Skip to content

কার্তুজ – পর্ব এক । জয়ন্ত সেন

— টার্গেট ইন ফোর এইটিন ইয়ার্ড, এ ওম্যান উইথ এ কিড, ওভার |
— নেগেটিভ, উই আর নট টার্গেটিং সিভিলিয়ান্স, আই রিপিট •• | ওয়াকির ওপাশ থেকে কথাটা পুরো হওয়ার আগেই এম-টোয়েন্টি-ফোর স্নাইপারের বাইনোকুলারে স্পষ্ট দেখতে পেলাম মহিলাটি বাচ্ছা-টাকে হাতে একটা RKG-গ্র্যানাইড ধরিয়ে দিলো | তার ঠিক দেড়শো মিটার দূরেই আট জন জওয়ান একটা বাড়ি ঘেরাও করতে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে | কথায় আছে ‘ পৃথিবীতে সবার কিছু গুন্ থাকে, আর তাকে সেই গুনের পরীক্ষা সবসময় দিতে হয় ‘| টু-পয়েন্ট-এইট থ্রি ইঞ্চির বুলেট দু-হাজার আট ফিট পার সেকেন্ড-এ ছুটে গিয়ে বাচ্ছা ছেলেটার কপালে পৌঁছবার কয়েক সেকেন্ড পরেই ব্লাস্ট করলো | গ্র্যানাইড-টা তখনও ছুঁড়ে উঠতে পারেনি | কাশ্মিরি বেশে মহিলা আর বাচ্ছা-টার শরীর ছেঁড়া কাপড়ের মতো আকাশে উড়তে থাকে |
– ওয়েলডান মাঃ বয়, টুডে আওয়ার এইট সোলজার সেভড বাই ইওর ভিজিলেন্স |” বেসক্যাম্প-এ ফিরে ইন্দ্রজিৎ সেন জলের ঝাপ্টা-টা সবে দিয়েছে, ক্যাপ্টেন জগজিৎ সিং সামনে এসে দাঁড়ায় | ক্যাপ্টেনের বাহবায় ইন্দ্রজিতের শরীর আরো চওড়া হয়ে ওঠে, আজকের হিরো ও, সঙ্গী জওয়ান-রা হাততালি দিচ্ছে | কাশ্মীরের লালন নামের একটা গ্রামের এক বাড়িতে জঙ্গি-দলনেতা জাহাঙ্গীর লুকিয়ে থাকার খবর পাওয়া গেছিলো | জাহাঙ্গীর কাশ্মীরের স্বাধীনতার নামে আর্মস সাপ্লাই করে, খুন-খারাপি চালাচ্ছে, সেই খুনের ভিডিও হচ্ছে, তারপর ভাইরাল হয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সাড়া দেশে | আজকের তারিখে জাহাঙ্গীর হাইয়েস্ট টার্গেট | কিন্তু ইন্দ্রজিৎ-দের টিম সেখানে গিয়ে বুঝতে পারলো ভুঁয়ো খবর দিয়ে ওদের ট্র্যাপে ফেলা হয়েছে | কাশ্মীরি পোশাকে মহিলা, বাচ্ছা-ছেলে সবই সেই ষড়যন্ত্রের পেয়াদা মাত্র | আজ ইন্দ্রর জন্য আটজন জওয়ানের প্রাণ বেঁচেছে | কিন্তু সেই ইন্দ্রর চওড়া শরীরের ভেতর দপদপ করতে থাকা গোলাপি বেলুন-টা চুপসে আছে | কতইবা বয়স হবে ছেলেটার ! আট- ন বছর ! ইন্দ্রজিৎ সেই বয়সে একটা খেলনা বন্দুক নিয়ে সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াতো | বন্দুক দিয়ে আওয়াজ হতো টির-র-র টির-র-র |

বিছানায় শুয়ে শয়েই শরীর-টাকে টানটান করে আড়মোড়া ভাঙে অর্পিতা | মাথা ঘুরিয়ে দেখে ইন্দ্রকে | কত সহজ-সরল লাগে ঘুমের মধ্যেও ইন্দ্রকে | বুকের ওপর থেকে হাত সরিয়ে পাশে পরে থাকা হাউসকোর্ট-টা গায়ে জড়িয়ে নেয়, পায়ের কাছে গুটিয়ে থাকা চাদরটা দিয়ে ইন্দ্রর অনাবৃত দেহটাকে ঢেকে দেয় |
ওপরনিচ করে ফেনা সুদ্দ দাঁতে ব্রাশ ঘষার সময় সামনে টাঙানো আয়নাতে চোখে পরে নিজেকে | চোয়ালের পেছনদিকে, কানের লতির নিচে, গলায় ইন্দ্রর ভালোবাসার দাগ গুলো চোখে পরে | ব্যথা নয়, গর্ব অনুভব হয় অর্পিতার | ইন্দ্র ইজ এ হিরো, ন্যাশনাল হিরো | দেশের বর্ডারে পাহারা দিয়ে দেশের মানুষদেরকে রক্ষা করে | আর সেই হিরো অর্পিতাকে আপন করেছে নিজের জীবনে | তাই নিজের প্রতিও গর্ব হয় অর্পিতার | অর্পিতা সারাক্ষন সে গর্ব বয়ে বেড়ায় | কিন্তু শুধুই গর্ব ! যে দমচাপা ভয় অর্পিতাকে তাড়া করে বেড়ায় তার কথাতো কেউ জানে না, কেউই নয় | কাশ্মীরের সিভিলওয়ার, কাশ্মীর সম্পূর্ণ ভাবে স্বরাষ্ট্র হতে চাইছে, পাকিস্তান থেকে হাতিয়ার পাচার হচ্ছে মিলিটনসদের মদতের যোগানে, সন্ধ্যের পর কারফিউ লেগে থাকে, মাঝে-মধ্যেই জঙ্গী হানা হয় আর্মি ক্যাম্পে, পলিটিশিয়ান-দের ওপর | কে জানে কখন কি খবর আসে | এক একটা সময়ে নিউজ দেখে দম বন্ধ হয়ে আসে, সবসময় চাইলেও যোগাযোগ করা যায়না | এবারের ছুটিতে গতকাল ইন্দ্রর বাড়ি আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাড়া করে বেরিয়েছে | এই লড়াইটা ইন্দ্র একা লড়ছেনা, অর্পিতাও প্রতি-মুহূর্তে লড়ছে |

লেফট্যানেন্ট প্রভীন ঝা-এর সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিলো ইন্দ্রর | কাশ্মীরের পাহাড়ের আড়াল থেকে সূর্য ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে, খুব মনোরম দৃশ্য, যেনো স্বর্গ | অথচ এই স্বর্গতুল্য দেশের কোনায় কোনায় বয়ে যাচ্ছে কত রক্ত | ইন্দ্রর মন বিষাদে ভরে আছে | প্রভীন হয়তো বুঝেছিলো | – কি এতো ভাবছো ভায়া ?” ইন্দ্র কোনো উত্তর দেয়না | খুরশিদ নামের এক ইনফর্মারের বাড়িতে রাত-বিরেতে অপারেশন চালিয়েছিলো | খুরশিদ মারা গেছে, জানলার বাইরে থেকে একটা বুলেট মাথার খুলি চিরে বেরিয়ে যায় | জাহাঙ্গীরের খবর তখনও জানা যায়নি | কোনো কিছু বোঝার আগে আহত হয়েছে আরো এক জওয়ান | এলোপাতালি গুলি ছুটে আসতে থাকে তাদের দিকে | জমিয়ে মুকাবিলা করে, ব্যাকাপ ফোর্স আসা অব্দি, এরই মধ্যে আরো দু-জন জওয়ান আহত হয়েছে | ভোর হওয়ার আগেই জঙ্গীরা পালিয়েছে | হাতে কিছুই আসেনি |
ক্লান্তির মধ্যে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে ইন্দ্র বলে “দে হ্যাভ এ সার্প-শুটার | যে বুলেট-এ খুরশিদ মারা পড়েছে, আমাদের জওয়ান ইনজুরড ওটা সেভেন-পয়েন্ট-সিক্স-টু এমএম রাউন্ডের বুলেট ছিলো, ইটস এ দ্রাগুনাভ স্নাইপার, আর শুটার অশিক্ষিত হতে পারেনা, রাতের অন্ধকারে খুপরি জানলা দিয়ে পারফেক্ট এইম | দে আর ইউসিং আওয়ার স্ট্রাটেজি, কভারে স্নাইপার রেখে সামনে ফোর্স এলোকেট করা |” কথা বলতে বলতে ইন্দ্র হাপিয়ে ওঠে | কথার সাথে শ্বাসের শ্বব্দ স্পষ্ট হয় | ” আর্মস, এ-কে-ফর্টিসেভেন, ইউজি, গ্রানাইড ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে |
-শান্ত হও ইন্দার, কি হয়েছিলো, কেনো হয়েছিলো এসব ভাবার সময় নয় এখন | উই মেড ফর ফলোইং অর্ডার |
কোয়াটারে রিপোর্ট করে ইন্দ্র তার ডায়েরিটা নিয়ে বসে | ” আমি জানি খুরশিদ এতদিন ধরে কেনো আমাদের ভুল ইনফরমেশন দিচ্ছিলো | গতকাল রাতেই অর্পিতা জানিয়েছে আমি বাবা হতে চলেছি,এখন টু-মান্থ, খুব খুশি হয়েছিলাম আমি, কিন্তু আমার বন্দুকের নলের সামনে পরে খুরশিদের ভীতু দুটো চোখ দেখে আমার খুশি আনন্দের সব কারণ যেন দুমড়ে মুষড়ে একাকার হয়েগেলো | পরিবারের জন্য ভয় | তাদের সুরক্ষার ভয় | সে একজন বাবা, একজন স্বামী, তারও পরিবারের সুরক্ষার দায়িত্ব আছে | জাহাঙ্গীর খুরশিদকে সেই ভয় দেখিয়েই তার হয়ে কাজ করাচ্ছিলো | কি হবে খুরশিদের ছেলেটার ? আতঙ্কবাদীর ছেলের পরিচয় বয়ে বেড়াবে সারাজীবন ?”

চারিদিকে বিস্ফোরণ হচ্ছে, জঙ্গীদের অবিরত গুলিতে মাটিতে পরে আছে সিভিলিয়ান্স আর জওয়ানদের অগুন্তি লাশ, একপাশে রক্তার্ত অবস্থায় অর্পিতা কোলের শিশু অনন্যাকে নিয়ে মাটিতে বসে, চিৎকার করছে তারস্বরে, এতকিছুর মধ্যেও আমি জাহাঙ্গীরের অট্টহাসির কন্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, আমি নিরস্ত্র, অসহায় অপাহিজের মত দাঁড়িয়ে, একটা স্নাইপার আমাকে তাক করে আছে তখনও, খুরশিদকে দেখছি, ওর মুখে রক্ত লেগে আছে, কবরের মাটি লেগে আছে, তবু ওকে চিনতে পেরেছি, দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখছে, রাগে যেন বলছে ‘আগে ঘর পরিষ্কার করো | দশ-বারো বছরের সৈয়দ ছেঁড়া-ফাটা আলখাল্লা গায়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, ওর হাতে একটা থ্রি-সিক্স-টু এমএম সাইজের আন্টি-ট্যাঙ্ক আর-কে-জি গ্রানাইড | ছুঁড়ে দিলো আমাদের দিকে |
ধড়ফড়িয়ে ওঠে ইন্দ্র | ঘেমে নেয়ে একসা, গলা শুকিয়ে কাঠ, ঢকঢকিয়ে জল খায়, দুঃস্বপ্ন থেকে বাস্তবে আসতে সময় লাগে, তাকিয়ে দেখে অর্পিতা আর দুধের শিশুটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে | গতকালই অর্পিতা ইন্দ্রকে বলেছে চাকরিটা ছেড়ে দিতে, অর্পিতার বাবা রাসবিহারীর মোড়ে জায়গা দেখেছে, রেস্টুরেন্ট-এর বিজনেস খারাপ হবেনা মোটেও | ঘর থেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরায় ইন্দ্র, পাশের ঘরের আলো জ্বলতে দেখে উঁকি দেয়, সৈয়দ নামাজ পড়ছে, নিষ্পাপ সহজ-সরল সৈয়দকে দেখে খুব মায়া হয়, ওরতো কোনো দোষ ছিলোনা ! তবু শৈশব হারিয়েছে, পরিবার হারিয়েছে, তবে জাহাঙ্গীরের মত জানোয়ারের জন্য ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে কেনো ? তাই খুরশিদের মারা যাবার পর সৈয়দকে নিয়ে এসেছে বাড়িতে | সবচেয়ে যে ভয়টা পেয়েছিলো অর্পিতাকে নিয়ে তা আর হয়নি | কোনো মেলোড্রামা না করেই অর্পিতা সৈয়দকে ঘরে নিয়ে যায়, যত্ন করে খেতে দেয়, তার থাকার জন্য পাশের খালি ঘরটায় ব্যবস্থা করেদেয় |
সেদিন মলে গেছিলো ইন্দ্র, সৈয়দ আর অনন্যার জন্য শপিং করতে | মল থেকে বাইরে বেরোনোর পথেই হটাৎ ইন্দ্রকে পেছন থেকে ডাক দেয় কে যেন -স্যার, চিনতে পেরেছেন ?”তিনজনেই তাকিয়ে দেখেছিলো, চেনা চেনাই ঠেকছিলো কিনতু তখনও সঠিক ভাবে ঠাহর করতে পারেনি ইন্দ্র | যুবকটা মনে করায় ‘- টি সেভেন্টি-টু এম ওয়ান আর্মারেড রেজিমেন্ট, এইচ-কিউ স্কোয়াড , লেফট্যানেন্ট সুবীর বোস স্যার | আমার প্রথম অপারেশন আপনার আন্ডারেই হয়েছিলো |
– ইয়েস ইয়েস আই রিমেম্বার | তোমারতো পায়ে গুলি লেগেছিলো | হাউ আর ইউ নাউ ?
যুবকটা ডানপায়ের প্যান্টের নিচের দিকটা গুটিয়ে নিয়ে দেখায় যে তার একটা পা কাঠের | তারপর বলে ” বাদ পড়েছে স্যার ‘|
– আই’ম সরি, আমার জানা ছিলোনা |
– নো স্যার, ডোন্ট বি, আমি তো গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়েছিলাম, আপনি যদি আমায় সেদিন নিজের পরোয়া না করে আমায় তুলে ঘরে ঢোকাতেন ! আজতো আমি বেঁচেও থাকতাম না |” একভাবে কথাগুলো বলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে সুবীর |
সেদিন রাতে অর্পিতার চোখে ঘুম আসেনি, অনন্যাকে কোলে নিয়ে পিঠ চাপড়ায় আর নিজের সাথে লড়ে যায় | সুবীরের কথাগুলো কানে বাজতে থাকে | ইন্দ্রর জন্য এক মায়ের কোল শূন্য হয়নি | সন্তানের মৃতদেহ বাবা-মায়ের কাছে কতোবড় বোঝ হতে পারে অর্পিতা বোঝে | সেখানে অর্পিতা একটু যদি কম স্বার্থপর হয় !
না, ইন্দ্রকে আর আটকাবে না অর্পিতা | শুধু ইন্দ্র যাবার সময় জড়িয়ে ধরে, বুকের ভেতরের সব আবেগ সব লড়াইয়ের সাথে ইন্দ্রকে বলে ‘কথা দাও,এভাবেই ফিরে আসবে |

মন্তব্য করুন