(০১)
হিংসা
-বিচিত্র কুমার
মানুষের চেতনায় হিংসা এক অদৃশ্য দানবের মতো লুকিয়ে থাকে। এই দানব কখনও প্রকাশ্যে রক্তপাত ঘটায়, কখনও নীরবে সম্পর্কের শিকড় উপড়ে ফেলে। মানুষের হৃদয়ে জমে থাকা বিষাক্ত অনুভূতির নামই হিংসা। এটি জন্মায় মানুষের ভেতরকার লোভ, অহংকার, দম্ভ ও আত্মঅসন্তুষ্টির মিশ্রণে। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ সুন্দরের পূজারী, কিন্তু সেই সুন্দরের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে, অন্যের সাফল্য ও সুখে ঈর্ষান্বিত হয়ে মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে। হিংসা তখন শুধুই নিজের নয়, তা সমাজের প্রতিটি শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে এবং একসময় তা বিস্ফোরণের রূপ নেয়।
বাস্তব জীবনের উদাহরণে বলা যায়, একই অফিসে কর্মরত দুই সহকর্মী, একজন নিঃশব্দে পরিশ্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে, আরেকজন শুধুমাত্র বাহ্যিক প্রশংসা ও পদোন্নতির লোভে প্রতিনিয়ত হিংসার বীজ বুনে চলেছে। তার কাছে অন্যের সাফল্য সহ্য হয় না। সে চায় সবাই তার নিচে থাকুক, যেন তার অবস্থান নিরাপদ থাকে। ফলত, সে গোপনে কুৎসা রটনা শুরু করে, তার উদ্দেশ্য একটাই—সেই সহকর্মীকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলা। এই যে হিংসার জন্ম, তা তার নিজের আত্মশক্তির অভাব থেকেই উদ্ভূত, কারণ সে জানে তার নিজের যোগ্যতা নেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার।
শুধুমাত্র কর্মক্ষেত্র নয়, পারিবারিক জীবনেও হিংসার বিষাক্ত শিকড় দেখা যায়। দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা যখন সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারায় গিয়ে ঠেকে, তখন হিংসা বিষের মতো মাথা তোলে। বড় ভাইয়ের উন্নতি ছোট ভাইয়ের চোখে তখন একধরনের অপমান মনে হয়, মনে হয় তার প্রাপ্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই অনুভূতি থেকেই ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গা, এমনকি হত্যা পর্যন্ত ঘটে। হিংসা সেখানে শুধু সম্পর্কেরই নয়, মানবিকতারও বিনাশ ঘটায়।
একের পর এক ঘটনা দেখিয়ে দেয়, হিংসার ফল কখনো মঙ্গলময় হয় না। স্কুলে পড়ুয়া ছোট্ট মেয়েটি, তার বান্ধবীর নতুন জামা দেখে হিংসায় জ্বলে ওঠে। সেই ছোট্ট মনেই জন্ম নেয় ঈর্ষার অঙ্কুর, যা ধীরে ধীরে যদি পুষ্টি পায়, তা বড় হয়ে হিংস্র শাখাপ্রশাখায় পরিণত হয়। অভিভাবক যদি সেই মুহূর্তে শিশুর মন থেকে হিংসার বীজ উপড়ে না ফেলে, তবে সেই শিশুই একদিন বড় হয়ে সমাজের জন্য হিংস্র শিকারিতে পরিণত হবে।
রাজনীতির মঞ্চে হিংসার নগ্ন নৃত্য আমরা বারবার দেখেছি। প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য মিথ্যা প্রচারণা, ব্যক্তিগত চরিত্রহনন, এমনকি হত্যা—এ সবকিছুই হিংসারই বহিঃপ্রকাশ। একজন রাজনীতিবিদের মনে যদি জনসেবা করার আন্তরিকতা থাকে, তবে সে কখনোই হিংসার আশ্রয় নেবে না। কিন্তু ক্ষমতার মোহ, আধিপত্যের নেশা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তখন সে ভেবে দেখে না তার হিংস্র আচরণে সমাজে কতটা ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে।
হিংসার প্রকৃতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম। এটি কখনও কখনও সরাসরি ব্যক্তির বিরুদ্ধে আঘাত হানে, আবার কখনও তা পরোক্ষভাবে কারও মানসিক শান্তি কেড়ে নেয়। সামাজিক মাধ্যমে এখন হিংসা আরও সহজলভ্য হয়েছে। কেউ সামান্য সাফল্য অর্জন করলেই তার পেছনে গুজবের ঝড় ওঠে, হিংস্র মন্তব্যে ভরে যায় পোস্টের নিচের মন্তব্যখাতাটি। মানুষ আনন্দের সংবাদকে স্বাগত জানানোর বদলে সেখানে হিংসার বিষ ঢালতে ব্যস্ত থাকে।
একজন গায়ক যখন তার সুরের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করে, তখন অনেকেই তার প্রশংসা করে, কিন্তু কেউ কেউ সেই সাফল্যে হিংসায় পুড়ে যায়। তারা প্রশ্ন তোলে—”ওর কী আছে? আমি পারিনি কেন?” এই প্রশ্নের উত্তর তারা নিজের ভেতরে খোঁজার চেষ্টা না করে, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপায়। হিংসা তখন শুধুই এক অন্তর্দাহ নয়, তা হয়ে ওঠে এক ধ্বংসাত্মক শক্তি।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে হিংসার উদাহরণ অসংখ্য। সিংহাসনের লোভে পিতাকে হত্যা করেছে পুত্র, বন্ধুকে বিষপান করিয়েছে বন্ধু, সাম্রাজ্যের অধিকার নিয়ে হয়েছে যুদ্ধ। এইসব ঘটনার পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিলো হিংসা। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হিংসা কখনো কাউকে চিরস্থায়ী শান্তি দেয়নি। সাময়িক জয়ের আনন্দে মানুষ ভাসলেও, শেষ পর্যন্ত সে হিংসার আগুনেই পুড়ে ছাই হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—মানুষ কেন হিংস্র হয়? উত্তরটা সহজ নয়। সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক শিক্ষা, আত্মসম্মানবোধের অভাব, আত্মবিশ্বাসের দুর্বলতা, অপরের সাফল্যকে স্বীকৃতি দিতে না পারার মানসিক সংকীর্ণতা—এইসবই মিলে হিংসার জন্ম দেয়। একজন মানুষ যদি নিজের অবস্থান ও সাফল্যে সন্তুষ্ট থাকতো, তবে অন্যের সুখ বা সমৃদ্ধি তার কাছে হুমকি মনে হতো না। তাই হিংসার প্রতিষেধক হলো আত্মবিশ্বাস, উদারতা ও সহমর্মিতা।
মানুষ যদি শিখতে পারে অন্যের আনন্দে নিজের আনন্দ খুঁজে নিতে, তবে হিংসা তার মনে স্থান পাবে না। পরিশ্রম করে নিজের লক্ষ্য অর্জনের মধ্যে যে আনন্দ, তা কখনো হিংসার মাধ্যমে পাওয়া যায় না। অন্যের উন্নতি দেখে যদি নিজেকে আরো দক্ষ করার চেষ্টা করা যায়, তবে তা হবে প্রকৃত উন্নতি। হিংসা শুধু নিজেকে ছোট করে, অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আর সমাজকে বিভক্ত করে। পক্ষান্তরে, পরিশ্রম ও সদিচ্ছা মানুষকে প্রকৃত সম্মান এনে দেয়।
একজন মানুষের সাফল্যের গল্পের পেছনে থাকে তার আত্মত্যাগ, পরিশ্রম ও সংগ্রাম। কিন্তু হিংসুক মানুষ সেই গল্প দেখতে পায় না, সে শুধু দেখে ফলাফলটুকু। তার মনে হয়, “সে পেরেছে, আমি কেন পারবো না?”—কিন্তু সেই ‘পারবো না’ শব্দটিই তাকে হিংস্র করে তোলে। অথচ প্রকৃত চেতনা হলো—”সে পেরেছে, আমিও পারবো, যদি চেষ্টা করি।”
একজন কৃষক যখন মাঠে ফসল ফলায়, তার পরিশ্রমের ঘাম জমে জমে সোনালী ধানে পরিণত হয়। কিন্তু পাশের জমির মালিক যদি তা দেখে হিংসায় দগ্ধ হয়, তবে সে ফসল ফলানোর বদলে শুধু পরশ্রীকাতরতা নিয়ে জীবন কাটাবে। হিংসা তাকে ধ্বংস করবে, কারণ সে নিজের চেষ্টা বাদ দিয়ে শুধু অন্যের ক্ষতি করতে চাইবে। অথচ যদি সে সেই কৃষকের কাছে গিয়ে জানতে চায় কিভাবে সে এত ভালো ফসল ফলায়, তবে সে নিজেও সাফল্যের ভাগীদার হতে পারত।
হিংসার সমাধান শুধুমাত্র বাইরের জগতে খোঁজা যায় না, তা খুঁজতে হবে নিজের ভেতর। আত্মসমালোচনা, আত্মবিশ্বাস ও আন্তরিকতাই পারে হিংসার বিষকে প্রশমিত করতে। মানুষের হৃদয়ে যখন সহানুভূতি, ভালোবাসা ও সহনশীলতা স্থান পায়, তখন হিংসার জন্য সেখানে আর কোনও স্থান থাকে না। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের প্রথম কর্তব্য হলো—নিজেকে উন্নত করা, নিজের ভিতরে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা এবং অন্যের সাফল্যে সহমর্মী হওয়া।
হিংসা কখনোই জয়ের পথে নিয়ে যায় না, এটি কেবলমাত্র আত্মধ্বংসের পথ প্রশস্ত করে। তাই মানুষকে শিখতে হবে কিভাবে অন্যের আনন্দে নিজেকে আনন্দিত করা যায়। অন্যের উন্নতি দেখে নিজের অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করা উচিত। হিংসা নয়, সহমর্মিতা, লোভ নয়, পরিশ্রম, অহংকার নয়, বিনয়—এই গুণগুলো যদি মানুষ আত্মস্থ করতে পারে, তবে সমাজে হিংসার জায়গা থাকবে না। তখন মানুষ হবে সত্যিকারের মানুষ।
(০২)
ক্রোধ
-বিচিত্র কুমার
মানুষের মনের গভীরে একটি আগ্নেয়গিরি থাকে, যেটি কখনো সুপ্ত, কখনো অগ্ন্যুৎপাতের অপেক্ষায় থাকে। সেই আগ্নেয়গিরির নাম—ক্রোধ। এটি মানুষের জন্মগত স্বভাবের অংশ, যা স্নায়বিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আচরণের উপর প্রভাব ফেলে। তবে, মানুষই একমাত্র জীব, যে তার ক্রোধকে চিন্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে—যদি সে চায়। অথচ, এই চাওয়াটাই অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে। ফলে, ক্ষণিকের উত্তেজনা থেকে জন্ম নেয় এমন সব ঘটনা, যা ব্যক্তিজীবন, সমাজ এবং সম্পর্কের উপর গভীর আঁচড় কেটে যায়।
বাস্তব জীবনের দিকে তাকালেই দেখা যায়, প্রতিদিন কত মানুষ কত তুচ্ছ কারণে নিজেদের শান্ত জীবনকে অশান্ত করে তোলে শুধু মাত্র ক্রোধের বশবর্তী হয়ে। একবারের জন্যও তারা ভাবেনা—এই মুহূর্তের রাগটা যদি আমি সামলে রাখতাম, তাহলে হয়তো ফলাফল এতটা ভয়াবহ হতো না।
একটি শহরের গল্প বলি। বাসে ওঠা নিয়ে দুই যুবকের মধ্যে সামান্য ধাক্কাধাক্কি হয়েছিল। একজন বলেছিল, “সাবধানে ওঠেন,” আরেকজন বলেছিল, “তুমি কে আমাকে শেখানোর?” সেখান থেকে বাক-বিতণ্ডা, হাতাহাতি, এবং শেষে পুলিশি ঝামেলা পর্যন্ত গড়ায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এটা কি আসলেই প্রয়োজন ছিল? শুধু মাত্র “ক্রোধ” নামক অগ্নিশিখার সংস্পর্শে এসে দু’জন মানুষ তাদের সারাদিনের শান্তি হারাল, আইনি হয়রানি বাড়াল এবং নিজেদের মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট করল।
ক্রোধের মধ্যে একধরনের “আমি”-এর অহংকার মিশে থাকে। মানুষ ভাবে, “আমি যদি চুপ থাকি, তাহলে দুর্বল মনে করবে,” কিংবা “আমার কথা শেষ কথা হতে হবে।” অথচ প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে জানে কখন চুপ থেকে পরিস্থিতিকে শান্ত করতে হয়। আমাদের সমাজে ধৈর্যশীল মানুষের সংখ্যা দিনদিন কমছে। সবাই চায় প্রতিটি বিষয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে, অথচ কেউ বুঝতে চায় না, শ্রেষ্ঠত্ব কখনো “চিৎকার” বা “রাগ” দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় না।
একজন মা যখন রাগে নিজের সন্তানকে মারধর করেন, তখন তিনি মনে করেন এটা শুধুই শাসন। কিন্তু শিশুর কোমল মনে সেই মুহূর্তের ভয় ও অপমান গভীরভাবে গেঁথে যায়। পরে সেই সন্তানই হয়তো অন্যের উপর তার সেই জমে থাকা ক্রোধ উগড়ে দেয়। এরকম হাজারো চক্র আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে। কেউ কারো কাছে “শান্তির পাঠ” শেখে না, বরং রাগের চক্রাকারে বেড়ে চলেছে হিংসা, বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসার আগুন।
ক্রোধের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, এটি “চিন্তাশক্তি” কে মুহূর্তেই গ্রাস করে নেয়। রাগান্বিত অবস্থায় মানুষ তার বিবেক-বিবেচনাকে ভুলে গিয়ে এমন সব কাজ করে ফেলে, যার জন্য সারাজীবন অনুশোচনায় পুড়তে হয়।
একজন ব্যবসায়ীর কথা বলি, যিনি ক্রমাগত প্রতিযোগিতার চাপে থাকেন। একদিন অফিসের একজন কর্মচারীর সামান্য ভুলে তিনি এতটাই রেগে যান যে, প্রকাশ্যে সেই কর্মচারীকে অপমান করে বসেন। অথচ পরদিনই তিনি জানতে পারেন যে, সেই কর্মচারীর মা হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি, আর সেই কারণেই ছেলেটির মনোযোগ ছিলো না। তখন নিজের ব্যবহারের জন্য তিনি লজ্জিত বোধ করেন। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। এই ঘটনাটি শুধুমাত্র ব্যবসায়ীর নয়, বরং আমাদের সকলের জীবনের প্রতিচ্ছবি।
ক্রোধ, একদিকে যেমন মানুষের আবেগপ্রবণতার স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে তা কখনো কখনো ন্যায়বিচারের দাবিতেও পরিণত হয়। তবে এই ন্যায়বিচার তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যখন তা নিয়ন্ত্রিত আবেগ ও যুক্তিবোধের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। গুটিকয়েক মুহূর্তের অন্ধ ক্রোধ যেমন ধ্বংস ডেকে আনে, তেমনি দীর্ঘদিনের সহ্য করার পর একটি সঠিক মুহূর্তে যুক্তির সাথে প্রকাশিত ক্রোধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদে পরিণত হতে পারে।
ক্রোধকে দমন করার কৌশল সকলেই জানে—শুধু প্রয়োগ করার মানসিকতা নেই। রাগের মুহূর্তে পাঁচ মিনিট চুপ থাকা, কয়েকবার গভীর শ্বাস নেওয়া, অথবা একটু হাঁটতে বেরিয়ে আসা—এই সাধারণ বিষয়গুলোই অনেক বড়ো দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে পারে। অথচ মানুষ তখন ভাবে, “এখনই প্রতিক্রিয়া না দিলে আমি দুর্বল হয়ে যাবো।”
ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও ক্রোধ ভয়ঙ্কর ফাটল ধরিয়ে দেয়। সামান্য তর্কাতর্কির মধ্যেও যখন অহংকার ও উত্তেজনা জড়িয়ে যায়, তখন সম্পর্কের মাধুর্য আর স্থায়িত্ব বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলে মানুষ। “তুমি কেন বললে?” — এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই শুরু হয় একেকটি সম্পর্কের মৃত্যু।
আরেকটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করা যায়। একটি গ্রামে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। একদিন কথা কাটাকাটি চলাকালে একপক্ষের একজন লোক আরেকজনকে ধাক্কা মারে। অপর পক্ষ রাগে উত্তেজিত হয়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি প্রাণহানিতে গড়ায়। অথচ তারা যদি প্রথমে নিজেদের ক্রোধকে সামলাতে পারত, বিষয়টি হয়তো কথাবার্তায় মীমাংসা হয়ে যেত। এই এক মুহূর্তের ক্রোধই কত পরিবারকে শোকগ্রস্ত করে দেয়, কত জীবন ধ্বংস করে দেয়—তার হিসাব কেউ রাখে না।
অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন দক্ষ ম্যানেজার তার অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রতি ধৈর্যশীল আচরণ করলেই কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায়। অথচ কেউ যদি বারংবার চিৎকার-চেঁচামেচি করে, তাহলে কর্মীরা মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এটা গবেষণাতেও প্রমাণিত যে, “রাগের পরিবেশ” কর্মস্থলে উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয় এবং কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ করে তোলে।
ক্রোধের ভিন্নতর দিক হলো “নীরব ক্রোধ”—যেটি মুখে প্রকাশ পায় না, বরং অন্তরে জমতে জমতে এক সময় বিষের মতো বিস্ফোরিত হয়। অনেক সময় মানুষ মুখে কিছু বলে না, কিন্তু মনে মনে অপমানের ক্ষত বহন করে চলে। এটি আরও ভয়ানক কারণ, বাহ্যিক প্রকাশ না পাওয়ায় এই ক্রোধকে উপশম করার সুযোগ থাকে না, ফলে তা দগ্ধ হতে হতে ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।
আমাদের চারপাশে যারা প্রতিনিয়ত হাসিমুখে ঘোরে, তাদের অনেকেই হয়তো ভিতরে ভিতরে নীরব ক্রোধে জ্বলছে। এই নীরব ক্রোধই কখনো কখনো আত্মহনন, মানসিক রোগ এবং সম্পর্কবিচ্ছেদের দিকে ঠেলে দেয়।
তবে ক্রোধকে পুরোপুরি নিঃশেষ করা যায় না। বরং একে পরিশীলিত ও নিয়ন্ত্রিত করা যায়। যেভাবে নদীর জল যদি বাঁধে না আটকে দেওয়া হয়, তাহলে তা ভাসিয়ে নিয়ে যায় চারপাশ, তেমনি ক্রোধও যদি সীমার মধ্যে রাখা যায়, তবে তা অনেক সময় শক্তি হয়ে উঠতে পারে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস, সমাজের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই—সবক্ষেত্রেই ক্রোধের প্রয়োজন আছে। তবে সেই ক্রোধ হতে হবে যুক্তিবোধ সম্পন্ন এবং আত্মনিয়ন্ত্রিত।
একজন সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ কখনোই রাগকে তার চিন্তাশক্তির উপর চড়তে দেয় না। সে জানে, কখন নিজের আবেগ প্রকাশ করতে হয়, কখন চুপ থেকে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
ক্রোধের প্রতিকার শুধুমাত্র “জ্ঞান” এবং “সচেতনতা”-এর মাধ্যমে সম্ভব। একজন ব্যক্তি যদি প্রতিদিন নিজের উপর অন্তত দশ মিনিট সময় দেয়, নিজের ভুল-ত্রুটি নিয়ে চিন্তা করে, তাহলে সে তার ক্রোধকেও সহজেই বুঝে উঠতে পারে। মনোবিদরা বলেন, প্রতিদিন ধ্যান করার মাধ্যমে মানুষের রাগের মাত্রা অনেকটাই কমানো যায়। তবে এই চেষ্টা করতে হয় নিজের জন্য, অন্যের জন্য নয়।
ক্রোধ একটি শক্তি—যদি তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে তা সৃষ্টি করে নেতৃত্বের ক্ষমতা; আর যদি তা নিজের উপর চড়ে বসে, তবে তা ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জীবনে বহু সফল মানুষের গল্পেও দেখা যায়, তারাও রাগ করতেন, কিন্তু তারা জানতেন কখন, কোথায় এবং কীভাবে সেই রাগ প্রকাশ করতে হবে। আর যারা এই শিখরে পৌঁছাতে পারেনি, তাদের অনেকেই ক্ষণিকের রাগে জীবনের অনেক বড়ো সুযোগ হারিয়েছেন।
সমাজে আমরা যদি ক্রোধের প্রতি সজাগ হই, নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিখি, তাহলে হয়তো অনেক অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব, হিংসা, বিচারহীন ঘটনা কমিয়ে আনতে পারব। প্রত্যেক মানুষের মনে থাকা ক্রোধের আগুনকে যদি জ্ঞানের শীতলতায় প্রশমিত করা যায়, তাহলে সমাজ হবে আরো সহনশীল, আরো মানবিক।
(০৩)
অসহিষ্ণুতা
-বিচিত্র কুমার
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। এই সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও সহাবস্থান। কিন্তু যখন এই সহনশীলতার জায়গাটি ক্ষীণ হয়ে আসে, তখনই সমাজে জন্ম নেয় অসহিষ্ণুতা। অসহিষ্ণুতা কোনো নতুন ব্যাধি নয়, বরং মানবসভ্যতার শুরু থেকেই এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। তবে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেক বিস্তৃত হয়েছে, সেখানে অসহিষ্ণুতার চেহারা আরও বিকট ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
আজকের পৃথিবীতে অসহিষ্ণুতা শুধু রাজনৈতিক মতবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; তা ছড়িয়ে পড়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, লিঙ্গ, জাতিগোষ্ঠী, এমনকি ব্যক্তিগত রুচিবোধের মধ্যেও। অন্যের মতের প্রতি সম্মান দেখানো কিংবা ভিন্নমতকে গ্রহণ করার মানসিকতা আজকের সমাজে ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। অথচ সমাজের সুস্থ বিকাশের জন্য এই মানসিকতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
গ্রামের মাঠ থেকে শহরের রাজপথ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে রাষ্ট্রীয় নীতি—সব জায়গাতেই অসহিষ্ণুতা আজ এক মহামারীর রূপ নিয়েছে। একজন ছাত্র যখন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককে প্রশ্ন করতে ভয় পায়, কারণ সে জানে তার প্রশ্ন যদি শিক্ষকের মনমতো না হয়, তাহলে হয়তো সে তিরস্কৃত হবে, তখনই বোঝা যায় অসহিষ্ণুতা কতটা গাঢ় হয়ে গেছে। একইভাবে, যখন কোনো মানুষ তার ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে চলতে পারে না, কারণ প্রতিবেশী ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে তাকে সন্দেহের চোখে দেখে, তখনই সমাজে অসহিষ্ণুতার বিষবৃক্ষের শিকড় অনুধাবন করা যায়।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিতে গেলে অসংখ্য চিত্র উঠে আসে। গ্রামের অশিক্ষিত কৃষক হোক বা শহরের উচ্চশিক্ষিত নাগরিক, সকলের মধ্যেই একধরনের “আমিই ঠিক” মানসিকতা প্রবল হয়ে উঠেছে। এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় সহিষ্ণুতার সংকট। ধরা যাক, একেবারে সাধারণ একটি দৃশ্য—বাসে উঠে একজন ব্যক্তি যদি বলে, “আমি জানালার পাশে বসতে চাই”, তখনই আরেকজন যাত্রী তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “আপনি কে আমাকে সরিয়ে বসানোর?” এখানে কেউ আর বুঝতে চায় না যে, হয়তো ওই ব্যক্তি অসুস্থ, হয়তো বাতাসের দরকার আছে তার। ছোট ছোট জায়গায় যদি আমরা একে অপরের অনুভূতিকে বুঝতে না চাই, তবে বৃহত্তর সমাজে কিভাবে সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে?
রাজনৈতিক অঙ্গনেও অসহিষ্ণুতার ভয়াবহ চিত্র লক্ষ্য করা যায়। ভিন্নমতের মানুষদের কণ্ঠরোধ করা, বিরোধী মতাদর্শকে শত্রু মনে করা, শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর হামলা চালানো, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা—এগুলোই হলো রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার নগ্ন প্রকাশ। অথচ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হলো ভিন্নমতের সহাবস্থান। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক দেশে যখন বিরোধীদলের সভা-সমাবেশকে প্রতিপক্ষ নয় বরং শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখনই সমাজে এক বিভাজনের দেয়াল নির্মিত হয়, যা সহিষ্ণুতার চর্চাকে পুরোপুরি বিনষ্ট করে দেয়।
ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। ধর্মের নামে মানুষকে বিভক্ত করা, ঘৃণা ছড়ানো, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর আক্রমণ করা, ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা—এসবই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার জ্বলন্ত উদাহরণ। অথচ সকল ধর্মেই সহিষ্ণুতা, ভালোবাসা, মানবতা শেখানো হয়। তবু কেন মানুষ ধর্মের আড়ালে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে? এর অন্যতম কারণ হলো—অজ্ঞতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা প্রচারণা। যারা নিজের ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা জানে না, তারাই অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আবার কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ইচ্ছাকৃতভাবে এই অজ্ঞতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সমাজে অসহিষ্ণুতা ছড়ায়।
অসহিষ্ণুতার আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এখানে মানুষ যেন আরও বেশি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। “মত প্রকাশের স্বাধীনতা”র নাম করে কেউ যখন নিজের মত অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়, তখনই সেখান থেকে শুরু হয় ট্রলিং, কটাক্ষ, অপমানজনক মন্তব্যের ঝড়। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের কমেন্ট সেকশনে যদি কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করে, তখনই তার ওপর নেমে আসে গালি-গালাজের বন্যা। এখানে যুক্তি নেই, সভ্যতা নেই, আছে শুধু “আমিই ঠিক, বাকিরা ভুল” এই আত্মঘাতী দম্ভ।
অসহিষ্ণুতার একটি নির্মম উদাহরণ দেখা যায়—পারিবারিক পরিসরে। শৈশব থেকেই যদি শিশু তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা না পায়, যদি মা-বাবা প্রতিনিয়ত তার মতামতকে উপেক্ষা করে, তখনই সে একটি সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। পরিবারই যদি সহিষ্ণুতার প্রথম পাঠশালা না হয়, তবে স্কুল, সমাজ, রাষ্ট্র তা হতে পারে না। আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়ে ভেদে চলন-বলন, পোশাক-আশাক, পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এক ধরনের অসহিষ্ণুতা কাজ করে। মেয়ে হলে তাকে রান্না শেখাতে হবে, ছেলে হলে মাঠে খেলতে পাঠাতে হবে—এই ধারণাগুলো আমাদের সমাজে প্রোথিত। অথচ, ছেলে যদি রান্না করতে চায় বা মেয়ে যদি ফুটবল খেলতে চায়, তখনই সমাজ তাকে বাঁকা চোখে দেখে। এটা আসলে চিন্তার অসহিষ্ণুতা, যা আমাদের সামাজিক গঠনকেই বিকৃত করে তুলছে।
অসহিষ্ণুতার কারণে সমাজে বিভাজন তৈরি হয়, সৃষ্টি হয় ঘৃণা, হিংসা, সহিংসতা। একবার ভাবুন, কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যখন ভয়ভীতির মধ্যে বসবাস করে, তখন তার সমাজের প্রতি আস্থাই ভেঙে যায়। একইভাবে, রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে যদি কাউকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়, তার কর্মস্থলে হেনস্থা করা হয়, তাহলে সেই সমাজে গণতন্ত্রের ভিত্তি বলতে কিছু থাকে না। আজকাল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কেও অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়িয়েছে। শিক্ষক যখন ছাত্রের প্রশ্ন শুনে বলেন, “এটা বোকার মতো প্রশ্ন”, তখনই ছাত্রের মধ্যে প্রশ্ন করার আগ্রহ হারিয়ে যায়। এর ফলে এক ধরনের মানসিক অসহিষ্ণুতা জন্ম নেয়, যা ছাত্রকে ভবিষ্যতে জ্ঞানচর্চায় নিরুৎসাহী করে তোলে।
অসহিষ্ণুতার ভয়াবহ দিক হলো—এটা ছোঁয়াচে। একটি পরিবার, একটি সম্প্রদায়, এমনকি একটি রাষ্ট্রও যখন অসহিষ্ণু মানসিকতা লালন করে, তখন তা ক্রমেই সামাজিকভাবে সংক্রমিত হয়। এটা ঠিক যেমনটা ঘটে—যখন এক ব্যক্তি অন্যকে গালি দেয়, তখন অপরজনও প্রতিক্রিয়ায় গালি দিয়ে বসে। ধীরে ধীরে এই আচরণ একটি সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। আজকের পৃথিবীতে আমরা সেই অসহিষ্ণু সংস্কৃতির চরম পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে মানুষ মতামত ভিন্ন হলেই শত্রু হয়ে ওঠে। অথচ মতের ভিন্নতা মানব সভ্যতার অন্যতম সৌন্দর্য। এই ভিন্নতাই নতুন ভাবনা, নতুন উদ্ভাবন, নতুন আলোচনার জন্ম দেয়।
অসহিষ্ণুতা মূলত দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাধি। এটি নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন—জ্ঞান, শিক্ষা, মানবিকতা ও সহানুভূতির চর্চা। কিন্তু বর্তমান সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রেই এই অসহিষ্ণুতা লালন করে চলে। পাঠ্যবইয়ের মধ্যে ভিন্নমতকে সম্মান করার শিক্ষা যতটা থাকা উচিত, তা অনুপস্থিত। বরং পরীক্ষায় “একই উত্তর” লেখার প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একরৈখিক চিন্তা গড়ে তোলে। ফলে, শিক্ষার্থীরা শিখে যায় ভিন্ন কিছু বললে সেটাকে ‘ভুল’ হিসেবে ধরা হবে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন, যেখানে যুক্তি-তর্ক, মতভেদ, প্রশ্ন করার অধিকারকে উৎসাহিত করা হবে।
অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো—শ্রবণশীলতা। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যের কথা ধৈর্য ধরে শুনতে না শিখব, ততক্ষণ পর্যন্ত অসহিষ্ণুতা দূর করা সম্ভব নয়। সমাজে অনেক মানুষ আছেন, যারা ভিন্নমত শুনলেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন, কথা বলার পরিবর্তে গলা চড়ান। এটা আসলে আত্মবিশ্বাসের অভাবের লক্ষণ। যারা আত্মবিশ্বাসী, তারা অন্যের মতামত শুনে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার সক্ষমতা রাখেন; তারা গলা চড়িয়ে নিজের মত চাপিয়ে দেন না।
মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতার বীজ বপন করতে হলে শৈশব থেকেই সন্তানদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, যুক্তিভিত্তিক চিন্তার চর্চা গড়ে তুলতে হবে। পরিবারকে হতে হবে শিশুদের প্রথম শিক্ষালয়, যেখানে ভিন্নমতকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হতে হবে মুক্তমনা, যারা শুধু বইয়ের শিক্ষা নয়, বরং জীবনের শিক্ষা দেবেন। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে হতে হবে সহিষ্ণুতার পাঠশালা, যেখানে মানুষ শিখবে সব ধর্মের প্রতি সম্মান রাখতে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, অসহিষ্ণুতা কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়; এটি এক সামাজিক ব্যাধি, যা সমগ্র সমাজকে গ্রাস করে। এই ব্যাধি নির্মূল করতে হলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিদিন আমাদের নিজেদের আচরণ বিশ্লেষণ করতে হবে—আমি কি অন্যের মতামতকে সম্মান করছি? আমি কি ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি সহানুভূতিশীল? আমি কি নিজের মতকে চেপে ধরছি অন্যের ওপর? এই প্রশ্নগুলো প্রতিদিনের আয়নায় দেখতে হবে।
যতদিন পর্যন্ত আমরা একে অপরকে সম্মান করতে শিখব না, ততদিন অসহিষ্ণুতার আগুন আমাদের সমাজকে গ্রাস করবে। তাই প্রয়োজন সহিষ্ণুতা চর্চার একটি সামাজিক আন্দোলন। যেখানে মানুষ শিখবে শ্রদ্ধা করতে, ভালোবাসতে, ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে।
অসহিষ্ণুতা আমাদের উন্নয়নের পথে এক ভয়াবহ বাধা। এটি মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে, সমাজে হিংসা ও অস্থিরতা ছড়ায়। তাই সময় এসেছে নিজেকে সংশোধনের, সহনশীলতার নতুন পাঠ নেওয়ার। একমাত্র মানবিকতা ও শ্রদ্ধাবোধের চর্চাই পারে আমাদের অসহিষ্ণুতার অন্ধকার গুহা থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে।
দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।