Skip to content

তিনটি শিশুতোষ গল্প -বিচিত্র কুমার

(০১)
শালিক ও বানরের বন্ধুত্বের শক্তি
-বিচিত্র কুমার

বনের মধ্যে ছিল এক ছোট্ট গ্রাম, যেখানে পাখি, পশু সবাই মিলে মিশে বাস করত। সেই গ্রামের এক বড় শিমুল গাছে বাস করত শালিক পাখি টুনটুনি আর ঠিক পাশের পুরনো অশ্বত্থ গাছে থাকত এক দুষ্টু বানর কাঁকন।

টুনটুনি ছিল খুব শান্ত, পরিশ্রমী আর গম্ভীর স্বভাবের, আর কাঁকন ছিল সারাদিন দুষ্টুমি করে বেড়ানো এক চঞ্চল বানর। গ্রামের সকলেই ভাবত, এদের মধ্যে কোনোদিন বন্ধুত্ব হবে না। কিন্তু টুনটুনি আর কাঁকন ছিল একেবারে উল্টো—তারা ছিল খুব ভালো বন্ধু।

সকালে কাঁকন গাছের ডালে ঝাঁপাঝাঁপি করত, আর টুনটুনি পাশ থেকে বলত, “ও কাঁকন, সাবধানে! ডাল ভেঙে পড়লে আবার কান্নাকাটি করবে!” কাঁকন হেসে বলত, “আরে ভয় কী, তুই তো আছিস!”

একদিন গ্রামের পশুপাখিদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ল—মানুষের দল এসে বনের মাঝখানে এক বিশাল রাস্তা বানাবে। শিমুল আর অশ্বত্থ গাছও কেটে ফেলা হবে। সবাই আতঙ্কিত। টুনটুনি বলল, “কিছু একটা করতে হবে, আমাদের ঘর তো এই বন!” কাঁকন বলল, “তুমি চিন্তা করো না টুনটুনি, আমরা একসাথে লড়ব।”

টুনটুনির বুদ্ধি আর কাঁকনের দুষ্টুমি একসাথে মিলে তারা এক চমৎকার পরিকল্পনা করল। পরদিন সকালে, যখন গাছ কাটার লোকেরা এল, তারা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল—পুরো শিমুল আর অশ্বত্থ গাছ জুড়ে ঝুলছে দড়ির মতো করে বানানো জালের ফাঁদ। উপর থেকে শালিকের দল কিচিরমিচির করছে, আর নিচে বানরের দল লাফিয়ে লাফিয়ে দড়ি টানছে।

গাছ কাটার লোকেরা ভয় পেয়ে ভাবল, এই গাছে বুঝি যাদু আছে! যেভাবে শালিক আর বানর একসাথে দড়ি বুনে গাছ ঘিরে রেখেছে, তাতে গাছ কাটতে গেলে কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে। তারা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল।

এরপর বনের পশুপাখিরা বুঝল, শালিক টুনটুনি আর বানর কাঁকনের বন্ধুত্বের শক্তি কতটা বড়। একা টুনটুনি কিংবা কাঁকন কিছুই করতে পারত না, কিন্তু একসাথে তারা বনের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল।

সেই দিন থেকে বনের সকলেই তাদের বলত—“বন্ধুত্ব মানেই শক্তি, আর টুনটুনি-কাঁকনের মতো বন্ধুত্ব মানেই সাহসের গল্প।”

টুনটুনি হাসত আর বলত, “বন্ধুত্ব যদি মনের হয়, তাহলে গাছও রক্ষা পায়, বনও বাঁচে!”

আর কাঁকন? সে তখনও ডালে লাফিয়ে বলত, “টুনটুনি, এবার তোকে নিয়ে গাছের মজা খাওয়াব!”

এভাবেই ছোট্ট শালিক আর দুষ্টু বানরের বন্ধুত্ব বনের সবাইকে শিখিয়ে দিল, সত্যিকারের বন্ধুত্বের শক্তি কখনো হার মানে না।

(০২)
চিকু ও গম্ভীরচন্দ্রের জ্ঞানের কাহিনী
-বিচিত্র কুমার

গহীন বনের পাশে ছোট্ট একটি গ্রামে থাকত চড়ুই পাখি চিকু। চিকু ছিল ভীষণ চঞ্চল ও কৌতূহলী। দিনরাত তার একটাই কাজ—নতুন কিছু শেখা আর সেটা সবাইকে দেখানো। কিন্তু চিকুর ছিল একটা সমস্যা—সে কখনও মন দিয়ে কিছু শেখার ধৈর্য ধরত না। সব কিছু সে হুড়মুড় করে শিখে ফেলার চেষ্টা করত। ফলে প্রায়ই ভুল করত।

একদিন সন্ধ্যাবেলা বনে ডাক পড়ল প্যাঁচা বুড়োর। তার নাম গম্ভীরচন্দ্র। তিনি ছিলেন বনের জ্ঞানী পণ্ডিত। যার কাছে সবাই পরামর্শ নিতে যেত। চিকু ভাবল, “আজ গম্ভীরচন্দ্রের কাছ থেকে আমি এমন কিছু শিখে নেব, যা দেখে সবাই হাঁ হয়ে যাবে!”

চিকু উড়ে গিয়ে গম্ভীরচন্দ্রের সামনে গিয়ে বলল, “গম্ভীরচন্দ্র দাদু, আমাকে আজই সবচেয়ে বড় জ্ঞান শিখিয়ে দিন। আমি একদিনে সব কিছু জানতে চাই।”

গম্ভীরচন্দ্র ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল, “সবচেয়ে বড় জ্ঞান? ওটা তো ধৈর্য আর অনুশীলন ছাড়া পাওয়া যায় না, চিকু। তবুও তুমি যদি শিখতে চাও, তবে চল, তোমায় কিছু দেখাই।”

গম্ভীরচন্দ্র চিকুকে নিয়ে গেল বনের ভেতর। সেখানে পুরনো এক গাছের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে একটা সাপ উঁকি দিচ্ছিল। তার নাম সুরসুরি নাগ। গম্ভীরচন্দ্র বলল, “দেখো, সুরসুরি নাগ কত ধৈর্য ধরে শিকার ধরার অপেক্ষা করছে। সে জানে তাড়াহুড়ো করলে তার ক্ষতি হতে পারে।”

চিকু মাথা নাড়ল। কিন্তু ভাবল, “এ তো খুবই সহজ কাজ। আমি তো এর চেয়ে অনেক ফুরফুরে।”

এরপর গম্ভীরচন্দ্র নিয়ে গেল নদীর ধার ঘেঁষে থাকা মাছরাঙা পাখির কাছে। তার নাম নীলিমা। নীলিমা খুব মনোযোগ দিয়ে জলের ওপর তাকিয়ে ছিল। গম্ভীরচন্দ্র বলল, “ও দেখো, নীলিমা কতক্ষণ ধৈর্য ধরে তার শিকার দেখছে। হুট করে ঝাঁপ দিলে সে ভুল করতে পারে।”

চিকু আবারও মাথা নাড়ল, কিন্তু তার মন ছিল অস্থির। সে ভাবল, “আমি তো দেখিয়ে দেব, কীভাবে দ্রুত শেখা যায়।”

পরদিন সকালে গম্ভীরচন্দ্র চিকুকে ডেকে বলল, “আজ তোমার পরীক্ষা। এই গাছের ফাঁকে একটা বিশেষ ফল রয়েছে। সেটা খুবই কোমল, ভুল করে জোরে ঠোকরালে ফলটি নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি যদি সত্যিকারের জ্ঞানী হও, তবে সেটাকে সঠিকভাবে বের করতে পারবে।”

চিকু হুড়মুড় করে গেল। সে গাছের ফাঁকে ঠোকর দিতে শুরু করল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সে ফলটিকে এমন জোরে ঠুকল যে সেটি ছিঁড়ে নিচে পড়ে গিয়ে চৌচির হয়ে গেল।

গম্ভীরচন্দ্র ধীরে হেসে বলল, “দেখলে, চিকু? জ্ঞান শুধু জানার বিষয় নয়, ধৈর্য আর সময়কে সঙ্গে নিয়েই প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে হয়।”

সেদিন থেকে চিকু বুঝে গেল, তাড়াহুড়ো নয়, বরং ধীরে ধীরে শেখাই সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমানের কাজ। সে প্রতিদিন সময় নিয়ে, ধৈর্য ধরে শিখতে শুরু করল। আর ধীরে ধীরে সে সত্যিই বনের সবার কাছেই জ্ঞানের পাখি হয়ে উঠল।

(০৩)
কাক ও শিয়ালের সত্যতা পরীক্ষা
-বিচিত্র কুমার

বড় বনের কোণায় ছিল এক বিশাল পুরোনো বটগাছ। তার ডালে বাস করত এক জ্ঞানী কাক, নাম তার কালু কাক। কালু কাকের বুদ্ধির গল্প আশেপাশের গাছে গাছে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে কাউকে ঠকাতো না, আবার কাউকে ঠকতেও দিতো না।

ওদিকে, পাশের ঝোপে থাকত এক চালাক শিয়াল, নাম ভোলানাথ। ভোলানাথ ছিল ধূর্ত আর কথা চালিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে ওস্তাদ। তবে সে কখনোই কালু কাককে ঠকাতে পারেনি। তাই ভোলানাথের মনে এক গোপন অভিমান জমে উঠেছিল।

একদিন সকালে ভোলানাথ কৌশলে ভাবল, “আজ কালুকে এমন ফাঁদে ফেলব, যাতে ওর সত্যতা পরীক্ষায় আমি জিতে যাই।” সে কিছু পাকা ফল নিয়ে বটগাছের নিচে গিয়ে চিৎকার করে বলল, “কালু ভাই, শুনেছো? আজ বনরাজ্যের রাজা সব প্রাণীর মধ্যে সৎ ও সত্যবাদীকে পুরস্কার দিবেন।”

কালু কাক ডাল থেকে নেমে এসে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে সেটা বোঝা যাবে, ভাই ভোলানাথ?”

ভোলানাথ ঠোঁটের কোণে এক চাতুর্যের হাসি রেখে বলল, “রাজা বলেছে, যার কথা কাজে মিল থাকবে, সেই-ই সৎ। এখন আমাদের দুইজনকে একটা পরীক্ষা দিতে হবে। আমি বলব আমি যা বলি তাই করব, আর তুমিও বলবে। কিন্তু শেষে দেখা যাবে কে সত্যি নিজের কথা রাখে।”

কালু কাক ভাবল, এ তো সহজ ব্যাপার। রাজা সৎ প্রাণীকে পুরস্কার দেবেন শুনে সে রাজি হয়ে গেল।

ভোলানাথ বলল, “আমি বলছি, আজ সারাদিন আমি কাউকে ঠকাবো না। আর তুমি বলো, তুমি কাউকে কোনো কথা না বলে সারাদিন চুপ করে থাকো।”

কালু কাক হেসে বলল, “ঠিক আছে, দেখা যাক কে কথা রাখে।”

সকাল গড়িয়ে দুপুর এলো। ভোলানাথ প্রথমেই এক খরগোশকে ডেকে বলল, “তুমি বনের সেরা দৌড়বাজ, আজ যদি তুমি আমার জন্য কিছু খাবার জোগাড় করো, আমি তোমাকে রানার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী করিয়ে দেবো।”

খরগোশটা বোকার মতো রাজি হয়ে গেল। দূর থেকে কালু কাক সব দেখল, কিন্তু সে কথা রাখার জন্য কিছুই বলল না।

ভোলানাথ দ্বিতীয় ফাঁদে ফেলল এক কচ্ছপকে। বলল, “তুমি যদি তোমার পিঠে করে আমায় নদীর পারি দাও, আমি তোমার খোলসের ওপর সুন্দর পাথরের অলংকার জুড়ে দেবো।”

কচ্ছপটা সরল মনে রাজি হয়ে গেল।

কালু কাক তখনো চুপ, সে কথা রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে ভোলানাথ তার কথা রাখছে না।

বিকেল হতেই বনরাজা এলেন। ভোলানাথ উল্লাসে বলল, “মহারাজ, আমি সারাদিন কাউকে ঠকাইনি। আর কালু কাক কোনো কথা না বলে থেকেছে। বিচার করুন কে সৎ।”

রাজা তখন খরগোশ আর কচ্ছপকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কী বলো?”

খরগোশ বলল, “ভোলানাথ আমার কাছ থেকে খাবার নিয়েছে কিন্তু প্রতিযোগিতার কথা ভুলে গেছে।” কচ্ছপ বলল, “আমার পিঠে চেপে নদী পার হলো, কিন্তু অলংকার দিলো না।”

রাজা এবার কালু কাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কালু, তুমি কেন কিছু বলোনি?”

কালু কাক শান্তভাবে বলল, “আমি কথা দিয়েছিলাম, সারাদিন কিছু বলব না। তাই কিছু বলিনি। কিন্তু আমি যা দেখেছি, তোমার সামনে সব বলব।”

এরপর কালু কাক রাজাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। রাজা হেসে বললেন, “ভোলানাথ, সত্যতা শুধু মুখের কথা নয়, তা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ হয়। আর কালু কাক নিজের দেওয়া কথা রেখেছে এবং অন্যায় দেখে চোখ বন্ধ করেনি।”

ভোলানাথ লজ্জায় মাথা নিচু করল। রাজা কালু কাককে পুরস্কৃত করলেন এবং বললেন, “সত্যতা পরীক্ষা শুধু কথা দিয়ে নয়, কাজে প্রমাণ হয়।”

সেদিন থেকে ভোলানাথ আর কাউকে ঠকানোর সাহস করল না। আর বনের সবাই বুঝে গেল সত্যতা পরীক্ষার আসল মানে।

নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753

https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL

মন্তব্য করুন