Skip to content

মায়ের কাছে চিঠি – রানা চৌধুরী

কুসুমপুর।
লতাপাতায় ভরা গাছ-পালায় ঘেরা ছোট্র একটি গ্রাম। টিনের চালা ও বেড়ায় আবর্তিত তার ঘর-বাড়ি। গ্রামের পাশে স্কুল মাঠ। মাঠের পাশ ঘেষে আছে শাপলা ও পদ্মফুলে ভরা ছোট একটি পুকুর । ছোট বলতে তেমন ছোট নয়, প্রায় আধাবিঘে জায়গা জুড়ে রয়েছে পুকুরটি। বিকেল বেলা স্কুল মাঠে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা হই হুল্লোড় আনন্দ উল্লাস ও খেলাধুলা করে। তাদের মনে খুশির সীমা নেই। কিন্তু একটি ছেলে উদাস মনে স্কুলের বারান্দায় বসে থাকে। তার মনে কোনো আনন্দ নেই, নেই কোনো উচ্ছাস। ছেলেরা তাকে খেলতে ডাকে-
-এই রতন আয় ক্রিকেট খেলি।
কিন্তু কোনো উত্তর নেই। আবার ডাকে-
-কী হলো আয়।
তবুও সে সাড়া দেয়না। খেলাধুলা তার ভালো লাগেনা বোধ হয়। কিন্তু না তা নয়। খেলাধুলা তার ভালো লাগে কিন্তু সে খেলে না। কেন খেলে না? আর কেনই বা সে উদাস মনে একাকী বসে থাকে?
সন্ধ্যাবেলা সূর্যটা যখন মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে আধারকে আহ্বান জানায়, মসজিদে মুয়াজ্জিনের মধুর কন্ঠে আযান ভেসে আসে। ছেলে মেয়েরা তখন নাচতে নাচতে ঘরে ফিরে। কিন্তু রতন নিস্তব্ধ মনে ধীর পায়ে হেটে যায় বাড়ির দিকে। সবাই যখন বই নিয়ে পড়তে বসে তখন সে পেন্সিল দিয়ে খাতার মধ্যে অর্থহীন আঁচড় কাটে।বাবা তাকে ধমক দিয়ে বলে-
-রতন! কী করছিস এসব?
বলেই ওর পিঠে কষে একটা মার দেয়। কিন্তু ও সেই আঘাতের ব্যথা নীরবে সহ্য করে বই পড়তে শুরু করল। সকালবেলা ছেলে-মেয়েরা হই হুল্লোড় করে। স্কুলে যাওয়ার আগে পুকুরে গোছল করে। কিন্তু রতন পুকুরে নামে না। বাড়িতে কুয়োর পানিতে গোছল করে। স্কুলের ঘণ্টা পড়লে ছেলে-মেয়েরা দল বেধে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে উৎফুল্ল মনে স্কুলে যায়। রতন এক হাতে বই নিয়ে একাকী নীরব চিত্তে চলে। সে কারোর সাথে গল্পও করেনা ঝগড়াও করেনা। তবে সে লেখাপড়ায় খুব ভালো ছাত্র। শিক্ষক-শিক্ষিকা তাকে খুব ভালবাসে। তারা ওকে হাসি খুশি রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু ওর মুখে হাসি ফোটে না। স্কুল ছুটি হলে ছেলেমেয়েরা নাচতে নাচতে ছড়া কাটতে কাটতে বাড়ি যায়। কিন্তু রতন একই রকম নীরব।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে ডুব দিল, চাঁদটা যখন মৃদু আলো ছড়িয়ে দিল; রতন তখন বই খাতা নিয়ে বসে পড়ল। বই খুলে তার মাঝখানে খাতা রাখল। কলম হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করল। কী লিখছে? আর কাকেই বা লিখছে?
সে তার মাকে চিঠি লিখছিল। তার মা মারা গেছে। যখন রতনের বয়স ছিল তিন বছর তখনই ওর মা ওকে নিষ্ঠুর এই দুনিয়াতে একা রেখে ঐ দুর আকাশে চলে গেছে। সবাই তাদের মাকে মা বলে ডাকে কিন্তু রতন ডাকতে পারেনা। কাকে সে মা বলে ডাকবে? দুনিয়ায় তো ওর মা নেই। সবাই তাদের মায়ের আদর ভালবাসা পায়। রতন সেই ¯েœহ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত। তার বাবাও তাকে আদর করেনা। সব সময় বকে আর মারে। রাতে বিছানায় শুয়ে মায়ের কথা মনে করে নীরবে কাঁদে। কেউ তার কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়না। কেউ চোখের জলও দেখতে পায়না। সে একাকী নির্জনে কাঁদে। তার দঃখের বোঝা সে একাই বয়ে বেড়ায়। মনের দুঃখ চেপে রাখতে না পেরে সে তার মায়ের কাছে চিঠি লিখছে-
মা,
জানিনা তুমি কেমন আছো। আমি তোমার সেই ছোট্র রতন। আমাকে চিনতে পারছ? নাকি ভুলে গেছো? যখন তোমার হাত ধরে হাটতে শিখেছি তখনই আমাকে ছেড়ে চলে গেছো। জানো মা? তোমার কথা মনে পড়লে কোনো কিছুই আমার ভালো লাগেনা। রাতে যখন ঘুমাতে যাই তোমার কথা ভেবে নীরবে কাঁদি আর ভাবি যদি তুমি থাকতে তাহলে আমাকে ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে। সকালে আমাকে আদর জড়ানো কন্ঠে ডেকে আমার ঘুম ভাঙাতে আর আমি ঘুমের ভান করে তোমার কোলে মাথা রেখে তোমার আদর মাখা হাতে ছোঁয়া নিতাম।
জানো মা? নয়নকে ওর মা কত ভালবাসে? প্রতিদিন ওকে ঘুম পাড়ানি গান শোনায়। সকালবেলা আদর করে ওর ঘুম ভাঙায়। স্কুলের সময় হলে নিজ হাতে গোছল করায়, খাইয়ে দেয় ও সাজিয়ে দেয়। কিন্তু আমাকে কেউ আদর করেনা, ঘুম পাড়ানি গান শোনায়না, গোছল করায় না, খাইছের দেয় না। কে বা দেবে বল? আমার তো আর মা নেই। তাই আমার মনে অনেক দুঃখ ও কষ্ট। সেই কষ্ট বুকের মাঝে চেপে রেখে নীরবে কাঁদি। বাবাও আমাকে একটু আদর করেনা। কথায় কথায় বকে আর মারে। শুনেছি তুমি নাকি ঐ দূর আকাশে গিয়ে তারা হয়ে গেছো? জোৎ¯œা রাতে তোমার মতো সবাই নাকি চাঁদের সাথে দল বেঁধে একসাথে ঘুরে বেড়াও?
মা! তারাদেও মাঝে তোমাকে আমি কত খুজি! জ্বোসনা রাতে পুকুর ধারের লিচু গাছটার নিচে বসে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। কিন্তু সব তারা তো একই রকম। তার মাঝে কোনটা তুমি বুঝতেই পারিনা। সেই লিচু গাছটা যেটা তুমি নিজ হাতে লাগিয়েছিলে। জানো মা? সেই গাছটা না দিনের বেলা ছায়া আর মৃদু হাওয়া দিয়ে আমাকে সান্ত¦না দেয়, কিন্তু রাতের আধারে সেও নীরবে কাঁদে। ওর চোখের জল গড়িয়ে পড়ে পাতায় আটকে থাকে। আমি দেখেছি ওর কান্না। তুমি নেই বলে সেও কাঁদে।
মা! তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে পারলে? তুমি কী আমার দুঃখ বুঝতে পারো না? নাকি আমায় ভুলে গেছো? মা! আমি তোমার কাছে যেতে চাই। তুমি আমাকে আদও করবে, গোছল করিয়ে দেবে। আমার চোখে ঘুম এলে আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকব আর তুমি আমাকে ঘুম পাড়ানি গান শোনাবে। শুধু ঘুম পাড়ানি গানই নয় থুমি আমকে জলপরি কাঠুরিয়া, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, রাজা বাদশা ও রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প শোনাবে। শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়ব। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখব। অনেক স্বপ্ন যার কোনো শেষ নেই। স্বপ্নে আমি হব রাজকুমার। কাধি তীর ধনুক, হাতে তলোয়ার নিয়ে জঙ্গলে যাবো শিকার করতে। যখন শিকার করে ঘাম ঝড়ানো ক্লান্ত শরীরে রাজপ্রাসাদে ফিরব তখন তুমি তোমার শাড়ীর আঁচল দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিবে। কখোনো বা স্বপ্ন দেখব সাদা ঘোড়ায় চড়ে ঢাল –তলোয়ার হাতে নিয়ে বীর বেশে রাজ্য জয় করতে বেরিয়েছি। শত শত শত্রুসেনাকে আমার তলোয়ারের আঘাতে বিপর্যস্ত করে তাদেরকে পরাজিত করে একের পর এক রাজ্য জয় করছি। কিন্তু কার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে এসব স্বপ্ন দেখব? তুমিই তো আমার পাশে নেই।
মা! আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। এত বড় নিষ্ঠুর পৃথিবীতে তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার ভালো লাগেনা। আমি তোমার কাছে চলে যেতে চাই ঐ দুর আকাশে, যেখানে তুমি তারা হয়ে শুন্যেও মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছ। আমি সেখানে গিয়ে তারা হয়ে তোমার পাশে পাশে থাকব। তোমার মত হাওয়ার মাঝে ভেসে বেড়াব। যখন ক্লান্ত হব, তুমি আমাকে তোমার বুকে টেনে নেবে। তোমার শাড়ীর আঁচল দিয়ে আমার ঘামে ভেজা কপাল মুছে দিবে। আর আমি তোমার কোলে মাথ রেখে শুবো। তুমি তখন ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াবে। ঘুমের মধ্যে আমি সেই রাজা-বাদশার স্বপ্ন দেখব।
আচ্ছা মা! তুমি যে আকাশে থাকো সেখানে কী পৃথিবীর মতো নদী-নালা, পুকুর, গাছপালা ও খেলার মাঠ আছে? থাকলে আমি সেই মাঠে খেলাধুলা করব, গাছে চড়ে পাঁকা পাঁকা ফল পাড়তাম, নদীতে সাঁতার কাটতাম। আচ্ছা মা! তুমি কিসে চড়ে ঐ আকাশে পাড়ি দিয়েছ? বিমানে নাকি রকেটে? শুনেছি বিমান আর রকেট ঐ আকাশের উপর দিয়ে উড়ে যায় আবার ফিরে আসে। তুমি রকেটে চড়ে চলে আসো মা। এসে আমাকে নিয়ে যাও। আমি তোর্মা কাছে চলে যেতে চাই। তোমার আদর সোহাগ পেতে চাই। মা তুমি আসবে তো? নিয়ে যাবে তো আমায় তোমার কাছে? তুমি তাড়াতাড়ি এসে আমায় তোমার কাছে নিয়ে চলো। আমি কিন্তু তোমার আসার পথ চেয়ে থাকব। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো আমাকে নিয়ে যাও। আমি সেই লিচু গাছটার নিচে বসে থাকব তোমার জন্য।
ইতি
তোমার দুঃখে ভরা ছোট্র
রতন
মায়ের কাছে চিঠি লিখে সেই চিঠি বুকের মাঝে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। পরদিন সকালে রতনকে ওর বাবা ডাকে-
-রতন! এই রতন!
কিন্তু রতনের কোনো সাড়া নেই। ওর বাবা এবার ধমক দিয়ে ডাকল তবুও সাড়া নেই। তাই রাগ হয়ে লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখে রতন গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে। ওর বুকের উপর একটা কাগজ, তাতে কী যেন লেখা। কাগজটা তুলে নিয়ে ওর বাবা পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে বুক ভিজে গেল। চিঠিটা পড়ার পর রতনের নাকের কাছে হাত রাখল। বুঝতে পারল যে রতন আর নিশ্বাস নিচ্ছে না।

মন্তব্য করুন