Skip to content

ফল্গুনদীর ধারা – পর্ব ১ – স্বপন চক্রবর্তী

তোমরা কি কেউ ভূতে বিশ্বাস করো ! কেউ হয়ত বলবে করো,আবার কেউ বলবে করো না। আর যুক্তিবাদী আধুনিক আধুনিকারা ত’ ভূত, আত্মা, এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্বকেও স্বীকার করেন না।

কিন্তু আমি করি। ভূত, আত্মা সবেতেই বিশ্বাস করি। কারণ নিজের চোখে যা দেখেছি , নিজের কানে যা শুনেছি তাকে অবিশ্বাস করি কি করে ! আর ঈশ্বরের অস্তিত্ব ত’ জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আমি উপলব্ধি করে আসছি সেই কৈশোরকাল থেকেই। এক আধিদৈবিক শক্তির অঙ্গুলিলেহনেই যে আমাদের সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত, তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি পৃথিবীর খ্যাতনামা চিকিৎসক তথা বিজ্ঞানীরাও বহু প্রাচীন কাল থেকেই এই শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে আসছেন।আর তথাকথিত আধুনিক যুক্তিবাদীরা যখন অনন্যোপায় হন তখন তাঁরাও এ বিষয়ে কোন বিরুদ্ধ মন্তব্য করা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখেন। যাই হোক, সেসব ত’ অনেক ভারী ভারী কথা। আজ সে প্রসঙ্গে যাবো না। তার থেকে আত্মা বা ভূত সম্বন্ধে একটা কাহিনী তোমাদের শোনাই। আমার জীবনের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ একটি কাহিনী।

আমার আজন্ম কেটেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তবে তখন কেবল চব্বিশ পরগণা ছিল। যদিও সেই গ্রামটি অধুনা এক বড়সড় শহরে পরিণত হয়েছে, কিন্তু আমার শৈশবে সেটি একটি গ্রামই ছিল।অবশ্য জায়গাটির অবস্থান কোলকাতা থেকে খুব দূরে নয়।আর সেই সময়েও ঐ গ্রামে ছেলেদের আর মেয়েদের দুটি করে উচ্চ বিদ্যালয় ছিল। সব থেকে গর্বের বিষয় হলো এই যে আজও এই ইংরাজী মাধ্যমের যুগেও সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সগর্বে বিদ্যমান।

যাই হোক আমাদের বাড়ীর খুব কাছে ছেলেদের যে বিদ্যালয়টি ছিল সেটি অতি সুপ্রাচীন এবং যথেষ্ট খ্যাতনামা। স্থানীয় অভিভাবকবৃন্দ তাঁদের ছেলেদের ঐ বিদ্যালয়ে পড়াতে পারলে সৌভাগ্যাণ্বিত বোধ করতেন।তার একটি প্রধান কারণ ছিল বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মহাশয় শ্রী শশীশেখর চট্টোপাধ্যায়।
অত্যন্ত রাশভারী প্রকৃতির মানুষ।শীত গ্রীষ্ম বর্ষা তাঁর পরণে সবসময়ই থাকত ধূতি , জামা আর তার উপরে ধূসর রঙের কোট।উচ্চশিক্ষিত এই মানুষটির যেমন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষার বিষয়টিই ছিল ধ্যানজ্ঞান, ঠিক তেমনই নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার প্রতি ছিল কড়া নজর।অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ তাঁকে যেমন শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন,তেমনই কিছুটা ভয়ও পেতেন। আর ছাত্রদের ত’ কথাই নেই। ‘হেডস্যারের’ সামনে এলে তাদের পাদুটো ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপত।কিন্তু হেডস্যার কারোকে প্রহার করা ত’ দূরের কথা, কারো সাথে উচ্চস্বরে কথাও বলতেন না।কিন্তু এমনই তাঁর দাপট ছিল যে তাঁর আগুনের মত চোখ, কঠোর চাহনি আর গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরের সামনে এলেই সবার বুঝি হৃদকম্প শুরু হয়ে যেত।সেই জন্য ছাত্ররা পিছনে তাঁকে শশী স্যার না বলে ফাঁসি স্যার বলে ডাকত।

কিন্তু মানুষটিকে যতই বাইরে থেকে দেখে কঠোর প্রকৃতির মনে হত, অন্তরটি ছিল ততটাই কোমল।অনেকটা ফল্গুনদীর ধারার মত।হেডস্যার নবম থেকে একাদশ শ্রেণী অবধি ছাত্রদের ইংরাজী পড়াতেন। তখন মাধ্যমিক অর্থাৎ দশম আর উচ্চ মাধ্যমিক অর্থাৎ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী ছিল না। একেবারেই উচ্চ মাধ্যমিক ছিল,নবম থেকে একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। সেই একাত্তর বাহাত্তর সালে হেডস্যারের মত ইংরাজী শিক্ষক সারা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় বিরল ছিলেন। দূরদূরান্ত থেকে অন্য বিদ্যালয়ের ছাত্ররাও তাঁর কাছে ইংরাজীর পাঠ নিতে আসতো। আর তিনি যখন ক্লাসে পড়াতে আসতেন তখন তাঁর হুঁশ থাকতো না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি পড়িয়ে যেতেন আর আমরা ছাত্ররা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁকে অনুসরণ করতাম। বাইরে কঠোর ভিতরে কোমল রূপের এই মানুষটির কাছে সকল ছাত্রই ছিল সন্তান স্বরূপ। আর মেধাবী এবং গরীব ছাত্র হলে ত’ কথাই ছিল না। তাদের জন্য সবরকম সাহায্যের উদ্দেশ্যে তাঁর গৃহের দুয়ার চির অবারিত থাকত।

এবার মূল কাহিনীতে আসি। হেডস্যার আমায় খুব ভালবাসতেন। ইংরেজী ভাষাটির ওপর আমার ছোট থেকেই সামান্য দখল ছিল। আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। ইংরাজীতে আমি ছিলাম সবার সেরা।তাই হেডস্যারের আমার উপর বিশেষ নজর ছিল এবং তিনি আমায় যথেষ্ট স্নেহ করতেন। আর তাঁর সেই স্নেহরূপ ফল্গুনদীর ধারা আমাকে কেমন করে প্লাবিত করেছিল সেই কাহিনীই তোমাদেরকে আজ শোনাব।

১৯৭১ সাল। বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ে ছুটি। পরীক্ষার ফলপ্রকাশের তখনো কয়েকদিন দেরী আছে। ডিসেম্বর মাস। শীতকাল। পাড়াগাঁ, লোকবসতি কম, গাডীঘোড়াও খুব বেশী চলত না। সবমিলিয়ে বেশ ফাঁকা ফাঁকা ছিল। রাস্তায় অনেকটা দূরে দূরে দুএকটা আলো যেন মিটমিট করে জ্বলত। সন্ধ্যার পরে রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যেত। আর শীতকালের রাত্রি নটা মানে ত’ সেখানে যথেষ্টই রাত।

সেদিনটা ছিল বৃহস্পতিবার,অমাবস্যা। খুব সম্ভবত: তারিখটি ছিল ১৬ই ডিসেম্বর। তখন ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ চলছিল। ফলে রাত্রিবেলা রাস্তায় ত’ দূরের কথা, বাড়ীতেই বিদ্যুৎ বাতি জ্বালানোর ব্যাপারে অনেক বাধানিষেধ ছিল। তারপর আবার আকাশ ছিল মেঘলা। মাঝে মাঝেই ঝিরঝির ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। সব মিলিয়ে চারিদিক ঘন অন্ধকার।আবহাওয়ার এই খামখেয়ালীপনায় আমরা সব ঠাণ্ডায় জড়সড়। তাই সেদিন হয়ত একটু তাড়াতাড়িই শোবার তোড়জোড় করছিলাম। ঘড়িতে তখন রাত নটার ঘণ্টা বাজল। এমন সময় হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ। আমরা একটু ভয় পেয়ে গেলাম। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন – কে, এত রাত্রে ! দরজার ওপার থেকে গুরুগম্ভীর গলাতে আওয়াজ ভেসে এল – আমি হেডস্যার, শশীশেখর। দয়া করে দরজাটা খুলবেন। আমরা হতবাক । হেডস্যার, এত রাত্রে ! বাবা তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দিলেন।

মন্তব্য করুন