এখনও সে আমারে ভাবে
——(ছোটগল্প)
কলমে:রমেন মজুমদার
তারিখ:১৫/০৩/২৩
শব্দ সংখ্যা -৭৫৫
———
ছেমরি তাড়াতাড়ি নায় ওড !
হালারপুতেরা পাইলে তোরে গিলা খাইব।
জানস, অগো কামুর বেশি; বাগের লাহাল চিপরাইয়া বুহের তন রক্ত চুষব।
বুকখানারে ছ্যারাভ্যারা করব।
——
বর্ষাকাল। তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে।পাকবাহিনী মেয়েমনুষ খুঁজে খুঁজে কামক্ষুধার জ্বালা মিটাচ্ছে।
কারণ,ওরা উপোষী হয়ে আছে বেশ কিছুমাস।
বাঙালি যুবতী ও বউদের নিয়ে ফুর্তি করছে।
—
এক শ্রেণীর দুষ্ট রাজাকার নারীখেকো ও লুটপাটের দলে যোগদিয়েছে।
করিমন ও রেবাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা। ওরা সোমন্ত,
ভরাট বুকে নাদুসনুদুস শরীর। গা’গতরে রুপোলি ইলিশের মত চকচকে ফর্সা। কামপ্রভাব মানুষের হঠাৎ জোয়ার আসে ওদের দেখলে। দুটিরই শ্রীচেহারা যেন এক ঐশ্বরিক দেবতুল্য।
সুস্থ মানুষকেও অসুস্থ করে তুলে এক নজর দেখার পরে।মুহূর্তে ধ্যান ধারনায় নর্দমার পাঁকে নিক্ষেপ করে কামরসের তাড়না।
ওরা দুই বান্ধবী এক সঙ্গে বড় হয়েছে।পাশাপাশি ঘর।
হিন্দু ও মুসলিম দুটি পরিবার।কিন্তু সম্প্রীতিতে কোন খামতি নেই,কোন পরিবারের দিক থেকে। ও’ঘরে ছিন্নি করলে কোন ঈদে পৌঁছে যায় এ’ঘরে।
এ’ঘরের পুজোর প্রসাদ বিতরণ করে ও’ঘরে।
এক আত্মার মানুষ দুটো পরিবার।
রাখাল ও কেরামত দুই ভাইয়ের মত সন্তানসন্ততি নিয়ে বসবাস করছে।
—-
সেদিন ছিল একাত্তরের মার্চ মাস।
রাতে রেডিওতে খবর রটল যে,মুজিবকে পাকিস্তানে নিয়ে গেছে ইয়াহিয়া খান।
তখন ইয়াহিয়া খান পাকপ্রেসিডেন্ট।
পঁচিশে মার্চ থেকেই বুদ্ধিজীবী হত্যা,যুবক হত্যা,নারী নির্যাতনের গা ‘ শিহরণ করা খবর চারদিক ছড়িয়ে পড়ল।
কেরামত বলল,
রাখাল তুই আজকের মধ্যেই বালবাচ্চা লইয়্যা দূরে কোথাও গতরহান ধাক,নইলে ইণ্ডিয়া চইল্যা যা।
বাড়িঘর ও জমিখেত আমি হামলাব।
তবে আমার মাইয়াডারে নগে কইরা নিয়া যা।
ছেমরিডা দেখতে দেখতে কত বড় অইল, তোরডাও।
মাইনসেরা আমগো ভালা নজরে দ্যাহেনা।
দুগ্গা ভাত খাইতাছি পেড ভইরা।আর মাইয়া দুইডা
পাহাড়ের ল্যাহাল বাইরা গেছে।
গতের য্যান চান্দের ফুলকি লাহাল আগুন বাইরাইতাছে…
চ্যমরি দুইডা মাইনসের নজরে বিষ!
হারা গেরামশুদ্ধা খালি পেসংসা….
আল্লায় ক্যান রূপের কলসি ভইরা অগো সাজাইছে,
হেইডাই বুঝিনা।
বুঝছি, এই ছেমরি দুইডা মা’নক্ষির নাহাল।
তবু হাজার শুকুর যে,অহন তাহাত কোন হালারপুত
রাজাকারের নজরে যায়নাই।
—
এপ্রিল পার হয়ে মে মাস। বর্ষা শুরু হয়েছে প্রায়।
যাই যাই করে রাখালের কোথাও যাওয়া হয়নি।
সম্পত্তির মায়া। মায়া বড্ড মাইনসেরে ভোগায় (!)
নইলে রাখল ক্যান পইড়া আছে গণ্ডগোল দেইহাও।
এই মায়ার সংসার
আল্লায় বেশি দয়া করছে মাইসেরে,
কি দরকার ছিল ??
—
চারদিক বর্ষার জল ঢেউ খেলছে । রাজাকারের মাধ্যমে চারজন মিলিটারি খা-চৌধুরী বাড়ি ঘেরাও করছে।
কেরামত টের পেয়ে রাখালকে তার বউসহ পচ্চিমের জংলা ভিটায় নামিয়ে দিয়ে এলো।
ওদিকে টর্চের আলো দেখতে পেল কেরামত।
এবার করিমন ও রেবাকে নিয়ে আরও দূরে কোথায় রেখে আসবে। ঘাটে নাও বাধা।
এবার করিমন ও রেবাকে নিয়ে দূরে নৌকা ভাসাল।
ওরা নিরাপদে আশ্রয় নিল তালদীঘির ওপারে এক মুক্তিসেনার বাড়িতে।
সেই মুক্তিসেনার দৌলতে নিরাপদে পৌঁছে গেল ভারত।
——
আজও তোমায় ভুলতে পারিনা।আজও সেই চোখের চাহুনি আমাকে বারবার আকৃষ্ট করে।এরই নাম কি প্রেম ?
বলতে পার ? — দীর্ঘ সতের বছর ঘর করার পরে একটা দুর্ঘটনায় স্বামী মারাগেল।
তার রেখে যাওয়া একমাত্র ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করল।বেঙ্গালুরুতে ভাল চাকরি হল।
কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য এই যে,মেল এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত হয়ে সেও আমাকে ছেড়ে গেল আজন্মের মত।
আমি চিরদিনের জন্য হলাম এতিম।
ভাবতে ভাবতে রেবার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
সেদিন তার আচমকা ফোন পেয়ে চমকে ওঠলাম।
জীবনে ভাবিনি,
রেবা আমাকে এতদিন পরেও মনে রাখতে পারে।
পঞ্চাশ বছর আগেও ভালোলাগা আজও অম্লান,অক্ষয়।
মানুষ না ছুঁয়ে না ধরে এতকাল মনে রাখতে পারে?
আমার পরম সৌভাগ্য। প্রেম বলে একই…
ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভরাট বার্ধক্য গলায় বলল,
তোমাকে খুঁজেছি কতদিন, পাইনি।
কেউ একজন বলল, রেবা তুই ফেসবুক ঘেঁটে দেখ।
নাম জানিস ?
সেই নামে সার্চ করে পাবি। ও তো এখন কবি হয়ে গেছে। মস্তবড় কবি।
সোশ্যাল যুগ। সবাই লিখছে। রেবা বলল,আমি জানতাম। বেঁচে আছে কিনা সেটাই আমার সন্দেহ ছিল।
মন দিয়ে ওকেই ভালবাসতাম।সে আগেও লিখত।আমরা তখন ছোট।
এক সময় শুনলাম,মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখেছে।
খবর ওই পর্যন্তই….
মনে মনে ভাবতাম,
এমন সোনারটুকরো ছেলেটা তোমার হতে পারত।
নিয়মের গদবাঁধা জীবন ছিল আমার।
স্বামীর ইচ্ছায় আমাকে সঙ্গ দিতে হতো।
নয়তো এ ‘ সম্পদ তোমার।সারাজীবন বিরহের আগুনে পুড়েছি। তোমার আর্থিক খারাপ বলে বাবা তোমাকে ঘৃণা করত।
বাবা ছিল অহংকারী। গরীব মানুষ ছিল তার চোখের শূল।
সমস্ত কথা বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল।
সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পাইনি।
শুধু একবার বলল,
বেলঘরিয়া স্টেশনে নেমে আমার এই নম্বরে ফোন দিও ; আমি গিয়ে নিয়ে আসব।
একটি রাত থেকে যেও আমার কাছে।
এখন আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই।নদীতে কবেই ভাঁটার টানে গাঙ মরে গেছে। আছে কিছু অবয়ব হাড়গোর!
তোমারও তাই…
বৌদির গত হবার খবর শুনেছি। ভীষণ কেঁদেছি আমিও।
যা’হোক , একবার এসো।
বার্ধক্যের শুকনো ডালপালায় এখন ভর সইবেনা।
স্পর্শের দোষ নেই এখন।
আমি স্বাধীন। একাই একার রাজত্বে বসবাস করি।
বললাম, সময় পেলে একবার আসব দেখতে।এখন
কতটা বুড়ি হয়েছে(?)
পঞ্চাশ বছর পরের এই বৃদ্ধ চোখ আর কামনার আগুনে ঝলসাবে না।
তবুও আসব।
ফোন কেটে দেবার আগে আপ্লুত কণ্ঠ!
একবার একটু ছুঁয়ে দেখব তোমায়,তাতেই সার্থক হবে জন্ম।
রাত দশটা বাজলেই প্রতিদিন একবার করে ফোন এখনও আসে।
আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।লেখালেখি,অনুষ্ঠান ইত্যাদি ইত্যাদির কারণে।।
—- সমাপ্ত।
————