শাহেদের কুড়ে ঘর থেকে তাঁর ছোট জমিটি স্পষ্ট দেখা যায়। সে ছোট জমিকে ঘিরে শাহিদের উপার্যনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সে প্রতিনিয়ত তাঁর জমিতে চাষাবাদ করে নিজের পরিবারের অভাবটুকু দূর করে বাকি অবশিষ্টাক্স বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্যন করে। শাহেদের পিতা নেই বলে তার একা একা জমিতে কাজ করতে হয়। মাথার ঘাম মোছার মত তাঁর কেউ নেই কেবল রয়েছে এক অসুস্থ মা। সে অসুখ কোনো শরীরের নয় বরং মস্তিষ্কের। শাহেদ যখন ছোট ছিল তখন তাঁর পিতা একাত্তরের যুদ্ধে শহীদ হন। কিন্তু শাহেদ তা বিশ্বাস করে না। সে মনে করে তাঁর পিতা এখনো জীবিত হয়তো আরালে কোথাও লুকিয়ে তাকে দেখছে। হয়তো সে আমার পাশেই আছেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মা নিজেকে সামলে নিতে পারে নি। তিনি অন্যমনষ্ক হয়ে যান। তিনি নির্ঘুম হয়ে একা একা থাকতেন কারো সাথে কোনো কথাও বলতেন না। এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায় তার স্মৃতিশক্তির ব্যাঘাত দেখা দিল। দেখা গেল মুহুর্তের মধ্যেই তিনি সব ভুলে গেতে লাগলেন। একদিন এমন কান্ড ঘটলো যে তিনি শাহেদকে চিনতে অস্বীকার করলো। শাহেদ ঘরে ঢুকতেই তাঁর মা মরিয়ম বলল
– তুই কে? তুই আমার বাড়িতে কি করছিস?
– মা তোমার কি হলো। তুমি আমাকে চিনতে পারলে না?
আমি তোমার ছেলে শাহেদ।
-কী তুই আমার ছেলে মানে কি? আমার তো কোনো ছেলে নেই। তুই কে। তুই অবস্যই কোনো চোর বাদমাশ হবি।
মরিয়ম চিতকার করতে করতে এক পযায় চেতনা হরিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। শাহেদ তার মাকে সামলানোর জন্য এগিয়ে গিয়ে জরিয়ে ধরলো। গরিবীর পিরায় আবদ্ধ শাহেদ তাঁর মার চিকিৎসার জন্য কিছু করতে পারে নি।
রাতে সাহেদ তাঁর মা মরিয়মকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো তার মার মায়ারি মুখখানার দিকে।
এই মায়ারি মুখ যেন অনেক বেদনাকে আগলে রেখেছে তার রিদয়ের জালে। মনের মাঝে কিছু বেদনা প্রকাশ্যে নয় গোপনে ভালো। শাহেদ তাঁর মার পাশে পাটিতে চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। সে দিনটি অন্যদিন অপেক্ষা বেশি ঠান্ডা ছিল। ফাল্গুন মাসের সে শীতের নিশা রাত্রি যেন এক রহস্যমত রাত ছিল। কুয়াশা ভরা এলাকা, ঘাসে বিন্দু বিন্দু পানি, জোছনার অগোছালো মেলা সব মিলিয়ে এক নতুন জগতের সৃষ্টি করেছে।
মাঝ রাতে হঠাৎ শাহেদ চিতকার দিয়ে বলল
– বাবা,বাবা তুমি যেও না, যেও না তুমি আমায় ছেড়ে।
বাবা,বাবা।
সে তাঁর ঘোর কাটার পর বুঝতে পেল সে স্বপ্ন দেখছিল।
শাহেদ তাঁর মার দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি আরাম করে ঘুমাছেন। যেন পৃথিবীর কোন বেদনা যেন তার নেই।
শাহেদ পাটি থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো।
দাড়িয়ে সে চোখ বদ্ধ করে তাঁর স্বপ্নের রাজ্যে চলে গেল।
সে দেখেছে তাঁর শহিদ পিতাকে তার স্বপ্নে। শাহেদের বাবা বলল
– বাবা শাহেদ, তুই তো দেখা যায় বেশ বড় হয়ে গেছিস।
তোর মা কেমন আছে?
– মার শরীর ভালো নেই বাবা।
– কেন কি হলো তর মার?
– বাবা, তোমার মৃত্যুর খবর শুনে মা নিজেকে সামলাতে পারে নি। তিনি মানুষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছেন । তুমি যান মা আজকে আমাকে চিনতে পারে নি। আমার কাছে টাকা থাকলে আমি মার অবস্যই চিকিৎসা করাতাম।
বাবা তুমি আমাদের সাথে কেন থাকো না। তোমাকে দেখে মা খুব খুশি হবেন আবার সুস্থও হয়ে যেতে পারেন।
তিনি কথাগুলো শুনে কিছুটা হাসলেন। তিনি মুচকি হাসি হেশে শাহেদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন । হয়তো তাকে আশীর্বাদ করলেন।
শাহেদ যতই তাঁর বাবার কাছে যাচ্ছে ততই তাঁর বাবা শাহেদ থেকে দূরে যেতে থাকলো। তখনই শাহেদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। সে তাঁর বাবাকে এদিক ওদিক খুজতে থাকে তবে তিনি আর দেখা দিলেন না। সে মনে করে তাঁর বাবা তার কাছে আবার ফিরে আসবে। তখন সারারাত জেগে জেগে শাহেদ তাঁর বাবার সাথে কথা বলবে আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনবে। তাকে আর দূরে যাতে দিবে না।
কিন্তু সে দিন আর এলনা। সে দিন শেষে শাহেদ তাঁর বাবার মুখ আর দেখতে পায়নি। তবে শাহেদের বিশ্বাস তার বাবা আবার আসবে ফাল্গুন মাসের জোছনা ভোরা রাতে। এ কথা ভাবতে ভাবতে শাহেদ একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
জীবনের কিছু কথা স্বপ্নাদেশে রেখে দেওয়াই ভালো। যার অস্তিত্ব সমন্ধে আমাদের যানা নেই তা নিয়ে ব্যস্ত হব কেন।
কেননা অস্তিত্ব পুরনের আশা অনেক সময় নিরাশা হয়ে ওঠে যা স্বপ্নাডোরের কাফন হয়ে অজান্তেই নিজের মাঝে জরিয়ে নেয়।।