কিশোর বয়সটা এক অদ্ভুত সময়। এই বয়সে মানুষ যেমন নিজেকে খুঁজে ফেরে, তেমনি নতুন কিছু গড়ার স্বপ্নও দেখতে শেখে। কিশোরদের মনে উদ্ভাবনী চিন্তার বীজ থাকে স্বাভাবিকভাবেই। এই বীজ যদি সঠিক পরিচর্যা পায়, তাহলে তা কবিতার অনুপ্রেরণায় পরিণত হতে পারে। কবিতা শুধু শব্দের খেলা নয়, এটা অনুভবের গভীরতা, চিন্তার উড়াল আর কল্পনার বিস্তার। তাই কিশোরদের উদ্ভাবনী চিন্তা আর কবিতার সম্পর্কটা একেবারে প্রাণের মতোই জীবন্ত ও গভীর।
প্রকৃতির দিকে তাকালেই কিশোর মনে নানা প্রশ্ন জাগে। আকাশের নীল কোথা থেকে এলো? মেঘ কেন কাঁদে? নদী কেন গান গায়? বড়রা এসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিয়ে দিলেও কিশোররা চায় অনুভব দিয়ে বোঝাতে। সেই অনুভব থেকেই জন্ম নেয় কবিতা। উদ্ভাবনী চিন্তা কেবল বিজ্ঞান গবেষণার জন্য নয়, কবিতার জন্যও সমান প্রয়োজন। কারণ কবিতার প্রতিটি চরণে লাগে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন ভাষা আর নতুন ভাবনা। এই নতুনত্বই কিশোরদের মনকে অনুপ্রাণিত করে—নিজের কথা নিজস্ব ঢঙে বলার জন্য।
কিশোর কবিতা মানে শিশুদের মতো সরলতা আর বড়দের মতো জটিলতার মাঝের এক সেতুবন্ধন। এখানে কিশোরেরা তাদের আবেগ, স্বপ্ন, প্রতিবাদ আর ভালোবাসাকে নতুন করে গড়ে তোলে। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা বলে দেয়—কবিতা কেবল প্রেম আর প্রকৃতির বর্ণনা নয়, এটা হতে পারে সমাজের প্রতিচ্ছবি, নিজের অস্তিত্বের অন্বেষণ, আবার কখনো নিছক মজার খেলা। তাই কিশোর কবিতা পড়লে বোঝা যায়, তারা কত সহজভাবে জটিল কথাগুলো বলে দিতে পারে। এই সরলতা থেকেই জন্ম নেয় তাদের সৃষ্টিশীলতা।
উদ্ভাবনী চিন্তার জন্য কিশোরদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তাদের আশেপাশের বিশ্ব। তারা যা দেখে, শোনে, অনুভব করে, তাই নিয়েই ভাবে নতুন কিছু। একটা পাখির উড়ে যাওয়া তাদের মনে জাগায় মুক্তির কথা, একফোঁটা বৃষ্টির ধাক্কা তাদের শোনায় মাটির গান। বড়রা যা দেখে শুধুমাত্র বাস্তবের চোখে, কিশোররা দেখে কল্পনার চোখে। এই কল্পনাই তাদের উদ্ভাবনী চিন্তার বীজ হয়ে ওঠে। সেই বীজ থেকেই গজায় কবিতার অক্ষর।
কিন্তু কিশোরদের উদ্ভাবনী চিন্তা তখনই প্রস্ফুটিত হয়, যখন তারা মুক্তভাবে ভাবতে পারে। সমাজের গোঁড়ামি, ভয়ের দেয়াল আর নিষেধের বেড়াজালে আটকে গেলে তাদের কল্পনা পঙ্গু হয়ে পড়ে। তাই কিশোরদের ভাবনাকে উড়তে দিতে হয় আকাশের মতো। তাদের ভাবনার ওপর প্রশ্ন নয়, বরং উৎসাহের আলো ফেলতে হয়। শিক্ষক-অভিভাবকরা যদি কিশোরদের প্রশ্ন শুনে বিরক্ত না হয়ে তাদের ভাবনাকে মূল্য দেয়, তাহলে তারা আরও উদ্ভাবনী হয়ে উঠবে। এই পরিবেশটাই তাদের কবিতার অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়।
কবিতা লেখা কিশোরদের মধ্যে ভাবনার গভীরতা তৈরি করে। তারা শব্দের পেছনে লুকিয়ে থাকা অর্থ খুঁজতে শেখে। একটা ফুল শুধু ফুল নয়, সেটা হয়ে ওঠে তাদের দৃষ্টিতে জীবনবোধের প্রতীক। একটা ভোরের হাওয়া হয়ে ওঠে নতুন দিনের স্বপ্ন। কিশোরেরা কবিতা লিখে বোঝে—তাদের ভাবনা কেবল নিজের জন্য নয়, বরং সবার জন্য। এই বোঝাপড়া থেকেই তারা সামাজিক সমস্যা, পরিবেশ দূষণ, যুদ্ধ-বিরোধিতা, ভালোবাসার অপূর্ণতা নিয়ে কবিতা লিখতে শেখে। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা তখন আর শুধু নিজের মনোবিনোদনের জন্য থাকে না, হয়ে ওঠে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।
কিশোরদের মধ্যে কবিতার প্রতি অনুপ্রেরণা জাগানোর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পাঠ্যবই, কবিতার আসর, সাহিত্যিক পরিবেশ ও বন্ধুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। সাহিত্যকর্মের প্রতি ভালোবাসা তখনই জন্মায়, যখন কিশোররা নিজের লেখা প্রকাশের সুযোগ পায়। তাদের ছোট ছোট কবিতাকে সম্মান দিলে, তারা বড় হতে শেখে। তাই স্কুল-কলেজে কবিতার প্রতিযোগিতা, দেয়ালপত্রিকা, কবিতার ক্লাস এসব আয়োজন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এসবের মধ্য দিয়েই কিশোরেরা তাদের অনুভবকে শব্দে রূপ দিতে শেখে।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির যুগে কিশোরেরা নানান দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু প্রযুক্তিই আবার তাদের উদ্ভাবনী চিন্তার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজের লেখা ছড়িয়ে দিতে পারছে, অন্যদের লেখা পড়তে পারছে, নানা সংস্কৃতির কবিতার সাথে পরিচিত হতে পারছে। এই প্রযুক্তিগত সুবিধা তাদের উদ্ভাবনী চিন্তাকে আরও বিস্তৃত করছে। তবে শর্ত একটাই—তাদের ভাবনাকে যেন কৃত্রিমতার বেড়াজালে না বাঁধা হয়। তাদের কবিতা যেন প্রকৃতির মতই স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত থাকে।
কিশোর বয়সেই যদি তারা কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের মনের কথা বলতে শেখে, তবে ভবিষ্যতে তারা সমাজের জন্য উদ্ভাবক, দার্শনিক, সাহিত্যিক হয়ে উঠবে। কারণ কবিতা লেখা মানে কেবল শব্দ সাজানো নয়, এটা নিজের ভাবনা গুছিয়ে বলা শেখা, নিজের অনুভূতি সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া শেখা। এই শিক্ষা কিশোরদের উদ্ভাবনী চিন্তাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে।
তাই কিশোরদের মধ্যে কবিতার অনুপ্রেরণা জাগাতে হলে আমাদের সমাজ, পরিবার ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উদার হতে হবে। তাদের প্রশ্ন শুনতে হবে, তাদের কল্পনার পাখা ছাঁটতে নয়, বরং আরও বড় আকাশ দিতে হবে। তখনই তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা থেকে জন্ম নেবে এমন সব কবিতা, যা একদিন বদলে দেবে সময়কে, সমাজকে এবং পৃথিবীকেও।
কিশোরদের উদ্ভাবনী চিন্তা আর কবিতার অনুপ্রেরণা—এই দুইয়ের মিলনেই সৃষ্টি হবে আগামী দিনের নতুন স্বপ্ন।
দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।
বইয়ের নামঃ আমাদের দেশ
লেখকঃ বিচিত্র কুমার
প্রচ্ছদশিল্পীঃ আমিনুল ইসলাম
প্রকাশকঃ Kali Pada Sen (Tipu)
বই মেলা ২০১৫
মূল্যঃ ১০০ টাকা