Skip to content

এক ছিটমহলের গল্প

সময়টা আঠারোশো শতাব্দীর আশে পাশে।হুগলী নদীর পারে এক ছোট্ট ছিটমহল। নদীবেষ্টিত বদ্বীপ।সেখান থেকে দেখা যায় দূরে কোলকাতা শহর জন্ম নিচ্ছে। এত কাছে তবু অনেক দূর।ব্রিটিশ রাজা সবজায়গার রাজা।তবু এখানে যেন তার আলো এসে পড়ে নি। এখানকার অধিবাসীরাও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে।একটুকরো জমি দখল করে বেড়াচাপার বাড়ি বানিয়েছে।তবে জমি পেতে একদল দালাল বা গুন্ডাকে টাকা দিতে হয়েছে।গুন্ডারা ওখানে থাকে না। কোলকাতা শহর থেকে আসে। এখানকার ওরাই রাজা।এই গজিয়ে ওঠা ছিটমহলের ওরাই সব।
ওদের জীবন না গ্রামীণ না শহুরে না বস্তির। সবকিছু মিলেমিশে একাকার।
এখানকার মেয়েরা অনেকেই কাজ করে।কেউ শহরে বাবুদের বাড়ী কাজ করে কেউ বা বাবুদের খু্শি করে।
ছেলেরাও তাই।যতরকম শ্রমিকের কাজ হয় তা করে।রিকশা চালায়,রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে,ঘরের চাল ছাওয়ায়,ইলেকট্রিকের কাজ করে,চুরি করে, প্রয়োজনে খুন জখম ও।
এ এক সবহারানো কিছু বিচিত্র মানুষজনের বিচিত্রময় জীবন।

এমনি এক সময়ে সেখানে এসে পড়ল এক পরিযায়ী কবি।কবিও সর্বহারা। একদিন সব ছিল তার ।জমিজিরেত ,স্ত্রী পুত্র কন্যা মা বাবা ,প্রসংশক দল, নাম যশ। কিন্তু মহামারী কলেরায় সব শেষ হয়ে গেল।সেই শুধু বেঁচে রইলো।
তাই বাকী পিছুটান ফেলে একদিন বেরিয়ে পড়ল জীবনের সন্ধানে।হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছল এই বিচিত্রনগরে।

এসে দেখে এ কি জীবন।দৈনন্দিতায় বেঁচে থাকা। কালকের ভাবনা নেই। পাখির বাসার মত বাসা।পশুদের মত দিনযাপন।তাতেই কি জীবনীশক্তি।হাসছে কাঁদছে খেলছে ছুটছে ।চিল চীৎকারে ঝগড়া করছে।অবলীলায় দা হাসুয়ার কোপ দিচ্ছে।মরে গেলে পুড়িয়ে ফেলা দেহ বা মাটির গভীরে পুঁতে ফেল। পুলিশ আসবে না।ঐ গুন্ডাদের শুধু জরিমানা দিতে হবে। আবার জীবন চলে জীবনের মতো।কোনো অনুশোচনা নেই,বিবেকের তাড়না নেই। শুধু বেঁচে থাকার প্রবলতায় সমুদ্রে তরী বাওয়া।আবেগহীন নিষ্ঠুর এবং রঙিন হিংস্র জীবন।
কবি যে দুঃখ আবেগ বেদনায় জর্জরিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এখানে এসে সব হারিয়ে গেল।এ ও তো জীবন। আজকের জন্য বেঁচে থাকা। চরম আনন্দে আপন বাঁচার প্রবলতার প্রগলভতায়।অন্য কিছু ভাবনার অবকাশ কোথায়।শিশুরা নিজের মতো বেড়ে ওঠে ।বড় হয়।অপারগ যারা , অসুস্থ যারা তারা বিদায় নেয়।নেই দুঃখ নেই বেদনা। শুধু নিজেকে নিয়ে নিজের জন্য বাঁচা।
কবি থেকে গেল।ওদের মাঝেই থেকে গেল। এতদিনের শিক্ষা দীক্ষা ভাবনা আবেগ তার ঝোলার মধ্যে ভরে রয়ে গেল ওদের মধ্যে। কিন্তু কোথায় এক ব্যবধান থেকে যায়।কবি কখনো মৌন, কখনো ওদের কথা শোনে।কখনো বুড়োদের দল কখনো বা শিশুরা এসে ভিড় করে ওর দাওয়ায়।গুন্ডারাও ওখানে ভয়ে ভয়ে যায়।সন্দেহের চোখে দেখে।কখনো বা শুভভাব এসে যায়।শুভের উদ্ভবের আশঙ্কায় পালিয়ে যায় সেখান থেকে।
পরপর অশক্ত শিশুদের কয়েকজন কবির আদর যত্নে প্রাণ ফিরে পায়।
এতেই ওখানকার নিষ্ঠুর জীবনে যেন একটু স্নেহের জন্ম দেয়।মায়েদের বুকের ভিতরে এক সুপ্ত আবেগের নদী থাকে। এসময়েই তারা বেরিয়ে আসে প্রবলভাবে।
ওদের মধ্যে মনুষ্যত্বের উদ্ভব হয়। এভাবেই ওদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল মানুষের মুখ।
একদিন কিভাবে এক শহুরে অপরাধীর সন্ধানে সেখানে এসে পৌঁছাল একদল নাগরিক পুলিশ।এসেই আবিষ্কার করল নতুন দেশের।তারপর ধীরে ধীরে এলো প্রশাসন।উন্নয়ন।
সেই ছিটমহলের মানুষের মনে যে মনুষ্যত্বের আলো প্রজ্বলিত হয়েছিল কবির ছোঁয়ায় ,নাগরিক ছোঁয়া তাকে পরিণত করল আধুনিকতায়।
কবি ততদিনে ঝোলা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে আবার কোনো অজানার সন্ধানে।

/////////১৩/০৫/২০২১///////

মন্তব্য করুন