Skip to content

আমার মা অমিতা রায়চৌধুরী — মলয় রায়চৌধুরী

আমার মায়ের জন্ম ১৯১৬ সালে, পানিহাটিতে । মায়ের ডাক নাম ভুল্টি । মায়ের বাবা, কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, পানিহাটির রামচাঁদ ঘাট রোডে ‘নিলামবাটী’ নামে এক একান্নবর্তি পরিবারের সদস্য ছিলেন । কিশোরীমোহন ছিলেন, কলকাতা ও সেকেন্দ্রাবাদে, ম্যালেরিয়া রোগের কারণ নির্ণয়কারী ও ১৯০২ সালে সেকালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ডাক্তার রোনাল্ড রস-এর সহকারী । তাঁর অবদানের জন্য ১৯০৩ সালে দিল্লি দরবারের সময়ে কিশোরীমোহনকে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছিল । ২০১৩ সালে প্রকাশিত তাঁদের ‘দি ফ্লাইং পাবলিক হেল্হ টুল : জেনেটিকালি মডিফায়েড মসকিটোজ অ্যান্ড ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল’ ( সায়েন্স অ্যাজ কালচার, ল্যাংকাস্টার, ইউ কে ) গবেষণাপত্রে উলি বিজেল এবং ক্রিস্টোফ বোয়েট অধ্যাপকদ্বয় জানিয়েছেন যে উপনিবেশের নেটিভ হবার কারণে কিশোরীমোহনের নাম রোনাল্ড রসের সঙ্গে সুপারিশ করা হয়নি । সমাজ সেবার কাজে স্ত্রীর গয়না এবং পৈতৃক সম্পত্তি বেচে, আর সঞ্চয়ের পুঁজি খরচ করে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান, আর মায়ের বিয়ের কয়েক বছর পরই মারা যান ।

দেউলিয়া অথচ খ্যাতিপ্রাপ্ত অমন একটি বাংলা-ইংরেজি পড়া আধুনিক পরিবার থেকে মা আমাদের সংস্কৃত-ফারসি পড়া গঙ্গার অপর পাড়ের উত্তরপাড়া নিবাসী পরিবারে এসেছিলেন । উত্তরপাড়ার জমিদারবাড়ি তখন খণ্ডহরে রূপান্তরিত হওয়া আরম্ভ হয়েছে । আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ ছিলেন কিশোরীমোহনের বন্ধু । ম্যালেরিয়া রোগ সম্পর্কে প্রচারের জন্য পেইন্টার-ফোটোগ্রাফার ঠাকুর্দা কিশোরীমোহনকে ম্যাজিক লন্ঠনের জন্য স্লাইড তৈরি করে দিতেন । বিয়ের সময় মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর । বাবা, রঞ্জিত, জন্মেছিলেন লাহোরে । ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার ঠাকুর্দা বহুকাল আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার আর বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ছিলেন । অর্থাৎ মা এসে পড়েছিলেন এমন একটি পরিবারে যার সদস্যদের সাংস্কৃতিক চরিত্রগঠন ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছিল ।

ছয় ভাই আর এক বোনের সেজভাই ছিলেন আমার বাবা । বড়জেঠিমা নন্দরানি নয় বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন । মেজজেঠিমা এসেছিলেন তেরো বছর বয়সে । কাকিমারা এসেছিলেন তাঁদের বয়স যখন সতেরো । দাদু তাঁর ছেলে আর তাদের স্ত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন রাজপরিবারের অতিথি হয়ে তার সদস্যদের ফোটো তুলে পেইনটিঙ তৈরি করে দিতেন । পাটনায় দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার সময়ে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । দাদু মারা যাবার পর বড়জেঠা পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ শ্রেনির কাজ পান ; কিন্তু ওইটুকু মাইনেতে এতজনের পরিবারের খরচ সামলানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল । বছর দশেক পরে অবশ্য উনি পদোন্নতি পেয়ে কিপার অফ পেইন্টিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচাসর হন । ভাই আর তাদের পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে বাবা ফোটোগ্রাফির স্হায়ী দোকান খোলেন পাটনায় । এই সময় থেকে আমাদের পরিবারে মায়ের গুরুত্ব বেড়ে যায় । দারিদ্র্য সামলাতে না পেরে ঠাকুমা মায়ের হাতে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে চলে যান উত্তরপাড়ার খণ্ডহরে একা থাকতে । ভূমিকম্পের পর ইমলিতলার অন্ত্যজ পাড়ায় বিহারি কাঠামোর একটি বাড়ি কিনে পুরো পরিবার সেখানে চলে আসেন । দলিত বিহারি এবং অতিদরিদ্র শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ার মাগধি আর ভোজপুরি ইথসকে সহজেই মা আ্ত্তীকরণ করে নিতে পেরেছিলেন ।

সংসারের ক্ষমতা মায়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবার পর মায়ের চরিত্রে লুকোনো কিশোরীমোহন বেরিয়ে আসে । প্রায়ই দেখতুম ইমলিতলার প্রতিবেশিরা এসে মায়ের কাছে নিজেদের আর্থিক দৈন্য আর পারিবারিক দুর্দশার গল্প করছে, আর মা তাদের সাহায্য করছেন, পয়সাকড়ি দিয়ে তো বটেই, চাল-ডাল, পুরোনো বাসনপত্র আর ব্যবহৃত জামাকাপড়, পুরোনো হয়ে আসা জুতো ইত্যাদি দিয়ে দিয়ে । মায়ের বোনেদের বিয়ে আরও গরিব পরিবারে হয়েছিল বলে পুজোয় পাওয়া শাড়ি-চটি ইত্যাদি নিজে না পরে বোনেদের বা নিলামবাটীর দুস্হ জ্ঞাতিদের পাঠিয়ে দিতেন বা যখন নিজে যেতেন তখন নিয়ে যেতেন । যদিও মা পরিবারের ডি ফ্যাক্টো কর্ত্রী ছিলেন, কিন্তু ইমলিতলার বাড়িতে মা-বাবা-দাদা-আমি থাকতুম সবচেয়ে ছোটো ঘরটায় । লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনা, রাস্তার কল থেকে জল ভরে আনা । দাদার এক ভায়রাভাই অত্যন্ত গরিব ছিলেন, চাকরি পাননি, তাঁদের পরিবারকেও মা নিয়মিত র‌্যাশান দিয়ে আসতেন, আমার মেয়ের ফ্রক আর জুতোও অনেক সময়ে লুকিয়ে দিয়ে এসেছেন যা আমরা এতোদিন পর জানতে পারছি সেই ভায়রাভাইয়ের মেয়ের কাছ থেকে ।

সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকার চারিত্রবৈশিষ্ট্যের দরুণ বড়জেঠা সংসারের সমস্ত ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করতেন । আমার মনে আছে, ১৯৫১ সালে যে বছর প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, কোন দলকে ভোট দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনার শেষে মায়ের নির্ণয় সবাই মেনে নিয়ে ছিলেন, অর্থাৎ যার যে দলকে ইচ্ছে ভোট দেবে । কলকাতায় নাকতলায় থাকতে অবাক লাগত দেখে যে বাড়ির কর্তা যে দলের সমর্থক, পরিবারের সকলেই সেই দলকে ভোট দ্যায়, অথচ তারাই আবার ডাইন্যাস্টিক পলিটিক্সের তর্ক তোলে !

স্কুলে ভর্তি হয়ে টের পাই যে মা শুদ্ধ হিন্দি জানেন না, ইমলিতলার ‘ছোটোলোকি’ বুলি দখল করে ফেলেছেন, আর তার বহু শব্দ যে শুদ্ধ হিন্দিতে অশোভন, এমনকি অশ্লীল, তা উনি অনেক পরে জানতে পারেন, যখন আমরা ইমলিতলা ছেড়ে দরিয়াপুরে সুন্নি মুসলমান পাড়ায় চলে যাই । পানিহাটিতে মেয়েদের স্কুল তখনও ছিল না বলে মা নিরক্ষর হয়েই এসেছিলেন ; নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন দাদা স্কুলে ভর্তি হবার পর । নভেল আর বাংলা সংবাদপত্র পড়া অভ্যাস করেন । একটা হিসাবের খাতা লেখা আরম্ভ করেন ।

ইমলিতলার বাড়িতে হিন্দুত্ব সামলাবার কাজ ছিল পুজারী বাড়ি থেকে আসা বড়-জেঠিমার । সেকারণে মা এবং কাকিমারা প্রতিদিনের ধর্মাচরণ থেকে নিজেদের আর আমাদের মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন । জনৈক পাদরির আর্থিক সৌজন্যে প্রাইমারি স্তরে আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম ; মা ঘটিতে গরম জল ভরে আমার শার্ট-প্যান্ট আয়রন করে রাখতেন। আমার বাংলা বনেদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বলে মায়ের নির্দেশে আমাকে ব্রাহ্ম স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করা হয়েছিল ।

দরিয়াপুরের বাড়িতে আমি একা থাকতুম বলে, এবং এর-তার কাছে শুনে, আমার চরিত্রদূষণ আটকাতে বাবা আর মা প্রতি রাতে ইমলিতলার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া সেরে, দরিয়াপুরে থাকা আরম্ভ করেন । দাদা ১৯৪৯ সালে কলকাতার সিটি কলেজে পড়তে চলে গিয়েছিলেন, দরিয়াপুরের বাড়িতে দাদা ফেরেন চাকরির শেষ বছরে, তখন আমি মা-বাবাকে নিয়ে লখনউ চলে গেছি । ইমলিতলার বাড়ি থেকে মা প্রতিদিন রাতে টিফিন ক্যরিয়ারে করে আমার আর বাবার খাবার নিয়ে দরিয়াপুরে আসতেন, প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে।

দরিয়াপুরে পাকাপাকি চলে আসার পরও ইমলিতলার সদস্যদের দায়িত্ব মা ছাড়েননি ; সপ্তাহে এক দিন গিয়ে টাকাকড়ি আর চাল-ডাল-আনাজের ব্যাপারটা সামাল দিয়ে আসতেন । গোলা রোডের এক বানিয়ার দোকানে তালিকা দিলে সে যাবতীয় জিনিস ইমলিতলা আর দরিয়াপুরে পাঠিয়ে দিত । পুজোর সময়ে পোশাকের ভেদাভেদ মেটাতে সবায়ের জন্য ছিল একই কাপড়ের শার্ট আর ফ্রক, এমনকি জেঠা-কাকারাও সেই কাপড়ের শার্ট পরতেন ।

স্কুলের পর্ব শেষ করে যেটুকু সময় ছিল আর ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে আমি আমার বন্ধু তরুণ শুরের মামার ট্রাকে করে নানা জায়গায় চলে যেতুম, বাড়িতে বলে যেতুম না, বললে বাবা-মা যেতে দেবেন না অনুমান করে । বলা যায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতুম । ফিরে আসার পর মা কিছুই বলতেন না । পরে আমার মেয়েকে উনি বলেছিলেন যে ওনাদের না জানিয়ে আমি বাড়ি থেকে পালাতুম ।

দাদা চাকরি পাবার পর দাদার চাকুরিস্হলে গিয়ে মা মাঝেমধ্যে সপ্তাহখানেকের ছুটি কাটিয়ে আসতেন । দরিয়াপুরের বাড়িতে কাজের মাসি রান্না করে দিত । নিম্নবর্ণের হাতে রাঁধা ভাত বাবা খেতেন না বলে ভাতটা আমিই বসিয়ে দিতুম । রান্নায় মাকে সাহায্য করতে হতো বলে ডাল-তরকারিও রাঁধতে শিখে গিয়েছিলুম । এখনও মাঝে-মাঝে স্ত্রীকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করি । মা বলতেন, ডাল আমি ভালো রাঁধতে পারি ।

হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার আর আমার বন্ধুরা কোর্টে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে গেছেন শুনে মা, যিনি ছিলেন অত্যন্ত চাপা প্রকৃতির, নিজের ক্রোধ সামলাতে পারেননি । আমি তাদের চিঠি ইত্যাদি ছিঁড়ে ফেলছি দেখে বলেছিলেন, ‘সব নিয়ে গিয়ে গুয়ের ডাবায় ফ্যাল ; সব কটাই আহাম্মক, অকৃতজ্ঞ ।’ আমার আর দাদার লেখালিখি সম্পর্কে উনিই ছিলেন প্রধান উৎসাহদাত্রী । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে যে কবিতাটা নিয়ে মকদ্দমা হয়েছিল সেটা মা-বাবা-ঠাকুমা সকলেই পড়েছিলেন ।

নাগপুরে অফিসের কাজে গিয়ে রাজ্যস্তরের হকি প্লেয়ার ও সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ে করতে চাই জানিয়ে পাটনায় খবর পাঠালে মা চিঠি লিখে পাঠান যে ‘সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে আসলেই হবে ।’ তার কারণ আমার বন্ধুনিদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকতেন উনি । আমার সম্পর্কে নানা গালগল্প শুনে বেশ উদ্বেগে থাকতেন । এমনকি আমার পেছনে কয়েকজন ঘটককে লাগিয়ে দিয়েছিলেন যারা প্রায়ই আমার অফিসে একজন তরুণীকে নিয়ে হাজির হতো । বাড়িতে এসে মায়ের কাছে এই বিষয়ে অভিযোগ করলে উনি বলতেন, এছাড়া আমার অন্য উপায় নেই, কোনো একজনকে তো পছন্দ কর ।

লখনউ বদলি হয়ে আমরা চলে গেলে মা একা হয়ে গিয়েছিলেন, রান্নার মাসি রাখা হয়েছিল ওনার দায়িত্ব কমাবার জন্য । আসলে উনি আমার মেয়ে আর ছেলের সঙ্গে সময় কাটানোয় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের অভাব বোধ করতেন । একাকীত্ব কাটাবার জন্য পাটনার বিভিন্ন বাঙালি পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে গল্প করতে চলে যেতেন প্রতি সন্ধ্যায় । দাদা পাটনায় চলে আসার পর মা আর বাবাকে আমি লখনউ নিয়ে চলে আসি । লখনউতে মায়ের হৃদরোগ আর আরথ্রাইটিস ধরা পড়ে ।

হৃদরোগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে তখন আমরা ততটা পরিচিত ছিলুম না, মাও তাঁর কষ্টের কথা বলতেন না। লখনউতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮ই নভেম্বর ১৯৮২ মারা যান । মা মারা যেতে আমি লখনউয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলুম ।

মন্তব্য করুন