যা পাকা পেয়ারা দিয়ে ভরা, মাটিতে পড়ে আছে। ঋতু দৌড়ে গিয়ে ঝুড়িটা তুলে দিল। বৃদ্ধ হেসে বললেন, “তুমি নতুন ছেলেটা, তাই তো?” ঋতু মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

বৃদ্ধের নাম ছিল হরিপদ কাকা। গ্রামবাসীরা তাঁকে চেনে, তবে সবাই খুব কাছাকাছি ছিল না। তিনি গাছের নিচে বসে পেয়ারা বিক্রি করতেন। তার রোজগারে তিনি চলে যেতেন।

ঋতুর সেই এক সহানুভূতির হাসিটা যেন হরিপদ কাকার হৃদয়ে এক ঝিলিক জ্বালিয়ে দিল। তারপর থেকে ঋতু প্রতিদিন স্কুল শেষে গাছতলায় বসে হরিপদ কাকার সঙ্গে গল্প করত, পেয়ারা বিক্রি করতে সাহায্য করত। গ্রামের ছেলেমেয়েরাও ধীরে ধীরে ঋতুর সঙ্গে মিশতে শুরু করল।

একদিন বৃষ্টি শুরু হল। সবাই গৃহবন্দী। ঋতু দেখল হরিপদ কাকা ভিজছেন, ঝুড়ি হাতে চুপচাপ চলছেন। ঋতু দৌড়ে গিয়ে ছাতা খুলে দিল কাকার মাথার ওপর। কাঁপতে কাঁপতে কাকা বললেন, “তুই বড় মানুষ হবি, মেয়ে। তোর এই মনটাই তো অমৃত।”

গাছটা যেন তাদের সবকিছু জানত। যাদের হৃদয়ে ভালোবাসা আর সহানুভূতি আছে, তাদের কাছে সে আশ্রয়। এই ছোট্ট সম্পর্ক থেকে ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ বদলে যেতে শুরু করল। কেউ আর হরিপদ কাকাকে অবহেলা করল না, কেউ আর পাশ কাটিয়ে গেল না।

একদিন মানিক নামের এক ছোট ছেলে গাছের ডালে উঠতে গিয়ে পড়ে পা ভেঙে ফেলল। সবাই দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল, কেউ এগিয়ে এল না। ঋতু দৌড়ে গিয়ে মানিককে কোলে তুলে নিয়ে তার পা বেঁধে দিল। তারপর ডাক্তার ডাকল। সেদিন গ্রামবাসী বুঝল, সহানুভূতি শুধু দয়া নয়, এক শক্তি যা মানুষকে পরিবর্তিত করে।

দিন গড়িয়ে গেল। ঋতু স্কুলে গিয়ে ফেরে, গাছতলায় বসে গল্প করে। একদিন হরিপদ কাকা আর ছিলেন না। ঝুড়িটা ফাঁকা, গাছের নিচে পড়ে আছে। ঋতুর চোখে জল এসে ভেসে উঠল, কিন্তু সে জানতো, মানুষ চলে গেলেও তাঁর রেখে যাওয়া সহানুভূতির অমৃত বৃক্ষ কখনো শুকিয়ে যাবে না।

গ্রামবাসী সিদ্ধান্ত নিল “সহানুভূতির চত্বর” নামে গাছটির চারপাশকে সাজাবে, যেখানে শিশুরা শেখাবে কিভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে অপরের কষ্ট নিজের মতো অনুভব করতে হয়।

ঋতু সেই চত্বরের প্রথম শিক্ষক। সে জানে, হরিপদ কাকার সেই সহানুভূতির অমৃত বৃক্ষ গ্রামবাসীর হৃদয়ে শেকড় গেড়ে ফেলবে। গাছটি যেন মৃদু হাসি দিয়ে বলে, “সহানুভূতি হল এমন এক অমৃত বৃক্ষ, যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে মন বড় হয়, হৃদয় বিশুদ্ধ হয়, আর মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়।”

আর তুমি চাইলে হতে পারো সেই অমৃত বৃক্ষের বীজ।

নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753

https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL

মন্তব্য করুন