Skip to content

আমরা – তখন ও এখন

একাধারে বহে পূত সুরধুনী একাধারে পারাবার,
নয়ন জুড়ানো ভুবনমোহিনী প্রকৃতির সম্ভার।
শস্যশ্যামলা সুজলা সুফলা ললাটে কনকশিখা,
হিমালয় নগ পরায়েছে মাথে ভাস্বর ভানুটীকা।
বিধির আশীষ যাহার শিয়রে সততই প্রতিভাস,
সেই পুণ্যসলিলা বঙ্গভূমিতে আমাদের অধিবাস।

মহাদুর্যোগ, বন্যা কি খরা , মণ্বন্তর, মারী,
মোদের জীবনে ফি বৎসরই ভয়াল যতেক অরি।
জীবন মোদের ছত্রভঙ্গ পদে পদে তারই জঙ্গ,
তথাপি বিধির কৃপায় তাঁহার লভিয়াছি অনুসঙ্গ।
ভয়াল প্রভন্জনের সাথে অসম জীবন যুদ্ধ,
শার্দুল তথা অহির সঙ্গ প্রতি পলে করে বিদ্ধ।
তথাপি আমরা নাহি শঙ্কিত সাহসিক প্রাণশক্তি,
সুধারূপ দেব ললাম অঙ্গে-যতেক বিপন্মুক্তি।
আমরা জীবিত দেবসুধা পানে-তাঁহার আশীষ মাথে,
ইষ্ট মোদের পরম আত্মীয় বিরাজ করেন সাথে।
পরমেষ্ঠীর করুণা ললাটে সততই সীমাহীন,
কবির কথনে মিলনমন্ত্রে শুদ্ধি হইবে ঋণ।

বাংলার ভূমি বাংলার বায়ু বাঙলার বহু পুণ্য,
মোদের আঙন মহামানবের পদধূলি লভে ধন্য।
চন্দ্রগর্ভ মোদের গর্ব শ্রীজ্ঞান দীপঙ্কর,
জ্ঞানের শিখায় আজিও অতীশ তিব্বতভাস্কর।
সিংহের থেকে সিংহল নাম প্রাচীন যুগের লঙ্কা,
বাঙালী তনয় বিজয়সিংহ বাজালেন জয়ডঙ্কা।
বারো ভুঁইয়ার প্রবল প্রতাপে মুঘলেরা পিছু হটে,
মহারাণী দেবী ভবশঙ্করী রায়বাঘিনীই বটে।
বীর জ্ঞানীগুণী এমনই বাঙালী ঊজ্জ্বল ইতিহাসে,
স্বদেশ গণ্ডী ছাড়ায়ে কীর্তি ছড়ায়ে গিয়েছে বিদেশে।

বাঙালী তনয় লৌহহৃদয় অসমসাহসী সুরেশ,
জ্ঞান ভাণ্ডারী তথাপি পরণে বীর যোদ্ধৃবেশ।
শ্রীচৈতন্য,শ্রীরামকৃষ্ণ,সারদা মায়ের স্পর্শ,
এই ধরণীর কোণেকোণে আজো জাগায় হিয়ায় হর্ষ।
দ্বিগ্বিজয়ী বীর সন্ন্যাসী স্বামীজি বিবেকানন্দ,
তাঁহার প্রভাবে পশ্চিম লভে সন্জীবনের ছন্দ।
দুর্জয় হিয়া শূর সুভাষের জীবনের জয়গান,
উথালপাথাল করে আপামর দেশভক্তের প্রাণ।
বিশ্বকবির জগতের মাঝে মহামিলনের ছন্দ,
ঘটায়েছে ইতি এই বিশ্বের কত হানাহানি দ্বন্দ্ব।
বাঙালীর ছেলে মেঘনাদ তথা সত্যেন,জগদীশ,
প্রমাণিত সারা বিশ্বের মাঝে বাঙালীরা জ্ঞানাধীশ।
মার্গগীতির গায়কীর সাথে কত কুশীলব গুণী,
বিশ্ব রঙ্গমন্চে আজিও তাঁহাদের নাম শুনি।
দূরকে করেছে গভীর আপন বঙ্গসংস্কৃতি,
মনের দুয়ার দিয়াছে খুলিয়া স্বর্ণযুগের গীতি।
সাহিত্য থেকে শিল্পকর্মে বঙ্গবাসীর মেধা,
দেশ দেশান্তরে ছড়ায়ে দিয়েছে সৃষ্টিনিপুণ সুধা।
সত্যজিতের অসীম প্রতিভা ঊজ্জ্বল সারা বিশ্বে,
যেমনি কলমে তেমনি নিপুণ চলচ্চিত্র দৃশ্যে।
বিশ্বশ্রী মনোহর ছিল চেহারাতে অতি খর্ব,
কিন্তু তাহার দেহমন্দির বাঙালীর চিরগর্ব।
আমরা বাঙালী উন্নত শির বিশ্বের দরবারে,
বারে বারে ঐ বিশ্বজয়ের মুকুট মোদের শিরে।

কিন্তু এসবই অতীত কথন-অধুনা অবক্ষয়,
দ্বেষাদ্বেষি তথা আত্মহননে বাঙালীর অত্যয়।
ভুলিয়াছে রঘু, কপিল,ধীমান-ভুলিয়াছে ইতিহাস,
যে জাতি আত্ম বিস্মৃত হায় তাহার সর্বনাশ।
সংস্কৃতের অমল ছন্দে গীতগোবিন্দ পুষ্ট,
রূপকধর্মী গোপনাট্যটি কবি জয়দেব সৃষ্ট।
বাঙালী মানসে অমর কবির আলয় বিলীন প্রায়,
নব্য যুগের উদাসীনতা-কবিপ্রাণে নাহি সয়।
কৃত্তিবাস কি কাশীরাম দাস-মহাকাব্যের কবি,
তাঁহারাও হায় ব্রাত্য অধুনা-হারায়ে গিয়েছে ছবি।
বাঙালীর প্রাণ রবীন্দ্রময়-নজরুলে টানে রাশ,
কোথা মধুকবি, কান্ত, দ্বিজেন, কুমুদ কি কালিদাস !
রবিকবি তিনি কবিগুরু তবু অন্যেরা মনকাড়া,
পালকির গান বাঙালীর প্রাণে আজ ত’ দেয়না সাড়া।স্মৃতির অতলে কত সাহিত্য কত যে শিল্পকর্ম,
বাঙালীরা আজি বিষ্মৃত প্রায় আপন কৃষ্টি ধর্ম।
জ্ঞানের সাধক প্রফুল্ল রায় ইতিহাস রসায়নে,
উদ্যোগপতি তাঁহার নামটি কজনা রাখিনু মনে !
শিক্ষা প্রসারে সবলা,অবলা এবং সতীশ দাস,
বাঙালী হিয়ায় তাঁহারা ব্রাত্য-নাহি কোন মধুবাস।
ন্যায়াধীশ শ্রীরাধাবিনোদকে কজন বাঙালী জানে !
অক্ষয় আজো তাঁহার স্মৃতিটি জাপানের কোণে কোণে।

আশাভরা ছিল কবির দৃষ্টি ভবিষ্যতের পানে,
কিন্তু সে আশা নির্মূল আজি সত্যের অনটনে।
ধাতা কি বিধাতা কাহারো আশীষ নাহি বাঙালীর সঙ্গে,
প্রজ্ঞা হেথায় নহে প্রোজ্জ্বল-হানাহানি সারা বঙ্গে।
বাঙালীর হিয়া আজি নির্দয় লালসায় পরিপুষ্ট,
মমতা যেথায় অনিকেত হায় অন্তরে নাহি দৃষ্ট।
অতীতে যাহার সূচনা তাহার অতীতেই বুঝি ইতি,
বাংলার মাটি রাজনীতিমুখী পূতিময় দুর্নীতি।
বাঙালী যা করে অন্যেরা ভাবে সেদিনেও মহাদীপ্ত,
আজিকে তাহার বীজ বপনের সৃজন ক্ষমতা সুপ্ত।
যেথায় একদা সগর বংশ লভে অভিশাপমুক্তি,
সে ভূমে মানুষ শাপগ্রস্ত হারায়েছে শুভশক্তি।
তাই বাংলা মায়ের কপোলে অশ্রু হৃদিখানি অতৃপ্ত,
মান হুঁশ সব হারায়ে বাঙালী অভাজন অভিশপ্ত।
বাঙালী প্রতিভা ক্ষীণতর আজি গরিমা লুপ্তপ্রায়,
কিরূপে আমরা মুক্ত হইব দেব-ঋণ সনে হায় !
————————————————————-

মন্তব্য করুন