Skip to content

কৃ্তজ্ঞতা

দিপ্তেন্দু ছিল আমাদের ক্লাস সেভেনের লিডার। ও ই বলল “ যে আসছে না,স্যারেদেরকে কান ধরে দাড় করিয়ে দেবে। আই এস কি জিনিস বুঝবি তোরা ” দৃশ্যটা কল্পনা করে আমরা বেজায় মজা পেলাম। কিন্তু কোন স্যারকে আর কেনই বা ? ভেবে দেখলাম আমাদের স্কুলেরই তো প্রাক্তন ছাত্র ,অংকের ননীবাবুর কান মলা খায় নি – এমন হতেই পারে না। নির্ঘাত উনিই হবেন টার্গেট। একে বারে সিনেমার মত হবে ব্যপারটা। আমাদের উত্তেজনা আর ধরে না। আজকের সন্ধ্যেটার আসতে আরও কত দেরী। সবে তো থার্ড পিরিয়ড শেষ হল। অর্থাৎ বারোটা বাজে মাত্র। আজ স্কুলে পুরো ছুটির মেজাজ। প্রথম দুটো পিরিয়ড ছিল আমাদের এক টিচারের ফেয়ায়ওয়েল।উনি আজই রিটায়ার করছেন। প্রভাত বাবু ইতিহাস পড়াতেন হায়ার ক্লাসে। আমাদের একবারই সৌভাগ্য হয়েছিল ওনার কাছে পড়ার। ক্লাস টিচার কমলবাবু আসেন নি সেদিন। প্রচন্ড হৈ চৈ করছি আমরা দরজা বন্ধ করে। এমন সময় উনি দরজা ফাঁক করে উঁকি মারলেন। মুখে একটুও রাগ নেই। ক্লাস চুপ। ”আয় ,একটা গল্প বলি তোদের“। উনি কিন্তু বসলেন চেয়ারে নয়। স্যারেদের অবর্তমানে আমরা যেমন স্যারের টেবিলে বসি,উনিও তেমন নিজেই বসলেন টেবিলে। শুরু করলেন গল্প। কোথা দিয়ে যে সময় গড়িয়ে গেল কেউ টের পেলাম না। ঘন্টা বাজলে বুঝতে পারনাম আমরা নিজেদের অলক্ষ্য়েই কখন শিবাজীর রাজ্যে বিচরণ করে এসেছি। কেমন যেন ঘোর লেগে আছে মনে। এভাবেও কেউ পড়ায় ?এমনিতে কিন্তু ভদ্রলোক একা একাই থাকতেন। শুনেছি পারিবারিক জীবনও তেমন সুখের নয়। বাকি টিচারদের থেকে যেন একটা দূরত্ব বজায় রাখতেন। যৎসামান্য আয়োজনে ওনার বিদায় -সম্বর্ধনা হল। নামমাত্র বক্তব্য রাখলেন নতুন হেড-স্যার আর একটা দাদা। উনিও ওনার কথা যে টুকু না বললেই নয়,সেই টুকুই শুধু বললেন। বিকেলে শুরু হবে আমাদের স্কুলের বার্ষিক উৎসব। হবে কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,পুরষ্কার বিতরণী ইত্যাদি। আর প্রধান অতিথি চিন্ময় বসু। আই এ এস। বারো বছর আগে এই মফস্বল শহরে আমাদের স্কুলেরই নাম উজ্জ্বল করেন মাধ্যমিকে তৃতীয় হয়ে। আর তাঁকে ঘিরেই আমাদের কল্পনার ফানুস উড়তে শুরু করেছে। দিপ্তেন্দুর কথা যদি সত্যি হয়!উনি আমাদের হিরো। আজ হাফ ছুটি। চলে এলাম বাড়ি। চিন্ময়বাবুই হলেন আলোচনার প্রধান টপিক। ওনার বাবার বদলীর চাকরী হওয়ার কারণে ওনারা তখন এই শহরে তিন বছর ছিলেন। মাত্র। তার পরে ওনারা কলকাতা চলে যান।
ঠিক সাতটার সময় দুটো পুলিশের গাড়ি এসে থামল আমাদের স্কুলের সামনে। তার মাঝে লাল বাতি লাগানো একটা সাদা গাড়ি। হেড স্যার এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। চিন্ময়বাবু নেমে এলেন। ছিপছিপে স্মার্ট চেহারা। কালো প্যান্ট,সাদা ফুল-শার্ট আর নীল টাই। আমরা অবাক হয়ে দেখছি। ওনাকে মন্চে আনা হল। ফুলের মালা দেওয়া হল। সামনের সারিতে সব টিচারেরা দাড়িয়ে। উনি বসলেন আর সবাইকে বসতে বললেন। ঠিক যে ভাবে স্যারেরা আমাদের বলেন ক্লাসে ঢুকে। হেড স্যারও এনাকে ” স্যার ” বলেই প্রথমে ডেকেছিলেন আর উনি বললেন ”আপনারাই আমার স্যার”। যাই হোক। বক্তব্য রাখতে উঠে বললেন ”এই স্কুল আমার প্রাণ। আমার জীবনের এখানকার তিন বছর আমাকে গড়ে তোলার পথে সব থেকে মূল্যবান অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। একটা ঘটনা বললে ব্যপারটা পরিষ্কার হবে। আমার আসার উদ্দেশ্য নিজের মুখে ঋণ স্বীকার করা। কাজের-অকাজের ব্যস্ততায় আর জীবিকার তাগিদে এটা এতদিন বাকি রয়ে গেছে। তখন এইটে পড়ি। আমি সায়েন্সে তেমন ভালো ছিলাম না। তাই আমি ডাক্তার-ইন্জিনীয়ার আর হতে পারিনি। কিন্তু আমার অনুরাগ ছিল ইতিহাসে। প্রভাত স্যারের পিরিয়ড এখনও আমার মনে পরে। ক্লাস এইটের আ্যনুয়াল পরীক্ষায় আমি ইতিহাসে ৮৫ পেয়েছিলাম। খুব আশা ছিল ”সরলা-বালা” সাবজেক্ট প্রাইজটা আমারই হবে। আর তাতে মোট প্রাইজের বিচারে আমার আর ফার্স্ট-বয় প্রসেন্জিতের সমান সমান হবে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। ঠিক আমাদের বছর থেকেই প্রাইজটা তুলে নেওয়া হয়েছে। আর চাপতে পারি নি চোখের জল। আমাকে এক মাত্র সান্ত্বনা দেন প্রভাত স্যার। তিন দিন যাই নি স্কুলে শরীর খারাপের মিথ্যে অজুহাতে। শেষ দিন দেখি আমাদের বাড়িতে এই স্যার গিয়ে উপস্থিত। কেমন আছি খোঁজ নিতে এসেছেন। হাতে একটা মোটা প্যাকেট। আমায় দিয়ে বললেন উনি চলে গেলে খুলতে। রবিবার বলে বাবাও বাড়িতেই ছিলেন। বাবার সাথে আমার আড়ালে কিছু আলোচনা করে চলে গেলেন। সবার সামনে প্যাকেটা খোলা হল। এ কি? সোনার জলে নাম লেখা একটা ইয়া মোটা ইংরেজিতে লেখা ইতিহাস বই- ভিনসেন্ট স্মীথ। এক দিন ক্লাসে এই বইটার কথা বলছিলেন বটে। প্রথম পাতায় সুন্দর হাতের লেখায় লেখা-”মন দিয়ে পড়বে,এক দিন খুব বড়ো হবে — আশীর্বাদান্তে , প্রভাত কর ”।
কেন জা নি না এই বইটা পাওয়ার আমার জীবন অনেক বদলে যায়। বাংলা মিডিয়াম পড়লেও ভালো ইৎরাজী শিখি,বাড়ে ইতিহাসের কৌতুহল আর সবচেয়ে বাড়ে আত্মবিশ্বাস। বইটা আজও আমার নিত্যসঙ্গী। প্রভাত স্যরকে অনুরোধ করছি একটু যদি কষ্ট করে মঞ্চে উঠে আসেন। ”
স্বভাব-লাজুক প্রভাত বাবু এলেন । অত বড় একজন বিশেষ অতাথি নিঃসংকোচে তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। স্যারও জড়িয়ে ধরলেন এই ছাত্রকে। স্যার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ক্য়ামেরার ফোকাস থেকে তাঁর চোখের জল আড়াল করার জন্য। হাত তালিতে কান পাতা দায়। সবার দৃষ্টি স্টেজে আটকে আছে। পাশে দাড়ানো দিপ্তেন্দুই দেখালো যে শুধু এক জনই ব্যতিক্রম -যিনিও অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন আর আমরা জানি কি কারণ – আমাদের অংক স্যার ননীবাবু।

মন্তব্য করুন