Skip to content

ঝুরোগল্প কাকে বলে : মলয় রায়চৌধুরী

ঝুরোগল্প কাকে বলে : মলয় রায়চৌধুরী

প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার যে, ‘ঝুরোগল্প’ নামের কনসেপ্ট এবং উৎপত্তি সম্পূর্ণরূপে বাঙালির। এর সঙ্গে ইউরোপ বা আমেরিকার গল্প-রচনার কোনও অবদান নেই। ঝুরোগল্প রচনার আঙ্গিক, কাঠামো ও ভাবনা ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সম্পাদক, কবি, গল্পকার-ঔপন্যাসিক কাজল সেন এবং অধুনান্তিক ভাবুক, কবি ও গল্পকার সমীর রায়চৌধুরীর।

গল্প এবং উপন্যাসের যে সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে ঔপনিবেশিক আমলে আনা হয়েছিল, যাকে মানদণ্ডের মান্যতা দিয়ে বিভিন্ন পাঠবস্তু গড়া আরম্ভ হয়েছিল, উত্তর-ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে, তা থেকে এখনকার মেইনস্ট্রিম বাঙালি লেখকরা কিঞ্চিদধিক সরে গেলেও, মনে হয় তাঁদের মধ্যে একটি এখনও উদ্বেগ কাজ করে। উদ্বেগটি হল বিদ্যায়তনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অস্বীকৃতির। অবশ্য লিটল ম্যাগাজিনের গল্প ও উপন্যাস লেখকরা, যেহেতু অমন সমালোচকদের স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করেন না, আর তা আদায়ের প্রয়াস করেন না, তাঁরা ইউরোপের সংজ্ঞাকে পেছনে ফেলে নিজেদের মতন করে লেখার পৃথক-পৃথক ধারা তৈরি করে নিতে পেরেছেন এবং তাতে ‘হাংরি’, ‘শাস্ত্রবিরোধী’, ‘নিমসাহিত্য’ ইত্যাদি আন্দোলনের গল্পকার-ঔপন্যাসিকদের অবদান হেলাফেলার নয়। যে ধরনের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কারণে ইউরোপে গল্প আর উপন্যাস লেখা আরম্ভ হয়েছিল, এবং ক্রমশ তার মানদণ্ড ও মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল, অমন উৎসসূত্র আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। যাইহোক, বিদ্যায়তনিক আলোচকদের বইগুলো থেকে জানতে পারি কোনগুলোকে তাঁরা প্রকৃত ছোটোগল্পের আর উপন্যাসের তকমা দিচ্ছেন এবং কেন। একটা ব্যাপারে কিন্তু ‘ভারতীয়তা’ ছিল; প্রায় দেড়শোর বেশি গল্পকার বা ন্যারেটিভ-লেখক প্রথম দিকে, বঙ্কিমচন্দ্রের সময়ের পরেও, পাঠবস্তুর ওপর নিজের নাম লেখেননি। অর্থাৎ সেই সময়ে লেখকের চেয়ে পাঠবস্তু ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ছোটোগল্প একটি বিশেষ রূপবন্ধ যা দৈর্ঘ্যে হ্রস্ব, এবং একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ছোটোগল্পের আকার কী হবে সে সম্পর্কে কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেই। সব ছোটোগল্পই গল্প, কিন্তু সব গল্পই ছো্টোগল্প নয়। একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটোগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কিছু নান্দনিক ও শিল্পশর্ত পূরণ করতে হয়। ছো্টোগল্পের সংজ্ঞার্থ কী তা নিয়ে নানা সাহিত্যিক-মুনীর নানা মত। বিদ্যায়তনিক মানদণ্ডে বলা যায় — যা আকারে ছোটো, প্রকারে গল্প তাকে ছো্টোগল্প বলা হয়।

ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের দরুণ যে প্যারাডাইম বদল থেকে আলোকপ্রাপ্তির কালখন্ড আরম্ভ হয়েছিল, তার প্রভাবে চাষবাসের জগত থেকে মানুষ ক্রমশ প্রবেশ করছিল যন্ত্রপাতির জগতে এবং সৃষ্টি হচ্ছিল ব্যক্তি-এককের প্রতিস্ব। ক্ষমতা চলে যাচ্ছিল জমির মালিকদের থেকে শিল্পমালিক পুঁজিপতিদের হাতে আর তৈরি হচ্ছিল বিশাল এক শহুরে শ্রমিকদল। অলস গ্রাম্য জীবন থেকে ব্যক্তি-একক স্হানান্তরিত হচ্ছিল শিল্পোদ্যোগের দ্রুতিময় একঘেয়ে জীবনযাত্রায় এবং অভাবনীয় রদবদল ঘটে যাচ্ছিল ব্যক্তি-প্রতিস্বে। এই নতুন মানুষটার ভঙ্গুর ও জটিল যাপনঘটনাই ছোটোগল্পের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দেখা দিয়েছিল। পক্ষান্তরে, প্রথাবাহিত উপন্যাসের বিকাশ ও বিলয় ইউরোপে ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদের উথ্থান-পতনের সঙ্গে। উপন্যাস ইউরোপের ‘সেকাল’-এর ফসল, যখন কিনা ছোটোগল্প ইউরোপীয় আধুনিকতার ফসল। খ্রিস্টান মিশনারিদের হাত ধরে দুটি জনারই একসঙ্গে পৌঁছেছিল নতুন বাংলা ভাষাসাহিত্যে। কর্ণওয়ালিসের দৌলতে বাঙালি মধ্যবিত্ত-সমাজও গড়ে উঠেছিল, যারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ছিল সাহেবকর্তাদের ঔপনিবেশিক সহায়ক হিসাবে। তাদের খোরাকের প্রয়োজন দেখা দিতে, এবং ম্যাকলের শিক্ষাকাঠামোয় গড়েপিটে তৈরি বাঙালি ব্যক্তি-এককদের জন্য ফিকশন প্রকাশিত হওয়া আরম্ভ হল ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পণ’ ‘সংবাদ প্রভাকর’, বঙ্গদর্শন, ভারতী, সাধনা, হিতবাদী, নবজীবন, সাহিত্য ইত্যাদি পত্রিকায়।

নিজের বাড়িতে ছাপার মেশিন স্হাপন করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তখনও ছোটোগল্পের সংজ্ঞা বাঙলায় নির্ধারিত হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্রের আঠারো পাতার ‘ইন্দিরা’, পনেরো পাতার ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, তাঁর দাদা পূর্ণচন্দ্রের পনেরো পাতার ‘মধুমতী’ ফিকশনগুলোকে বলা হয়েছিল উপন্যাস। আশি বছর পরে বিদ্যায়তনিক আলোচকরা বললেন যে প্রথম দুটি ছোটোগল্প বা উপন্যাস কোনোটাই নয়, কিন্তু পূর্ণচন্দ্রেরটি ছোটোগল্প। ইউরোপীয় মানদণ্ড অনুযায়ী ছোটোগল্পের তকমা পেলো ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় ১৮৯১ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’। রবীন্দ্রনাথের মত অনুযায়ী ছোটোগল্পের সমাপ্তি হবে এমন, যেখানে মন তৃপ্তি পাবে না। বাংলা ছো্টোগল্প ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর ‘সোনারতরী’ কাব্যের ‘বর্ষাযাপন’ কবিতাটি তুলে ধরা হয় :

ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্ত সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রু জল।
নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অকালের জীবনগুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল

ছোটোগল্প শেষ হবার পর পরবর্তী ঘটনা জানার আগ্রহে পাঠকের মন ভরে থাকবে। ছোটোগল্পের বিষয়বস্তুর মধ্যে সংযমবোধ থাকবে। নাটকীয়তা সংঘাত ব্যঞ্জনাধর্মীতা ছোটোগল্পের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ছো্টোগল্পের মধ্যে ঘটনার একটি শীর্ষ মুহূর্ত বা ক্লাইম্যাক্স থাকবে, যেখানে গল্পের বিষয়বস্তু বাঁক নিয়ে অনন্য হয়ে উঠতে পারে। এই হুইপক্রাক এনডিঙ বা বদ্ধসমাপ্তি ছোটোগল্পে জরুরি। এডগার অ্যালান পো-এর মতে, যে গল্প আধ থেকে এক বা দু’ঘণ্টার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়, তাকে ছোটোগল্প বলে। কিন্তু এইচ জি ওয়েলস বলেছেন, ছো্টোগল্প সাধারণত ১০ হতে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। ছোটোগল্পে জীবনের সামগ্রিক দিকগুলো উপন্যাসের মতো বিস্তারিতভাবে বলা হয় না বরং এর টুকরোটুকু তুলে ধরা হয়। এজন্য ছোটোগল্প যথাসম্ভব বাহুল্যবর্জিত, রসঘন ও নিবিড় হয়। সংগত কারণেই এতে পাত্রপাত্রী বা চরিত্রের সংখ্যা খুবই সীমিত হয়।

ছোটোগল্পে প্রথম বাঁকবদল আনতে চেয়েছিলেন শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনকারীরা। ১৯৬৬ সালের মার্চে প্রকাশিত ‘এই দশক পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে’ ‘শাস্ত্রবিরোধী ছোটোগল্প’তে যে যৌথ (সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, শেখর বসু, কল্যাণ সেন ও আশীস ঘোষ) বক্তব্য রাখা হয়েছিল, তা এরকম : “সময় হয়েছে যা কিছু পুরনো তাকে বর্জন করবার, সময় হয়েছে যা কিছু নতুন তার জন্য প্রস্তুত হবার। আলমারি থেকে সব বই নামিয়ে ফেল। আমাদের জন্যে এবার একে-একে তাকগুলো খালি করে দাও। তথাকথিত মহৎ উপন্যাস এবং গল্পগুলোকে ট্রাঙ্কে তাড়াতাড়ি পুরে ফেল। ওগুলো আর দরকার নেই। ওগুলো এখন আবেদনহীন এবং বিরক্তিকর। মনে রেখো আর্তোর সেই বিখ্যাত উক্তি : Masterpieces of the past, they are not good for us. ছোটোগল্প আজ থেকে সমস্ত শর্তের বিরুদ্ধে। সমালোচকের সমস্ত সংজ্ঞার বেড়া ভেঙে সে বেরিয়ে এসেছে। ছোটোগল্প এখন কবিতার মতই স্বাধীন এবং মুক্ত। আমরা যা লিখব, যেমন করে লিখব, তাই ছোটোগল্প। শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা বাউল। আমরা শিল্পের শাস্ত্রবিধি মানি না। আমাদের কোন সামাজিক দায় নেই। বাউলের মতো আমরাও বলি, ‘মরলেই সব দায় ঘুচে যায়। তোমাদের দৃষ্টিতে আমাদের মৃত মনে করো। আমরা মরমী। অন্তরাত্মার জটিল অনুভবই আমাদের গল্পের বিষয়’। লক্ষ্যয়ীয় যে শাস্ত্রবিরোধীরা স্বীকার করেছিলেন যে তাঁদের গল্পে ‘বিষয়’ থাকবে।

‘এই দশক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন – ১) গল্পে আমরা আমাদের কথাই বলব। ২) আমরা এখন বাস্তবতায় ক্লান্ত। ৩) অতীতের মহৎ সৃষ্টি অতীতের কাছে মহৎ, আমাদের কাছে নয়। ৪) গল্পে যারা এখন কাহিনী খুঁজবে তাদের গুলি করা হবে। এই আন্দোলনে পরে যোগ দিয়েছিলেন অমল চন্দ, সমীর মিত্র, অশোককুমার দাস, বলরাম বসাক, মনোমোহন বিশ্বাস, সমর মিত্র, কুমারেশ নিয়োগী, প্রিয়ব্রত বসাক, দেবশ্রী দাস, তপনলাল ধর, সুকুমার ঘোষ, সুনীল জানা, রথীন ভৌমিক, অতীন্দ্রিয় পাঠক প্রমুখ। বলরাম বসাক অবশ্য এই আন্দোলনের সঙ্গে সংস্পর্শ অস্বীকার করলেও তাঁর গল্পের ধারা পালটায়নি। পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় প্রত্যেকেই শাস্ত্রবিরোধী ছোটোগল্প বলতে কী বোঝায় তা ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু তাঁরা গল্পের বদ্ধ সূচনা ও বদ্ধ সমাপ্তি অমান্য করেননি। বরং হাংরি আন্দোলনের গদ্য লেখক সুভাষ ঘোষ তাঁর ছোটো ন্যারেটিভগুলোতে সমাপ্তির মুক্তি ঘটাতে পেরেছিলেন।

ঝুরোগল্প নামের আঙ্গিকটির উদ্ভাবকদের অন্যতম কাজল সেন লিখেছেন, “আমি জীবনে আশ্চর্য দুটি মানুষের স্নেহ ও সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, যাঁরা আমার সাহিত্য ভাবনাকে সম্পূর্ণ নতুন খাতে বা ধারায় বইয়ে দিয়েছিলেন। এঁরা আজ দুজনেই প্রয়াত – স্বদেশ সেন ও সমীর রায়চৌধুরী। এই দুই স্মরণীয় সাহিত্যব্যক্তিত্বের আশীর্বাদ আমার মাথায় আছে বলেই আমি আমার সাধ্যমতো নতুন কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। একদিন স্বদেশদা কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন, দেখো কাজল, প্রচলিত ধারায় তুমি কেমন লিখছ বা কতটা ভালো লিখছ, তা কিন্তু বিচার্য নয়, বরং তুমি নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারছ কিনা সেটাই আসল ব্যাপার। স্বদেশদা আমাকে কথাটা বলেছিলেন কবিতা লেখার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু তাঁর এই কথাটাই আমার সাহিত্য জীবনে ‘অমোঘ বাণী’র মতোই আমাকে আলোড়িত করে চলেছে। আর হয়তো ঠিক এখান থেকেই আমার ‘ঝুরো’ ভাবনাটা মাথার মধ্যে পাক খেতে লাগল। আমি সমীরদার সঙ্গে আমার যাবতীয় চিন্তা ভাবনা শেয়ার করলাম। সমীরদা আমাকে উৎসাহিত করলেন এবং এই নতুন আঙ্গিক ও ভাবনার তিনিই নামকরণ করলেন ‘ঝুরোগল্প’। এখন তো ঝুরোগল্প বাংলা সাহিত্যে একটা স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। অনেকেই ঝুরোগল্প লিখছেন। ঝুরোগল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তবে ঝুরোগল্পের প্রাসঙ্গিকতায় আমি যে ‘ঝুরোকবিতা’ লেখা শুরু করেছি, তা এখনও পর্যন্ত আর কেউ লেখেননি। সমীরাদার লেখার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।”

কাজল সেন আরও বলেছেন, “ঝুরোগল্প ও অণুগল্প এক নয়। অণুগল্প মূলত ছোটোগল্পের বনসাই। এবং ছো্টোগল্প ও অণুগল্পে গল্পের পরিণতি থাকে বা পরিণতির ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু ঝুরোগল্প ওপেন এন্ডেড গল্প, কখনই ক্লোজ এন্ডেড গল্প নয়। তাই ঝুরোগল্প শুরু হয় কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই এবং শেষ হয় কোনো পরিণতি ছাড়াই। এই দৃষ্টিকোণে ঝুরোগল্পকে বলা যেতে পারে অসমাপ্ত গল্প বা অসম্পূর্ণ গল্প। আর ঝুরোগল্প সীমাবদ্ধ থাকে সর্বাধিক চারশো শব্দের মধ্যে।”

ইউরোপে সীমিত শব্দের ছোটোগল্প লেখা আরম্ভ হয়েছে বেশ কিছুকাল আগে, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফ্ল্যাশ ফিকশান’, যেমন দুশো আশি শব্দের ‘টুইটারেচার’, পঞ্চাশ শব্দের ‘ড্রিবল’ বা ‘মিনিসাগা’ কিংবা একশো শব্দের ‘ড্রাবল’ বা ‘মাইক্রোফিকশান’, সাতশো পঞ্চাশ শব্দের ‘সাডন ফিকশান’ ইত্যাদি। আদি ‘ফ্ল্যাশ ফিকশান’ ছিল একহাজার শব্দের এবং তা একটি বৃহত্তর গল্পের প্রতি ইঙ্গিত করতো বা বোঝানোর ক্ষমতা রাখতো বলে তাকে মনে করা হতো যে তা একটি অনন্য সাহিত্যিক গুণের অধিকারী। তুর্কির মোল্লা নাসেরুদ্দিন খুব সংক্ষেপে গল্প বলতেন। জেন ধর্মীদের ‘কোয়ান’ ছিল সীমিত শব্দের কাহিনি। আমেরিকায় সীমিত শব্দের গল্প লেখা আরম্ভ করেছিলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান, আমব্রোজ বিয়ার্স এবং কেট শোপাঁ। ১৯২০ সালে আমেরিকায় কসমোপলিটান পত্রিকা সীমিত শব্দের গল্পকে সংজ্ঞায়িত করেছিল ‘ছোটো ছো্টো গল্প’ হিসাবে এবং তেমন রচনাবলীর একটি সংকলন ‘আমেরিকান শর্ট শর্ট স্টোরি’ নামে ১৯৩০ সালে প্রকাশ করেছিল। সমারসেট মম এই ধরনের আঙ্গিকের প্রচলন ঘটাতে ১৯৩৬ সালে প্রকাশ করেন ‘ভেরি শর্ট স্টোরিজ’। তার আগে আর্নস্ট হেমিংওয়ে বাজি রেখে ‘ফ্ল্যাশ ফিকশান’ লিখেছিলেন। সীমিত শব্দের ছোটোগল্প বা ফ্ল্যাশ ফিকশান লিখেছেন বোলেসলো প্রুস, আনতন চেকভ, ও হেনরি, ফ্রানৎস কাফকা, এইচ পি লাভক্র্যাফ্ট, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, হুলিও কোরটফাজার, দানীল খার্মস, আর্থার সি ক্লার্ক, রিচার্ড ব্রটিগান, রে ব্র্যাডবেরি, কুর্ট ভনেগাট জুনিয়ার, ফ্রেডরিক ব্রাউন, জন কেজ, ফিলিপ কে ডিক, রবার্ট শেকলে, ইতালো ক্যালভিনো, লিডিয়া ডেভিস, বারবারা হেনিঙ, নাগুইব মাহফুজ প্রমুখ। শব্দসংখ্যা সীমিত হলেও তাঁরা ছোটোগল্পের বিদ্যায়তনিক সংজ্ঞাকে অস্বীকার করেননি। অণুগল্পের শব্দসীমাকে চীনা সাহিত্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে ‘স্মোক লং’ ফিকশন বলে। অর্থাৎ একটি সিগারেট শেষ করতে যে সময় লাগবে তার ভেতর এ গল্প শেষ হয়ে যাবে। এটিকে পোস্টকার্ড ফিকশন, ন্যানো ফিকশন, সুপার শর্ট ফিকশনও বলা হয়।

‘মিনিসাগা’ আরম্ভ করেছিলেন ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার ব্রায়ান অ্যালডিস, দীর্ঘ ঘটনা সম্বলিত কাহিনিকে পঞ্চাশ শব্দে উপস্হাপনের উদ্দেশে, যাতে সংবাদপত্র পাঠকেরা ঘটনার কথা জানতে পারে। এটা মূলত সংবাদ, ছোটোগল্প নয়। বিবিসি রেডিও ফোর একসময়ে মিনিসাগা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, শিক্ষানবীশরা যাতে সংক্ষেপে সংবাদ পরিবেশন করতে শেখে।

প্রয়াত অশোক তাঁতী একটি নিবন্ধে জানিয়েছেন যে, পশ্চিমবাংলায় অণুগল্প লেখা আরম্ভ হয়েছিল সত্তর দশকে অমিয় চট্টোপাধ্যায় ও আশিসতরু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পত্রাণু’ পত্রিকার মাধ্যমে। পরে মানব পালের সম্পাদনায় মুহূর্ত (১৯৭০), প্রদীপ ভট্টাচার্য, জগদীশ বসাক, কুমারেশ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘মিনি পত্রিকা (১৯৭০), তারাপদ দে ও বিবেকজ্যোতি মৈত্রের সম্পাদনায় ‘মাটি’ (১৯৭০), নির্ঝর চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘নক্ষত্র’ (১৯৭১) ইত্যাদি পত্রিকা অণুগল্পের একটা ঢেউ সৃষ্টি করেন। ‘বাংলা সাহিত্যের নানারূপ’ বইতে শুদ্ধসত্ব বসু অণুগল্পকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস করেছিলেন এইভাবে, “অতিশয় স্বল্প পরিসরে যথার্থ ছোটোগল্পকে অণুগল্প বলা হয়।” অণুগল্প পত্রিকার সম্পাদকরা চাইতেন পঞ্চাশ থেকে চারশো শব্দের মধ্যে সীমিত হবে অণুগল্প। চিন্ময় বিশ্বাস ‘মিনিট তিনেক গল্প’ সংকলনের ভূমিকায় অমিয় চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “আমাদের জীবনে এমন অনেক চকিত ঘটনা হঠাৎই উদ্দীপিত হয়ে আমাদের চেতনায় গভীরভাবে নাড়া দেয়, যেগুলো প্রকাশের জন্য পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দরকার হয় না। বনফুল ১৯৭৬ সালে প্রকাশ করেন তাঁর ছোটোমাপের গল্পের সংকলন ‘নূতন গল্প’। তাঁর দৃষ্টিতে ছোটোগল্প ও অণুগল্পের গঠনশৈলী আলাদা ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে গল্পের শেষে একটা মোচড় থাকবে। অর্থাৎ ছোটোগল্পের প্রধান শর্তটিকেই তিনি মান্যতা দিয়েছিলেন, পরিসর কম হলেও।

তার মানে ইউরোপ-আমেরিকায় যাকে ফ্ল্যাশ ফিকশান বলা হয়েছে, বাংলায় তাকেই আমরা বলছি অণুগল্প। ব্রিটেনের সাহিত্যজগতে ‘ন্যাশনাল ফ্লাশফিকশন ডে’ উদযাপিত হয়ে আসছে। নিউজিল্যান্ডেও অনুরূপভাবে জাতীয় অণুগল্প দিবস পালিত হয়। উল্লেখ্য যে, অণুগল্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে আমেরিকায়। সেখানে অণুগল্প এখন ছো্টোগল্প থেকে কিছুটা সরে এসে সাহিত্যের স্বতন্ত্র বিভাগ (genre) হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু হয়েছে। অণুগল্প লিখে ‘ম্যান অব বুকার’ পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন লেখক লিডিয়া ডেভিস। ডেভিসের গল্পের দৈর্ঘ্য এক লাইন থেকে শুরু করে দু-তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তাঁর গল্পকে আদর্শ অণুগল্প বা ফ্লাশ ফিকশন বলা হয়। ছো্টোগল্পের পাশাপাশি অণুগল্প লিখে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন আরেক মার্কিন কথাসাহিত্যিক রবার্ট ওলেন বার্টলার। শার্ল বোদলেয়ার তাঁর ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ বইতে যে ছোটো-ছো্টো গদ্য-কবিতা লিখেছেন যেগুলোকে অণুগল্প হিসেবে চিহ্নিত করা চলে, কিন্তু তিনিও কবিতা-বিশেষের শেষে রেখেছেন হুইপ-ক্রাক এনডিঙ বা বিদ্যুচ্চমক। তুলনামূলকভাবে র‌্যাঁবোর ‘ইল্যুমিনেশানস’-এর ন্যারেটিভগুলোতে সমাপ্তির মুক্তি পাওয়া যায়। ছোটোগল্পের এই বিদ্যুচ্চমকই বদ্ধ সমাপ্তি যা ঝুরোগল্পে থাকে না। একইভাবে ঝুরোগল্পের সূচনাও মুক্ত এবং সংক্ষিপ্ত ন্যারেটিভটিতে দেখা মেলে ভঙ্গুর আত্মপরিচয়ের, বহুস্বরের, অনির্ণেয়তার। অর্থাৎ ঝুরোগল্পকে চিহ্ণিত করার জন্য মুক্ত সূচনা ও মুক্ত সমাপ্তি জরুরি।

মন্তব্য করুন