আকাশটা সেদিন ছিল ধোঁয়াটে। রানওয়ের পাশ ঘেঁষে থাকা স্কুলটি তখনো গুঞ্জনময় শিশুদের কোলাহলে। ক্লাস চলছিল, বইয়ের পাতা উল্টানো শব্দে ভরে উঠছিল শ্রেণিকক্ষ। কিন্তু মুহূর্তের ব্যবধানে, সেই গুঞ্জন থেমে গেল এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে।
একটি বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছুটে এসে আছড়ে পড়ল স্কুলের ছাদে। চারদিক আগুনে ঘেরা—কান্না, আর্তনাদ, ছুটোছুটি। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকা বাচ্চাদের মধ্যে একজন ছিলেন শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরী। সেই বিভীষিকাময় আগুনের মধ্যে তিনিও ছিলেন, কিন্তু পালিয়ে যাননি।
মাহেরীন চৌধুরী ওই মুহূর্তে ছিলেন শ্রেণিকক্ষে। আগুনের ধোঁয়া ঘন হয়ে আসছিল, ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে উঠছিল—“ম্যাডাম, বাঁচান!” তিনি জানতেন, দরজা পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন হবে। কিন্তু তবুও তিনি ছুটলেন—একটি একটি করে শিশুদের ধরে বার করছিলেন। কে জানে, তিনি কতজনকে ঠেলে দিয়েছিলেন জীবনের দিকে, আর নিজে ঠেলে দিয়েছিলেন নিজেকে মৃত্যুর অগ্নিকুন্ডে।
একবার বেরিয়েও যেতে পারতেন তিনি। চাইলে নিজের জীবন বাঁচানো অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তিনি ফিরে গিয়েছিলেন, আরও একটি শিশুকে ধরতে, আরও একটি প্রাণ রক্ষা করতে।
সেই মুহূর্তের সাহস আর মাতৃত্বের তীব্রতা অগ্নির থেকেও উজ্জ্বল ছিল। তাঁর পোশাকে আগুন ধরে গিয়েছিল, তবু তিনি থামেননি। চিৎকার করে ডেকে গিয়েছেন, “ছেলেমেয়েরা জানালার কাছে আসো, আমি আছি!” সেই ডাকের ভেতরে ছিল মা-হওয়ার এক গভীর প্রতিশ্রুতি, শিক্ষিকাকে ছাপিয়ে এক স্নেহময়ীর আত্মবলিদান।
শেষবার যখন তাঁকে দেখা গিয়েছিল, তখন তাঁর শরীর আগুনে পোড়া, মুখের চামড়া গলে পড়েছে, কণ্ঠস্বর থেমে গেছে চিরতরে। কিন্তু তাঁর দুই হাত তখনো একটি শিশুর গায়ে রাখা—যেন শেষ নিঃশ্বাসেও তিনি রক্ষা করছিলেন তাঁর ছেলেমেয়েদের।
মাহেরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ কোনো গল্পকথা নয়, কোনো উপমার ছায়া নয়—এ এক নিঃশব্দ বিপ্লব, যা মানুষকে আবার বিশ্বাস করায় ‘মানুষ’ শব্দটির গভীরতাকে।
তার মৃত্যুর পর, কান্নায় ভেঙে পড়েছিল পুরো দেশ। কিন্তু সেই কান্নার ভেতরে এক গর্বও ছিল—একজন নারী, একজন শিক্ষক, এমন আত্মত্যাগ করে গেছেন যা সাহসের সংজ্ঞাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে।
এই ঘটনার পর বেঁচে ফেরা এক ছাত্র বলে, “ম্যাডাম না থাকলে আমি বাঁচতাম না। তিনি আমাকে ঠেলে দিয়েছিলেন জানালার দিকে, নিজে পড়ে গিয়েছিলেন আগুনের ভেতর।”
এমন অনেক শিশুর প্রাণ আজ বেঁচে আছে শুধু মাহেরীন চৌধুরীর শেষ মুহূর্তের সেই দৃঢ়তায়। তিনি কোনো রাষ্ট্রনায়ক নন, কোনো বিখ্যাত লেখক কিংবা অভিনেত্রী নন—তবু তিনি হৃদয়ের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
তার গল্পটা কোনো রূপকথা নয়, কোনো অতিনাটকীয় চিত্রনাট্য নয়। এটা এক শিক্ষিকার অগ্নি-পরীক্ষার গল্প, যেখানে তিনি পাস করেছেন নিজের জীবন দিয়ে। পৃথিবীজুড়ে হাজার হাজার শিক্ষক প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন। কেউ বই পড়ান, কেউ জীবনের পাঠ দেন। কিন্তু মাহেরীন চৌধুরী সেই বিরল একজন—যিনি নিজের জীবনের শেষ পৃষ্ঠা লিখে গেছেন অন্যদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে।
এই গল্পের শেষ নেই। কারণ, তিনি চলে গিয়েও থেকে গেছেন—প্রত্যেক শিশুর চোখে যাকে তিনি আগুন থেকে বাঁচিয়েছিলেন, প্রত্যেক শিক্ষকের কাছে যিনি বলে গেছেন কীভাবে হতে হয় সত্যিকারের ‘গার্ডিয়ান’।
আজ হয়তো তার নামে কোনো পুরস্কার থাকবে না, কোনো মেমোরিয়াল গেট কিংবা উৎসব হবে না তাঁর নামে। কিন্তু তার আত্মত্যাগ, তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে জ্বলবে এক অবিনশ্বর শিখা হয়ে।
মাহেরীন চৌধুরী—একজন শিক্ষক, একজন মা, একজন নীরব যোদ্ধা—আপনাকে স্যালুট। আপনি আগুনে পুড়ে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন আলোর ধারা, যার দ্যুতি কোনো দিন নিভবে না।
দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।