Skip to content

‌৪৬ – চিহ্নও কথা বলে ‌- সুপ্রিয় ঘোষ

মৈনাক টুকরো কাগজটার উপর আঁকিবুকি করছে। কলম চলছে ঠিকই কাগজের উপর, কিন্তু মন রয়েছে, অন্য কোথাও।
উপরের ঘুলঘুলির মতো ছোট্ট জানালাটার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ-ই এক টুকরো আলো এসে পড়ল, তার ঐ কাগজটার উপর। চমকে উঠল প্রান্তিক, সে যেন এক আন্তরিকতার প্রগাঢ় ছোঁয়া পেল। কেঁপে উঠল শরীর! অদ্ভুত অনুভুতির এক রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে গেল তার সারা শরীরে।
ভিতরের মুঠো মুঠো আবেগগুলো ছটফট করতে লাগল, মুক্তির যন্ত্রণা নিয়ে। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এল। সেই জলে ভেসে উঠল, স্নেহের সম্পৃক্ততার ছায়া। সেই জলো এলবামে একটা চেহারা একটু একটু করে যেন স্পষ্ট হতে লাগল।
“দাদুভাই!” একটু অস্পষ্ট স্বর প্রান্তিকের, কিন্তু বেশ জোরে। বাইরে থেকে মনে হল, একটা গোঙানি।
সেই এক মাথা পাকা চুল। চোখে সেই মোটা ফ্রেমের চশমা। দীপ্তিময় ফোকলা হাসি। কী প্রশান্তি! কী স্বস্তি ঝরানো! যেন, প্রান্তিক হাল্কা হয়ে মাটি ছেড়ে উপরে উঠছে।
এক দিব্য জোতির্ময় মূর্তি!
“কিরে দাদুভাই, কেমন আছিস ? আগে চোখের জল মোছ্। কাঁদছিস কেন ? তোর মনকে একবার জিজ্ঞাসা করতো, সেখানে কোনো অন্যায়বোধ বাসা বেঁধেছে কি ? নেই তো ?”
প্রান্তিক আড়ষ্ট গলায় বলে, ” দাদাভাই, তবে আইনের চোখে যে আমি তো অপরাধী ! সবাই তো আমায় খুনী বলে।”
“দুর বোকা, আইন তো সমাজকে নিজের পথে চালনার জন্য কিছু বাধ্যতামূলক সুরক্ষিত বন্ধনে বেঁধেছে, অমঙ্গলের স্বেচ্ছাচারীতাকে শাসন করার জন্য। সে কি কখনো মনকে বাঁধতে পারে” ?
“কিন্তু দাদুভাই, আমি তো সত্যিই খুন করেছি। একটা নয়, দু-দু’টো। বাবাকে আর বাবার বন্ধু, রজতকাকুকে ।” সেই একই ধরনের প্রশ্ন ভঙ্গিমা, প্রান্তিকের।
দাদুভাইয়ের গম্ভীর কন্ঠস্বর জেলের কূঠরিটায় অনুরণিত হয়, ” জানি দাদু, আমি সব জানি। তুই তো মায়ের সম্মান রক্ষার্থে যা’ করতে হয় তাই করেছিস। এতে আমি তোর কোনো দোষ দেখিনা। দেশমাতার সম্মান বাঁচাতে যারা সীমান্তে দাঁড়িয়ে এত খুন করছে, তাঁরা তো দেশের গর্বের বীর পুত্র। কতো বীর দেশের জন্য জেল খেটেছে। তুইও তোর মায়ের বীরপুরুষ, মায়ের সম্মান বাঁচানোর জন্য ঐ চশমখোর হিংস্র অস্বাভাবিক মানসিকতার দুই দানবকে সরিয়ে দিয়েছিস পৃথিবী থেকে। পৃথিবীতে ওদের জায়গা নেই। আমি মনে করি, এতে কোনো দোষ নেই। বরং দাদুভাই, আমি তোর জন্য গর্ব বোধ করি।”
সমর্থনের আবেগে প্রান্তিকের দু’চোখ জলে ভেসে যায়, কিন্তু সেই ছায়ামূর্তি তখনও সামনে দাঁড়িয়ে।
প্রান্তিক বলতে থাকে, ” কিন্তু এটা তো অপরাধ বলে প্রমাণিত করার বিচার চলছে, বিচার শেষ না হলেও- তার শাস্তি ভোগ করছি আমি, এখনও। কত সময় এখানে আছি, আমি জানিনা। কবে যে আবার আকাশ দেখবো, জানিনা।”
” দাদুভাই, তোকে যে কথাগুলো বলতাম, মন আছে ? অঙ্ক করাতে গিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলাম? সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কগুলো তুই এড়িয়ে যেতিস। কী বলেছিলাম সে সময়ে, মনে আছে তোর ?”
প্রান্তিক শিরদাঁড়া সোজা করে বলল, ” হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে, দাদুভাই মনে আছে। বলেছিলে যে, সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কগুলো জীবনের ধাপের প্রচ্ছন্ন নকশা। প্রতি ধাপের হিসাবের দিকে কড়া নজর দিতে। চিহ্নগুলো এক একটা এগিয়ে চলার ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষা। আমায় বুঝে নিতে হবে, ওরা কি বলছে। বিশ্লেষণ সঠিক হলেই, এগিয়ে চলার পথ মসৃণ হবে। এক একটি ধাপ ডিঙিয়ে অবলীলায় উপরে উঠতে পারবো।”
“হাঃ, হাঃ, হাঃ , হাঃ,” সেই বজ্রগর্ভ হাসি, যেন সব ভয়কে এক নিমেষে দুর করে দেয়।
“এখন আমার কী হবে, দাদুভাই? স্কুলে আমার আর পড়া হবেনা ! ত্রিদিব এখন আমার প্রথম স্থানটা দখল করে নেবে। আমি পড়ে থাকব সবার নীচে! সমাজ আর আমায় গ্রহণ করবে কি ?” কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রান্তিক।
“আরে না দাদুভাই, কী করছো তুমি ? এতো সাপ-সিঁড়ির লুডো খেলা। তোমার মনে নেই ? সাপে খেয়ে নীচে আসার পর কি খেলা শেষ হয় ? আবার চালতে থাক্, দেখবি আবার সিঁড়ি পেয়ে যাবি। হয়তো সেই সিঁড়ি একেবারেই নিরানব্বই-এর ঘরে পৌঁছে দেবে। তার পরের চালে মাত। তখন অন্য সবাই তোর অনেক পেছনে। তবে ? আমার বীরপুরুষের চোখে এভাবে বান ডাকলে কীভাবে হবে ? তুমি তাহলে মাকে কীভাবে সাহস যোগাবে ? কীভাবে বলবে তাহলে –
” …………………’দেখো না চুপ করে’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে
কী ভয়ানক যুদ্ধ হলো মা যে,
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।..” তুমিই বলো?
মায়ের কথায় অস্থির হয়ে ওঠে।
” মা, মা কোথায় এখন আছে, জানো তুমি? সেই সেদিন, ‘পাপান’ ‘পাপান’ বলে পাগলের মতো ভ্যানের পিছনে পিছনে চিৎকার করে ছুটে আসছিল। তারপর, হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মা-বলে চিৎকার করে উঠলাম, যতদূর দেখা যাচ্ছিল, ভা তখনও ওঠেনি। মা কেমন আছে, দাদুভাই, তুভি জানো ? মা তো তারপর একদিনও এখানে এলো না। কেউই এলো না, আমার সাথে দেখা করতে। শুধু এক সাহেব ফাদার…….”
ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দাদুভাই।
তারস্বরে চিৎকার করে উঠল প্রান্তিক, ” দাদুভাই, দাদুভাই, তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা। কোথায় যাচ্ছ তুমি ? আমায় নিয়ে যাও দাদুভাই। দা–দু–ভা–ই।”
একটা ঠাণ্ডা হাত কপালে ছোঁয়াতে ঘুম ভেঙে গেল প্রান্তিকের।
” কি হলো, মাই সান ? স্বপন দেখিয়াছো কি ?” ভাঙা ভাঙা বাংলায় স্নেহের পর মাখানো কন্ঠস্বর।
তাকিয়ে দেখলো চেনা এক দেবমূর্তি, যে সেই অন্ধকার কুঠরির বাইরে এনে তাকে মুক্ত আকাশ দেখিয়েছিল। শুনতে পেয়েছিল, পাখির ডাক। পেয়েছিল, নদীর ধারের স্নিগ্ধ বাতাস, সবুজ ঘাসের শান্তির আশ্বাস আর প্রকৃতির সখ্যতা। বাঁচাবার প্রেরণা।
কিন্তু হারিয়ে ফেলেছিল, পাঁচ পাঁচটি বছর। হারিয়ে ফেলেছিল মায়ের ‘পাপান’ ডাকটিও। আজ ষোলো বছরের একটি মন, একষট্টি বছরের নাব্যতা পেয়েছিল। ফাদারের এই ‘শান্তি নিকেতন’-এ কেটে গেছে আরও তিনটি বছর। সংবিধানের বিচারে সে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। মনের বয়স বেড়ে গেছে আরও অনেক বেশি।
ফাদারও যেন তার দাদুভাইয়েরই এক সহোদর যেন। মানবিক মূল্যবোধের স্থিতি, মননের গভীরতা একই। ছন্দও এক। তিনিই তাকে হাতে ধরালেন কলম। বাড়ালেন কলমের শক্তি।
ছদ্মনামে প্রান্তিকের ঊনিশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত। তার মধ্যে বেস্ট সেলার পনেরোটি। সাহিত্যপ্রেমীরা খুঁজেই চলেছে তাঁদের প্রিয় কবি, ‘মহাকাল’কে। এই ফাদারের ছত্রছায়া আড়াল করে রেখেছে তাঁকে। শেষ কাব্যগ্রন্থটিও প্রকাশিত হওয়ার দিন গুনছে।
এবারের কাব্যগ্রন্থের নামটি ফাদারের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া শব্দ সমাহার, ‘মহাকালের মৃত্যু ‘।
তৃষিত পাঠক-পাঠিকারাও গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।

@সু

মন্তব্য করুন