Skip to content

নিঃস্বার্থ প্রেম – হাকিকুর রহমান

নদী থেকে কলসী করে জল আনতে গিয়ে ক’য়েক বান্ধবী নদীপাড়ে গল্প করছিলো। তখন পাশ দিয়ে পাশের গাঁয়ের দুই বন্ধু হেঁটে যাচ্ছিলো। দুই বন্ধুর একজনের কাছে ওই মেয়েদের মধ্যে একজনকে খুবই ভালো লাগলো। সে তার বন্ধুকে ডেকে কইলো, দ্যাখ বন্ধু। মনে হচ্ছে মেয়েটা যেন ডানা কাটা পরী। মনে হচ্ছে এই এখনই স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। চলনা যাই একটু আলাপ করি।

মেয়েটা খুবই লাজুক স্বভাবের। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। লজ্জায় মুখখানা লাল হয়ে গেলো। তাতে করে তাকে আরও মোহনীয় করে তুললো। তারপর তারা সব বান্ধবী মিলে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিলো। আর ছেলে দু’টোও ওদের পেছন পেছন হাঁটতে থাকলো লুকিয়ে লুকিয়ে যাতে করে ওরা দেখতে না পায়। তারপর ছেলেটা মেয়েটার বাড়িটাকে চিনে নিয়ে নিজের বাড়ির পথে রওনা দিলো।

বাড়ি যেয়ে ছেলেটা তার মাকে বললো মেয়েটার কথা। মা তো মহা খুশী। তিনি ছেলের জন্যে এরকম পাত্রীই তো খুঁজছিলেন। তিনি সময় নষ্ট না করে মেয়েটার বাড়িতে যেয়ে ওদের দু’জনার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। ছেলেটাও সম্ভ্রান্ত পরিবারের, তাই মেয়ের মা-বাবাও এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। একটা শুভ দিন দেখে দু’জনার বিয়ে হয়ে গেল।

সে কি আয়োজন! পুরো সাত দিন ধরে চললো উৎসব। আশে পাশের সাত গাঁয়ের লোকদের দাওয়াত দেয়া হলো। সবাই তো মহা খুশী। এমন বিয়ে বহুকাল কেউ দেখেনি। পেট পুরে খেয়ে ছেলে-মেয়েকে আশীর্বাদ করে সবাই যে যার গাঁয়ে ফিরে গেলো।

মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি এসে বেশ খুশী। ছিমছাম গোছালো বাড়িঘর। চারিদিকে কেমন সুন্দর করে সব সাজানো। ছেলেকে তো আগেই চিনেছে সে। ছেলেটা অনেক ভালো। শ্বশুর মশাইও ভালো লোক। খুব আপন করে মেয়েকে ঘরে তুলে নিলেন। ওই যে সব কথার এক কথা। মেয়ের শ্বাশুড়ীটা একটুখানি দজ্জাল। একটুখানি কি বলি, বেশ দজ্জাল। ছেলের মায়ের ইচ্ছা ছিলো, ছেলেকে কোন ধনী লোকের মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে। প্রচুর উপধৌকন পাবে। ঘর ভরে যাবে উপহার সামগ্রীতে। সাথে নগদ তো পাবেই পাবে।

কিন্তু, পাশের গাঁয়ের মেয়েকে ছেলে যে ঘরে তুললো, তাতে তিনি খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। শ্বাশুড়ী ছেলে বৌকে মোটেই সহ্য করতে পারেননা। উঠতে বসতে খোটা, কাজে কাজে খুঁত ধরা, এমন কি গায়ে হাত উঠাতেও দ্বিধা করতেন না। মেয়ের জীবনটা ক্রমে ক্রমে নরক হয়ে উঠছিলো। তবুও স্বামীর মনের কথা চিন্তা করে কাউকেই কিছু জানাতোনা। তার গায়ের ক্ষত চিহ্নগুলোও সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে নীরবে বাড়ির সব কাজ করে যেতো। কিভাবে স্বামীর সুখ হবে, সেই চিন্তাতেই বিভোর থাকতো।

এভাবেই থেমে থেমে তার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। শ্বাশুড়ীর গঞ্জনা এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে বছর ঘুরে যেতে চল্লো। বাবার বাড়ি যাওয়া হয়নি। বাবার বাড়ি যাবার নাম মুখে আনলেই শ্বাশুড়ী অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন। তা সে নীরবে সহ্য করেই চুপ থাকে। স্বামী মাঝে মাঝে চেষ্টা করেছে, কিন্তু মায়ের সাথে পেরে উঠেনি। তাই সেও ক্ষান্ত দিয়েছে। দেখা যাক, মা’র বিবেকে কি বলে। ওদিকে মেয়ের বাবা-মা’ও অধীর হয়ে আছেন। কবে যে তাদের প্রাণপ্রিয় মেয়ে বাড়ি আসবে।

মেয়েটা এর ভিতর গর্ভবতী হলো। চুপি চুপি স্বামীকে জানালো। স্বামী তো মহা খুশী। ছেলে হলে কি নাম রাখবে, বা মেয়ে হলে কি নাম রাখবে, তা দু’জনে মিলে ঠিক করে রাখলো। ঘরে নতুন মুখটা কবে আসবে সেই অপেক্ষাতেই দিন গুনতে থাকলো। তবে, মা কি মনে করেন, সেই ভয়ে কেউই আর মুখ খোলেনা। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে শ্বাশুড়ী যে কি মনে করেন। এমনিতেই যেভাবে আচরন করেন, তার উপর এই খবরে যে কি করেন, তা বলা দুষ্কর।

শ্বাশুড়ীর মনে ক্ষোভ। বড়লোকের ঘর থেকে মেয়ে আনলে আজকে খরগুলো সব পুরে থাকতো। আর কিনা, ছোটঘরের মেয়েটা এসে জুড়ে বসেছে। তাই তিনি সারাক্ষণ ফন্দি আঁটেন, কি করে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তাড়ানো যায়। উঠতে বসতে খোটা, গালমন্দ তো লেগেই আছে। আগেই বলেছি, এমনকি পারলে গায়ে হাতটা ওঠান।

ছেলেটা একটু অনুভূতি পরায়ণ। সে আর থাকতে না পেরে একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুটাকে মুখ ফসকে বলেই ফেলেছে একদিন এই কথা, যে সে বাবা হতে চলেছে। আর কি, এ মুখ ও মুখ হতে ঠিকই মায়ের কানে চলে আসলো। শ্বাশুড়ী মনে মনে এই ক্ষনটারই অপেক্ষায় ছিলেন। যেই না লোক মুখে শুনতে পেলেন, ছেলের বউ মা হতে চলেছে। চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুল্লেন। এটা কি করে সম্ভব! ওটা আমার ছেলের বাচ্চাই হতে পারেনা। ওই মেয়ে চরিত্রহীন। ওটা অন্য কারও বাচ্চা। সম্পত্তি দখলের জন্যে মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। তিনি বল্লেন, আমিও দেখে নেবো, কি করে অন্যের বাচ্চাকে আমার ছেলের বাচ্চা বলে চালানো হয়।

ছেলে-মেয়ে দু’জনেই মুখে কুলুপ এঁটে রইলো। জানে, মায়ের সাথে কোনমতেই কথায় পেরে উঠবেনা। তাই তারা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকলো, যে যেদিন বাচ্চা হবার সময় হবে, পাশের গাঁয়ের দাইমাকে লুকিয়ে ডেকে এনে তাকে দিয়েই প্রসব কালীন সাহায্য নেবে।

দেখতে দেখতে সেই সময় হয়ে আসলো। মেয়েটা স্বামীকে লুকিয়ে জানালো ব্যাপারটা। ছেলেটা এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে দাইমা’র বাড়ির দিকে রওনা দিলো। এদিকে, শ্বাশুড়ী কান পেতে তা শুনে ফেল্লেন। আর প্রসব কালীন সময়ে কোনও সাহায্য তো দূরের কথা, এমনভাবে মেয়েটাকে ভুল চিকিৎসা দিলেন যে মেয়েটার পেটে থাকা ছেলেটা জন্ম নেবার আগেই মারা গেলো। মেয়েটা নিজের চোখে এসব দেখে সহ্য না করতে পেরে, ওই রক্তাক্ত শরীরেই ছুটে দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলো। ছেলেটা দাইমাকে নিয়ে খুশী মনে বাড়ি ঢুকলো। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

বহু বছর চলে গেছে এর ভিতরে। আজও ছেলেটা নদীর ধাঁরে বসে থাকে সাঁঝের বেলায়। লোকমুখে শুনতে পেয়েছে, মেয়েটা একটা বিশাল সোনালী মাছে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আর ভরা পূর্ণিমা রাতে ঘাটের ওপরে উঠে মানুষের রূপ ধরে মিহি সুরে গান গায়। আহা! কি সে কষ্ট সেই সুরে, যে শোনে সেই কেঁদে ব্যাকুল হয়ে যায়। ছেলেটা আজও রয়েছে অপেক্ষায়, কবে তার প্রাণের দোসর ফিরে আসবে। (ভীনদেশী এক সত্য ঘটনার অবলম্বনে, সংক্ষিপ্ত)

(তবে, আমাদের শ্বাশুড়ী মায়েদের উদ্দেশ্যে দু’টো কথা বলি। আপনারা তো মায়ের জাত। নাহলে শ্বাশুড়ী হলেন কি করে। আবার অবশ্যই একজন গৃহবধুও বটে। তো জানিনা, হয়তোবা আপনার শ্বাশুড়ী আপনার সাথে ওরকম ব্যবহার করেছিলো বলে, আপনিও আপনারই মতন আর একটা মেয়ের সাথে বিরূপ আচরণ করবেন? যে কিনা আপনাকে মা বলে ডাকে। ভেবে দেখবেন।)

মন্তব্য করুন