আমার দেখা শেখ মুজিব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম–২০
———————-
বিংশতি অধ্যায়–২০
আমরা ধীরে ধীরে জাতির জনকের বাড়ির সামনে গেটের পশ্চিম দিকে তার ছবির সামনে এসে দাঁড়ালাম। একজন পুলিশকর্মীকে চেনা চেনা মনে হলো। সামনে এগিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
একটা কথা বলতে পারি ?
পুলিশকর্মীটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ!
তারপর জিজ্ঞাসা করলো—- খালু কেমন আছেন ?
আমাকে চিনতে পারলেন না ? তা’ কী মনে করে এখানে এলেন ?
সঙ্গে এরা কারা ?এক সঙ্গে বেশ কত গুলো প্রশ্ন করে তারপর পায়ে হাত দিয়ে সালাম জানালো।
খালু এখন চিনতে পারছেন ?
—-হ্যাঁ তাই, চেনা মানুষও অনেক সময় অচেনা লাগে।
বললাম, তুমি চানমিয়া ভাইর আত্মীয় ? জে, উনি আমার ফুফা ।
—-আপনিতো গন্ডগোলের সময় আমার ফুফার বাড়িতে ছিলেন। দেখেই চিনতে পারছি।
—বললাম, তা’তুমি এ’লাইনে কবে এলে ? প্রায় চারবছর হয়ে গেছে খালু। ৭২ সালে ফরিদপুর পুলিশ লাইনে যোগদিয়ে ছিলাম।
ভাগ্যক্রমে আজ ৩২ নং ধানমন্ডিতে ডিউটি করছি।
এখানে প্রতিদিন পালাকরে আমাদের ডিউটি করতে হয়। বললাম,
তুমি কোন থানায় পোস্টিং নিয়েছ ?
—ধানমন্ডি থানায় খালু ! আগামী সপ্তায় বদলি হবো রাজারবাগ থানায়।
আচ্ছা, তোমার নামটা যেন কী ? —হাফিজ মোল্লা।
আপনারা আমাকে হাপিজ্যা বলে ডাকতেন। আমার ফুফু ডাকতো হাজু করে।
পাশে দাঁড়ানো পুলিশ গুলি ফিক করে হেসে উঠলো।
—বললাম, আচ্ছা হাফিজ আমরা একটু ভিতর বাড়ি যেতে পারবো ?—না খালু এই মুহূর্তে ঢুকতে দিলে আমাদের চাকুরী চলে যাবে।
—-কেন হাফিজ ?
–ওই দেখতেছেন সাদা রঙের টয়োটা গাড়ি ! ওই গাড়িতে প্রাক্তন মন্ত্রীরা এসেছে।ওনারা চলে গেলে আমি ভিতরে নিয়ে যাবো।
জিজ্ঞাসা করলাম, কোন কোন মন্ত্রী এলেন ?
—খালু ,এলেন রাজ্জাক সাহেব ও তোফায়েল আহমেদ।
আমি বললাম হাফিজ একটা কাজ করো, আমার নাম লিখে দিলাম, তুমি এই কাগজটা ভিতরে রাজ্জাক ভাইর হাতে দিবে। উনি আমাকে চিনবেন।
আমি লিখে দিলাম,
—জুনিয়র মজুমদার,ফণীদার আত্মীয়,
মাদারীপুর শাখায় একদা লড়াকু “সেই উজ্জ্বল “।
দু’মিনিট পরেই আমার ভিতরে ডাক পড়লো, আমি ভিতরে গেলাম।
বাড়ির প্রধান গেট ভিতর থেকে বন্ধ থাকে। থাকে ভিতরের কেচি গেট। তার পর কাঠের দরজা।
আমি জানি উপরে ওঠার রাস্তা কোনদিকে।
তাই দক্ষিন পূর্ব দিকের লোহার মোড়ানো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম।
ওটা বাড়ির ইমারজেন্সি সিঁড়ি। আম গাছের ছায়ার তলে সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। ড্রইং রুমে রাজ্জাক ভাই,তোফায়েল আহমেদ ও আমার থানার আওয়ামীলীগ নেতা কাজী মাহবুবউল্য সাহেব।আছে আর দুজন থানা লেভেলের নেতা।
এগিয়ে এসে সবাইকে সালাম করলাম।
রাজ্জাক ভাই বললো, তুই কবে ঢাকায় এলি?
আগে রাজ্জাক ভাই বলতাম। এখন ভাই বলতে সাহস পাইনা—- তাই বললাম,
স্যার, কাল এসেছি।
রাজ্জাক ভাই বললেন, আমাকে স্যার না বলে ভাই বলবি।
তূই আগে যেমন বলতিস, ঠিক তেমন করেই ডাকবি।
আমাকে মাহবুবউল্যা সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি ফণীদার প্রাণপ্রিয় কাছের মানুষ, সেটা বুঝিয়ে দিলেন।
আমি একদা সংগ্রাম করেছি সে কথাও বললেন।
কাজী সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাড়ি কোথায় ? বললাম, আপনার কলেজের পাশেই।
ওনারা কথা বলছেন, আমি ততক্ষণে মৃত্যুর মর্মান্তিক দৃশ্যগুলো দেখতে পাশের ঘরে এলাম।
বঙ্গবন্ধুর বেডরুম অগোছালো।চশমা,রক্ত মাখা সেন্টু গেঞ্জি,রক্ত মাখা লুঙ্গি,পায়ের চটি,এলোমেলো করে রাখা।
মুজিব কোট, পাঞ্জাবি,পাজামা, ওয়াল হাঙ্গারে ঝুলছে। বাম পাশে সিঁড়ির ধাপগুলিতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ
তেমনি রয়ে গেছে। আওয়ামীলীগের পত্রিকা অফিস থেকে সাংবাদিক এলেন। তারা সবটা ভিডিও করলেন।
প্রেসিডিয়াম নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন শীঘ্রই বাড়িটি সকলের জন্য মুক্ত করে দিবেন,এটিকে মুজিব স্মৃতি
হিসাবে ধরে রাখবেন।
রাজ্জাক ভাই বললেন, এখন কিছু করছিস ?
আমি বললাম, চাকরির জন্য ঢাকায় এসেছি।
রাজ্জাক ভাই একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন, পরে আমি যেন তার সাথে যোগাযোগ রাখি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সবাই নীচে নেমে এলেন।
সিকুইরিটি পুলিশ নেতাদের সালাম জানালেন।
ওনারা ৩২ নং ধানমন্ডি ত্যাগ করে চলে গেলেন।
আমিও ফিরে এলাম আমার ঠিকানায়।
রাতে শুয়ে শুয়ে পুরানোদিনের কথা ভাবতে লাগলাম। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। স্মৃতির পাতা ওল্টাতে গিয়ে বুকের মধ্যে চীন করে ব্যথ্যা ডুকরে ওঠলো।
শেখ পরিবারের মর্মান্তিক মৃত্যু ও সেই উটকো রক্তের চাপ চাপ গন্ধে রাত কাটতে লাগলো।
তার উপর সেই ৭৩ সালের নিরু হাওলাদারের মর্মান্তিক মৃত্যু রক্ষীবাহিনীর হাতে
সে কথা ভাবতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল আমার।
রাত ভোর হয়ে এলো। ঘুমাতে পারিনি সারাটা রাত।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে ক্ষমতায়ন নানাভাবে বন্টন হয়েছে।
কালের ইতিহাস সকলেই জানেন।
আমার এই লেখা ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট পর্যন্ত ঠিক রাখতে চেয়েছিলাম। তার পরে কিছু না লিখলে অসুম্পূর্ণ থেকে যায় লেখাটি।
এতক্ষণ যা লিখলাম, সত্য ঘটনার অবলম্বনে স্মরণ কালের বাস্তব জীবনে যা উপলদ্ধি করেছি,দেখেছি,
তাই নিয়ে প্রকৃত বাস্তব নিয়ে লেখার জন্য কলমের উপর ভরকরে লিখেছি।
জীবন দেবতা যা লেখার সাহায্য করেছে,আমি তাই নিয়েই লিখেছি ।
জীবন একটা কালের চক্র।কোথায় কি ভাবে তার গতি প্রবাহিত হবে তা’সে নিজেও জানেনা।
ভোরের সূর্য উঠে গেছে। চারিদিক সোনালী রোদ্দুর
খিল খিল করে হাসছে।
ফসলের একটা মৌ মৌ গন্ধ অন্তরকে নাড়া দিয়ে যায়।
একদিকে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ জমির ফসল ফলানো নিয়ে ব্যস্ত। অন্য দিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে।
একদিকে কেউ শোষণ করছে,আবার কোথায় শোষিত হচ্ছে মানুষ।
আমি কবি সাহিত্যিক বা দার্শনিক নই। এবং একজন রাজনীতিবিদও নই।
আমি একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।
মনের টানে,প্রাণের আবেগে কাগজ কলম নিয়ে বসেছি। স্মরণ কালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি গুলো একত্রে জোড়া দিয়েছি। তাতে কি হলো জানিনা।
শুধু ইতিহাসের বাস্তব সত্যটা সময়,তারিখ বছরের বিবর্তন না ঘটে সেটাই কেবল ইতিহাস থেকে সাহায্য নিয়েছি।
বাংলা আমার ভাষা। আমার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ জান্নাতবাসী। তার আত্মার শান্তির জন্য শ্রষ্ঠার কাছে প্রার্থনা করছি ।
……….তার কথা কিছু না বললে আমার লেখাটা অসুম্পূর্ণ থেকে যাবে,
তাই লিখছি।
তিনি ছিলেন দরবেশ শেখ আউয়ালের বংশধর।
হজরত বায়জিত বোস্তামীর (রা:) সঙ্গে ১৪৬৩ খ্রি:বঙ্গীয় এলাকায় আগমন করেন।
তিনি কে ছিলেন ?—— তিনি ছিলেন শেখ আউয়ালের পুত্র শেখ জহিরউদ্দিন।
তার পুত্র ছিলেন শেখ জানমাহুমুদ ওরফে তেকড়ি শেখ।
তেকড়ি শেখের পুত্র ছিলেন—শেখ বোরহানউদ্দিন।
বোরহানউদ্দিন শেখের পুত্র ছিলেন–শেখ আকরাম।
শেখ আকরামের পুত্র ছিলেন–শেখ আব্দুল হামিদ।
শেখ আব্দুল হামিদের পুত্র ছিলেন—-শেখ লুৎফর রহমান বা এস,এল, আর।
তারই পুত্র ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এবং মুজিব পুত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ।।
ভাবছিলাম লেখা আর দীর্ঘ করবোনা।কিন্তু তবুও লিখতে হয় আওয়ামীলীগের যুগ সন্ধিক্ষণের পরে শুরু হয় দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর ক্ষমতার লড়াই। সামরিক অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান ।একে একে বিদায় হলো খন্দকার মোশতাক আহমেদ,মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ,বিচারপতি সায়েম,তারপর পাকিস্তানি কায়দায় জিয়াউর রহমান।
সেই জিয়া একাত্তরের রাজাকার,আলবদর নিয়ে সরকার গঠন করেন। শুরু হলো মৌলবাদী সরকার।
১৯৮১ সালে সার্কিট হাউসে ৩০ শে মে একদল উগ্র সেনার হাতে জিয়াউর রহমান মারা যান চট্টগ্রামে।
এক নজরে শেখ মুজিব
——————–
১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ৩রা চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দের রাত ৮ ঘটিকায় জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান,মাতা মোসাম্মৎ সায়েরা বেগম। তিনি প্রথম সন্তান।ডাক নাম খোকা।
১৯২৭-২৯ সাল । সাত বছর বয়সে স্কুল শিক্ষা ডিমডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়,পরে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে।
১৯৩১ সালে পিতার চাকুরী সূত্রে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তিহন। সেখানে মুজিব গ্লুকোমা রোগে চোখ আক্রান্ত হয়।
১৯৩৬ সালে মুজিবকে নিয়ে তার পিতা চলে আসেন কলকাতা। বিখ্যাত টি,আহমেদ তার চোখে অস্ত্র প্রচার করে চিকিৎসা করেন ।
১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেছা ওরফে রেণুকে বিয়ে করেন।
১৯৪০ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধান মন্ত্রী শেরে বাংলা এ,কে,ফজলুল হক ও মন্ত্রী হোসাইন শহীদ সোয়ারওয়ার্দী গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শন করতে এলে মুজিব তাদের নিকট থেকে ১২০০ টাকা আদায় করেন স্কুলের স্বার্থে।
১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উর্তীর্ন হলে কলকাতা গিয়ে ইসলামিয়া কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হন।
তখন তিনি মুসলিমলীগের ছাত্র পরিষদে নিযুক্ত হন।
১৯৪৩ সালে পূর্ববাংলার প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ শুরু হলে নিরন্ন মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে নোঙ্গরখানা খুলেন এবং স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেন।
সেই বছর পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। যাকে আমরা বলতাম
তেতাল্লিশের মন্বন্তর ।
১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ার নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মুজিব নেতৃত্ত দেন এবং কলকাতায় অবস্থিত ফরিদপুর জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন।
১৯৪৫ সালে ভোটাধিকারের ভিত্তিতে কেন্দ্র ও প্রদেশের সাধারণ নির্বাচন করার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের
ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন ১৬ ই আগস্ট শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
সেই দাঙ্গায় মুজিব অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভ্রাম্যমান সাহায্য করেন অনেককেই।
১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযে আইন নিয়ে ভর্তি হন। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদে পূর্ব বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দেন উর্দু ভাষা । মুজিব চরম ভাবে তার প্রতিবাদ করেন। ২১ শে মার্চ ঢাকার ময়দানে
জিন্নাহ সাহেব উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার পক্ষে
বক্তৃতা দিতে গেলে চিৎকার করে মুজিব বলেন,
নো নো নো—-
তার পরেই ১১ই সেপ্টেম্বর মুজিব এরেস্ট হন।
১৯৪৯, সালে ২১ সে ফেব্রুয়ারি মুজিব কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন।ঢাকা উনিভার্সিটি ছাত্র ধর্ম ঘটে মুজিব নেতৃত্ব দেন ।সে বছর তাকে বহিস্কার করা হয়।
সেই দিন মুজিব প্রতিজ্ঞা করেন যে, যদি সন্মান নিয়ে আসতে পারি তবে সেইদিন ফিরবো।নতুবা মুজিবুর রহমান কোনোদিন ফিরবেনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে।
২৬ শে এপ্রিল উপনির্বাচনে মুসলিমলিগ পরাজিত হলে মুজিব আবার গ্রেফতার হন।
ঢাকার রোজ গার্ডেনে মুজিব আওয়ামী মুসলিমলীগ গঠন করেন। এবং পার্টির উপসম্পাদক নির্বাচিত হন।
জুলাই মাসে মুজিব মুক্তি পেলে ‘ভুখা’ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে প্রধান মন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করেন এবং পুনরায় মুজিব এরেস্ট হন ।
১৯৫২ সালে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ১৪৪ ধারা আইন ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন ছাত্র সিদ্ধান্ত নিলে মুজিব তাতে পূর্ণ সমর্থন করেন।
তখন মুজিবুর রহমানকে ঢাকার জেল থেকে বদলি করা হয় ফরিদপুর জেলে।
১৪৪ ধরা ভঙ্গ কারীদের উপর গুলি চালালে রফিক শফিক,সালাম, বরকত, আরো কয়জন মারা যান
সেদিন ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের শেষে মুজিবকে মুক্তি দিলে ” বিশ্বশান্তি সম্মেলন “পরিষদে যোগ দিতে মুজিব ও ভাসানী সাহেব চীন সফর করেন। সেখানে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌএনলাই এর সাথে দূরদর্শী বৈঠক করেন।
১৯৫৩ সালে জুলাই ৯ তারিখে কাউন্সিল অধিবেশনে সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত হন এবং
মুসলমলিগকে পরাস্ত করে -” যুক্তফ্রন্ট ” গঠন করেন ।যুক্ত ফ্রন্টের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান,মওলানা ভাসানী,শেরে বাংলা এ,কে,ফজলুল হক,এবং হোসেন শহীদ সোয়ারওয়ার্দী । তারা নতুন সরকার গঠনে পরিকল্পনা করেন।
১৯৫৪ সালে ১০ ই মার্চ সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭ আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করেন ২২৭ আসন পেয়ে।
এর মধ্যে মুজিবের একক দল জয়লাভ করেন ১৫২ আসন পেয়ে। ১৫, ই মে শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেন। ৩০ শে মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিয়ে সাথে সাথে মুজিবকে এরেস্ট করেন। আবার ২৩ শে ডিসেম্বর মুজিব কারামুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৫ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। এবং আইন সভা থেকে সদস্যপদ প্রত্যারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯ শে ফেব্রুয়ারি বিল পাশ করে পূর্ববাংলার নাম বদল করে রাখা হয় পূর্বপাকিস্তান। মুজিবের নির্দেশে বিল পাশের স্বাক্ষর থেকে বিরত রাখেন।
কেন্দ্রের তখন প্রধানমন্ত্রী সোসাইন শহীদ সোয়ারওয়ার্দী।
১৯৫৭ সালে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সময় মওলানা ভাসানী পার্টির সভাপতির পদ ছেড়ে “ন্যাপ ” পার্টি গঠন করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়েদেন হোসেন শহীদ সোয়ারওয়ার্দী । পরে নতুন প্রধান মন্ত্রী হন
ফিরোজ খান নুন ।
১৯৫৮ সালে ১৬ ই জুন আওয়ামীলীগ পার্টির পতন ঘটে। ২৩ শে জুন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন জনাব আতাউর রহমান।
ঐ দিন বাজেট অধিবেশনে বিরোধীদের আক্রমণে
ডেপুটি স্পিকার মারা যান। মৃত্যুর পরে মুজিবকে দায়ী করা হয়।
৭ই অক্টোবর পাক প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন বাতিল করে হাজার হাজার নেতাকে আটক করেন,। তখন বিনা বিচারে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়।
১১ ই অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে একবস্ত্রে দেশত্যাগ করিয়ে আইয়ুব খান ক্ষমতা কেড়েনেন।
১৯৫৯ সালে আয়ুইব খান মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেন। সে সময় শেখ মুজিব একটানা ১৪ মাস জেল খাটেন । তারপর হাইকোর্টের নির্দেশে জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।
১৯৬০ সালে প্রহসন মূলক গণভোট করে আয়ুইব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৯৬১ সালে ২৭ শে এপ্রিল শেরে বাংলা এ,কে,ফজলুল হক মারা যান। তখন কোনো শোক বার্তা না দিয়ে আয়ুইব খান সানন্দে আমেরিকা সফর করেন ।
১৯৬২ সালে নিরাপত্তা আইন দেখিয়ে ৬ ই ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ ই জুন সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন চার বছর পরে এসে। তখন বঙ্গবন্ধুকে জেলহতে মুক্তিদেন।
৫ ই জুলাই পল্টন ময়দানে আয়ুইব খানের কড়া সমালোচনা করেন এবং ২৪ শে জুলাই মুজিবুর রহমান লাহোর গমন করেন ।
১৯৬৩ সালে আয়ুইব খানের পরামর্শে ভাসানী সাহেব গোপনে বৈঠক করেন চিনে গিয়ে,তখন ভারত বিরোধী কথাবার্তা বলেন তারা। লেবাননের এক হোটেল কক্ষে হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী মৃত্যু বরণ করেন ।
১৯৬৪ সালে ২৫ শে জানুয়ারি শেখ মুজিবের বাস ভবনে এক সভায় আওয়ামীলীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। তখন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের দাবি করা হয়। সেই বছর মুজিব পার্টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
সেই বছর আয়ুইব খান পরোক্ষ ভোট করেন উনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দ্বারা। ঘুষের মাধ্যমে আয়ুইব খান পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৯৬৫ সালে আপত্তিকর মন্ত্যেবের জন্য শেখ মুজিবকে পুনরায় এক বছরের জন্য কারাদন্ড দেয়া হয়। সেই বছর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয়। ১৭ দিন যুদ্ধে পূর্ব বাংলার কোনো ক্ষতি হয়নি। তখন নিষিদ্ধ ছিল ভারতের খবরাখবর শোনা যাবেনা ।
১৯৬৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যস্থায় তাসখন্দে লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও আয়ুইব খানের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৫ ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ঐ ৬ দফা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসাবে আখ্যায়িত হয়।
শেখ সাহেব তখন সারা বাংলায় ঢাকা,খুলনা,রাজশাহী,দিনাজপুর,রংপুর,চট্রগ্রাম,
ফরিদপুর, সিলেট, বরিশাল,ময়মনসিংহ,জনমত তৈরি করতে গিয়ে বারবার এরেস্ট হন।
১৯৬৭ সালে তাসখন্দে যুদ্ধ বিরতিতে যে চুক্তি হয়েছিল, তার বিরোধী করেছিল জুলফিক্কার আলী ভুট্টো।
১৯৬৮ সালে ৬ ই জানুয়ারি এক প্রেসনোটে
পাকিস্তানকে দুই ভাগে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র দেখিয়ে সেনাবাহিনীর ২৮ জন বাঙালি অফিসারকে
গ্রেফতার করেন আয়ুইব খানের হুকুমে। জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় এক প্রেসনোটের
আদেশ জারি করে তথাকথিত আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ১নং আসামি করে
গ্রেফতার করা হয়।
১১ ই এপ্রিল পাঞ্জাবের এক বাঙালি বিচারপতি মকছুমূল হাকিমের দ্বারা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শেখ মুজিবের বিচার কার্য শুরু হয়।
সে সময় সমগ্র পূর্ব বাংলার আন্দোলনের ঢেউ ওঠে মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে,আর মিথ্যা মামলা তুলে নিতে হবে।
সেই সময় আমি ফণীভূষণ মজুমদারের নির্দেশে উক্ত আন্দোলনে আওয়ামীলীগের ব্যানারে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ি শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে।
১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলায় কারফিউ উপেক্ষা করে জয়বাংলা ধ্বনি উচ্চারিত হয়। ১৭ ই জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ভিপি জনাব তোফায়েল আহমেদ ১৪৪ ধরা ভেঙে রমনার বট মূলে জনসভা করেন। সারা দেশেই কারফিউ ভঙ্গ করে উত্থাল আন্দোলন শুরু হয়।
আমি তখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী আন্দোলনের মাদারীপুর শহরে আওয়ামীলীগ ব্যানার নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করি।
আমাদের স্লোগান ছিল””তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা মেঘনা যমুনা,”” জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো “”১৪৪ ধরা মানিনা মানিনা,মুজিব ছাড়া অন্যকিছু জানিনা””
আয়ুইব তুমি গদি ছাড়, শেখ মুজিবকে মুক্ত করো।””
২৪শে মার্চ আয়ুইব খান পদত্যাগ করেন। তার পূর্বে এক অধ্যাদেশ জারি করে ২১ শে ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে সকল বিবাদিগণকে মুক্তি দেয়া হয়।।
২৩ শে ফেব্রুয়ারি মুজিবকে পল্টন ময়দানে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
আর আমরা মুজিবকে সংবর্ধনা দেই পরের দিন ফরিদপুর, মাদারীপুর শহরে।
২৪ শে মার্চ থেকে শুরু হয় ইয়াহিয়া খানের শাসন।
চলবে—-