Skip to content

মাধবীলতা – তীর্থরাজ ভট্টাচার্য্য

মাধবীলতার ভারী কান্না পাচ্ছে আজ। সে জানেনা কেন এই ভরা বসন্তে ঝরাপাতার মাধুর্যে তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। মাধবীলতার চোখের পুরু কাজলে আমি যে কখনও বিধ্বস্ত হ‌ইনি তা নয়। আমি বহুবার তাকে ছুঁয়েওছি। কিন্তু সে আমল দেয়নি বিশেষ। কী জানি আমার ছোঁয়ায় হয়ত সেই জোর ছিলনা। মাধবীলতাকে বিষন্নভাবে সেই শুকনো পুকুরের পাড়ে একা বসে থাকতে দেখে আমার যে খারাপ লাগছিল, সেটা অস্বীকার করলে বড় পাপ হবে। কিন্তু সাহস হয়নি কাছে গিয়ে প্রশ্ন করার, যদি রেগে যায়। দূর থেকে দেখছিলাম বিনুনি করা চুল, অশ্রুসিক্ত কাজল, ছোট্টো কালো টিপ। মাঝে ভাবছিলাম ভয় ভেঙে ওর কাছে গিয়ে বসি। কিন্তু চিত্ত অনুমতি প্রদান করেনি। খানিকক্ষণ পর যখন গোধূলি তখনও সে ঠায় বসে। আমিও ঝোপের আড়ালে বসে আছি। আমি ওকে দেখছি। একটা মৃদু হাওয়া এল, সাথে সুগন্ধী তেলের সুবাস। যতটা সম্ভব ওর কেশের সুবাস আহরণ করলাম ব‌ইতে থাকা হাওয়ার মধ্য থেকে। ধীরে ধীরে শীতল হাওয়া ব‌ইতে লাগল। গায়ে কাঁটা দিল। আমি হাতের তালু ঘষে শরীর গরম করার বৃথা চেষ্টা করতে থাকলাম। ধীরে ধীরে পূর্ণিমার বৃত্তাকার চাঁদ বিকশিত হল গগণে। ও তখন‌ও ঠায় বসে! আমিও ওকে দেখার নেশায় কনকনে হিমেল হাওয়ায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু ওর কী এতটুকুও শীত করছেনা! ঠান্ডা লেগে শরীর খারাপ হয়ে যাবেতো ওর। এবার সাহসে ভর করে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ওর পেছনে দাঁড়ালাম। আহ্! কী সুবাস। ওর বিনুনি করা চুল থেকে পাওয়া সুবাস অন্তরে গ্রহণ করছিলাম। পূর্ণিমায় প্রেম। উপরি হিসেবে হিমেল স্নিগ্ধ হাওয়া, হাল্কা কুয়াশা, পর্ণমোচীদের সারি, ঝরে পড়া পাতা, পুকুর আর জোনাকি। জানিনা কোন সাহসে ভর করে ওর কাঁধে হাত রাখলাম। কিন্তু এই হিমেল হাওয়ায় ওর শরীর উষ্ণ কীভাবে! একটু আনমনা হলাম বটে, কিন্তু ও আমার দিকে তাকিয়েছে সেটা অনুধাবন করে আমিও ওর কাজলচোখে চোখ রাখলাম। মায়া, গভীর মায়া। সে মায়ায় আমি পাড়ি দিয়ে দেব বাল্টিক কিংবা তুলে আনবো গন্ধমাদন। এই মায়ার দৌড় বহুদূর অবধি। আমি এই প্রথমবার সাহস নিয়ে বললাম “ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। বলা হয়নি কোনোদিন। স্কুলে অনেকবার তোমায় ছুঁয়েছি, বোঝাতে চেয়েছি মনের টান। কিন্তু চারবছর আগে অন্য শহরে পাড়ি জমালে তুমি ও তোমার পরিবার। কোনো খোঁজ পাইনি তারপর। স্কুলের অনুষ্ঠানে তোমার গান গাওয়ার একখানা ছবি ছিল, সেটা নিয়েই তোমায় ভালোবেসেছি।”
জানিনা একনাগাড়ে এতগুলো কথা আজ কীভাবে বললাম। মাধবীলতার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আমার শরীর তপ্ত করে দিল। ও যদিও নির্বিকার। মাধবীলতা আস্তে করে মুখমন্ডল সামনের দিকে করে নিল। আমিও খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইলাম চাঁদের কলঙ্কের দিকে তাকিয়ে। এত রূপের মাঝে জানিনা কেন কালো দাগগুলোই আমার এত পছন্দের! হঠাৎ ঝিঁ-ঝিঁর ডাকের মাঝে শুনলাম “আমিও ভালোবেসেছিলাম তোমায়।” উৎফুল্ল হয়ে মাধবীলতার দিকে তাকাতেই দেখলাম ও নেই। চারিদিকে তাকালাম, হাজার চিৎকার করলাম। কেউ সাড়া দিলনা এই নির্জনে। পুকুরের বুক জলে ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ পেলাম একটা। কিন্তু চাঁদের প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছু নেই সেথায়।

মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাথা টন্‌টন্ করতে লাগল। স্বপ্ন! মাধবীলতার স্বপ্ন! হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খাচ্ছি। সেইসময় শুনি বাবা মাকে বলছে “ইস্, কি অবস্থা দেশের। একটা কমবয়সী মেয়েকে মাথা থেঁতলে খুন করে কারা যেন শহরের পার্কের পাশের পুকুরে বডি ফেলে দিয়েছে। বাজারে গিয়ে শুনলুম। জানিনা কার মেয়ে। কিন্তু নামখানা মিষ্টি ছিল বেশ মেয়েটার,- মাধবীলতা….”

মন্তব্য করুন