Skip to content

৪৫ – জোনাক জ্বলে- সুপ্রিয় ঘোষ

সকাল থেকেই আকাশের মুখভার। দু’টো গুরুত্বপূর্ণ কাজ যে করতেই হবে। টিউশন যাওয়া, আজ মাইনেটা পাওয়ার দিন। আর, ইলেক্ট্রিক বিলটা
দিতেই হবে আজকে, নাহলে রিবেটের টাকাটা যাবে।
তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিধান।
টিউশন সেরে সোজা ‘ব্লাইন্ড হাউস’। একতলাতেই
বিল জমা দেওয়ার অফিস। শনিবার, তাই ভিড়টা একটু বেশী। দাঁড়িয়ে পড়ল লাইনে।
অন্যদিন হলে, হয়তো বিরক্ত হতো। পকেট যে গরম, তাই মনটাও ফুরফুরে। মনও তো রঙ পাল্টায় পরিস্থিতির সাথে। প্রকৃতির বহুরূপতার মতো।
বিল জমা দেওয়ার পর বিধান চায়ের খোঁজ করল। রাসবিহারীর দিকে এগোতেই সামনের ফুটপাতে একটা ঝুপড়িতে চায়ের সন্ধান পেল।
চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। পাশের বেঞ্চে একজন মহিলা, বয়স প্রায় তিরিশের কাছাকাছি। কাগজের একটা পাতায় একমনে কী পড়ছে।
এমন সময়ে একটি বাচ্চা মেয়ে, তার মাকে টেনে এনে বসালো। বোঝাগেল, তিনি অন্ধ। কোলে একটা শিশু চিৎকার করে কাঁদছে।
অন্ধা বললেন, ‘দাদা,একটু গরম জল দেবেন ? বাচ্চাটাকে খাওয়াবো । সকাল থেকে দুধ খাওয়াতে পারিনি’।
চেতনার রঙে পান্না যেমন সবুজ হয়ে ওঠে, ফুল যেমন সুন্দর হয়ে যায়, ঠিক তেমনিই মাতৃত্ব জাগে চেতনাতেই, রক্তের সম্পর্ককে পরোয়া না করেই। প্রকৃত মাতৃত্ব সংকোচহীন। দেশ, কাল, জাত, ধনী, দরিদ্রের সে প্রভেদ জানেনা। এক অমোঘ অনুভূতি !
বিধানকে বললেন, ‘ভাই, তুমি একটু আমাকে পিছন ফিরে আড়াল করতো’।
তাঁর কথামতো কাজ করল বিধান। অবলীলায় তাঁর দুগ্ধভাণ্ডার খুলে গেল শিশুটির জন্য। কান্না থেমে গেল তার।
বিধান সেই মাতৃত্বের উৎসারিত বিচ্ছুরণে আপ্লুত হতে থাকল। মন বলে উঠল, ‘মা তুঝে সালাম’।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে, বাচ্চাটার তৃপ্তির ঢেকুরে সম্বিত ফেরে বিধানের। ঘুরে দেখে, আদর করে তার মায়ের কোলে তুলে দিচ্ছেন মহিলা। অন্ধার চোখে তখন কৃতজ্ঞতার অশ্রু।
‘একটু দাঁড়াবেন, যাবেন না’, বলে বিধান একটা মেডিসিন দোকান থেকে একটা দুধের কৌটো কিনে এনে, অন্ধ মহিলার হাতে দিয়ে বলল,
‘এটা ওকে খাওয়াবেন’।
একগাল হেসে ধন্যবাদ জানালেন।
বিধানের মন ভরে গেল তৃপ্তিতে। এই মাতৃত্ব ও সেই হাসি, জীবনবোধের চেতনার লকারে সযত্নে তুলে রাখল, বিধান।
হঠাৎই মোবাইলটা বেজে উঠলো। নীলুর ফোন।
ওপার থেকে নীলু, ‘বিধু তুই কোথায়’?
‘রাসবিহারীতে, কেন রে ‘?
‘আজ সন্ধ্যায় আড্ডায় আসছিস তো? সেই পুকুর ধারে’? নীলুর জোড়ালো আওয়াজ।
‘হ্যাঁ যাবো, কিন্তু যদি বৃষ্টি আসে ? আকাশের যা অবস্থা’।
‘আরে, ছাতা নিয়ে আয়। বিথী এসেছে। ও আসবে।’
ফোনটা কেটে দিল।
যথারীতি প্রতি শনিবারের সান্ধ্য বৈঠকে সকলে হাজির। চায়ের অর্ডার দিয়ে আজকের ঘটনাটা বিধান সবাইকে বলল। বিথী যেন হাঁ-করে গিলছিল।
বিধান হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা বলতো, মানুষ মানুষের কাছ থেকে কি আশা করে’ ?
নীলু বলে উঠল, ‘কেন, সম্মান, ভালোবাসা ‘ ?
বিধান বলল, ‘আংশিক সত্য ‘।
বিথী বলে উঠল, ‘আরে না, বিশ্বাস, আস্থা’।
শোভন সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার তো মনে হয়, যথার্থ ভালবাসা’।
অনেক মতামত হতে থাকল, বিধান কোনো উত্তরেই সন্তুষ্ট নয়। সে দর্শনের স্কলার।
এমন সময় অঝোর ধারায় বৃষ্টি।
তড়িঘড়ি সবাই উঠে পড়ল। একমাত্র বিথীই ছাতা আনেনি।
বিধান বলল, ‘ বিথী তুই এই ছাতার নীচে আয়’।
বিথী ইতস্তত করছিল। আর সবাই এগিয়ে গেল।
ভুলে গেল, বিথীর কথা।
একা বিধান আর বিথী। বিথীর অস্বস্তি বুঝে বলল, ‘ তুইই ছাতাটা ধর’।
জোর করে ছাতাটা ধরিয়ে বিধান বলল, ‘চল তোর বাড়ি অবধি যাই’।
বিথী ছাতা খুলে বিধানের সাথে চলতে থাকল।
দু’জনায় বাড়ি পৌঁছে গেল নিশ্চিন্তে।
বিধান শুতে যাবে, বিথীর ফোন।
‘বিধান, তোর প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা বোধহয়, গুরুত্ব’।
ফোনটা ছেড়ে দিল।
বাইরে সমস্ত অস্বচ্ছতাকে যেন ধুয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির ধারা।

মন্তব্য করুন