Skip to content

কার্তুজ – পর্ব তিন – জয়ন্ত সেন

ঠিক হিসেব নেই, পনেরো ষোলো বছর-তো হবেই, ইকবালের জীবন এখন অন্য | তার একটা বউ আছে, বাচ্চা আছে, যারা ওর চিন্তা করে, যাদের জন্য ইকবালের চিন্তা হয় | আর সে-চিন্তা করেই করাচি-তে জাহাঙ্গীর-কে দেখেও না দেখা করতে পারতো | আর দেখেও যদি না দেখে থাকতো তাহলে এই-বছর মিঃ ভিক্টর ইকবাল খানকে ইন্ডিয়াতে চলে আসতে বলতো | পাকিস্তানী সিটিজেন বউ নূর আর ছেলে ফায়াদকে ইংল্যান্ড-এ শিফট করার ব্যাবস্থাও হতো | তাহলে হয়তো রুদ্রদ্বীপ সেনকে গোপন রাস্তায়, রিফিউজিদের মতো দেশ পারাপার করতে হতোনা |
রুদ্রদ্বীপ সেন, লম্বা পেটানো চেহারা, রোদে পোড়া তামাটে রং, বাবরি চুল, ডায়মন্ড চিবুক, না কখনো কারোর শোনে না কাউকে কিছু বলে | কে এই রুদ্রদ্বীপ ? ইকবালের জাহাঙ্গীরকে দেখা বা না দেখাতে কি আসে যায় রুদ্রর ! এইসব প্রশ্নের শ্বশানপুরী থেকে পালাতেই হয়তো রুদ্র করাচির নেপিয়ার রোড-এর বেশ্যাখানায় লুকিয়ে রয়েছিলো | এখানে কেউ প্রশ্ন করেনা |
ফাতেমা, আসল নাম আসলে কেউই জানে না | বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামের পাস্টপোর্ট আছে, আসলে কোন দেশের ঠিকমত কারোর জানা নেই | অনেক দেশের ভাষায় রপ্ত | তবে জিন্না এয়ারপোর্ট-এ যে পাস্টপোর্ট-টা দেখানো হয়েছিলো, তাতে ফাতেমা বেগম ছিলো | লন্ডন থেকে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে করাচি এসেছে | চেহারার আদল, শরীরের গঠন অত্যাধিক আকর্ষণীয় |
ফাতেমার উপস্থিতি এই মিশনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন |

মিশন, পনেরো ষোলো বছর আগে মিশন ছিলো না | শুধু একটা সন্দেহ ছিলো |

( পনেরো কি ষোলো বছর আগের কথা ) ইন্দ্রজিতের কাছে যখন কমল একটা কল-ট্যাপিং রেকর্ড নিয়ে এলো | কয়েকমাস আগেই আনসারীর মার্ডার হয়েছে | তারপর থেকেই প্রটোকল ক্যাচ করা শুরু হয় স্যাটালাইট-এর মাধ্যমে | কাশ্মীরের পলিটিশিয়ান-দের কল ট্রেস করা হতে থাকে | একটা কোনভার্সেশন-এর দুটো ভয়েস, যার একটা জাহাঙ্গীরেরও ছিলো |
একবছর আগে ইন্দ্রজিৎ আনসারীর কাছ থেকে লোকেশন পেয়ে আর্মি-কে ব্রিফ করে দেয়, বাহাই নামের একটা গ্রামে একটা স্পেশাল টাস্ক ফোর্স সার্জিকাল স্ট্রাইক সাড়ে সে-রাতেই | কবর-স্থানের পাশের একটা কটেজ বাজুকার গোলাতে উড়ে যাওয়ার পর জানা গেছিলো কেউ বেঁচে নেই | বিস্ফোরণে ক্ষত শরীর-গুলো চিহ্নিত-ও করা হয়েছিলো কিন্তু কমলের দেওয়া রেকর্ড-এ সন্দেহ জাহাঙ্গীর এখনো বেঁচে আছে | কনভার্সেশনের কথা গুলো নাম্বার দিয়ে বলা | কমল ডি-কোড করে | ইংরেজি আলফাবেট গুলোকে নাম্বারিং-এ কনভার্ট করে বলা | নাইনটিন-টুয়েলভ-ফাইভ-ফাইভ-সিক্সটিন-ফাইভ-এইটিন-থ্রি-ফাইভ-টুয়েলভ-টুয়েলভ- ওয়ান-থ্রি-টোয়েন্টি-নাইন-টোয়েন্টিটু-ওয়ান-টোয়েন্টি-ফাইভ- নাইন-ফোর্টিন- ইলেভেন-ফিফটিন-টুয়েলভ-ইলেভেন-ওয়ান-টোয়েন্টি-ওয়ান ” এর মানে এসে দাঁড়ায় স্লীপার-সেল এক্টিভেট ইন কলকাতা |
স্লীপার-সেল, এরা সাধারণ মানুষের মতোই থাকে, ভীড়ের মাঝে | এদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়না | ভীড়ের মধ্যে যে-কোনো একটা চেহারা স্লিপার-সেল হতে পারে | তারপর কোনো বিস্ফোরক দুর্ঘটনা হওয়ার পর মিলিয়ে যায় হাওয়ায় ছাই-এর মত | কিন্তু তিন কোটি লোকের মধ্যে গুটি কয়েক স্লীপারসেল-কে খোঁজা কিভাবে ? চিরুনি তল্লাশি শুরু হোলো কলকাতায় | ভারত বাংলাদেশ বর্ডার থেকে শুরু করে এয়ারপোর্ট, মেট্রো স্টেশন, বড়ো রেস্ট্রুরেন্ট,শপিং-মল, ভিড় ভাড়াক্কা এলাকায় পুলিশি ব্যাবস্থা আরো সুরক্ষিত করা হোলো | জায়গায় জায়গায় এজেন্ট এলোকেট করা হোলো, কোনোরকম আন-ন্যাচারাল একটিভিটি লক্ষ্যের জন্য | কিন্তু যে ঘটনাটা ঘটলো সেটার কথা বিন্দুমাত্রও কেউ চিন্তা করতে পারেনি |

বাইপাসের ওপর হু-হু করে ইন্দ্রজিতের স্করপিও দৌড়োচ্ছে | সন্ধ্যেটা কেটেগেছে অনেক্ষন, অর্পিতার বাপেরবাড়ির অনুষ্ঠান ছিলো বলেই ইন্দ্রকে যেতে হয়েছিলো | ব্যাকসিট থেকে অর্পিতা নালিশ করে, “তোমার এই ইম্পোর্ট-এক্সপোর্টের বিজনেস-টা করার কি দরকার ছিলো বুঝি না”|
-কেনো ! কি হোলো ?
-তুমিতো সময়ই দিতে পারোনা কাউকে | আজকাল-তো দেখি বেশি টেনশনে থাকো | তুমি- কি খেয়াল করেছো তুমি আজকাল ঠিক মত কথা পর্যন্ত বলোনা |”
ইন্দ্র চুপ করে থেকে গেলো | র-য়ে যোগ দেওয়ার পর এটাই কন্ডিশন কেউ যেনো না জানে যে র-য়ের এজেন্ট | তাই অর্পিতাকে কিছু জানায়নি | ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট-এর বিজনেস দেখিয়ে ইন্দ্র বর্তমানে বেন্টিং-স্ট্রিটের একটা ভাড়ার অফিস থেকে অপারেট করে | ইদানিং সত্যি বড়ো চিন্তায় রয়েছে স্লীপার-সেলের খবরটা জানার পর | কখন কি হতে পারে, কেই-বা সঠিক বলতে পারে ! অথচ খবরটা ভাইরাল করেও যে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করা যাবে না | গোটা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাবে | মানুষ হয়তো রাস্তায় বেরোনো বন্ধ করে দেবে | তাতে, ফিনান্সিয়ালি খুব বাজে ভাবে এফেক্ট হবে, স্টক-মার্কেট পরে যাবে | সামনে দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে ওঠা আলো দ্রুতবেগে এগিয়ে এসে ধাক্কা মারলো | চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসে জ্ঞানশূন্য হওয়ার আগে দুটো গুলি ছোঁড়ার শব্দ শুনতে পায় ইন্দ্র | তারপর কিছু মনে নেই |

দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকা অর্পিতার চিতার সামনে পাঁজরের সবকটা হাড় ভাঙা অবস্থায় নিথর ইন্দ্র হুইল-চেয়ারে বসে | একপাশে সৈয়দ, আরেকপাশে ভিক্টর, কমল সাথে আরো দু-জন অফিসার | দূরে দাঁড়িয়ে অর্পিতার বাবা-মা সমেত অন্য আত্মীয়-রাও |
এবারের এটাই স্ট্রাটেজি ছিলো জাহাঙ্গীরের | ইন্ডিয়া আর ইন্ডিয়ার বাইরে ভারতের এজেন্ট-দের খুঁজে খুঁজে মার্ডার করা | শুধু কলকাতা নয়, হায়দ্রাবাদ, দিল্লী, লন্ডন, কানাডা, বুদ্যাপিস্ট, অনেক জায়গাতেই একদিনের মধ্যে অনেক এজেন্ট-এর ওপর হামলা হয়েছে | ইন্দ্র ছাড়া তারা কেউই এখন বেঁচে নেই | সেদিন কমলের কাছে বুদ্যাপিস্ট আর দিল্লীতে একইসময়ে একইরকম ঘটনা হওয়ার রিপোর্ট আসার পর কমলের সন্দেহ হয় | ইন্দ্রর সেলফোন ট্রেস করে লোকেশন ট্র্যাক করে, তারপর একটা ছোট টিম নিয়ে ছুটে যায় | এদিকে ইন্দ্রর স্কোরপিওতে একটা লরি সজোরে ধাক্কা মারে, ইন্দ্রর গাড়ি ছিটকে যেতেই দুজন লরি থেকে নেমে গুলি চালায় | কিন্তু দুটো গুলি ছোঁড়ার মুহূর্তেই সেখানে পৌঁছে যায় কমলের টিম | কিন্তু এ-এক্সিডেন্ট-এ ইন্দ্র বেঁচে গেলেও তার পরিবার বাঁচেনি |
আর কিছুক্ষন বাদেই অর্পিতার চিতা ঠান্ডা হয়েযাবে | ডোম এসে পিন্ডি সমেত ছাই একটা মাটির ছোট হাঁড়িতে দিয়ে যাবে ইন্দ্রর হাতে | অনন্যা-র চেপ্টে যাওয়া লাশটা আগেই দফন করা হয়েছে | ইন্দ্রর চোখের কোন দিয়ে সুতোর মত জল গড়িয়ে পরে | ভিক্টর ক্রাইম-স্পট থেকে পাওয়া দুটো কার্তুজ ইন্দ্রর হাতে দেয় |

মন্তব্য করুন