Skip to content

একগুচ্ছ বর্ষার প্রবন্ধ- বিচিত্র কুমার

(০১)
প্লাবনের মতো আসা-যাওয়া: জীবন ও বর্ষার চক্র
-বিচিত্র কুমার

মানুষের জীবন এক নিরন্তর আসা-যাওয়ার গল্প। নদীর প্লাবনের মতো জীবনেরও রয়েছে এক চক্রাকার গতি—কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। ঠিক যেমন বর্ষাকাল আমাদের প্রকৃতিতে বয়ে আনে নতুন সম্ভাবনা আর ভাঙনের দুঃখ, তেমনি মানুষের জীবনেও আসে আনন্দ-বেদনার প্লাবন। এই চক্রটাই আমাদের জীবন দর্শনের সবচেয়ে বড় পাঠ।

একটি শিশুর জন্ম যেমন একটি পরিবারের আনন্দের প্লাবন, তেমনি সেই শিশুর বড় হয়ে ওঠা, পরিণতি এবং জীবনের ওঠাপড়াও পরিবারের মানসিক জগতে নানান ঢেউ তোলে। এই ঢেউ কখনো শান্তির, কখনো দুঃখের। সময়ের সাথে সাথে সেই ঢেউগুলোই জীবনের নতুন নতুন গল্প বুনে চলে।

গ্রামবাংলার মানুষ জানে প্লাবন মানেই ধ্বংস নয়। বর্ষার জল যেখানে ভাসায়, সেখানেই রেখে যায় উর্বরতার উপহার। ধ্বংস আর সৃষ্টির এই দ্বৈত রূপ প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম। মানুষের জীবনও তাই। বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ যখন ভাবে সব শেষ, তখনই আশার নতুন সূর্য ওঠে।

জীবনের প্লাবন শুধু বাহ্যিক ঘটনায় সীমাবদ্ধ নয়। সম্পর্কের টানাপোড়েন, কর্মক্ষেত্রের ব্যর্থতা, প্রিয়জনের মৃত্যু—এসবই মানসিক প্লাবন যা আমাদের ভেতরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এই ভাসা মানেই শেষ নয়। ডুবে গিয়ে মানুষ শেখে কিভাবে আবার ভাসতে হয়, কিভাবে নতুন করে জীবনকে আঁকড়ে ধরা যায়।

প্লাবনের মতো জীবনের ওঠানামা মানুষকে করে পরিণত। ঠিক যেমন কৃষক জানে প্লাবনের পরে নতুন করে চাষ করতে হয়, তেমনি মানুষও জানে পতনের পর উঠে দাঁড়ানোর পাঠ। জীবনের এই সংগ্রামই মানুষকে সাহসী করে তোলে। প্রতিটি ভাঙনের পরেই শুরু হয় নতুন গড়ার প্রস্তুতি।

সমাজের কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের প্লাবনের মধ্যে হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অবলম্বন। তারা নিজেদের কষ্ট ভুলে অন্যের পাশে দাঁড়ায়। এরা সমাজের নীরব নায়ক, যাদের কৃতিত্ব আমরা প্রায়শই দেখি না, অথচ তাদের কারণেই সমাজ টিকে থাকে। অন্যদিকে কিছু মানুষ আছে যারা নিজের দুঃখেই এতটাই ডুবে যায় যে অন্যের দিকে তাকানোর সময় পায় না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারাও উপলব্ধি করে, শুধু নিজের ব্যথা নিয়ে বাঁচা যায় না, অন্যের কান্না শোনার মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়।

প্লাবনের মতো জীবনের এই আসা-যাওয়ার চক্র মানুষকে শেখায় বিনয়। প্রকৃতি যেমন একদিন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ধ্বংস করে, আবার অন্যদিন সেই ধ্বংসস্তূপের উপরই গড়ে তোলে নতুন সবুজের রাজত্ব, তেমনি মানুষের অহংকারের জায়গাও ক্ষণিক। আজ যে ক্ষমতায়, কাল সে-ই ভেসে যেতে পারে সময়ের প্লাবনে।

জীবনের এই চক্র আমাদের শেখায় মানবিকতা। যে মানুষ আজ বেঁচে থাকার জন্য অন্যের সহায়তার অপেক্ষায়, আগামীকাল সে-ই হয়তো কারো জন্য আশ্রয় হবে। জীবন কখনো একমুখী নয়, এটি পারস্পরিক সম্পর্কের স্রোতধারা। এই সত্য আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব, তত দ্রুত আমাদের সমাজ মানবিক হয়ে উঠবে।

ব্যক্তিগত জীবন ছাড়াও সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর স্তরেও এই প্লাবনের চক্র কাজ করে। অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবই মানুষের জীবনে নতুন করে বাঁচার চ্যালেঞ্জ এনে দেয়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ কখনোই হার মানেনি। প্রতিবারই সে ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে এসেছে।

বর্ষার প্লাবন আমাদের শেখায় অপেক্ষা করতে। আমরা প্রায়ই ফলাফল চাই দ্রুত, কিন্তু প্রকৃতি বলে—সবকিছুরই সময় লাগে। যেমন ধানের বীজ থেকে ফসল হতে সময় লাগে, তেমনি জীবনের প্রতিটি সাফল্য, প্রতিটি স্বপ্ন পূরণও ধীরে ধীরে ঘটে। ধৈর্য্যই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

সবশেষে বলা যায়, প্লাবনের মতো জীবনের আসা-যাওয়ার চক্র এক অবিচ্ছেদ্য সত্য। এই সত্য থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। বরং এই চক্রকে গ্রহণ করাই আমাদের জীবনের পথ। যতক্ষণ না আমরা এই সত্য মেনে নেব, ততক্ষণ জীবনের ছোটখাটো বিপর্যয়েও আমরা ভেঙে পড়ব। কিন্তু একবার যদি বুঝতে পারি, প্রতিটি প্লাবনের পরেই নতুন সূর্য ওঠে, তখন জীবন হয়ে উঠবে এক নবজন্মের উৎসব।

জীবনের প্লাবন মানেই শুধু ধ্বংস নয়, এটি সৃষ্টিরও বার্তা দেয়। যেমন বর্ষার শেষে আকাশে রামধনু ওঠে, তেমনি জীবনের প্রতিটি অন্ধকার রাতের পরেই নতুন সকালের আলো ফোটে। এই বিশ্বাসই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পাথেয়।

তাই জীবন ও বর্ষার এই চক্রকে উপলব্ধি করুন, গ্রহণ করুন, এবং তার সাথে তাল মিলিয়ে চলুন। কারণ নদী থেমে থাকে না, বর্ষার জল থেমে থাকে না, জীবনও থেমে থাকে না। এটাই জীবনের প্লাবনের মতো আসা-যাওয়ার চিরন্তন সুর।

(০২)
ধ্বংস আর সৃষ্টির দোলাচলে বর্ষার উপলব্ধি
-বিচিত্র কুমার

বর্ষা আমাদের জীবনে আসে শুধু বৃষ্টির শীতল পরশ হয়ে নয়, সে আসে ধ্বংস আর সৃষ্টির দোলাচল নিয়ে। প্রকৃতির অবিরাম চক্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মানুষ যখন তার ক্ষুদ্র অস্তিত্ব নিয়ে বাঁচে, তখন বর্ষার প্রতিটি ফোঁটা হয়ে ওঠে নতুন উপলব্ধির জলের ধারা। বাংলার মাটি, নদী আর মানুষের জীবন বর্ষার কাছে নতজানু হয়ে থাকে, আবার সেই বর্ষারই স্পর্শে নতুন করে বাঁচার সাহস খুঁজে পায়।

প্রাচীনকাল থেকেই বর্ষা শুধু ঋতু নয়, জীবনচক্রের এক গূঢ় সংকেত। একদিকে সে উজাড় করে দেয় সবকিছু— ভাসিয়ে নেয় ঘরবাড়ি, ফসল, জীবনের অবলম্বন। অন্যদিকে, সেই ধ্বংসের মাঝেই সে বুনে যায় নবজাগরণের বীজ। নদীর প্লাবনে যেমন ভূমি উর্বর হয়, তেমনি জীবনের প্লাবনেও মানুষ খুঁজে পায় তার অস্তিত্বের নতুন মানে। এ যেন প্রকৃতিরই চিরন্তন দোলাচল, যেখানে ধ্বংস আর সৃষ্টি যুগল নৃত্যের মতো পাশাপাশি চলে।

গ্রামের কৃষক যখন আকাশের মেঘ দেখে মাঠের দিকে তাকায়, তার চোখে থাকে ভয় আর আশার মিশ্র অভিব্যক্তি। বৃষ্টি হলে ফসল হবে, নদীতে পানি এলে জমি উর্বর হবে— এই আশায় সে বুক বাঁধে। কিন্তু সেই বৃষ্টি যদি সীমা ছাড়িয়ে যায়, নদী যদি তার সীমানা ভুলে যায়, তবে তার ঘর ভেসে যায়, নিঃস্ব হয়ে সে দাঁড়ায় পথে। এই দ্বন্দ্ব, এই অনিশ্চয়তা মানুষকে শেখায়— জীবন কখনোই সরলরৈখিক নয়, বরং তা বহুমাত্রিক।

বর্ষার ধ্বংস-সৃষ্টি চক্র আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির কাছে মানুষ এক ক্ষণিক অতিথি মাত্র। আধুনিক সভ্যতা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি দিয়েও মানুষ প্রকৃতির এই নিয়তি থেকে মুক্ত নয়। বর্ষার বন্যা যখন শহরের রাজপথ ডুবিয়ে দেয়, ইলেকট্রনিক ডিভাইস অকেজো হয়ে পড়ে, তখন মানুষ তার নগ্ন অসহায়ত্বের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এই ধ্বংসের মাঝেই যে উপলব্ধি জন্ম নেয়, তা মানুষকে মানবিক করে তোলে, মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসে।

ধ্বংস মানেই শূন্যতা নয়, বরং ধ্বংসের মাঝেই সৃষ্টির সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। বর্ষা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়— পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টি একদিন ধ্বংসের দিকে এগোয়, আর সেই ধ্বংসের মধ্য দিয়েই নতুন সৃষ্টির বীজ জন্ম নেয়। পচা গাছ, ভাঙা মাটির গন্ধে জন্ম নেয় নতুন চারা, ভাসমান কচুরিপানার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় নবজীবনের সূচনা।

বর্ষার ধ্বংস শুধু বাহ্যিক নয়, তা মানুষের ভেতরের অহংকারও ধুয়ে-মুছে দেয়। সেই অহংকার, যা মানুষকে মনে করায় সে প্রকৃতির মালিক। বর্ষা সেই মিথ ভেঙে দিয়ে মানুষকে প্রকৃতির সামনে নগ্ন করে দাঁড় করায়। কিন্তু এই ভাঙনের মধ্য দিয়েই মানুষ শিখে বিনম্রতা, সহনশীলতা। সে বুঝতে শেখে— প্রকৃতি শুধু ধ্বংস করে না, সৃষ্টি করতেও জানে।

মানুষের জীবনের সাথে বর্ষার এই ধ্বংস-সৃষ্টি দোলাচল যেন এক গভীর প্রতিফলন। জীবনও ঠিক বর্ষার মতো— কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। জীবনের একেকটি অধ্যায়ে আসে ধ্বংসের কালো মেঘ, ভাসিয়ে নেয় সবকিছু। সম্পর্ক ভাঙে, স্বপ্ন চূর্ণ হয়, জীবন অবধারিত শূন্যতার দিকে এগোয়। কিন্তু সেই শূন্যতার মাঝেই জন্ম নেয় নতুন পথ, নতুন দিগন্তের সন্ধান। যেমন বর্ষার শেষে প্রকৃতিতে ফিরে আসে সবুজের উচ্ছ্বাস, তেমনি জীবনের ধ্বংসের পরেও আসে নবজাগরণ।

বাংলার সাহিত্যে বর্ষা শুধু প্রকৃতির রূপকথা নয়, তা জীবনদর্শনের এক গভীর পাঠ। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ— সকলেই বর্ষার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন জীবনের ধ্রুব সত্য। এই সত্য আমাদের শেখায়— ধ্বংস আর সৃষ্টি পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং তারা পরিপূরক। বর্ষার প্লাবনে যখন আমরা ধ্বংস দেখি, তখনই আমাদের চোখে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনাও জেগে ওঠে।

মানুষের আত্মিক জগতেও বর্ষার এই দোলাচল স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। মানুষের ভেতরের অহংকার, ক্রোধ, মোহ— সবকিছু বর্ষার ধারায় ধুয়ে যায়। এই ধুয়ে ফেলার প্রক্রিয়াটাই ধ্বংস, আর পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে মানুষ নতুন করে সৃজনের পথে এগোয়। যেমন প্রকৃতি তার পুরোনো আবর্জনা সরিয়ে দিয়ে নতুন জীবনের জন্ম দেয়।

ধ্বংসের ভয় থেকে মুক্ত হয়ে যদি আমরা সৃষ্টির দিকে তাকাই, তবে বর্ষার উপলব্ধি হবে সম্পূর্ণ। আমরা শিখতে পারব— ধ্বংস আসলে এক ধাপ এগোনোরই সুযোগ। বর্ষার প্রতিটি প্লাবন, প্রতিটি ঝড় আমাদের শেখায়— জীবন কখনো স্থির নয়, পরিবর্তনই তার ধর্ম। সেই পরিবর্তনকে ভয় না পেয়ে যদি আমরা গ্রহণ করি, তবে জীবনের প্রতিটি ধ্বংসই হবে একেকটি সৃষ্টির সূচনা।

আজকের নগরজীবনে আমরা বর্ষাকে শুধু ভোগান্তির ঋতু হিসেবে দেখি— জলাবদ্ধতা, যানজট, রোগব্যাধি। কিন্তু বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বর্ষার রয়েছে এক অনন্ত দার্শনিক তাৎপর্য। বর্ষা আমাদের শেখায় ধৈর্য, সহনশীলতা আর আত্মসমীক্ষার গুরুত্ব। যখন প্রকৃতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখনই আমরা উপলব্ধি করি— আমাদের সীমাবদ্ধতা, আমাদের ক্ষুদ্র অস্তিত্ব।

এই উপলব্ধি শুধু ব্যক্তিজীবনেই নয়, সমষ্টিগত জীবনেও প্রাসঙ্গিক। সমাজের ধ্বংসপ্রাপ্ত মূল্যবোধ, নষ্ট রাজনীতি, ভেঙে পড়া অর্থনীতি— সবকিছুই একরকম বর্ষার প্লাবন। কিন্তু এই ধ্বংসের মাঝেই লুকিয়ে থাকে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধ্বংসের পরে এসেছে নতুন সূর্য, নতুন সভ্যতা। মানুষের প্রতিটি বিপর্যয়ই হয়ে উঠেছে তার উন্নতির সিঁড়ি।

বর্ষার প্রতিটি ফোঁটায় জীবনের দার্শনিকতা মিশে থাকে। প্রতিটি বিন্দু আমাদের মনে করিয়ে দেয়— ধ্বংস মানেই শেষ নয়। বরং ধ্বংসের গর্ভেই সৃষ্টি জন্ম নেয়। যেকোনো বিপর্যয়ের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে পরিবর্তনের বীজ। জীবনও তাই বর্ষার মতো— কখনো তুমুল, কখনো প্রশান্ত, কিন্তু প্রতিবার ধ্বংসের পরেই সে নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলে।

এই দোলাচলের মাঝে দাঁড়িয়ে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে— বর্ষা শুধু প্রকৃতির ঋতু নয়, এটি আমাদের মানসিক ঋতুও। আমাদের চিন্তা-চেতনায়, অনুভবে, বোধে বর্ষা ধ্বংস আর সৃষ্টির প্রতীক। জীবনের প্রতিটি ব্যর্থতা, প্রতিটি পতনই একটি নতুন অভিযাত্রার প্রস্তুতি। বর্ষা তাই আমাদের শেখায়— ধ্বংসের ভেতর দিয়েই সৃষ্টির আলো দেখা যায়।

ধ্বংস আর সৃষ্টির দোলাচলে বর্ষার উপলব্ধি আমাদের জীবনের গভীর সত্যকে উন্মোচন করে দেয়। সে আমাদের শেখায়, জীবন কখনোই নিরবিচ্ছিন্ন সুখের নয়, বরং তা ধ্বংস আর সৃষ্টির পরস্পর নির্ভরশীল চক্রের মধ্য দিয়ে এগোয়। এই উপলব্ধি আমাদের বিনম্র করে, আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, এবং আমাদের শেখায়— প্রতিটি ধ্বংসের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা।

তাই বর্ষার দিকে তাকালে, আমাদের শুধু ভিজে রাস্তা আর কাদা নয়, দেখতে হবে জীবনের সেই চিরন্তন দোলাচল— যেখানে ধ্বংস আর সৃষ্টি হাতে হাত ধরে চলে। এই পথেই আমরা খুঁজে পাবো আমাদের অস্তিত্বের প্রকৃত মানে।

(০৩)
জলধারার মতো গড়িয়ে চলা জীবনের প্রহেলিকা
-বিচিত্র কুমার

জীবন যেন এক নিরবচ্ছিন্ন জলধারা। কখনো শান্ত, কখনো উন্মাতাল; কখনো পাহাড় বেয়ে নেমে আসা সরল স্রোতধারা, আবার কখনো অন্ধকার গুহার গোপন স্রোত। মানুষ সেই স্রোতের মাঝেই বয়ে চলে। সে জানে না কোথা থেকে এসেছে, বা আদৌ কোথায় গিয়ে সে থামবে। তবুও চলা থেমে থাকে না। জীবন নিজের নিয়মে, প্রকৃতির সুরে, সময়ের ছন্দে গড়িয়ে চলে। এই চলার মাঝেই রয়েছে জীবনের গভীরতম রহস্য, যাকে আমরা বলি “প্রহেলিকা”।

শৈশবকাল থেকেই মানুষ এই রহস্যের মুখোমুখি হতে শুরু করে। শিশু মনে প্রশ্ন জাগে— “আমি কে?”, “কেন এসেছি এই পৃথিবীতে?”, “আমার কাজ কী?”, “মৃত্যু মানে কী?”। কিন্তু উত্তর মেলে না। বড়দের উত্তরগুলো যেন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। শৈশবের নির্মল হাসি, মাটির গন্ধ, জলপানির কলতান— এগুলোই তখন জীবনের পরিচয়। তখনও মানুষ জানে না, এই স্রোতের গভীরে কত যে দুঃখ, কত যে আনন্দ, কত যে প্রতারণা আর কত যে ভালোবাসা লুকিয়ে আছে।

যৌবনের দ্বার উন্মোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এই স্রোতের প্রবল স্রোতধারায় গড়িয়ে যেতে শুরু করে। তখন জীবন যেন নদীর মাঝখানে পড়া এক খণ্ড কচুরিপানা— চারদিক থেকে ধাক্কা খায়, তবু নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়। প্রেম, স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিযোগিতা, সংকট— সবকিছু এসে তাকে ঘিরে ধরে। মানুষ ভাবে, সে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জীবনই তাকে নিজের মতো করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

জীবনের এই স্রোতে প্রতিটি মানুষই এক এক প্রহেলিকা। কেউ ভালোবাসার জন্য ছুটছে, কেউ অর্থের জন্য, কেউ সাফল্যের জন্য, কেউ আবার মুক্তির সন্ধানে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এরা কেউই জানে না সেই চূড়ান্ত গন্তব্যের ঠিকানা। অনেকেই ভাবে, “যখন বড় চাকরি পাবো, তখন জীবনের সার্থকতা আসবে”; কেউ ভাবে, “যখন সংসার করবো, তখন পূর্ণতা আসবে”; আবার কেউ ভাবে, “যখন বৃদ্ধ বয়সে শান্তিময় অবসর আসবে, তখন জীবনের আসল অর্থ খুঁজে পাবো।” কিন্তু জীবন কখনো সেই প্রত্যাশার গন্তব্যে পৌঁছাতে দেয় না। কারণ সে নিজেই একটি চলমান রহস্য, একটি প্রবাহমান প্রহেলিকা।

মানুষের জীবন-চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় দোলাচল দেখা যায় তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝখানে। এই দোলাচলে জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। মানুষ সারাজীবন ধরে ছুটে চলে, সুখের সন্ধানে। সে ভাবে, “অধিক সম্পদ থাকলে আমি সুখী হবো”, “সামাজিক মর্যাদা পেলে আমি শান্তি পাবো”। কিন্তু যখন সে সেই সম্পদ বা মর্যাদা অর্জন করে, তখন তার মন খালি থাকে। তখন সে বুঝতে পারে, সুখ কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নয়, বরং চলার পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষণিক অনুভূতি।

এই প্রহেলিকাময় জীবনপ্রবাহে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো সময়। সময় যেন এক অকৃতজ্ঞ জলধারা, যা কাউকে চিনে না, কাউকে ধরে রাখে না। মানুষের হাসি, কান্না, ভালোবাসা, ত্যাগ— সবকিছু সময়ের স্রোতে ধুয়ে যায়। মানুষ ভাবে, তার কর্ম, তার ভালোবাসা, তার কীর্তি যুগ যুগ ধরে থাকবে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম বড়ই নির্মম। সময়ের প্রবল স্রোত সবকিছু নিঃশেষ করে দেয়।

তবুও মানুষ থেমে থাকে না। সে জানে না কেন সে ছুটে চলেছে, তবুও ছুটে চলে। জীবনের এই স্রোতে মানুষ কখনো দুঃখে ভেসে যায়, কখনো আনন্দের ফেনায় মাখামাখি হয়, আবার কখনো নিষ্ঠুর বাস্তবতার পাথরে ধাক্কা খেয়ে আহত হয়। কিন্তু থামে না। থামতে পারে না। কারণ জীবনের এই স্রোতধারা কোনোদিন কাউকে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয় না।

জীবনের আরেকটি গভীরতম প্রহেলিকা হলো সম্পর্ক। মানুষ সম্পর্কের বাঁধনে জড়ায়, ভালোবাসে, আবার কখনো সেই সম্পর্কেই পুড়ে যায়। পরিবার, বন্ধুত্ব, প্রেম— সবকিছু যেন এই স্রোতের মাঝে ভেসে থাকা অস্থায়ী দ্বীপ। কখনো সেই দ্বীপে আশ্রয় মেলে, আবার কখনো সেই দ্বীপই হারিয়ে যায় বন্যার তোড়ে। মানুষ ভাবে, সম্পর্ক চিরস্থায়ী হবে, কিন্তু জীবন বারবার বুঝিয়ে দেয়, সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী, সবকিছুই চলমান।

এই প্রহেলিকার আরেকটি নাম “প্রত্যাশা”। প্রত্যাশা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়, আবার অনেক সময় ভেঙে চুরমার করে দেয়। মানুষ প্রত্যাশা করে, তার সন্তান তার স্বপ্ন পূরণ করবে; সে প্রত্যাশা করে, তার পরিশ্রম একদিন তাকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেবে; সে প্রত্যাশা করে, ভালোবাসার মানুষ কখনো তাকে ছেড়ে যাবে না। কিন্তু জীবনের স্রোত সব প্রত্যাশা পূরণ করে না। কিছু পূরণ হয়, কিছু হয় অপূর্ণ। কিছু স্বপ্ন বাস্তব হয়, আর কিছু থেকে যায় কষ্টের দহন হয়ে।

জীবনের প্রহেলিকার সবচেয়ে বড় দিক হলো মৃত্যু। মানুষ জানে, একদিন তাকে এই স্রোতের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু মৃত্যুর সময়, জায়গা, রূপ— সবকিছুই অজানা। এই অনিশ্চয়তাই জীবনের রহস্যকে আরও গভীর করে তোলে। মৃত্যুর কথা ভাবলে মানুষ ভীত হয়, আবার মৃত্যুর কথা না ভাবলেও জীবনের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে না। মৃত্যু যেন জীবনের এক কঠিন আয়না, যেখানে তাকিয়ে মানুষ উপলব্ধি করে, এই জীবন শুধু ভোগের নয়, ত্যাগেরও।

এতসব অনিশ্চয়তার মধ্যেও জীবন সুন্দর। কারণ জীবনকে সুন্দর করে তোলে তার অস্থায়িত্ব। যে ফুল জানে, সে কাল ঝরে যাবে, তার সৌরভটাই সবচেয়ে মধুর হয়। মানুষের হাসি, কান্না, ভালোবাসাও তেমনি। তারা জানে, সবকিছুই একদিন শেষ হয়ে যাবে। তবুও তারা ভালোবাসে, ত্যাগ করে, স্বপ্ন দেখে। এই অস্থায়ী সুখ-দুঃখ, এই ক্ষণিক আনন্দ-বেদনার ভেতর দিয়েই জীবন তার সৌন্দর্য খুঁজে পায়।

জীবনের প্রহেলিকা বোঝার জন্য মানুষকে তাকাতে হয় প্রকৃতির দিকে। নদীর দিকে তাকালেই দেখা যায়, সে কখনো থামে না, কখনোই একই জায়গায় থাকে না। সে জানে না গন্তব্য কোথায়, তবুও সে বয়ে চলে, কারণ তার স্রোতেই তার অস্তিত্ব। মানুষও তেমনি। গন্তব্য জানা নেই, তবুও চলা থামে না। কারণ চলাতেই জীবনের আসল সত্য লুকিয়ে আছে।

এই প্রহেলিকাকে যারা উপলব্ধি করতে পারে, তারা জীবনের প্রতি এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে। তারা বোঝে, জীবনের সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, আশা-নিরাশা— সবকিছুই এক ধরনের প্রবাহ। এখানে স্থায়িত্ব বলে কিছু নেই। তাই তারা ছোট ছোট মুহূর্তকে বড় করে তোলে। তারা জানে, এক কাপ চায়ের সঙ্গে প্রিয়জনের সঙ্গে গল্প করাও জীবনের সার্থকতা। তারা জানে, সূর্যাস্তের আভায় ডুবে থাকা মুহূর্তও এক অনন্য আনন্দের উৎস।

জীবনের এই প্রহেলিকাময় স্রোতধারা আমাদের শিখিয়ে দেয়, “ধরার কিছু নেই, ছেড়ে দেওয়াই প্রকৃত শান্তি।” আমাদের চাওয়া-পাওয়ার দোলাচল, আমাদের অহংকার, আমাদের ভোগ-বিলাস— সবকিছুই একদিন সময়ের জলধারায় ভেসে যাবে। কিন্তু যে মুহূর্তগুলো আমরা সত্যিকারের অনুভব করবো, সেগুলোই থেকে যাবে আমাদের অন্তরজুড়ে।

জীবনের স্রোত আমাদের বাধ্য করে গ্রহণ করতে, ছেড়ে দিতে, আবার নতুন করে শুরু করতে। এই গ্রহণ-বর্জনের খেলা চলতেই থাকে। কেউ কেউ ভাবে, জীবন মানে সংগ্রাম; কেউ ভাবে, জীবন মানে ভোগ; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জীবন মানে— চলমান এক ধাঁধা, যাকে বুঝে নেওয়ার জন্যই আমরা প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে থাকি।

এই প্রহেলিকার সৌন্দর্য এখানেই যে, জীবনকে কখনো পুরোপুরি ধরা যায় না। যতই আমরা ব্যাখ্যা করতে যাই, সে আরও নতুন রূপে ধরা দেয়। সে যেন এক প্রবাহমান কবিতা, যার প্রতিটি শব্দ জীবনের নতুন অর্থ বহন করে।

জীবনের জলধারা আমাদের শেখায়— “সবকিছু শেষ হয়ে যায়, তবুও কিছুই শেষ হয় না।” এটাই জীবনের চূড়ান্ত প্রহেলিকা। আমরা চলে যাই, তবুও এই স্রোত চলতেই থাকে, নতুন মানুষদের সঙ্গে, নতুন গল্পের সঙ্গে, নতুন স্বপ্নের সঙ্গে।

(০৪)
জলস্রোতের মতো প্রবাহমান জীবনদর্শন
-বিচিত্র কুমার

জীবনকে যদি কোনো উপমার সাথে তুলনা করতে হয়, তবে ‘জলস্রোত’ই তার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যাখ্যা। কারণ জল যেমন নিরবিচারে বহমান, বাঁক নেয়, বয়ে চলে নিজস্ব ছন্দে, জীবনও ঠিক তেমনি তার আপন নিয়মে গড়িয়ে চলে। কখনো শান্ত, কখনো উথাল-পাথাল, কখনো অস্থির ধারা হয়ে নেমে আসে মানুষের জীবনের উপর দিয়ে। এই স্রোতের কোনো শুরু আছে, কিন্তু শেষ কোথায় তা কেউ জানে না। মানুষের জীবন তাই আসলে এক নিরবচ্ছিন্ন স্রোতের গল্প, যেখানে গন্তব্য নয়, প্রবাহই হয়ে ওঠে মুখ্য।

মানুষের জীবনের এই প্রবাহমান ধারা কখনো একঘেয়ে নয়। ঠিক যেমন নদীর পথ কখনো সরলরেখায় চলে না, মানুষও তার জীবনের পথে নানান বাঁক নেয়, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগোয়। কখনো ভাটির টানে পিছিয়ে পড়ে, কখনো জোয়ারের জলে সিক্ত হয়ে ওঠে জীবনের সাফল্যে। কিন্তু স্রোত থেমে থাকে না। জলের মতোই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত প্রবাহিত হয় এক অনন্ত গতিময়তায়।

জীবনের এই প্রবাহের সঙ্গে মানুষের আশা-নিরাশা, স্বপ্ন-বাস্তবতা, আনন্দ-বেদনার নিগূঢ় এক সম্পর্ক রয়েছে। ছোটবেলায় যে জীবন আমরা কল্পনা করি, কৈশোরে তা অন্য রূপ নেয়, যৌবনে এসে সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবের মুখোমুখি হয়, পরিণত বয়সে জীবনের স্রোত আমাদের অনেক কিছু শেখায়। প্রত্যেকটি ধাপেই জীবনের জলের ধারা এক নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। জীবনের প্রবাহ তাই কখনো কারও জন্য থেমে থাকে না, কারও দুঃখে, সুখে, ব্যর্থতায় কিংবা সাফল্যে এই স্রোত তার গতি বদলায় না।

আমরা যখন ছোট, তখন জীবন মানে নিখাদ আনন্দের এক নদী। ছোট ছোট খেলা, মায়ের কোলে ঘুমানো, বাবার হাত ধরে হেঁটে চলা, এই সবকিছুই ছিল সেই স্রোতের কোমল জলরাশি। তখন বুঝতাম না জীবন কতটা গভীর, কতটা জটিল। সময়ের স্রোত যখন আমাদের টেনে নিয়ে যায় কৈশোরের দুনিয়ায়, তখন ধীরে ধীরে উপলব্ধি করি, এই স্রোতের মধ্যে রয়েছে কিছু গোপন ঘূর্ণিপাক, যা মানুষকে কখনো ডুবিয়ে দেয়, কখনো আবার ভাসিয়ে তোলে নতুন করে।

জীবনের জলধারা শুধু বাইরের পরিবেশে সীমাবদ্ধ থাকে না, এই স্রোত মানুষের মনের গভীরেও প্রবাহিত হয়। আমাদের চিন্তা, বোধ, অনুভূতি, স্বপ্ন সবকিছুই এই স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। আমরা যত বড় হই, ততই দেখি এই স্রোতের গতি কখনো শান্ত নদীর মতো, কখনো আবার উন্মত্ত স্রোতের মতো সবকিছু ভেঙে-চুরে দিয়ে চলে যায়। জীবনের সুখ, দুঃখ, প্রেম, বিরহ সবকিছুই যেন এই স্রোতের জলের মতোই আসে ও যায়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই স্রোতের সঙ্গে কিভাবে তাল মিলিয়ে চলা যায়? জীবন যখন কঠিন বাঁক নেয়, যখন প্রবাহের গতি হঠাৎ দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে, তখন মানুষ কি করে টিকে থাকে? এর উত্তরও লুকিয়ে আছে জলের মধ্যে। জল যেমন বাঁধা পেলে পথ বদলায়, স্রোতের গতি কমিয়ে দেয়, আবার কখনো স্রোত ছিন্ন করে পথ বের করে নেয়, তেমনি মানুষের জীবনেও যখন বাধা আসে, তখন তার প্রয়োজন হয় নম্রতা ও দৃঢ়তার। কখনো পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, কখনো আবার প্রতিকূলতাকে চূর্ণ করে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে জীবনদর্শনের গভীর সত্য।

মানুষ চায় জীবন হবে স্থির, নিশ্চিন্ত, সুনির্দিষ্ট। কিন্তু বাস্তবতা হল, জীবন কখনোই একরৈখিক নয়। জল যেমন তার নিজের পথ নিজেই খুঁজে নেয়, জীবনও তেমনি আপন গতিতে এগিয়ে চলে, বাধা এলে সে পথ ঘুরে নেয়, আবার নতুন পথে বয়ে চলে। এই গ্রহণযোগ্যতাই জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।

একটি নদীর জন্ম হয় পাহাড়ের কোলে। ছোট্ট ঝর্ণা থেকে শুরু করে সে নেমে আসে সমতলে, পথে পথে তার শরীর ফুলে ফেঁপে ওঠে, নদী হয়ে ওঠে মহীরুহের মতো বিশাল। তেমনি মানুষের জীবনও জন্ম নেয় একটি ছোট্ট পরিবারে, তারপর ক্রমে সময়ের স্রোতে সে বড় হতে থাকে, চারপাশের মানুষ, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, ব্যর্থতা ও সাফল্যের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে পরিণত হয়। এই পরিণত হওয়ার ধারাই আসলে জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য।

জীবনের জলস্রোত অনেক সময় মানুষকে এমন জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে সে কখনোই যেতে চায়নি। কিন্তু স্রোতের ধারা বলে দেয়, চাইলে কি হবে? প্রবাহিত তো হবেই। এখানেই রয়েছে জীবনদর্শনের সবচেয়ে বড় পাঠ। অনেক সময় মানুষ ভাবে, তার নিয়ন্ত্রণে সবকিছু থাকবে, কিন্তু প্রকৃতি বলে দেয়, ‘না, তুমি শুধু স্রোতের এক যাত্রী মাত্র।’ জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য তখনই উপলব্ধি করা যায়, যখন মানুষ বুঝতে শেখে— থামিয়ে রাখা যায় না, শুধু নিজের মনকে প্রস্তুত করতে হয় এগিয়ে যাওয়ার জন্য।

জীবনের প্রতিটি ব্যর্থতাই জলের একেকটি ঢেউ। কখনো কখনো সেই ঢেউ আমাদের ডুবিয়ে দেয়, আবার কখনো সেই ঢেউয়ের কাঁধে ভর করেই আমরা উঠে যাই নতুন উচ্চতায়। মানুষের জীবনে সাফল্য-ব্যর্থতা তাই কখনো চূড়ান্ত নয়, বরং এটি প্রবাহের একেকটি ধাপ মাত্র। ব্যর্থতা মানেই নতুন সম্ভাবনার শুরু, স্রোতের একটি বাঁক, যেখানে সামনে রয়েছে অন্য এক সম্ভাবনাময় দিগন্ত।

জীবনের স্রোত তাই শেখায় নম্রতা, ধৈর্য, স্থিতি ও গ্রহণযোগ্যতা। যারা এই স্রোতের সাথে তাল মেলাতে পারে, তারাই জীবনের গভীর অর্থ বুঝতে পারে। যারা ভাবে স্রোতকে আটকাবে, তারা আসলে নিজের জীবনেই জটিলতা সৃষ্টি করে। প্রকৃতি কখনোই থেমে থাকে না, তাই মানুষও যদি এই অনন্ত গতিময়তাকে মেনে নিতে পারে, তবেই সে প্রকৃত সুখের সন্ধান পায়।

মানুষের জীবনে প্রতিটি সম্পর্কও এই স্রোতের মতো। কখনো তা গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়, কখনো সময়ের স্রোত তা ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরে। বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, পরিবার— সবকিছুই এই প্রবাহমান ধারার মধ্যে গড়ে ওঠে এবং আবার কখনো কখনো মিলিয়ে যায়। কিন্তু প্রতিটি সম্পর্কের স্মৃতি, শিক্ষা ও অনুভূতি আমাদের জীবনের স্রোতের সঙ্গে মিশে থাকে চিরকাল।

জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হলো, এই স্রোতের শেষে কোথাও গিয়ে সবাই মিলিত হয় এক মহাসাগরে, যাকে মৃত্যু বলা হয়। কিন্তু এই মৃত্যুও কোনো শেষ নয়, বরং অন্য এক অনন্ত স্রোতের শুরু। জীবনের জলস্রোতের মতোই মৃত্যুও আসলে এক প্রবাহমান ধারার অংশ, যা মানুষকে নিয়ে যায় নতুন এক অস্তিত্বের দিকে।

অতএব, জীবনের জলস্রোত কখনো থেমে থাকে না। জীবনের আনন্দ, দুঃখ, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি— সবকিছুই এই স্রোতের অংশ। মানুষের উচিত এই প্রবাহের সাথে নিজেকে মেলানো, বাধা পেলে পথ খুঁজে নেওয়া, সুখ-দুঃখকে সমানভাবে গ্রহণ করা। কারণ শেষমেশ আমরা সবাই এই প্রবাহমান জীবনের যাত্রী মাত্র। জলের মতোই আমাদের বয়ে যেতে হবে— বাঁক নিতেও হবে, আবার স্রোতের টানেও এগিয়ে যেতে হবে।

জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য তাই গন্তব্যে নয়, এই চলার মধ্যেই নিহিত। তাই জলস্রোতের মতো প্রবাহমান জীবনকে অনুভব করাই মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

(০৫)
বর্ষার অন্তর্নিহিত প্রেম ও সম্পর্কের গভীরতা
-বিচিত্র কুমার

বর্ষা শুধুমাত্র এক ঋতুর নাম নয়, এটি মানুষের হৃদয়ের গভীরতর অনুভূতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা এক অব্যক্ত ভাষা। মানুষের প্রেম, সম্পর্ক, অপেক্ষা, বিচ্ছেদ, পুনর্মিলন—সবকিছুই যেন বর্ষার নরম জলধারায় ধুয়ে-মুছে এক নতুন অর্থ ধারণ করে। বর্ষার প্রতিটি ফোঁটা যেন আমাদের মনের অলক্ষ্য কোন কোণে জমে থাকা অব্যক্ত কথাগুলোকে টেনে আনে, যেগুলো বছরের অন্য কোনও সময়ে বলা হয় না। এই প্রবন্ধে আমরা বর্ষার সেই অন্তর্নিহিত প্রেম ও সম্পর্কের গভীরতাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করবো, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষের অনুভূতির এক গভীর বন্ধন গড়ে ওঠে।

বর্ষা মানেই অপেক্ষার ঋতু। ধুলোমাখা গ্রীষ্মের দীর্ঘশ্বাসের শেষে যখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, তখন সেই প্রথম ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে বহুদিনের জমে থাকা অপেক্ষাগুলো যেন ভেসে আসে। একজন প্রিয়জনের চিঠির জন্য, কারও ফোনের অপেক্ষায়, অথবা শুধুই কোনও পুরনো স্মৃতির স্পর্শের আশায় মানুষ বসে থাকে জানালার ধারে। বর্ষা সেই অপেক্ষাকে দৃশ্যমান করে তোলে। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ যেন অন্তরের গভীরতম কথোপকথন, যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।

একটা প্রেম যদি সত্যিকারের গভীর হয়, তাহলে তার একটা নিজস্ব বর্ষা থাকে। যেটা শুধুই আবহাওয়ার বর্ষা নয়, বরং সম্পর্কের এমন একটা সময়কাল, যেখানে ভালোবাসার আবেগগুলো পূর্ণতা পায়, আবার কোথাও কোথাও ভিজে যায় অবহেলার জলকণায়। বর্ষা আমাদের শেখায়, সম্পর্কের গভীরতা কখনও শুকনো মাটিতে মেলে না, বরং তা মেলে সিক্ত হৃদয়ের ভেতরেই। বৃষ্টির মতোই সম্পর্কের গভীরতা কখনও মৃদু ঝিরিঝিরি, কখনও বা প্রলয়ংকারী, কখনও সে নিঃশব্দে নামে, আবার কখনও সে ঝড় তোলে।

মানুষের জীবনের প্রতিটি সম্পর্কেই একটা বর্ষাকাল আসে। কোনও সম্পর্কের শুরুতেই যদি সেই বর্ষার পরশ লাগে, তাহলে সেই সম্পর্ক হয় কোমল, কাঁচা, সতেজ। আবার সম্পর্ক যখন দীর্ঘদিনের ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়ে, তখন বর্ষা আসে নতুন করে জীবনের স্পর্শ নিয়ে। বর্ষার মতোই সম্পর্কের জগতে সময়ে সময়ে প্লাবন আসে, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেই প্লাবনে যদি ভালোবাসার ভিত্তি শক্ত হয়, তাহলে সম্পর্ক টিকে থাকে, আর যদি ভিত্তিটা দুর্বল হয়, তাহলে সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়।

বর্ষা মানেই ফিরে দেখা। পুরনো দিনের সেই প্রথম বৃষ্টি, সেই ছাতা ভাগাভাগি করে হেঁটে যাওয়া পথ, অথবা জানালার পাশে বসে থাকা দুইজনে—সবকিছুই বর্ষা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। বর্ষা আমাদের শিখিয়ে দেয়, সময় কখনও থেমে থাকে না, কিন্তু স্মৃতিগুলো ঠিকই থেকে যায়। এই স্মৃতিগুলোই সম্পর্কের গভীরতার মাপকাঠি। সম্পর্ক যতই এগিয়ে যাক, তার শিকড় বর্ষার নরম মাটিতে গাঁথা থাকলে তা সহজে উপড়ে যায় না।

বর্ষা কেবল প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বর্ষা বাবা-মেয়ের সম্পর্কেও আসে, যেখানে বাবা তার মেয়েকে নিয়ে স্কুলে ছাতা ধরে নিয়ে যায়; বর্ষা মায়ের কোলের মধ্যেও থাকে, যখন মা তার শিশুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বৃষ্টির শব্দ শোনায়। বন্ধুত্বেও বর্ষা আসে, যখন দুই বন্ধু বৃষ্টির মধ্যে ভিজে একসঙ্গে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসে। এমনকি বর্ষা সেই সম্পর্কেও থাকে, যেখানে কেউ কারও সঙ্গে কোনও কথা বলেনি, কিন্তু জানালার ওপার থেকে চোখাচোখি হয়েছে।

বর্ষা আমাদের শিখিয়ে দেয়, সম্পর্ক মানেই নিখুঁত হওয়া নয়, বরং অসম্পূর্ণতাকে ভালোবাসার নামই সম্পর্ক। যেমন বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা নিখুঁত নয়, কখনও কখনও তা কাদা করে, কখনও বা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। তবুও বর্ষা আমাদের কাছে প্রিয়, কারণ তার মধ্যে প্রকৃতির অকৃত্রিমতা থাকে। সম্পর্কও ঠিক তেমনই। ভুল, ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা নিয়েই সম্পর্ক পূর্ণতা পায়।

বর্ষার বৃষ্টি যেমন একদিকে নতুন ফসলের সজীবতা নিয়ে আসে, অন্যদিকে আবার বন্যা, ধ্বংস, দুর্ভোগও ডেকে আনে; তেমনি সম্পর্কের জগতে প্রেম যেমন একদিকে সুখের, স্নিগ্ধতার, মাধুর্যের, অন্যদিকে তা আবার দুঃখ, যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতারও জন্ম দেয়। বর্ষার এই দ্বৈততা আমাদের শেখায়, জীবনের প্রতিটি সম্পর্কের গভীরতাই এই বিপরীতমুখী অনুভূতির সংমিশ্রণ। একদিকে টানা বৃষ্টির মতো কাছাকাছি থাকা, অন্যদিকে জলাবদ্ধতার মতোই একটানা অবসাদের ঘূর্ণাবর্ত। এই দুইয়ের মাঝেই সম্পর্ক টিকে থাকে, এবং তা-ই তার আসল সৌন্দর্য।

জীবনের প্রতিটি সম্পর্কেই একটি মৌসুম থাকে। কখনও তা বসন্ত, কখনও তা গ্রীষ্ম, আবার কখনও তা শীত। কিন্তু বর্ষা সেই মৌসুম, যা বারবার ফিরে আসে সম্পর্কের গভীরতা পরিমাপ করতে। আমরা হয়তো সম্পর্কের প্রতিদিনকার ব্যস্ততায় ভুলে যাই একজনের অনুভূতি, উপেক্ষা করি কারও নিঃশব্দ কান্না, অথবা ভুলে যাই বলার কথা। কিন্তু বর্ষা আমাদের থামিয়ে দেয়। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে মনে পড়িয়ে দেয় সেই মানুষটাকে, যার চোখে বৃষ্টি জমে আছে, যার মনে তোমার জন্য অপেক্ষার সুর বাজছে।

বর্ষা প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তর্দ্বন্দ্বকেও উন্মোচন করে। কখনও বর্ষার একদিনে বহুদিনের জমে থাকা অভিমান গলে যায়, কখনও আবার সেই বর্ষাই দুইজনের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু বর্ষার প্রতিটি মুহূর্ত সম্পর্কের ভেতরের সত্যিকারের আবেগগুলোকে সামনে এনে দাঁড় করায়। বর্ষা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সম্পর্ক মানে কেবল উপহার দেয়া, ভালোলাগা বলা নয়, বরং নিঃশব্দে পাশে থাকা, ভিজে যাওয়া হাত ধরে রাখা।

আবার বর্ষা সেই সম্পর্কেও ফিরে আসে, যা হারিয়ে গেছে। বহুদিন আগে যে বন্ধু হারিয়ে গেছে, অথবা যে প্রেমিকা আজ আর পাশে নেই, বর্ষা তার স্মৃতিকে নতুন করে উজ্জীবিত করে। বৃষ্টির ধ্বনির মধ্যেই তাদের হাসি, কান্না, গল্পগুলো ফিরে আসে। এই ফিরে আসাটাই বর্ষার প্রেমের গভীরতা। বর্ষা কখনও হারায় না, সে বারবার ফিরে আসে তার আপন ছন্দে। সম্পর্কও তেমনি। যেগুলো সত্যিকারের গভীর হয়, সেগুলো সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায় না, বরং বর্ষার মতোই ফিরে ফিরে আসে মনে।

মানুষের জীবনে বর্ষার প্রেম কেবল বাহ্যিক অনুভূতি নয়, বরং আত্মিক এক উপলব্ধি। বর্ষা আমাদের শিখিয়ে দেয়, সম্পর্ক মানে একে অপরের পাশে থাকা নয়, বরং মন থেকে মনের ভেতরে এক অনন্ত সংযোগ তৈরি করা। সেই সংযোগ যখন তৈরি হয়, তখন বর্ষার মতোই সম্পর্কের প্রতিটি মুহূর্ত ভেজা থাকে ভালোবাসার সিক্ততায়।

বর্ষার শেষ ফোঁটা পর্যন্ত সম্পর্কের গভীরতা অনুভব করতে জানতে হয়। কেবল মেঘলা আকাশ দেখে বৃষ্টির সৌন্দর্য বোঝা যায় না, ঠিক তেমনই সম্পর্কের বাহ্যিক আচরণ দেখে তার গভীরতা নির্ণয় করা যায় না। সম্পর্কের ভেতরে যে অনুভূতির স্রোত প্রবাহিত হয়, বর্ষা তার প্রতিচ্ছবি মাত্র।

বর্ষা আমাদের শেখায়, প্রেম আর সম্পর্ক কেবল উপস্থিতির নয়, বরং অনুভবের। বর্ষার বৃষ্টি যেমন শুধু মাটিকে ভেজায় না, ভিজিয়ে দেয় আমাদের হৃদয়ের গভীরতম কোণকেও; তেমনি সত্যিকারের সম্পর্ক কেবল চোখে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় হৃদয় দিয়ে।

বর্ষার অন্তর্নিহিত প্রেম ও সম্পর্কের গভীরতা বুঝতে হলে আমাদের শিখতে হবে ভিজে যেতে, থেমে যেতে, নিঃশব্দে শুনতে। কারণ, বর্ষা কখনও জোরে কথা বলে না, সে মৃদু ঝিরিঝিরি শব্দে মনের কথা শোনায়। সম্পর্কও ঠিক তেমনই। সেই সম্পর্কই টিকে থাকে, যার ভিতর বর্ষার মতোই গভীরতা, সহনশীলতা আর নিঃশব্দ অনুভবের স্রোত থাকে।

তাই বর্ষা শুধু প্রকৃতির এক ঋতু নয়, বরং মানুষের হৃদয়ের গভীরতম প্রেম ও সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। বর্ষার মতোই সম্পর্কের সৌন্দর্য খুঁজে নিতে হলে আমাদের হৃদয়কেও সিক্ত হতে হবে সেই অনুভূতির বৃষ্টিতে।

(০৬)
বর্ষার নৌকা ও জীবনের সংকল্প যাত্রা
-বিচিত্র কুমার

জীবনকে যদি নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে বর্ষার নৌকা সেই জীবনের সংকল্পের সবচেয়ে জীবন্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। বর্ষার জলরাশি যেমন নদী-নালা ভরিয়ে দেয়, তেমনি মানুষের জীবনে সময়-অসময়ে ভেসে আসে নানা সম্ভাবনা ও সংকট। সেই ভরা জলের মধ্যে একখণ্ড নৌকা নিয়েই মানুষ শুরু করে তার যাত্রা, যেটি কেবল বেঁচে থাকার সংগ্রাম নয়, বরং জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার এক অনন্ত সাধনা।

বর্ষা প্রকৃতির একটি ঋতু মাত্র নয়; এটি জীবনের উত্থান-পতনের এক অবচেতন রূপক। আকাশের ধারাবাহিক ঝরাপাত, নদীর উথাল-পাথাল ঢেউ, জমে থাকা জলরাশি—এগুলো যেন আমাদের জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি হয়ে ওঠে। কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল, কখনো বিপর্যস্ত। জীবনের পথে চলতে চলতে হঠাৎই এসে পড়ে এই বর্ষার প্লাবনের মতো সময়গুলো, যেখানে আমাদের অস্তিত্ব, সংগ্রাম আর সংকল্প একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায়।

বর্ষার জল এসে ছোট ছোট খাল-বিল-ডোবা ভরিয়ে তোলে। জীবনের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই ঘটে—যখন ভাবি চারপাশটা শূন্য, তখনই হঠাৎ কোনো সংকট, কোনো সুযোগ, কিংবা সম্পর্কের টানাপোড়েন এসে জমাট বাঁধে। সেই সময় মানুষের সংকল্পই তার সবচেয়ে বড় সম্বল। যে ব্যক্তি নিজের সংকল্পের নৌকাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে, সে-ই পারে সেই স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকতে।

বর্ষার স্রোতের মুখোমুখি দাঁড়ানো মাঝিদের দৃশ্য যারা দেখেছে, তারা জানে—স্রোতের বিপরীতে নৌকা টেনে নেওয়া শুধুমাত্র শক্তির ব্যাপার নয়, বরং সময়জ্ঞান, ধৈর্য আর দিকনির্দেশনার গভীর উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে। জীবনও ঠিক তেমনি। শুধু কঠোর পরিশ্রম করলেই চলবে না; জানতে হবে কখন এগোতে হবে, কখন অপেক্ষা করতে হবে, আর কখন নীরব থেকে পরিস্থিতি বোঝার সময়।

জীবনের প্রতিটি যাত্রায় সামনে আসে ডুবে যাওয়ার ভয়। বর্ষার নদীতে নৌকা ভাসানোর সময় মাঝিও ভাবে, হয়তো এই স্রোত তাকে ডুবিয়ে দেবে। আমাদের জীবনের সংকল্প যাত্রাতেও ঠিক তেমনই হয়—কখনো চরম আর্থিক সংকট, কখনো সম্পর্কের টানাপোড়েন, কখনো নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলার ভয়। কিন্তু সেই মুহূর্তেই যে ব্যক্তি ডুবে যাওয়ার ভয়কে জয় করতে পারে, তার সামনে খুলে যায় নতুন দ্বীপের স্বপ্ন। সংকল্পের যাত্রা মানে শুধু প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই নয়; সংকল্পের যাত্রা মানে প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও সম্ভাবনার আলো খুঁজে পাওয়া।

বর্ষার মাঝিদের কেউ কেউ আছেন, যারা স্রোতের মুখে দাঁড় টানতে টানতে গান গেয়ে ওঠেন। সেই গান শুধু সময় কাটানোর জন্য নয়; সেটি একধরনের আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ, সংকল্পের প্রকাশ। জীবনেও যারা জানে কিভাবে কষ্টের মাঝেও হাসতে হয়, যারা জানে কীভাবে সমস্যার মধ্যেও গান গাইতে হয়, তারাই প্রকৃত অর্থে জীবন্ত মানুষ।

জীবনের সংকল্প যাত্রার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। বর্ষার স্রোতের মতোই জীবনের কষ্ট, সংকটগুলোও একদিন কেটে যায়। মাঝি যেমন জানে, ঢেউ আসবে আবার ঢেউ চলে যাবে; তেমনি সংকল্পের মানুষও জানে, জীবন থেমে থাকে না। সংকল্পের মানুষ পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়, কখনো স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, আবার কখনো স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে।

বর্ষার শেষে যখন নদী শান্ত হয়, মাঝি তখন নিজের যাত্রাপথের দিকে ফিরে তাকায়। কোথায় কোথায় তার নৌকা বেশি কষ্ট পেয়েছে, কোথায় সে ভুল করেছে, কোথায় সে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে—এই আত্মসমালোচনাই জীবনের সংকল্প যাত্রার প্রকৃত পাঠ। জীবন মানে শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া নয়; বরং মাঝে মাঝে থেমে দাঁড়িয়ে নিজের ভুলগুলোকে অনুধাবন করা, এবং সেখান থেকে নতুনভাবে শুরু করার শক্তি অর্জন করা।

বর্ষার নৌকা আমাদের শেখায়—সংকল্প মানে শুধু জেদ নয়, সংকল্প মানে নমনীয়তা, সময়জ্ঞান ও ধৈর্যের মিশ্রণ। সংকল্প মানে শুধু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা নয়; সংকল্প মানে মাঝে মাঝে পেছনে সরে গিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া, যাতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময় নৌকাটি আবার ভারসাম্য ফিরে পায়।

জীবন নদীর মতো প্রবাহমান। কোনো সময় সেই নদী শান্ত, আবার কোনো সময় উত্তাল। সংকল্পের মানুষ জানে, কিভাবে সেই পরিবর্তনশীল স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। কখনো তাকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, কখনো স্রোতের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়াতে হয়, আবার কখনো প্রয়োজন হলে কৌশলে পেছনে সরে গিয়ে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সংকল্পের মানুষ জানে, জীবন মানেই ওঠানামা, স্থিতিশীলতা মানেই কৌশল।

বর্ষার প্রতিটি ফোঁটা আমাদের শেখায়—জীবন ভিজে যাবে, কাদা হবে, স্রোত আসবে; কিন্তু আমাদের নৌকাটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্বল। সংকল্পে সেই নৌকাকে ধরে রাখতে হবে। জীবনের সংকল্প যাত্রা সহজ নয়, বরং এটি এক অবিরাম যুদ্ধ। তবে যারা সত্যিকারের সংকল্প নিয়ে জীবনের বৈরী স্রোত পেরোতে জানে, তাদের কাছে বর্ষার নৌকা হয়ে ওঠে জীবনের দর্শন। বর্ষার মাঝির মতো সংকল্পের মানুষও জানে, জীবন মানে চলার মধ্যে আনন্দ খোঁজা, সংগ্রামের মধ্যে সৌন্দর্য খোঁজা, আর প্রতিকূলতার মধ্যে নতুন দিগন্তের সন্ধান করা।

জীবনের যাত্রা কখনোই শেষ হয় না। বর্ষার নৌকা যেমন নদীর স্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজের নতুন পথ খুঁজে নেয়, তেমনি সংকল্পের মানুষও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করে, নতুন যাত্রায় বেরিয়ে পড়ে। সংকল্প মানেই গন্তব্যে পৌঁছানো নয়; সংকল্প মানে যাত্রাটাকে উপভোগ করা, প্রতিটি ঢেউয়ের আঘাতকে বরণ করে নেওয়া, আর সেই ঢেউয়ের মধ্য দিয়েই জীবনের আসল সৌন্দর্যকে খুঁজে নেওয়া।

(০৭)
নৌকায় চড়ে জীবনের স্রোত পারাপার
-বিচিত্র কুমার

জীবন এক অনন্ত যাত্রার নাম। সেই যাত্রা কখনো শান্ত নদীর মতো প্রশান্ত, কখনো আবার বিক্ষুব্ধ স্রোতের মতো উন্মত্ত। মানুষের জীবন যেন সেই নদীরই প্রতিচ্ছবি, যেখানে প্রত্যেকেই নিজের নিজের নৌকায় চেপে স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে চলে ওপারের খুঁজে। কেউ সহজেই পাড় পায়, কেউ মাঝপথেই দিশেহারা হয়, আবার কেউ শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য পাড়ের সন্ধানেই কাটিয়ে দেয় সারাটি জীবন। এই জীবনের স্রোত পারাপারের গল্প প্রতিটা মানুষের ভেতরেই গাঁথা থাকে; কেউ তা উপলব্ধি করে, কেউ করে না।

নৌকা—এখানে শুধু বাহন নয়, বরং একেকজন মানুষের নিজস্ব সামর্থ্য, মূল্যবোধ, চরিত্র, আর জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক। স্রোত মানে জীবনের চলমানতা, কখনো প্রতিকূল, কখনো অনুকূল, কখনো আবার অনিশ্চয়তা আর অজানার ভয়। এই নৌকা আর স্রোতের টানাপোড়েনে জীবন এক অনবদ্য নাট্যরূপ পায়, যার মঞ্চ হলো এই পৃথিবী।

জন্ম থেকেই মানুষ সেই নৌকায় চেপে বসে, যদিও তার জানা থাকে না সামনে কেমন স্রোত আসছে। শৈশবের স্রোত মৃদু, সহজ, আর আনন্দঘন। মা-বাবার ভালোবাসার আচ্ছাদনে শিশুর নৌকা তখন বয়ে চলে স্নিগ্ধ বাতাসে। কিন্তু কৈশোরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতেই সেই স্রোতে দেখা দেয় ছোট ছোট ঢেউ। আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েন, পড়াশোনার চাপ, সমাজের প্রত্যাশা—এসব ঢেউ তখন নৌকার ভারসাম্য পরীক্ষায় ফেলে দেয়।

তরুণ বয়সে স্রোত হয়ে ওঠে আরও দুরন্ত, আরও প্রতিকূল। জীবনের এই অধ্যায়ে এসে মানুষকে পাড়ি দিতে হয় কঠিন বাস্তবতার স্রোতধারা। স্বপ্ন আর বাস্তবতার দ্বন্দ্ব, চাওয়া আর পাওয়ার হিসাব, ভালোবাসা আর বিচ্ছেদের যন্ত্রণা—এসবই তখন জীবনের স্রোতকে করে তোলে আরও উত্তাল। এই সময়েই মানুষ বুঝতে শেখে, নিজের নৌকোটা কতটা মজবুত, বৈঠা কতটা শক্ত, আর দিকনির্দেশক তার আত্মবিশ্বাস কতটা প্রবল।

যাদের আত্মবিশ্বাস দৃঢ়, যারা ধৈর্যের সঙ্গে স্রোতের গতি বুঝে বৈঠার টান ঠিক রাখে, তারা ধীরে ধীরে পারের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু যারা স্রোতের প্রতিকূলতা দেখেই ভয় পেয়ে যায়, তারা মাঝপথেই হাল ছেড়ে দেয়। জীবনের এই স্রোত পারাপারের ক্ষেত্রে বৈঠা চালানোর কৌশল যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সহনশীলতা ও দূরদর্শিতা। কারণ, স্রোত কখনোই স্থির থাকে না। যে স্রোত আজ উত্তাল, কাল সে শান্তও হতে পারে।

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কিছু বিশেষ মুহূর্ত আসে, যখন সে বুঝতে পারে তার নৌকা কোন পথে এগোচ্ছে। এই উপলব্ধির সময়টাই হলো পরিপক্কতার শুরু। তখন সে বুঝতে শেখে, স্রোতকে বদলানো যায় না, কিন্তু নিজের নৌকা চালানোর কৌশলটা বদলে নেওয়া যায়। যারা জীবনের এই পাঠ শেখে, তারাই শেষ পর্যন্ত সাফল্যের পাড়ে পৌঁছায়। অন্যদিকে যারা স্রোতকে দোষারোপ করে সময় নষ্ট করে, তাদের নৌকা স্রোতের ঘূর্ণিপাকে ঘুরতেই থাকে।

মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কখনো কখনো স্রোতের সঙ্গেও তাল মেলাতে জানতে হয়। যেমন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা, ব্যর্থতাকে সহজভাবে গ্রহণ করা, এবং নতুন করে শুরু করার সাহস রাখা—এসবই জীবনের নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আবার কখনো কখনো স্রোতের তীব্রতা এত বেশি হয় যে, কৌশল বা শক্তি কোনো কিছুই কাজে আসে না। তখন প্রয়োজন হয় সময়ের অপেক্ষা করার। কারণ সময়ই একমাত্র উপাদান, যা স্রোতের রূপ বদলে দিতে পারে।

জীবনের স্রোত পারাপার করতে গিয়ে মানুষ কখনো একা থাকে, কখনো আবার সঙ্গে পায় সহযাত্রী। কখনো বন্ধু, কখনো পরিবার, কখনো ভালোবাসার মানুষ। তবে প্রত্যেকের নৌকা আলাদা, আর প্রত্যেকেই নিজ নিজ নৌকার বৈঠা নিজের হাতে রাখে। কেউ কাউকে সত্যিকার অর্থে বয়ে নিতে পারে না। কেউ কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না যদি সে নিজে বৈঠা চালাতে না জানে। জীবনের এই সত্যটা মানুষ বারবার ভুলে যায়।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের স্রোতও বদলে যায়। যৌবনের তীব্রতা ফিকে হয়ে আসে, স্রোত হয়তো খানিকটা শান্ত হয়, কিন্তু তখনও নদীর গভীরে লুকিয়ে থাকে অদৃশ্য স্রোতের খেলা। মধ্য বয়সের সময়ে মানুষ পিছু ফিরে দেখে, কতটা পথ সে পার হলো, কতটা হারালো, আর কতটা অর্জন করলো। তখন সে বোঝে, জীবনের স্রোত আসলে কখনোই থামে না।

বৃদ্ধ বয়সে এসে মানুষের নৌকা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, বৈঠার টান দুর্বল হয়ে আসে, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে যায়। তখন সে নিজের জীবনের নদীর শেষ পাড়ের অপেক্ষায় থাকে। কেউ শান্তিপূর্ণভাবে সে পাড়ে পৌঁছায়, কেউ আবার মাঝনদীতেই থেমে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবার গন্তব্য একটাই—নীরবতার পাড়।

মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ, সফলতা-ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা সবই সেই স্রোতের মতোই—কখনো আসে, কখনো যায়। কেউ সেই স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কেউ আবার স্রোতের ছন্দে নিজেকে গড়ে তোলে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি অনুভূতি সেই নৌকা চালানোর পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে।

জীবনের নৌকা চালাতে গিয়ে মানুষ যতবার পড়ে, ততবারই সে শেখে কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়। যতবার সে স্রোতের ঘূর্ণিপাকে আটকে যায়, ততবারই নতুন করে পথ খুঁজে বের করে। এই খোঁজাটাই আসলে জীবনের আসল সৌন্দর্য। কারণ, কোনো নৌকাই আগে থেকে নিশ্চিত করে রাখতে পারে না কখন কোন স্রোতের মুখোমুখি হবে।

মানুষের মধ্যে যারা স্থিতধী, তারা জানে, জীবনের স্রোত কখনো তাদের পছন্দমতো চলবে না। কিন্তু তারা তাদের নৌকা চালানোর দক্ষতা অর্জন করে, তারা জানে কখন ধীর গতিতে চলতে হয়, কখন জোরে বৈঠা মারতে হয়, আর কখন স্রোতের সঙ্গে তাল মেলাতে হয়। এই শিক্ষাই জীবনযাত্রার প্রকৃত প্রজ্ঞা।

জীবনের স্রোত পারাপার শুধু ব্যক্তিগত যাত্রাই নয়, বরং এটি একটি গভীর জীবনদর্শনের অনুসন্ধান। মানুষ যখন নিজের আত্মার গভীরে ডুবে নিজের অস্তিত্বের মানে খোঁজে, তখন সে বুঝতে পারে, সে আসলে এই স্রোতের যাত্রীমাত্র, স্রোত নিজে কোনোদিনই তার কাছে ধরা দেয় না। স্রোত প্রবাহমান, আর মানুষ সেই প্রবাহের মাঝখানে এক ক্ষণিক যাত্রী।

জীবনের নৌকা নিয়ে যারা নিজের স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করে, তাদের জয়ের গল্প অন্যরকম। তারা জানে কীভাবে হারতে হয়, কীভাবে হার থেকে শিক্ষা নিতে হয়, আর কীভাবে নতুন করে শুরু করতে হয়। তারা জানে, পাড়ের দেখা না পেলেও, সেই চেষ্টা করাটাই তাদের সবচেয়ে বড় জয়। কারণ, জীবনের প্রকৃত অর্থ গন্তব্যে পৌঁছানো নয়, বরং সেই স্রোত পারাপারের যাত্রাটুকুই।

তাই জীবন মানে শুধু স্রোতের বিপরীতে নৌকা চালানো নয়, বরং কখনো কখনো স্রোতের সঙ্গে তাল মেলানো, কখনো আবার স্রোতের ওপর ভেসে থাকার সাহস রাখা। জীবনের আসল বুদ্ধিমত্তা হলো, কখন কোথায় বৈঠা চালাতে হবে আর কখন ছেড়ে দিতে হবে নিজের নিয়ন্ত্রণ। এই উপলব্ধি যাদের হয়, তারাই শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রকৃত পাড়ে পৌঁছায়, হয়তো না-থাকা পাড়েও পৌঁছায় এক অভ্যন্তরীণ শান্তির জায়গায়।

জীবন এক নৌকায় চড়ে স্রোত পারাপারেরই নাম। এই যাত্রায় কোনো গ্যারান্টি নেই, নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয়। তবুও মানুষ নৌকা ভাসায়, বৈঠা চালায়, আর চেষ্টা করে ওপার দেখতে। এই চেষ্টা, এই পথ চলাই মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠতা।

নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753

https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL

মন্তব্য করুন