(০১)
স্বার্থের সিঁড়ি ও সম্পর্কের দোতলা
-বিচিত্র কুমার
রুদ্র ছিল একসময় অফিসের প্রিয় মুখ। সহজ-সরল ব্যবহার, কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর সহকর্মীদের প্রতি আন্তরিকতার জন্য সবাই তাকে ভালোবাসতো। তবে দিন যতই গড়াতে লাগল, সে দেখল, অফিসের মানুষগুলো বদলে যাচ্ছে। সবাই যেন কেবল নিজের লাভ-লোকসানের হিসেব নিয়ে ব্যস্ত। অন্যকে পেছনে ফেলে ওপরে ওঠার লড়াইয়ে সবাই এতটাই ব্যস্ত যে, সম্পর্ক বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
প্রথমদিকে রুদ্র এই প্রতিযোগিতার বাইরে থাকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এক সময় বুঝে গেল—“এভাবে থাকলে পিছিয়ে পড়তে হবে।”
তখন থেকেই সে শুরু করলো স্বার্থের সিঁড়ি বানানো। জুনিয়রদের কাজ নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া, সিনিয়রদের সামনে মিষ্টি কথা আর পিছনে কুৎসা রটানো—সবকিছুই সে রপ্ত করে ফেলল দ্রুত। তার এই চাতুর্যের জন্য সে অল্প সময়েই পদোন্নতি পেলো, উচ্চ পদে বসে অফিসের সবার ওপর কর্তৃত্ব করতে লাগল।
কিন্তু যখন সে শীর্ষে পৌঁছাল, তখনই টের পেল—এই উচ্চতা আসলে কতটা ফাঁকা।
তার চারপাশে কেউ নেই যাকে সে নির্ভর করতে পারে, নেই কেউ যার সঙ্গে সে নিজের আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নিতে পারে।
ওপরে ওঠার তাড়নায় সে সম্পর্কের দোতলা ভুলেই গিয়েছিল, ভুলে গিয়েছিল সেই মানুষগুলোর কথা, যারা একসময় তার পাশে ছিল।
একদিন অফিসের ছাদে দাঁড়িয়ে রুদ্র একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। ঠিক তখনই তার জুনিয়র সহকর্মী তন্ময় পাশে এসে দাঁড়াল। তন্ময় ছিল রুদ্রের পুরনো দিনের মতো—সহজ, সৎ এবং সম্পর্কের মূল্য বোঝে।
তন্ময় হেসে বলল,
—“স্যার, আজ আমার ছোট বোনের জন্মদিন, আপনার হাতে লেখা একটা শুভেচ্ছা পেলে ও খুব খুশি হবে।”
রুদ্র খানিকক্ষণ নীরব থেকে বলল,
—“তুমি কী মনে করো, আমি এখনও সেই রুদ্র আছি, যে সম্পর্কের কথা ভাবে?”
তন্ময়ের মুখে এক রহস্যময় হাসি,
—“আপনি হয়তো ভুলে গেছেন স্যার, কিন্তু সম্পর্কের দোতলা কখনও বন্ধ হয় না। ফিরে আসার পথ সবসময় খোলা থাকে। শুধু স্বার্থের সিঁড়ি থেকে একটু নামতে হয়।”
তন্ময়ের সরল কথাগুলো রুদ্রকে থমকে দিলো। সে বুঝতে পারলো—স্বার্থের সিঁড়ি বেয়ে সে এত ওপরে উঠেছে যে, সম্পর্কের দোতলায় নামার সিঁড়িটাই সে ভেঙে ফেলেছিল নিজের হাতে। কিন্তু তন্ময়ের সেই নিমন্ত্রণ ছিল সেই সিঁড়ির প্রথম ধাপ।
রুদ্র সেদিন নিজের হাতে তন্ময়ের বোনের জন্য শুভেচ্ছা লিখলো। ছোট্ট সে লেখা যেন তার নিজের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা ‘মানুষ রুদ্র’কে জাগিয়ে দিলো।
এরপর থেকে রুদ্র বদলে গেল। সে প্রতিটি সহকর্মীর কাছে গিয়ে নতুন করে সম্পর্ক গড়তে শুরু করলো। বুঝতে শিখলো, মানুষের ভালোবাসা ছাড়া কোনো উচ্চতা স্থায়ী হয় না।
স্বার্থের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যত সহজ, সেই সিঁড়িতে দাঁড়ানোর জন্য সম্পর্কের দোতলায় জায়গা না থাকলে, সেই সিঁড়ি একদিন ধসে পড়ে নিজের ভারেই।
রুদ্রের জীবন তাই বলে—
“স্বার্থের সিঁড়ি বানাও, তবে সম্পর্কের দোতলায় ফিরে যেতে ভুলো না, কারণ সম্পর্কই সেই ভিত্তি, যেখানে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের উচ্চতা মাপা হয়।”
(০২)
কাগজের দুনিয়া আর হৃদয়ের রাজ্য
-বিচিত্র কুমার
তুষার ছোটবেলা থেকেই দারুণ মেধাবী। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—প্রতিটি স্তরেই সে ছিল সেরাদের তালিকায়। সার্টিফিকেট, মেডেল, প্রশংসাপত্রে তার ঘরের দেয়ালগুলো ভরে গিয়েছিলো। লোকজন তাকে দেখলে বলত—“ওই যে, কাগজে-কলমে সফল মানুষটা।”
কিন্তু তুষারের নিজের মনে একটা খালি জায়গা ছিল, যেটা সে নিজেও বোঝে না। সে সব পেয়েও যেন কিছু হারিয়ে ফেলেছে।
তার বন্ধু, শুভ্র, একদিন তাকে বলল,
—“তুই কাগজে অনেক কিছু লিখেছিস, কিন্তু তোর হৃদয়ের পাতাগুলো তো এখনো ফাঁকা!”
তুষার বিরক্ত হয়ে বলল,
—“হৃদয়ের পাতা দিয়ে তো চাকরি হয় না, পদোন্নতি মেলে না!”
শুভ্র হেসে বলল,
—“ঠিক, কিন্তু মানুষ মেলে। মানুষ হারালে সবই বৃথা।”
সময় গড়াতে থাকল। তুষার একের পর এক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেল, কিন্তু মানুষ তার পাশে কমতে লাগল।
সে সারাক্ষণ ডিপ্লোমা, ডিগ্রি, কাগজের দুনিয়াতেই আটকে থাকলো। কিন্তু অফিসে কেউ তার পাশে দাঁড়াতো না, বন্ধুরা ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল।
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে তুষার দেখল, এক বৃদ্ধ লোক রাস্তায় পড়ে আছে। সবাই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, কারণ তার পকেটে কোনো মূল্যবান কাগজ ছিল না, তার গায়ে ছিল শুধু জরাজীর্ণ কাপড় আর চোখে ছিল অসহায়তা।
তুষার নিজেও প্রথমে পা বাড়িয়েছিল চলে যাওয়ার জন্য, কিন্তু শুভ্রর সেই কথাটা মনে পড়ে গেল—”হৃদয়ের পাতাগুলো ফাঁকা!”
সে ফিরে দাঁড়াল। বৃদ্ধকে হাত ধরে তুললো, জিজ্ঞাসা করল,
—“চাচা, কোথায় যাবেন?”
বৃদ্ধ বললেন,
—“ছেলে ছিল, নাতি ছিল, কিন্তু তারা শুধু কাগজের হিসাব বোঝে। আমি এখন কেবল বোঝা।”
তুষারের বুকটা ধক করে উঠল। সে বুঝতে পারল, সে নিজেও তো দিনকে দিন এমনই এক বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার হৃদয়ের রাজ্যে কেউ নেই।
সেদিন সে বাড়ি ফিরে প্রথমবারের মতো নিজের সার্টিফিকেট গুলো তাকিয়ে দেখল—সেগুলো কেবল কাগজের টুকরো।
কিন্তু তার মায়ের একফালি হাসি, বাবার চোখের প্রশ্রয়, বন্ধু শুভ্রর সঙ্গ—এসব ছিল তার হারিয়ে ফেলা হৃদয়ের রাজ্য, যা কাগজে লেখা যায় না।
তুষার সিদ্ধান্ত নিল, এবার সে কাগজের দুনিয়া আর হৃদয়ের রাজ্যকে আলাদা করবে না। সে মানুষকে সময় দেবে, তাদের কথা শুনবে, তাদের পাশে দাঁড়াবে।
একদিন হয়তো এই হৃদয়ের রাজ্যই তাকে সেই সত্যিকারের সফলতা এনে দেবে, যা কোনো সার্টিফিকেটে লেখা থাকে না।
গল্পটা বলে—
“কাগজের দুনিয়া তোমাকে পরিচয় দিতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের রাজ্য তোমাকে মানুষ করে তোলে।”
নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753