Skip to content

দাদুর স্মার্টফোন ট্রেনিং ক্লাস -বিচিত্র কুমার

আমাদের গ্রামের দাদু এক কথায় কিংবদন্তি। তাঁর বয়স আশির কোঠায়, কিন্তু মনটা এখনও আঠারোতেই আটকে আছে। এক সময়ের কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া, পাকদণ্ডি পথে লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটা দাদু হঠাৎ একদিন ঘোষণা করলেন, “আমি এখন স্মার্টফোন শিখব!” শুনে গ্রামের লোকজন তো হাঁ! দাদু আর স্মার্টফোন? এটা কি সম্ভব? কিন্তু দাদু সম্ভব-অসম্ভবের তোয়াক্কা করেন না।

ঘটনাটা শুরু হয়েছিল নাতি রাহুলের বায়নায়। রাহুল একদিন দাদুকে জোর করে হাতে একটা নতুন চকচকে স্মার্টফোন ধরিয়ে বলল, “দাদু, তোমাকেও লাইভে আসতে হবে। তুমি ফেসবুকে না এলে গ্রাম তো আর গ্রাম থাকছে না!” দাদু প্রথমে ভেবেছিলেন, লাইভ মানে বুঝি লাইভ কবর! তাঁর চোখমুখ থমথমে হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যখন শুনলেন, লাইভে গিয়ে মানুষ কথা বলে, হাসে-গায়-নাচে, তখনই বললেন, “তাহলে তো আমি-ই বেস্ট ক্যান্ডিডেট!”

পরদিন থেকেই শুরু হলো ‘দাদুর স্মার্টফোন ট্রেনিং ক্লাস’। ক্লাস মানে আসলে রাহুলের ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে বসে দাদুকে মোবাইল শেখানোর চেষ্টা আর দাদু তাদের দিয়ে হাসির খোরাক বানানো।

প্রথমেই দাদু শিখলেন স্ক্রিন টাচ করা। কিন্তু দাদুর আঙুলে যেন হাইভোল্টেজ! তিনি স্ক্রিন টাচ না করে ঠকঠক করে টোকা মারেন। ফোনের স্ক্রিন কাঁপতে কাঁপতে বলছিল, “বাঁচাও গো, দাদুর ভালোবাসা সহ্য হচ্ছে না!” কখনো আঙুল দিয়ে চেপে চেপে স্ক্রিনে এমন দাগ কাটেন, মনে হয় ধান মাড়াইয়ের দানা বুনছেন!

কিছুতেই বোঝানো গেল না যে টোকা না দিয়ে হালকা ছোঁয়ায় কাজ হয়। শেষে রাহুল তাকে বলল, “দাদু, স্ক্রিনের গায়ে মনে করো তোমার ছোট্ট ছেলেবেলার মাটির পুতুল আছে, যাকে তুমি আলতো করে আদর করতে!” দাদু এবার একটু বুঝলেন। কিন্তু ফোনের স্ক্রিনে টোকা দেয়ার সময়ও তিনি মুখে বলে যাচ্ছিলেন, “আব্বা! এখন একটু আদর খাও, বাবা!”

তারপর এল সেলফি তোলার পালা। দাদুকে ফোন ধরিয়ে বলা হলো, “দাদু, নিজের ছবি তুলো।” দাদু ফোন উল্টোপাল্টা ঘুরিয়ে শেষে কপালের কাছ থেকে শুরু করে বুক পকেট পর্যন্ত ছবি তুলে বললেন, “এই তো আমার ছবি আইলো!” সবাই দেখে হেসে কুটি কুটি। কারণ ছবিতে শুধু দাদুর পাঞ্জাবির কলার আর পকেট দেখা যাচ্ছে। রাহুল হেসে বলল, “দাদু, এটা সেলফি না, এটা তো তোমার কলারের ডকুমেন্টারি ফিল্ম!” দাদু বললেন, “পকেটও তো আমার পরিবারের সদস্য!”

ভয়েস কমান্ড শেখার সময় দাদু এক নতুন ইতিহাস গড়লেন। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডাকতে গিয়ে দাদু বললেন, “গুগুল দাদা, রাধা-কৃষ্ণের ভজন শোনাও তো!” গুগল তো আর দাদুর গ্রাম্য ভাষা বোঝে না, সে ভাবল ফরাসি ভাষায় কিছু শুনতে চাচ্ছে! ফলে শুরু হলো ফ্রেঞ্চ র‍্যাপ গান। দাদু হতভম্ব! বললেন, “বাউল গান তো জানতাম, এই বাউল র‍্যাপ আবার কোন দিকপালের?”

এরপর এল ফেসবুক লাইভ। দাদু ভাবলেন, লাইভ মানে ফোনের সঙ্গে একান্তে কথা বলা যায়। তিনি সরাসরি লাইভে গিয়ে বলতে শুরু করলেন, “যাদের সারাজীবন বকাঝকা করেছি, তারা সবাই ক্ষমা করে দিয়ো। আমি তো বুড়ো হয়েই গেছি!” অথচ সারা গ্রাম তখন লাইভে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। দাদু ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন, যখন রাহুল এসে বলল, “দাদু, তোমার লাইভ ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে!”

দাদু তখনই ঘোষণা দিলেন, “এইবার আমি তোদের ছাড়বো না। আমিও ইউটিউবে পিঠা বানানোর ভিডিও দেবো, ফেসবুকে লাইভে নাচবো আর হোয়াটসঅ্যাপে প্রেমের গল্প শোনাব। সাবধান, আমার পরের ভিডিওতে তোদেরও ধরব!”

সেই থেকে আর কেউ দাদুকে নিয়ে হাসাহাসি করে না। দাদু এখন গ্রামের ডিজিটাল দাদু, সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন ইনফ্লুয়েন্সার। আর গ্রামের লোকজন? তারা হাসতে হাসতে বলে, “দাদুর মতো স্মার্ট ইনফ্লুয়েন্সার আর নেই গো!”

দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।

মন্তব্য করুন