Skip to content

গরীব মানুষ, হাতের লেখা খারাপ

গরীব মানুষ, হাতের লেখা খারাপ
******************************
একসময় এই সংলাপটি খুব শোনা যেত, ” ভাই, গরীব মানুষ, হাতের লেখা খারাপ।” শুনে খুব হাসতাম। কোন একটা বাংলা সিনেমার সুপারহিট ডায়ালগ এইটা। হাতের লেখা খারাপ ভালো হওয়ার সাথে যদি গরীব হওয়ার সম্পর্ক থাকত তবে বড় ভালো হতো। আমি বলতেই পারতাম আমি বেশ বড়লোক।

সেই কিশোর বয়স থেকেই বন্ধু বান্ধব আর সিনিয়রদের বেশ তোয়াজ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিলো এই হাতের লেখার কল্যানে। তাদের প্রেমপত্রের ভাষা আর সৌন্দর্য দু’ক্ষেত্রেই তারা নিশ্চিন্তে আমার উপর নির্ভর করতে পারতো। কোথাও যে ক্রস কানেক্টেড হয়ে যেত না তা কিন্তু নয় সে গল্প অন্য কোন দিন। খ্যাতির বিড়ম্বনা তো কিছু থাকবেই।

ছোটবেলায় বিশেষ ভালো ছেলে ছিলাম, যাকে বলে গুডি বয়। পরে সুদে আসলে উসুল হয়ে গেছে অবশ্য । বাবা অফিসে বেরোবার আগে দু পৃষ্ঠা হাতের লেখা বাড়ির কাজ দিয়ে যেতেন। লেখা খুব খারাপ না হলে আর বাবার মেজাজ খুব বেশি বিগড়ে না গেলে পিঠে মার পড়ত না। এক হাতের লেখা ছাড়া অন্য কোন কারনে মার খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। আর আমার দাদি বেঁচে থাকতে আমার গায়ে হাত তোলা ছিল সত্যিই কঠিন বিষয়।

সেই হাতের লেখা আমায় ধনী না করলেও অনেক দুঃসময়ে পাশে এসে দাড়িয়েছে। ২০০১ সাল, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বেরিয়ে গেছি। তারপর সুফিয়া হোটেল, ছাপড়া, মেস, গলিগুপচি পেড়িয়ে আপাত আশ্রয় মগবাজারের এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে। কয়েকজন বড় ভাই বন্ধু মিলে কোনরকম মাথা গুজে থাকা আর কি। কঠিন সে সময় জীবনধারা বদলে দেয়, সে গল্প ও আজ থাক।

কিছুদিন গোফ রেখে মাস্টার্স এর ছাত্র পরিচয়ে টিউশনি করি। কিছুদিন স্বল্প টাকায় একটা বই অনুবাদের কাজ করি। বলা বাহুল্য নয়, সে বই আরেকজনের নামে ছাপা হবে। সেই পান্ডুলিপি লিখছি বসে একটা ট্রানকের উপর। হল থেকে তো এক কাপড়ে বেরিয়ে আসছি। ট্রানকের উপর পান্ডুলিপি তে হাতের লেখা দেখে একদিন হাবিব ভাই বলে, “লিটন তোর হস্তাক্ষর তো খুবই সুন্দর।” আমরা বন্ধুরা আড়ালে আবডালে হাবিব ভাই কে নিয়ে মজা করতাম। উনি গল্প বলেন সাধু ভাষায়। এমনিতে ঠিক আছে, কিন্তু কোন ঘটনা বর্ননা করতে গেলেই কেন যেন তা সাধু ভাষায় চলে আসে৷ হাবিব ভাই কে তার বন্ধুরা বলে হাবিব শ। আমরা প্রথমে বুঝিনি। পরে জানলাম, উনি বলতেন- কেউ লাখপতি, কেউবা হাজারি, আর আমি হলাম শ পতি। সে থেকে হাবিব শ।

একসময় অনেক রাজপথ আর আন্দোলনের গল্প শেষে আবার হলে উঠি। তখন আসলেই মাস্টার্সে পড়ি, ততদিনে বিরোধী দলে কেন্দ্রীয় নেতা। টিউশনি করতে ভালো লাগে না, ভালো দেখায় ও না। ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে, সাথে খরচ ও । এদিকে পকেট তো গড়ের মাঠ। বাড়ি থেকে আগে যা আসতো, এখনো তা ই আসে। আমি অন্ধকার দেখছি। একদিন চৌধুরী সাইফুন্নবি সাগর ভাইয়ের সাথে দেখা। উনি এফ এইচ হল ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন একসময়। তখন 3DA এর ডিরেক্টর। “লিটন, হাবিব বললো তোর হাতের লেখা নাকি খুব সুন্দর। আমাদের কিছু হ্যান্ডনোট লিখে দে। নোট আমরাই দিব, তুই শুধু কপি করে গুছিয়ে লিখে দিবি। ওটাই প্রিন্ট হবে। প্রতি পেইজ বিশ টাকা করে পাবি।” আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সারাদিন ক্যাম্পাস, মধু, পার্টি অফিস, টি এস সি শেষে গভীর রাতে রুমে ফিরি। তারপর ফ্রেশ হয়ে দশ পাতা লিখে ঘুমুতে যাই। প্রতিদিন ২০০ টাকায় তখন আমাদের ভালোই চলত।

সেই হাতের লেখা আমায় ধনী না করলেও স্বস্তি দিয়েছে। ইন্টারমিডিয়েট এর পর তো একাডেমিক বাংলা লেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখালেখির মাধ্যম ইংরেজি। বিসিএসের যে একটি মাত্র পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম তাও ইংরেজিতেই দিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষা ছাড়া আর কোথাও বাংলা লেখার প্রয়োজন খুব একটা পড়েনি। অফিসে তো বিজয় আর অভ্র নিজেই লেখে, আমার সুন্দর হস্তাক্ষর এর আর প্রয়োজন পড়ে না। আর চিঠি লেখা তো এখন ইতিহাস।

অনেক দিন পর বাংলায় লিখলাম আবার। কবিতা। এ বছরই বেহুলা বাংলা থেকে বেরিয়েছে কবিতার বই “নোনা দেয়ালে গ্রাফিতি “। প্রথম মূদ্রণ শেষ, দ্বিতীয় মূদ্রণ পাওয়া যাচ্ছে রকমারি তে।

পেন্ডুলাম পাবলিসার্স থেকে যখন দ্বিতীয় কবিতার বই
“সোডিয়ামে খসে যায় মুখোশ ” এর পান্ডুলিপি এডিটে যাবে, আমার সৃজনশীল প্রকাশক দাবি করে বসলেন, ভাই আমরা এই বইটা আপনার হস্তাক্ষরে!! প্রকাশ করতে চাই।

আমার মনে পড়ে যায় এই হস্তাক্ষরের বিস্মৃত ইতিহাস। ১৮ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এবারের বইমেলায় ৪৮৮ নং পেন্ডুলাম এর স্টলে পাওয়া যাবে হস্তাক্ষরে ছাপানো কবিতার এই বইটি।

মন্তব্য করুন