Skip to content

ষাটের দশকে সুবিমল বসাকের সঙ্গে — মলয় রায়চৌধুরী

ষাটের দশকে সুবিমল বসাকের সঙ্গে
………………………………………………..

ষাটের এলিট বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সুবিমল বসাক আবির্ভূত হয়েছিলেন কাউন্টারকালচারাল একজন সাবঅলটার্ন লেখক হিসাবে । নবারুণ ভট্টাচার্যের মতন তিনি অন্য মানুষদের জীবন থেকে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেননি, করেছেন নিজের নিম্নবর্ণ-নিম্নবর্গ জীবনের লাৎ খাবার অভিজ্ঞতা থেকে । সুবিমলের বর্গে শৈশবে গায়ে চামউকুন হয়, চুলে জট পড়ে, নখে ময়লা জমে, ময়লা নখ নিয়েই ভাত-ডাল মাখতে হয়, রাস্তার কলে স্নান করতে হয়, দেনার দায়ে বাপ আত্মহত্যা করলে কৈশোর থেকে সংসার চালাতে হয় । তাই মধ্যবিত্ত জীবনে পৌঁছেও এলিটদের সংস্কৃতিতে ঢোকার অনুমতি পান না সুবিমল বসাক । আসলে, যে বিদ্যায়তনিক আলোচক এলিট সংস্কৃতির প্রডাক্ট, তিনি তাঁর দোসরদের খোঁজ করেন পাল্প ফিকশানে, কেননা প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়া ছাড়া পাল্প ফিকশান শেকড় পায় না ।

উকুন জানতুম, চুলে হয়, বলতে গেলে দেখা যায় না, মাথার চুলে খুঁজে-খুঁজে বের করে টিপে মারতে হয়, বাঁদরদের মতন । ব্যাংকশাল কোর্টে মামলার সময়ে, রাতের বেলায় সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের বইঠকখানার স্যাকরার প্রায়ান্ধকার দোকানঘরে মাদুরে শুয়েছিলুম, সুবিমল বলল, শালা, তোমার গায়ে চামউকুন হয়ে গেছে । সুবিমল আমার গা থেকে ছোটো ছারপোকার মাপের একটা চামউকুন তুলে বলল, পনেরোদিন স্নান করোনি, আদালতের পাবলিকদের সঙ্গে ওঠাবসা করছ, গায়ে চামউকুন হয়ে গেছে, বিহারিদের মতন । সত্যিই, ফৌজদারি আদালতে এতো রকমের ক্রিমিনাল জড়ো হতো যে সাবধানে না থাকলে খোস-পাঁচড়া, আর নানা ছোঁয়াচে রোগও হয়ে যেতে পারতো । কলকাতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় দিনের পর দিন স্নান হতো না ; ততোদিনে চামউকুনরা নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে ফেলতো আমার গায়ে ।

হাংরি আন্দোলন মামলার সময়ে কলকাতায় রাতের বেলায় যেখানে হোক মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে হতো ; সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকান ছিল লাস্ট রিসর্ট । রিসর্ট !! চামউকুন বাছার রিসর্ট । ওর এক আত্মীয়ের বাড়ির দালানে মাদুরে শুয়ে রাত কাটিয়েছি । ওই পাড়ায় কোথাও ওর ব্যর্থ প্রেমের নায়িকা থাকতেন ।

চামউকুন যে কেমনতরো উকুন, তা অন্য হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলুম, কখনও দেখেনি । একটা চামউকুন মেরে কাগজে মুড়ে সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্তকে দেখিয়েছিলুম । বাসুদেব তখন বেবি-দীপ্তি-মীরার রেগুলার খদ্দের । সেই পাড়াতেও কারোর গায়ে চামউকুন দেখেনি ।

সুবিমল বসাক পাটনাতেই থাকতো, গান্ধি ময়দানের ওই পারে, পশ্চিম দিকে, গোলঘর নামে ব্রিটিশদের তৈরি একশো চুয়াল্লিশ পাকানো সিঁড়ির ঢাউস খামারবাড়ির কাছে ; গিন্সবার্গকে নিয়ে উঠেছিলুম ওই খামারবাড়ির টঙে, নেমে ভেতরে ঢুকে গিন্সবার্গ ওর ‘সানফ্লাওয়ার সূত্র’ কবিতা চেঁচিয়ে আবৃত্তি করার পর আফশোষ করেছিল যে একটা রেকর্ডার আনা উচিত ছিল ।

পাটনায় থাকলেও সুবিমল বসাকের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না ; ও পড়তো পশ্চিমের কোনো স্কুলে আর আমি পূর্বদিকের রামমোহন রায় সেমিনারিতে । তবে ওদের পরিবারের কথা বাবা জানতেন ; বলেছিলেন যে ওর বাবা নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছিলেন । কারোর বাবা আত্মহত্যা করলে তাঁর ছেলের মনে কেমন প্রতিক্রিয়া হয় ? কে জানে, আমার পক্ষে ভেবে ওঠা কঠিন । আমার খুড়তুতো বোন পুটি কড়িকাঠ থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল বাছুরের গলা থেকে দড়ি খুলে ।

‘দুরুক্ষী গলি’ নামে একটা উপন্যাস লিখেছে সুবিমল, ওর আত্মজীবনী, তাতে সোনার গয়না যে কতো ধরণের হতো আর তাদের বিস্ময়কর নাম ছিল, তা ওর ‘দুরুক্ষী গলি’ পড়ে জানা যায় । আমার মনে হয় এটা ওর সেরা উপন্যস, ধরা পড়ে আর্থসাংস্কৃতিক আর ঐতিহাসিক যুগলক্ষণ, আর সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হতে-থাকা আত্মনির্ভর স্যাকরাদের ইতিহাসও বটে । পুঁজিবাদী স্বার্থের নিরিখে যখন সাহিত্যিকদের খ্যাতি বিবেচিত হচ্ছে, তখন বঙ্গসংস্কৃতিতে হঠাৎ ঢুকে পড়া ব্যাণ্টামওয়েট মুষ্ঠিযোদ্ধার আদলে ময়লা এক যুবক নিজের লেখালিখিকে নিয়ে গিয়েছে কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটির বাইরে ।

সুবিমল পাটনা থেকে কলকাতায় চাকরি করতে গিয়েছিল বলে জানতো যে এখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকলে রাতে কতো বিপদে পড়তে হয় । অন্য হাংরি আন্দোলনকারীরাও অনেকে কলকাতার বাইরে থেকে পৌঁছেছিল, কিন্তু কেউই রাতের বেলায় থাকতে দিতে রাজি হয়নি, নানা অজুহাত দেখিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে ।

কলকাতায় হাংরি আন্দোলনের খবর পেয়ে সুবিমল বসাক জানতে পেরেছিল যে বুলেটিন ছাপাবার ইংরেজি ম্যাটার আর টাকাকড়ি আমিই দিই, তাই ১৯৬৩ সালের কোনো এক সময়ে আমার সঙ্গে পাটনায় দেখা করতে এসেছিল, আন্দোলনে যোগ দেবার উদ্দেশে । একদিক থেকে ভালোই হলো, ভেবেছিলুম, ঠিকই ভেবেছিলুম, কেননা চাষি পরিবারের হারাধন ধাড়া তখন নিজের পিতৃদত্ত নাম নিয়ে হিমশিম, এফিডেভিট করে দেবী রায় হবার নির্ণয় নিয়ে ফেলেছে ।

ঢাকার তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাকের নিম্নবর্গ নিয়ে তেমন মনোভাব ছিল না, যখন কিনা ওর বাবা স্যাকরা ছিলেন । দেবী রায় যেমন থাকতো হাওড়ার বস্তিতে, সুবিমল বসাকের বাড়ি গিয়ে দেখলুম, ওদের বাড়িও নিম্নবর্গ বিহারি এলাকায়, আর বাবা না থাকায়, একটা আধখেঁচড়া বাড়িতে বসবাস করে ওকেই ভাইদের বড়ো করে তুলতে হচ্ছে । কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছিল সাহিত্যের আকর্ষণে । কিছুকাল আগে নিম্নবর্গের জন্য নির্ধারিত একটা পুরস্কারও পেয়েছে সুবিমল । অনুবাদের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমির পুরস্কার পেয়েছে ।

সুবিমল কাজ করতো ইনকামট্যাক্স দপতরে, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে । ও স্কেচ আঁকতে পারতো, উড-কাট করতে পারতো । তখন এসট্যাবলিশমেন্টের কর্তাদের ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ ছাপানো রাক্ষস জীবজন্তু ইত্যাদির মুখোশ, হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিলি করা সারা হয়ে গেছে, বিয়ের কার্ডে ‘Fuck the bastards of Gangshalik school of poetry’ ছাপিয়ে বিদ্যায়তনিক কবিদের পাঠানো হয়ে গেছে, কলকাতার মালিকরা ব্লাস্ট ফারনেসে টগবগ করে ফুটছে, সুবিমল বলল যে, ও এবার নানারকম স্কেচ এঁকে স্টেনসিলে একশো কপি ছাপিয়ে বিলি করবে, হাংরি আন্দোলনের নতুন ধরনের বুলেটিন । আমি একটা চার্ট তৈরি করেছিলুম, উনিশ নম্বর হাংরি বুলেটিন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল, তার স্টেনসিলও সুবিমল তৈরি করে দিয়েছিল । চার্টে দেখানো হয়েছিল যে বাঙালি কবিদের পূর্বপুরুষরা কবিয়াল ছিলেন ; পূর্বপুরুষরা সকলেই নিম্নবর্ণের ছিলেন বলে আধুনিক কবিরা বেশ চটে ছিলেন ।

মজার ছিল বুলেটিনগুলো, মধ্যবিত্ত কবি-লেখকদের ওয়াটারশেডের ওপর থেকে ঠেলে ফেলার জন্য যুৎসই । কয়েকটা মনে আছে : একজন তরুণীর সারা শরীর জুড়ে স্তন, একজোড়া পায়ের স্কেচ যা দেখলেই টের পাওয়া যায় যে মানুষ-মানুষী মিশনারি আঙ্গিকে ছিল, সামনা-সামনি যুবক-যুবতী যা দেখে মনে হবে ফুলদানি, এরকম বহু বুলেটিন, সপ্তাহে একটা করে। নিজের বইয়ের আর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ পত্রিকার প্রচ্ছদও নিজেই আঁকতো সুবিমল । কেবল ওর ‘ছাতামাথা’ বইয়ের প্রচ্ছদ আমি পেপার কাটিং দিয়ে তৈরি করে দিয়েছিলুম । ‘ছাতামাথা’ বইয়ের উৎসর্গপত্রের আইডিয়াটাও দিয়েছিলুম ।

সংবাদপত্র দপতরে গিয়ে ব্ল্যাংক কাগজকে ছোটোগল্প হিসাবে জমা দেয়া আর রিভিউ করার জন্য বাচ্চাদের চটির বাক্স ব্রাউন কাগজে মুড়ে জমা দেবার ব্যাপারে সুবিমলও গিয়েছিল আমার সঙ্গে । এর জন্য শক্তি চট্টোপাধ্যায় খচে কাঁইবিচি, সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে আমাকে আর সুবিমলকে প্যাঁদাবার জন্য কফিহাউসের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন । কফিহাউসের সিঁড়ির কাছে ইসমাইলের পান-সিগারেটের দোকানে লোহার রড লুকিয়ে রাখা হয়েছিল মার দেবার জন্য । নিচে নামতেই প্যাঁদাবার জন্য ঘিরে ধরা হয় । সুবিমল সেসময়ে ব্যাণ্টাম ওয়েট বক্সার, হুমকি দিয়ে তেড়ে ভোজপুরি গালমন্দ করতেই সব দেদ্দৌড়, যারা ঘিরে ধরেছিল তারা তো বটেই, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষরাও । পরে জানা গিয়েছিল যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যেমন আয়ওয়া থেকে হুমকিচিঠি পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা, তেমনই পেয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় – উনি তখন সবে সহসম্পাদকের চাকরির অফার পেয়েছেন ।

পশ্চিমবাংলায় সেই সময়ে রিফিউজিরা সোভিয়েত দেশে বাংলায় অনুবাদ করা মার্কস-এঙ্গেলস পড়ে-পড়ে বামপন্হী হবার দৌড়ে শামিল । বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ আর অরুণেশ ঘোষও বই পড়ে ঢুকেছিল জমায়েতে, সবায়ের দেখাদেখি । পরে ওদের বক্তব্য ছিল যে মফসসলে বেঁচে থাকতে হলে এছাড়া উপায় ছিল না । ওদের বক্তব্যে যুক্তি ছিল, কেননা প্রমোদ দাশগুপ্ত ক্যাডার পাঠিয়ে স্কুলগুলো আর ক্লাবগুলো স্ট্যালিনি কায়দায় দখল করছিলেন । পরে তারা ইংরেজির এমন পেছন মেরে দিল যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ইউপিএসসির পরীক্ষাগুলোয় কেউই প্রতিযোগীতা করতে পারে না, দলে-দলে পালিয়েছে-পালাচ্ছে বাইরের রাজ্যে বা বিদেশে ।

বই পড়ে যা হয়, বামপন্হীরা জোটবেঁধে নিজেদের আখের গুছিয়ে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগীতায় মাতলো আর বামপন্হাকে ডোবালো । সুবিমল বসাক ওই সব বই পড়াপড়ির দিকে যায়নি, ওর আগ্রহ হয়নি, নিজের জীবনে যতো লাৎ খেয়েছিল, ওর দরকার ছিল না বই পড়ে সেসব জানা-বোঝার । লাৎগুলো ও প্রয়োগ করেছে ওর লেখায়, কবিতা-গল্প-উপন্যাসে । মনে রাখা দরকার যে সুবিমল যখন লেখালিখি আরম্ভ করে, তখন কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সাহিত্যিকরা দল বেঁধে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের অনুগামী করে তুলেছিলেন ।

সুবিমল বসাক ‘ছাতামাথা’ নামে একটা ফিকশানে হাত দিলো, হাংরি আন্দোলনের ডামাডোলের মাঝেই, যেখানে সুযোগ পেতো লিখতে বসে যেতো । আমি আইডিয়া দিয়েছিলুম যে আমরা যেহেতু এসট্যাবলিশমেন্টের লিটেরারি ভ্যালুজকে রিভার্স করে দিচ্ছি, ‘ছাতামাথা’ ফিকশানের সংলাপ লেখো কলকাতার বুলিতে আর ন্যারেটিভ লেখো ঢাকার কুট্টিদের বুলিতে । কুট্টিদের বুলি নিয়ে সুবিমল প্রায়ই রগড় করতো । ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’ এর ধরতাইকে ছিৎরে লাট করে দিয়েছিল ‘ছাতামাথা’, প্রধানত ট্রান্সকালচারালাইজেশনের বিরুদ্ধে স্হানিকতাকে প্রয়োগ করে ।

এখন বাংলাদেশে একটা বিদ্যায়তনিক ধুয়ো উঠেছে যে কলকাতার ভাষা বর্জন করে বাংলাদেশের কথ্যবুলিকে ভাষার পর্যায়ে উন্নীত করা হোক, তাইতে সাহিত্য রচিত হোক, অথচ যখন আমি ওনাদের বলি যে সুবিমল বসাক অলরেডি এই কাজ পাঁচ দশক আগে করে ফেলেছেন, তখন ব্রাত্য রাইসু আর সলিমুল্লা খানরা কানে তুলো দিয়ে থাকেন । সুবিমল বসাকের গদ্য আর পদ্য কাল্পনিক নিম্নবর্গীয় নয় । প্রতীকি নয়, তা রিয়্যাল ফ্লেশ অ্যান্ড ব্লাড । খোলনলচে পালটে ফেলার জন্য যতো ধরণের টেকনিক সম্ভব, ব্যবহার করেছে সুবিমল । তাকে যদি কোনো আলোচক অ্যানার্কিক বলে তকমা দেন, তাহলে তাই সই ।

নকশাল আন্দোলনের ঠিক আগে বেলঘরিয়ায় জমি কিনে সুবিমল নিজের আস্তানা গড়ে ফেলল, চারিদিকে সুনসান, তখনও বাড়িঘর তেমন হয়নি, সেখানে হাংরি আন্দোলনকারীরা জমায়েত হবার নিরিবিলি খুঁজে পেলো । ফালগুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র আর ওর প্রেমিকা আলো মিত্র, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই, কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় আর বিদেশ থেকে যারা আসতো, যেমন ট্রেশম গ্রেগ, ডেভিড গারসিয়া, জর্জ ডাউডেন, নেপালি কবি পারিজাত যিনি আমার প্রেমে পড়েছিলেন এবং যাঁকে নিয়ে আমি বেশ কিছু প্রেমের কবিতা লিখেছিলুম ।

নকশাল আন্দোলনের সময়ে সুবিমল বসাকের বাড়ির সামনে প্রায়ই গোষ্ঠী-খুনোখুনি হতো, পুলিশও লাশ হাপিশ করার অন্ধকার খুঁজে পেতো । সুভাষ ঘোষ কিছুদিন ওর আস্তানায় ছিল আর সুবিমলের কাছে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত যে কাটিঙের ফাইল ছিল তা নিয়ে শৈলেশ্বর ঘোষের শালা সুভাষ কুণ্ডুকে দিয়েছিল । অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ছিল সেটা, হাংরি আন্দোলনের সমস্ত কাটিঙ সংগ্রহ করে হাইকোর্টের ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়কে দিয়েছিলুম । বহু সংবাদপত্রে আমার আর অনেক সময়ে আমার আর দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল, হাংরি আন্দোলনের গবেষকদের কাজে লাগতো । সুভাষ ঘোষের আত্মীয় ছিল সুভাষ কুণ্ডু, শৈলেশ্বর ঘোষের শালা হবার সূত্রে।

সুবিমল বসাক ওর রিভার্স ন্যারেটিভ টেকনিক বজায় রেখে কবিতা লিখল পূর্ববঙ্গের বুলিতে, অথচ সেগুলো কেন নজর কাড়লো না বলা কঠিন, কেননা আইরিশ ভাষায় সিমাস হিনির লেখা কবিতা ইংরেজি পত্রিকায় নিয়মিত আলোচিত হয়েছে । সুবিমল ছোটোগল্প লেখা আরম্ভ করল কলকাতাবাসী অবাঙালি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, তাদের কথাবার্তায় যে বদল ঘটে গেছে তা প্রতিফলিত হলো ওর গদ্যে । বহুকাল অবহেলিত ছিল ওর বইগুলো । এখন তন্ময় ভট্টাচার্যের উদ্যোগে সৃষ্টিসুখ থেকে সেগুলো খণ্ডে-খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছে । সুবিমল বসাক ওর মায়ের কাছ থেকে আর বৃদ্ধা আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে ‘ঢাকাই বিয়ার গীত’ সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিল । একটা ‘কুসংস্কার সংকলন’ও প্রকাশ করেছিল ।

হাংরি আন্দোলন মামলার সময়ে সুবিমল বসাকই শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিল । ওর অফিস থেকে চলে আসতো ব্যাংকশাল কোর্টে, আমার মামলার ডেট পড়লে । সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত সব হাওয়া হয়ে গিয়েছিল । আমি পাটনায় গেলে সুবিমল আমার উকিলদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো । হাইকোর্টের জুনিয়ার ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো । হাইকোর্টে আমি মামলা জিতে গেলে সুবিমলই কোর্ট থেকে রায়ের কপি নিয়ে আমাকে পাঠিয়েছিল পাটনায় ।

তবে সুবিমলের একটা ধারণা ভুল । নব্বুই দশকে আমি আমার কলকাতা অফিসে বিভাগীয় প্রধান হয়ে ফেরার পর শৈলেশ্বর, সুভাষ, প্রদীপের সঙ্গে দেখা করেছিলুম । সুবিমলের সঙ্গেও । তাকে সুবিমল ভেবেছিল আমি হাংরি আন্দোলন রিভাইভ করতে চাইছি । আসলে আমি যে ইতিমধ্যে প্রচুর পড়াশুনা করে ফেলেছি, ভারতের বহু গ্রামে ঘোরাঘুরি করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তার হদিশ পায়নি সুবিমল । যাই হোক, আমার নতুন লেখালিখি নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে সুবিমল নিজেই বলেছে যে আমার লেখার ধরন আর ভাবনাচিন্তা পুরো পালটে গেছে ।

‘ছিটেফোঁটা’ পত্রিকার বইমেলা ২০১০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যায় কলিম খান এই কথাগুলো সুবিমল বসাক সম্পর্কে লিখেছিলেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :

“আধুনিকতাবাদী, অ্যাকাডেমিশিয়ান, প্রগতিপন্হি, কমিউনিস্ট-সাম্যবাদী, মৌলবাদী, হাংরি, উগ্রপন্হী… বহু রকম মানুষই আমরা চারিদিকে দেখতে পাই; এবং তাঁদের নেতৃস্হানীয়রা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত স্বাতন্ত্র্যাভিমানী।স্বাতন্ত্র্যের অভিমানের মধ্যে সকলের থাকে বিশেষ হওয়ার, পৃথক হওয়ার প্রবণতা থাকে। তথাকথিত সাম্যবাদীদের মধ্যে তো স্বাতন্ত্র্যের অভিমান সবচেয়ে বেশি, যদিও স্বাতন্ত্র্য সাধারণভাবে বিশেষবাদী বা অসাম্যবাদী। বিপরীতে দেখা যায়, গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে, তথাকথিত ধর্মভিরু সাধারণ মানুষদের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অভিমান সবচেয়ে কম। তাঁদের ভিতরে সকলের থেকে পৃথক বা আলাদা হয়ে থাকার কোনো প্রবণতা দেখা যায় না, বিপরীতে মিলে-জুলে থাকার প্রবণতা দেখা যায়। বাংলা ভাষার শব্দার্থতত্বের বিচারে এরকম মানুষদেরই ‘সুন্দর’ মানুষ বলতে হয়। সেই হিসেবে শ্রী সুবিমল বসাকও সুন্দর মানুষ।

১৯৯৬ সালে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। বিগতকালের হাংরি আন্দোলনের এক বিদগ্ধ আত্মারূপেই আমি তাঁকে চিনেছিলাম। একালের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যাবাদী সমাজে সকল সামাজিক সত্তার ও প্রতিষ্ঠানাদির যেমন কেন্দ্র ও প্রান্ত হয়ে থাকে, হাংরি আন্দোলনেও সেইরূপ কেন্দ্র-প্রান্ত ব্যাপার ছিল। কেন্দ্রে যখন মলয় রায়চৌধুরী সগৌরবে বিরাজিত ছিলেন, তখন প্রান্তে ছিলেন সুবিমল বসাক। কালধর্ম তাঁকে যে-কলঙ্ক বা গৌরব দিয়েছিল, তা সবই তখন মলিন হয়ে এসেছিল। তাঁর স্বভাবের মধ্যে সেসবের রং-রূপ, তেজ-ছটা আমার চোখে খুব একটা পড়েনি। যেটি পড়েছিল, তা হল তাঁর নিষ্কলুষ আত্মার দীপ্তি। প্রথম আলাপেই বুঝেছিলাম, এই মানুষটির সঙ্গে নির্বিবাদে ঘর করা চলে।

কলকাতার বাংলা সাহিত্যের জগতে আমার অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৭-৯৮ সালের মধ্যেই আমি টের পেয়ে যাই, এই জগৎ অত্যন্ত কলুষিত হয়ে গেছে। ভাল সাহিত্যিক তো পরের ব্যাপার, আগে তো ভাল মানুষের সাক্ষাৎ পেতে হবে। এখানে যে ভাল মানুষের দেখা মেলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে! কার্যত আজকের কলকাতায় বঙ্গসাহিত্যের সারস্বত ব্রহ্মলোকে ভালমানুষের দেখা পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে। যাঁরা মানিষ হিসেবেই কলুষিত, তাঁরা ভাল সাহিত্যিক হবেন, এমন আশা করা খুবই ত্রুটিপূর্ণ এবং দুরাশা মাত্র। তারই মাঝে যে আমি দু’চারজনকে ভালো মানুষ রূপে পাই, তাঁদেরই একজন শ্রী সুবিমল বসাক। ২০০০ সাল থেকে আমি সেমিনার, সাহিত্যসভা ইত্যাদিতে যাতায়াত বন্ধ করে দিই এবং অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে একান্তে নিজের কাজ করতে থাকি। সেই একান্ত সময়েও যাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কমবেশি অক্ষুণ্ণ থাকে, শ্রী সুবিমল বসাক তাঁদের একজন। তাঁর সান্নিধ্য আমার খুবই ভাল লাগত। তাঁর ভালমানিষির গন্ধ মনেপ্রাণে মাখামাখি হয়ে যেত। মনে পড়ত সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই অমোঘ বাণী — ‘কয়লাওলার সাথে দোস্তি, ময়লা হতে রেহাই নাই/ আতরওলার বাক্স বন্ধ, দিল খুশ তবু পাই খুশবাই।’ শ্রী সুবিমল বসাকের সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কেননা, তাঁর সাহিত্য আমার মস্তিষ্কের স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায়নি বলে তা আমার উপভোগ্য হয়নি। অতএব, যা আমি ভাল করে উপভোগ করিনি, তা রসাল ও সুস্বাদু কি না, বলদায়ক কি না, উপাদেয় কি না, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে আমি পারব না। কিন্তু মানুষটি যে আমার খুবই আপনজন রূপে গৃহীত হয়েছিলেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাঁকে আমি ‘সুন্দর মানুষ’ বলেই চিনেছিলাম, চিনেছি, ভালবেসেছি।”

সুবিমলের ‘’হাবিজাবি’ কবিতা দিয়ে চামউকুন পর্ব শেষ করছি :-

আমারে মাইরা ফেলনের এউগা ষড়যন্ত্র হইসে

চারো কোনা দিয়া ফুসফুস আওয়াজ কানে আহে

ছাওয়াগুলান সইরা যায় হুমকে থিক্যা

অরা আমারে এক্কেরে শ্যায করতে সায়

আমি নিজের ডাকাইতে্ যা হাতেরে লইয়া সচেত্তন আসি

কেউ আইয়া চ্যারায় দিশায় চ্যাবা কথা কয় না

আমি সুপসাপ থাকি

ভালাসির গুছাইয়া আমি কথা কইতে পারি না

২ কইতে গিয়া সাত হইয়া পড়ে

১৫ সাইলে ৯ আইয়া হাজির হয়

ছ্যাব ফেলনের লাইগ্যা বিচড়াইতাসি অহন

আহ, আমার দাঁত মাজনের বুরুশ পাইতাসি না

বিশ্বাস করেন, কেউ একজনা আমার মুহের সকরা খাবার খাইসে ।

(হাংরি বুলেটিন নং ১৮ থেকে)

মন্তব্য করুন